ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৫৮


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (July 29, 2024)
     

    সাদাকে বলছিলি লাল

    হাঁড়িতে চাল বগবগ করে ও আক্রোশের চোটে ঢাকনাটাকে উচ্চে উৎক্ষিপ্ত করে, ইদানীং ক্রোধ-ক্ষোভ-হিংস্রতার শোঁ-বাষ্পের ঠেলায় সভ্যতার ঢাকনা ছিটকে মেঝেতে ঠংঠং। কোপা আমেরিকা জিতে আর্জেন্তিনার খেলোয়াড় ফার্নান্দেজ টিম-বাসে উঠে ফ্রান্সের ফুটবলদলের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি ব্যঙ্গ-সংগীত গাইলেন, মানে যাঁদের নাইজিরিয়ার মা বা ক্যামেরুনের বাবা, তাঁরা কেমন হাহাহিহি। তাই নিয়ে দু’দেশের মধ্যে এখন প্রকাণ্ড বিতণ্ডা। কেউ বলছে মেসি ক্ষমা চান (ফার্নান্দেজ চেয়েছেন), কেউ বলছে ছ্যা ছ্যা রেসিস্ট। অনেকে ভোলেনি, (ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে) বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্তিনার গোলকিপার মার্তিনেজ একটা ছোট্ট পুতুলে ফ্রান্সের তারকা-খেলোয়াড় এমব্যাপের মুখ বসিয়ে (তাঁকে বিদ্রুপ করে) অভিনন্দন-যাত্রায় ঘুরেছিলেন। ওদিকে ফ্রান্স-কৃত সমালোচনার জবাবে আর্জেন্তিনার উপ-রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তা যা-ই হোক আমরা বাপু কোনওদিন উপনিবেশ গড়িনি, কখনও কাউকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলিনি, নিজেদের জীবনযাপনের ধারা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিইনি। শুধু তা-ই নয়, ফ্রান্স দল বিশ্বকাপ জিতে (২০১৮ সালে) মেসিকে ব্যঙ্গ করছে, সে-ভিডিয়োও খুঁড়ে বার করা হয়েছে। আবার ২০১৯-এ ফ্রান্সের খেলোয়াড় গ্রিজমান ও দেম্বেলে জাপানি ভাষা নিয়ে ইয়ার্কি মারছেন, ‘চিং-চং’ বলছেন, সেই ভিডিয়োও। অর্থাৎ কথা হল, তুমি কি কম সাম্প্রদায়িক, কম বর্ণবিদ্বেষী? তুমি হইলে গিয়া প্রাক্তন শোষক, তাইলে হামাকে গাল দিচ্ছ ক্যামনে? ফ্রান্সের কালো-বিদ্বেষ বা মুসলিম-বিদ্বেষ নিয়ে গুচ্ছের কথাবার্তা চলে, প্রচুর বিতর্ক হয়, কিন্তু অন্য দেশ গাল পাড়লে তো ভুলি ভেদাভেদজ্ঞান ফরাসিরা একত্র হবেই, কারণ নিয়মটাই হল ‘ঘটিয়া’ বলে নীচু করলে বাঙালিরা পর্যন্ত বাংলা সিনেমার সমর্থনে সাফাই গাইতে নেমে পড়বে, যদিও নিজেরা অহোরাত্র চিল্লায়, বাংলা সিনেমা পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়।

