জাফনা, বুলেট, পোড়া বই
জাফনা পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে পা রেখে অটোর সন্ধানে ইতিউতি তাকাচ্ছি। যেমন দীঘা-মন্দারমণি স্টাইলে চলে আর কি বাঙালি! আর মাঝারি মাপের হোটেলের দালাল যে অটোওয়ালারা, কে না জানে! আপনার পকেট বুঝে তারা ঠিক সেই মাপের হোটেলেই নিয়ে যাবে। এদেশেও কি সেই নিয়ম খাটে? অন্ধকার নামার আগেই ঢুকে পড়তে হবে। এসব ভাবছি যখন, হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন একজন। টেরিকটের প্যান্ট আর ওপর দিয়ে ঝোলানো হালকা রঙের শার্ট; অন্য অটোওয়ালাদের থেকে আলাদা। চেন্নাইয়ের পথেঘাটে যেমন দেখা যায়, হাঁটু পর্যন্ত গোটানো ধুতি আর সস্তার টি-শার্ট— এই লোকটি সেরকম না। ‘শিক্ষিত’ চেহারা আর সেই সঙ্গে পরিষ্কার ইংরেজি শুনে আমি তো মুগ্ধ! তাছাড়া বলার আগেই যেন বুঝে গেছেন, বাজেট-হোটেলের খোঁজে আছি। এ যে মেঘ না চাইতে জল! আগামী দুটো দিন আর একে ছাড়া নেই, এমন গাইড পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তখন কি আর জানতাম, ‘ছাড়ালে না ছাড়ে’ কেস হবে, মানে আমরা ছাড়তে চাইলেও তিনি আমাদের এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করবেন না, কারণ সেটাই তাঁর অ্যাসাইনমেন্ট!
আমার যেমন স্বভাব, অচেনা জায়গায়, বিশেষ করে বিদেশে— ট্রেনে, টিউবে, বাসে আমি আশেপাশের লোকের সঙ্গে কথা বলবই। এভাবে আমি কত দরকারি তথ্য সংগ্রহ করেছি, কত খবরের টিপ্স পেয়েছি, কত উপকার হয়েছে আমার, সেই ফিরিস্তি, দুঃখের বিষয়, আমার পরিবারের কেউ বা আমার সহকর্মীরা বিশ্বাসই করে না। শিমুলতলার লাট্টু পাহাড়ে একটা ছেলের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ না জমালে কি আমি জানতে পারতাম, পাহাড়ের অন্য পাশে একটা নদী আছে আর তার পাড়ে পরিযায়ী পাখির মেলা? কলম্বোর লোকাল ট্রেনে এক বৃদ্ধ অঙ্কের শিক্ষকের সঙ্গে গল্প না জমালে কি সন্ধান পেতাম নেগম্বোর, যেখানে জেলেদের ছোট্ট গ্রাম আর সমুদ্রের স্ফটিকস্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে নীচে তাকালেই লাল টুকটুকে প্রবাল, কোরাল রিফ? সে যাক গে, তা বলে তো আর আমি স্বভাব পালটাব না! এই গোধূলিবেলায় জাফনার রাজপথেও আমি কথা শুরু করলাম অটোচালকের সঙ্গে। ‘আপনি এত ভাল ইংরেজি বলেন?’ সংক্ষিপ্ত জবাব এল (পিছন থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না, একচিলতে হাসিটা আমার কল্পনা), ‘এত বিদেশি আসতেন আগে এই সুন্দর জাফনায় যে ইংরেজি তখনই শিখেছিলাম।’ এই ঘনায়মান অন্ধকারেও আবছা দেখছিলাম, রাজপথের পাশে বড়-বড় বুলেটবিদ্ধ বাড়ি। আর রাস্তায় লোক খুব কম, গাড়িও প্রায় নেই, দোকানপাট বন্ধ। কেমন একটা পরিত্যক্ত ভাব শহরটায়, জীবনের স্পন্দন ক্ষীণ।
একটু পরেই একটা বাঁক নিয়ে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়াল অটো, বুঝলাম হোটেল এসে গেছে। সাদা তিন তলা বাড়ি, বাইরে আলো নেই। ডাকাডাকির পর দরজা খুলে একজন বেরোলেন, তামিল স্টাইলে গোটানো ধুতি, শার্ট পরা। আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কিছু কথোপকথন হল। এরপর আমাদের ইঙ্গিত করলেন কেয়ারটেকার, ভেতরে ঢোকার। এ আবার কেমন হোটেল! কেউ কোথাও নেই। আমাদের অপছন্দ ভাবটা বুঝেই বোধহয় অটোচালক বললেন, ‘জাফনায় হোটেল সব বন্ধ। এরকম দু’চারটে গেস্ট হাউস চলছে, তাও রেফারেন্স ছাড়া বিদেশিদের কেউ থাকতে দেবে না।’ বুঝলাম, অগতির গতি, ভেবে লাভ নেই। ভেতরেও আলো কম, যেটুকু না হলে নয়। রিসেপশন বলে কিছু নেই। সোজা দোতলায় নিয়ে গিয়ে দুটো পাশাপাশি ঘরের আলো জ্বাললেন। সাধারণ খাট, আলমারি, তবে পরিষ্কার। আর কোনও বোর্ডার আছে বলে মনে হল না। ইনি তামিল ছাড়া কিছু বলেন না। জিগ্যেস করলেন, ‘ডিনার?’ সঙ্গে বোঝালেন, ভাত-ডাল-আলুর তরকারি ছাড়া কিছু দেওয়া যাবে না। খেয়ে নিতে হবে আটটার মধ্যে। কারণ উনি বাড়ি চলে যাবেন। সে কী! এই মৃত্যু উপত্যকায় গোটা একটা তিন তলা বাড়িতে আমরা দুই বিদেশি? একে তেমন আলো নেই, তার ওপর সেই সন্ধেবেলাতেই চারদিক ভয়ানক নিঝুম!
ক্যামেরাম্যান সে-কথা ফিসফিস করে বলতেই আশ্বাস দিলাম, ‘সারাদিনের ধকলে যা ঘুম পাচ্ছে! স্নান-টান সেরে ভাত খেয়ে নিলেই দেখবি চোখ খুলে রাখতে পারছিস না।’ বললাম বটে, কিন্তু বাস্তবে হল ঠিক উলটো। রাত দশটা নাগাদ যে যার ঘরে শুতে যাব মনস্থ করতেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। প্রথম কথা, সদর দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গেছেন কেয়ারটেকার। সেটাই নাকি নিরাপদ, খেতে বসার সময়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই নিয়ম। জানালা খোলা না রাখতে এবং তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়তেও বলেছিলেন। শুধু ভাষা-সমস্যায় জানা হয়নি, এসব নিয়ম কীসের আশঙ্কায়! এবার যদি আগুন লাগে, শরীর খারাপ হয়, বাইরে বেরনো যাবে না। এটা ভেবেই দম বন্ধ লাগতে শুরু করল। তার মধ্যে রাত যত বাড়ছে, তত বিচিত্র আওয়াজ আসছে চারপাশ থেকে। না, মানুষের চলাচল বা কথাবার্তার নয়, তাহলে তো ভরসা পেতাম! কোথাও যেন ভারী কিছু পড়ল। কেউ কি লাফ দিল? আজকে এসে মনে হয়, এতই নিস্তব্ধ ছিল চারদিক যে একটু আওয়াজ হলেই মনে হচ্ছিল, কী না কী হয়ে গেল!
সকালে চোখ মেলে দেখলাম, আমি বিছানায় গুটিসুটি। কখন চোখ লেগে এসেছিল কে জানে! সাড়ে সাতটা বাজে। পাশের ঘরে উঁকি দিলাম, ক্যামেরাম্যান অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চা দিলে বরং বেচারিকে ডাকব, এই ভেবেই মনে হল, দেখি তো, যে চা দেবে সে কি এসেছে? এক তলা পর্যন্ত সন্ধান করেও কারও দেখা মিলল না। সে না এলে তো বেরোতেও পারব না তালাবন্ধ বাড়ি থেকে। কী মুশকিল! পয়সা দিয়ে থাকব, বন্দি হয়ে? আধঘণ্টা পরে কেয়ারটেকার এলেন, সঙ্গে কালকের অটোচালক। আমরা তো তাঁকে বলিনি যে আজ সকালে তাঁর সঙ্গে বেরোব! মোবাইল নেই, তাই নম্বর দেওয়ার প্রশ্নও নেই। চা খেলাম। ওঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যে ওঁর ছত্রছায়ায় কাটাব এই জাফনায়, সেটা এতই নিশ্চিত একটা ব্যাপার যে, তা নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে না। যাই হোক, বেশি কথা না বাড়িয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। আর তো কাউকে চিনিও না এই নির্বান্ধব পুরীতে যে আমাদের অন্য কোনও বিকল্প আছে। অটো স্টার্ট দিয়ে তিনি জানতেও চাইলেন না আমরা কোথায় যেতে চাই। আমি বললাম, ‘আমাদের কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি দেখান, লাইব্রেরিটা দেখান, সমাধিক্ষেত্রটা দেখান আর…’, বলে একটু থমকে গেলাম। এই অটোচালককে বলে কী লাভ, আমি প্রভাকরণের ইন্টারভিউ চাই?
আজ দিনের আলোয় দেখলাম, পথের দু’ধারে একটাও বাড়ি নেই যার দেওয়ালে বুলেটচিহ্ন নেই। এসব বাড়িতে আদৌ কি লোকজন থাকে না ছেড়ে পালিয়েছে? হঠাৎ নজরে এল বাটার দোকান। চেনাশুনো একটা কিছু তবু চোখে পড়ল। আমার শহরে আছে, পৃথিবীর প্রায় সব শহরেই আছে বাটার জুতোর শোরুম। এখানে অবশ্য সে দেওয়ালজোড়া বুলেটক্ষত নিয়ে কবে থেকে বন্ধ কে জানে! আহা, ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’ কেউ বলে না এ-শহরে! অটো দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হল বেশ কিছু। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চলছে আর তার এপিসেন্টার জাফনা, তার এরকম চেহারা হবে না তো কী!
এবার অটো চলল চালকের নিয়মে, এ-গলি সে-গলি ঘুরে থামল একটা পাড়ায়। বলা বাহুল্য, জনমানবহীন সে-এলাকা, চারপাশে শুধু ভাঙা, পোড়া বাড়ি। প্রথমটায় ঢুকেই চোখে জল এল। নিম্নমধ্যবিত্ত সংসার ছিল বোঝাই যায়। বোমার ঘায়ে ধ্বসে পড়া পাঁচিলের পাশেই ভাঙা উনুন; তোবড়ানো হাঁড়িকুড়ি জানান দেয়, অকস্মাৎ নেমে এসেছিল সর্বনাশ। পালানোর সময় কি পেয়েছিল তারা? অটোচালক এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘ডিভাস্টেটেড বাই দ্য পিস কিপিং আর্মি।’ এই রে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই সেনাবাহিনীতে তো ভারতীয় জওয়ানরাও ছিল, যেজন্য এলটিটিই-র হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল রাজীব গান্ধীকে। আমাদের ওপর রাগ দেখাবে না তো এখানকার মানুষ? চারপাশে অবশ্য লোকজন দেখছি না। একটু এগিয়ে আবার একইরকম একটা বাড়িতে ঢুকে ছবি তোলা। ক্যামেরাম্যান মনপ্রাণ ঢেলে চেষ্টা করছে ধ্বংসের ছবি ডিটেলে তুলতে। হঠাৎ দু’চারজন মহিলার আবির্ভাব, তামিল ভাষায় খুব উত্তেজিতভাবে কিছু বলছিল তারা। কিছুই না-বুঝে তাকিয়ে ছিলাম। অটোচালক শুনে নিয়ে আমাকে জানালেন, ওরা বলছে কীভাবে বিদেশি সেনারা নির্বিচারে অত্যাচার করেছে, লুঠপাট করেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মেয়েদের টেনে নিয়ে গেছে। আমি উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘ওরা কি ভারতের ওপর রেগে আছে?’ আশ্বস্ত করলেন অটোচালক, ‘এখন আর রাগ নেই। ওরা জানে, ইন্ডিয়া হেল্প করে শ্রীলঙ্কাকে। গত বছর সুনামির পর রাস্তা, রেললাইন তৈরি করে দিয়েছে। শান্তিবাহিনীতে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে সেনা আসে। তাদের সামনে পেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।’
এবার গন্তব্য সেই ঐতিহাসিক লাইব্রেরি। ১৯৩৩ সাল থেকে তিল-তিল করে গড়ে তোলা এশিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থাগারগুলির একটি জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি, শ্রীলঙ্কার গর্ব। আর কী অসাধারণ স্থাপত্য! শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ একটি। লাখখানেক বই আর দুষ্প্রাপ্য পুথিসমেত সেই তীর্থক্ষেত্র পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল উন্মত্ত সিংহলি জনতা। মতান্তরে, সরকারি মদতে পুলিশ আর প্যারামিলিটারি বাহিনী। ১৯৮১ সালের পয়লা জুনের সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল আপাতশান্ত চেহারার অটোচালকের। ‘যুদ্ধ তো কত দেশেই হয়, আস্ত লাইব্রেরি দাউ দাউ করে জ্বলছে, ভাবতে পারো? কত গবেষক আসতেন! তোমাদের দেশ থেকেও। তামিলরা এই আক্রমণকে তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করার চক্রান্ত বলে মনে করে।’ বাবা, একদম নেতাদের মতো কথা বলেন দেখছি ইনি! পাক্কা গাইডের ঢঙে শোনালেন লাইব্রেরি ধ্বংস আর গড়ার ইতিহাস। বার বার যে ছাই থেকে মাথা তুলেছে ফিনিক্স পাখির মতো! কখনও সাধারণ মানুষের দানের টাকায়, কখনও বিদেশি সাহায্যে কেনা হয়েছে বই। ১৯৮৫ সালে যখন ফের সাজিয়ে ফেলা হয়েছে লাইব্রেরি, এলটিটিইকে রুখতে লাইব্রেরিতে ঢুকল সেনাবাহিনী আর আরও একবার জ্বলে গেল বইয়ের সম্ভার। তামিলদের ক্ষোভ সামাল দিতে শেষমেশ ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গার সরকার উদ্যোগী হল জাফনা পাবলিক লাইব্রেরিকে স্বমহিমায় ফেরানোর। ২০০৩-এ পুরনো চেহারায় যখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত গ্রন্থাগার, দাবি তুলল এলটিটিই, পুড়ে যাওয়া বইপত্রের নমুনা রাখতে হবে যাতে ভবিষ্যতের দর্শকেরা জানতে পারে অতীত সন্ত্রাসের কাহিনি। কিছুটা মেনে নিয়ে খোলা হল জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি। আমরা ঘুরে দেখলাম। সত্যি, আধপোড়া বই দেখলে কেমন যেন হু-হু করে ওঠে বুকের ভেতর।
এবার তাড়া দিলেন অটোচালক, যেতে হবে এলটিটিই সমাধিক্ষেত্রে। আর তারপরের গন্তব্য সম্পর্কে যা বললেন, তাতে আমি আর আমার ক্যামেরাম্যান হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম মানুষটির মুখের দিকে। ও হরি, ইনি তো সাধারণ অটোচালক নন, ইনি তামিল টাইগার্স-এর প্রশিক্ষিত ক্যাডার! চেক পয়েন্ট থেকে যাঁকে খবর পাঠানো হয়েছে আমাদের জাফনা প্রবেশের এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাদের ‘দেখভালের’। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ নেমে গেল…
ছবি সৌজন্যে : লেখক