    এত যুগ ধরে এত উপদেশ আউড়ে মনীষীরা যখন মানবসমাজকে এতটুকু সভ্য করে তুলতে পারলেন না, যখন বোঝা যাচ্ছে থাকিলে ডোবাখানা অ্যাক্কেরে কম্পালসরি কচুরিপানা, তখন সম্ভাব্য কাজ: হাল ছেড়ে দাও এবং ললাটে করাঘাত করতঃ আদিযুগে (পলিটিকাল কারেক্টনেস যখন ছিল না) ফিরে যাও। ফরাসিরা বলবে জাপানিরা চিংচং, বাঙালিরা বলবে চিনেম্যান চ্যাংচুং, আফ্রিকানরা ‘কালুয়া’, উত্তর-পূর্ব ভারতীয়রা ‘চাউমিন’, আবার আফ্রিকানদের কাছে নির্ঘাত শ্বেতাঙ্গদের জুতসই ডাকনাম আছে। আশ্চর্য হল, আর্জেন্তিনার ফার্নান্দেজ খ্যালেন চেলসিতে, মানে লন্ডনে, সেখানে গুচ্ছ জাতির লোক পিলপিল। দেম্বেলে নিজে কৃষ্ণাঙ্গ। আর গ্রিজমানের মা পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত, গ্রিজমান বলেন তাঁর আত্মা উরুগুয়ের। অর্থাৎ খাড়াইল ইহা: তুমি যে-ই হও, আদতে সাম্প্রদায়িক। অন্য লোকে তোমাকে গায়ের রং বা রক্তের মিশেল নিয়ে টিটকিরি দেয় বলে তুমি অন্যকে গায়ের রং বা রক্তের মিশেল নিয়ে টিটকিরি দিতে ছাড়ো না। এইখানে মুশকিল। সাধারণত গরিব গরিবকে ‘এ ম্মা, গোরিইইব!’ বলে বক দেখায় না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার শিকার দিব্যি সাম্প্রদায়িক রসিকতা ছড়ায় ও তলপেট চেপে হাসে। আসলে মানুষের গভীরে প্রোথিত অচেনার প্রতি অস্বস্তি ও বিকর্ষণকে সে কিছুতে ধুতে-মুছতে চায় না, বা চাইলেও অতিরিক্ত আনন্দ বা বিষাদের মুহূর্তে অসতর্ক হয়ে পড়ে, ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো মুখের আগলখানি, খরদাঁত বেরিয়ে পড়ে। বৈষম্য থরে-থরে: মেয়েদের খেলাধুলো করা উচিত না, অনেকেই আগে মনে করতেন, আধুনিক অলিম্পিক্সের জনকও। পিয়ের দ্য কুবারত্যাঁ বলছেন, তিনি মেয়েদের অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ চান না, (তার একাধিক কারণের একটা হল) মেয়েরা যদি দৌড়োয় বা ফুটবল খ্যালে, তা খুব শোভন দৃশ্য হবে না। ভারত বা বাংলার বহু লোক হাফপ্যান্ট বা আঁটো পোশাক পরা খেলুড়ে মেয়েদের সম্পর্কে হাটেমাঠে দাপুটে অবমাননাকর মন্তব্য করত, এখনও করে। আর এই অলিম্পিক্সে কিনা পুরুষ ও নারী প্রতিযোগীদের অনুপাত প্রায় টায়ে-টায়ে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। এ-জিনিস সম্ভব হয়েছে লাগাতার লড়াইয়ের ফলেই, এবং বিরুদ্ধ-মতাবলম্বীর আচরণকে নিয়মিত ব্যবচ্ছেদ করার পরিণামেই। কিন্তু তাতে অন্তরের বিদ্বেষ কমেছে কি? নারীবিরোধিতা গিয়েছে কি? সম্ভবত না। নারী ও পুরুষের টেনিস গ্র্যান্ড স্ল্যাম-এ পুরস্কারের অর্থমূল্য সমান হলেও অনেকেই তীব্র মতামত দেন: ছেলেদের টেনিস দেখলে আর মেয়েদের টেনিস বসে দেখা যায় না। গতি, শক্তি ও শৈলী সবেতেই কমতি। ছেলেদের আইপিএল আর মেয়েদের আাইপিএল ঘিরে মানুষের উৎসাহের বিকট তারতম্য তো ঔচিত্যের ম্যানুয়াল এসে ঘোচাতে পারবে না।

    আবার, শেষ অবধি ‘অলিম্পিক্সে মোর দেশ জিতুক গো’ প্রার্থনার মূলে তো এই বোধই, আমার দেশ আর ওর দেশ আলাদা, তাই আমারটা জিতলে বেশি আনন্দ। নিজগোষ্ঠী সম্পর্কিত অস্মিতা আর অন্যগোষ্ঠী সম্পর্কিত ‘কাঁচকলা খাও’ অঙ্গাঙ্গি। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর বিরোধিতা এক নয়, খেলায় ফাউল করলেও খেলাশেষে করমর্দন করতে হবে, কিন্তু সাধারণ লোক অত সহজে ও নৈপুণ্যে চাল ও কাঁকর আলাদা করতে শেখেনি। হয়তো কিছুতেই এ-ঘৃণার শেকড় উপড়ে ফেলা যাবে না মেনে নিয়ে, উচিত-নজর প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে একটা সমঝোতার জায়গায় আসতে হবে। কারণ প্রকাশ্যে বেফাঁস কথা না বললেও, অন্তরঙ্গ আড্ডায় প্রায় সকলেই অনর্গল হাবিজাবি বকে এবং তাকে একটা মুক্তির আড়মোড়া বলেই ভাবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর টিম-বাসে কে কী করছে, বা খেলোয়াড়রা ড্রেসিং রুমে নিজেদের মধ্যে কী বলছে, তা রেকর্ডেড হলে যে-সে যুগে-যুগে মুশকিলে পড়বে। অতি বড় ন্যায়-প্রচারকও হয়তো গেঞ্জি ছাড়তে-ছাড়তে বউকে বলেন, ওই ট্যারাটাকে দেখেই বুঝেছি, মহা বদমাশ। কিংবা, পুরুষমানুষ পাঁচ ফুটের কম, দেখলেই সন্দেহ। এখন মোবাইলের ক্যামেরার দাপটে সব মানুষকে প্রতি মুহূর্তে নৈতিক অবস্থান একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় প্রার্থিত বিন্দুতে রেখে চলতে হলে, কেউ মুহূর্তেকও কুঁজো হয়ে রিল্যাক্স করতে পারবে না। গ্রাম্ভারি সভায় পোপ যদি সমকামীদের সম্পর্কে কুমন্তব্য করেন তা যেমন মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, রাজনৈতিক সমাবেশে কেউ যদি বিরোধী নেত্রীর খিলখিল হাসি নিয়ে ব্যঙ্গ করেন তা মাপ করার কথাই ওঠে না, সমাজমাধ্যমে কেউ যদি কারও শরীর নিয়ে অপমান-বাক্য ছোড়ে তাকে ধিক্কার দিতেই হবে, কিন্তু একই কড়া দাঁড়িপাল্লায় যদি নিতান্ত আলুথালু আড্ডায় কোন লোকটা কোন অনৈতিক রসিকতা রটাচ্ছে তাকেও ওজন করা হয়, তাহলে কোনও সম্পর্ক রাখাই মুশকিল। হিন্দু বাড়িতে মুসলিম নিয়ে ও মুসলিম বাড়িতে হিন্দু নিয়ে অন্যায় মন্তব্য হবে না, প্রায় অসম্ভব। মেয়েদের আড্ডায় ছেলেদের শরীর এবং ছেলেদের আড্ডায় মেয়েদের শরীরকে নিয়ে এমন টিপ্পনী ঘটবেই যেন তারা ভোগ্যপণ্য এবং রূপ ও সৌষ্ঠবই তাদের প্রধান পরিচয়। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু প্রতিবারই কুরুক্ষেত্র বাধালে বোঝা যাবে, স্বাভাবিক যে-ছাড় ও মার্জনার ওপর দৈনন্দিন জীবন দাঁড়িয়ে আছে, সে-বিষয়ে সচেতনতার অভাব ঘটছে। ঠিকই, ব্যক্তিগত অপমানের তুলনায় জাতিগত বা রাষ্ট্রগত বেইজ্জতির ক্ষেত্রে ক্ষমা বেশ বিরল, কারণ সেখানে ক্রোধ একটা গণ-গর্জনের ঝাঁঝালো স্রোত পেয়ে যায়। তাই আর্জেন্তিনার খেলোয়াড়কে নির্ঘাত প্রশ্ন করতে হবে, একইসঙ্গে ফ্রান্সের সামনেও আয়না তুলে ধরতে হবে, কিন্তু তা বলে আর্জেন্তিনা প্যারিস অলিম্পিক্সে মাঠে নামলেই তাদের দুয়ো দেওয়া চলবে না। ভদ্রতা বড় কঠিন জিনিস, অ্যাবস্ট্রাক্ট আঁক কষার চেয়েও শক্ত, এ-কথা অন্তত এ-যুগে সহস্রবার প্রমাণিত। সহিষ্ণুতা ও পর-সমাদর অনুশীলন করতে জীবন বয়ে যায়। গাদা-গাদা দেশের জনতা শুধু অভিবাসী ও শরণার্থী-বিরোধী খেউড়কে জিন্দাবাদ চিল্লে বুকে জড়াচ্ছে। কেউ আবার এই খেউড়-রত প্রেসিডেন্ট-পদপ্রার্থীকে ভাল লাগছে না বলে তাঁকে তাক করে গুলি ছুড়ছে। তাই হইহই-হেডলাইনের কুকাজটার মাত্রা কতটা, ঠান্ডা মাথায় হিসেব করা ভাল। খুচখাচ অসৌজন্যের বিরুদ্ধে একটা ‘হায় রে সিভিলাই, তুই কুকুর কি বিলাই’ দীর্ঘশ্বাস ও কাঁধঝাঁক্কি ‘যেতে দাও’ আয়ত্ত করা আবশ্যক। এ তামাশা-সংগীত গেয়েছে বা ও উচ্চারণ ভেঙিয়েছে বলে ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ রে তুই নাকি কাল’ বলে কোমর বেঁধে ঝামেলা কিছু হোক, কিন্তু একপক্ষ মোটামুটি ‘সরি’ বলার পর ‘মশলা খাবি?’ হেসে বন্ধুত্বের কৌটো বাড়িয়ে ধরাও মন্দ নয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook