আড়াই লক্ষ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভোলেবাবার পায়ের ধুলো খামচে ধরতে। সিন্ডিকেটের সিমেন্টে লুকিয়ে থাকা যেমন-তেমন ধুলোবালি নয়, তার জাতই আলাদা। সারিয়ে দিতে পারে কুষ্ঠ থেকে ক্যান্সার। চাকরি এবং সন্তান দুই প্রাপ্তি একইসঙ্গে, সৎসঙ্গের ধুলো যদি একমুঠো বেশি ছিনিয়ে আনা যায়। ধুলোরও জাত আছে, ব্রাহ্মণের কাছে শিখেছে দলিত পরম্পরায়। নতুন ন্যারেটিভে তাদের বোঝানো হয়েছে, ভোলেবাবা আর বাবাসাহেবের ফারাক। সম্পদ-বিলাস-ক্ষমতার চূড়ায় থাকা বিশেষ গোত্রের মানুষ, শিখিয়েছে অন্য আরেক মানুষকে, যে অসহায়, কোণঠাসা, শোষিত, বিচ্ছিন্ন, একেবারে শেষ পর্যন্ত। সাষ্টাঙ্গে, নির্মাণ করে দেওয়া মগজে, চরণামৃতর মতো পান করেছে সে বিরিঞ্চি-বাহিনীর কৌশল-টনিক। তারপর আফিম-আমেজে ছুটে এসেছে সে। সে এখন আর একা নয়, চারপাশে কত মানুষ! তারই মতো, নতজানু। সেও তাদেরই একজন। সাময়িক হলেও ভোলেবাবার কৃপায় সে এখন সামাজিক। হোক না হুড়োহুড়ি, বিচ্ছিরি রকমের কাড়াকাড়ি। পায়ের নীচে দলিত হয়ে চোখ ফেটে ছিটকে বেরিয়ে আসুক রক্ত। থেঁতলে যাক সন্তান। আসুক না যন্ত্রণার মরণ, কুছ পরোয়া নেহি। ভোলেবাবা পার করেগা। কথায় যে আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস।
ধর্মে হোক বা জিরাফে, যে-মানুষ একঘরে, বার বার যার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তোমার স্থান সকলের পায়ের নীচে, সুযোগ পেলে সে তো চাইবেই মাথা উঁচু করে দলিত পায়ে হিন্দুত্বের দরজার দিকে হেঁটে যেতে। এই হেজে-মজে-যাওয়া জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্তিম আশ্রয় তো এখানেই। আর এমনটা হলেই তো চোখে ঠুলি পরানো অন্ধভক্তের সংখ্যা বাড়ে। শিক্ষার হার তরতরিয়ে কমে আসে। আর গডম্যানদের ধুলো নিতে পিষ্ট হয়ে মরে যেতে হয় সহভক্তদেরই ভক্তিতে-ভীষণ-ভারী পায়ের চাপে আচমকা কোনও একদিন। ভারতের এই লোকপ্ৰিয় চালু আবহে ভক্ত রামদাস কিন্ত বলে ওঠেন, এতে ভোলেবাবার কী দোষ! তিনি প্রস্থান করার পরেই তো যা ঘটার ঘটেছে। রামদাসের ষাট বছরের স্ত্রী চন্দ্রপ্রভাও ছিলেন হাথরসের সেই সৎসঙ্গে। ১২১ জনের সঙ্গে তিনিও আজ মৃতদের তালিকায়।
সঙ্গদোষে সৎ-অসৎ গুলিয়ে ফেলা রামদাসের যুক্তি শাসককে স্বস্তি দেয়। শাসকের ফিচেল হাসি কিন্ত চওড়া হয়। সার্থক হয় তাদের প্রোপাগান্ডা। এই সাফল্যে গ্রাম-গঞ্জ, মফস্সল-শহরের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একই চরিত্রের আরও নানান যুক্তি। মানুষ যেহেতু অন্তর থেকে যুক্ত হতেই চায়, তাই অগত্যা এই আকালের দিনগুলোয় সেই যুক্তিতে সহজেই যুক্ত হয়ে যায় ভারতের কোটি-কোটি নারী, পুরুষ, তরুণ সব মনগুলি। আর যখন সৎসঙ্গের হাতছানি নেই, ধর্ম-মিছিলে ভিড় বাড়ানোর নির্দেশ নেই, গৃহবন্দি নারী, কর্মহীন পুরুষ, অবকাশে কীই-বা করতে পারে! ঠিক তখনই নেশাঘন ভিডিয়ো রিলস দেখাতে কান ধরে সকলকেই টেনে নামানো হয়, অলৌকিক থেকে সোজা ভার্চুয়াল বাস্তবে। ব্যবসা বাড়ে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের। চুপিসারে। তারপরেও যদি অবকাশ অবশিষ্ট থেকে যায়, তার দখল নেয় ফ্যান্টাসি-ক্রিকেট, যার ছদ্মনাম জুয়া। পকেট আরও মোটা হয়ে ওঠে ৭০ হাজার কোটির সংস্থা ড্রিম-ইলেভেনের হর্ষ জৈন-এর।
ভোলেবাবার সৎসঙ্গে কোনও এন্ট্রি-ফি ছিল না। ফেসবুকে মোটাসোটা পোস্টও বিনা পয়সায় করা যায়। আমাদের ডেটা এবং বিশ্বাস, দুই নিয়েই চলে গভীর কারবার একে অপরের গা ঘেঁষে। ভোলেবাবার আরও বেশি ভক্তের দরকার, মার্ক জাকার্বার্গের তেমনই ফেসবুক ইউজার। নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে একে অপরের পাশে থাকা শাসকদের যে অনেক রং!
বস্তুত, ব্রাহ্মণ-দলিত-ভোট-ক্রিকেট-বলিউড-ফেসবুক, এইসব আপাত দেখায়, বিচ্ছিন্নই মনে হয়। কিন্তু ডিজিটাল ভারতে, বিষয়গুলি জোরজবস্তি ছাড়াই জুড়ে যায় ধর্ম, রাজনীতি, পুঁজির পরিপূরক হাইফেনে। আলাদা করে উইকিপিডিয়ায় দীক্ষিত স্বঘোষিত ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ কিছু মানুষ।
সৎসঙ্গের ভিড়ে মারা যাওয়া মানুষের কথা জেনে প্রথম দিন অনলাইন দুঃখ, পরের দিনেই মেরিন ড্রাইভে ক্রিকেট-বিশ্বকাপ জয়ীদের ঘিরে থাকা ভিড় দেখে তুমুল আনন্দ। সৎসঙ্গের ঘটনা জেনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বেশ হয়েছে’ বলে পৈশাচিক উল্লাসেও নিজেদের জাহির করতে দেখা যায় বেশ কিছু মানুষকে। প্রগতিশীলতার আবরণে মধ্যবিত্ত-ইমোশনের এমন নিদারুণ সাইকোডেলিক দোলাচলও বেশ চিন্তার বিষয় আগামীর জন্য।
জাতপাত আর পুরুষতন্ত্রের ডাবল ডোজে আগেভাগেই পিষে যাওয়া নারীদের সংখ্যাই ছিল বেশি সেই দিনের জমায়েতে। বার বার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতবিক্ষত, শহরের মাঙ্গলিক মেয়ে, সেলফির গুটিকয়েক লাইক, কমেন্ট দেখে যেভাবে একলা নিজের মনেই হেসে ওঠে, সেভাবেই সম্ভবত গ্রামের চন্দ্রপ্রভারা নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব খুঁজে পায় এইসব সৎসঙ্গে। কেউ তো সেখানে আছে, যে তাদের সমস্যার কথা শুনবে। দুটো শান্তির, মন ভালো কথা বলবে আদর চোখে। তাই সেই ভোলেবাবার বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর হয়নি। প্রত্যাশিত। যে-রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায়, কাঠখড় পুড়িয়ে এই সর্বজনীন আয়োজন, ভোলেবাবা-ভক্তি-ভক্তের নির্মাণ, সামান্য একটা এফআইআর যদি সব ভেস্তে দেয়! রাষ্ট্রের জ্ঞান টনটনে। দোষ তাই সাবিত্রী দেবী, চন্দ্রপ্রভাদের। দোষ অত্যাধিক ভিড়ের। দোষ স্বঘোষিত গডম্যানের নয়, বিপন্নতায় গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা সাধারণ মানুষের সমষ্টির।
পায়ে চাপা পড়ে এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা, অতঃপর নিউজ হেডলাইন, তদন্ত, তুমুল চর্চা, লেখালিখি নতুন কোনও বাস্তবতা নয়। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসেই কম করে ১২ জনের মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ। কেন্দ্রে বৈষ্ণোদেবীর মন্দির। ২০১৩ সালে আবার সেই উত্তরপ্রদেশ। দু’মাসের মধ্যে কুম্ভ মেলায় তীর্থযাত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিল ১০ কোটিরও বেশি। মেলার ব্যস্ততম দিনে মারাত্মক শোরগোল। পদপৃষ্ট হয় ৮ বছরের একটি মেয়ে। সঙ্গে আরও ২৭ জন নারী। সাকুল্যে ৩৬ জন। স্মৃতির ঘা তখনও শুকিয়ে যায়নি। সে-বছরেরই নভেম্বরে দেড় লক্ষ ভক্ত জড়ো হয় নবরাত্রি উদযাপনে। মৃতের সংখ্যা ১১৫। নেপথ্যে অলৌকিকে নিবেদিত ভক্তের সেই নতজানু মন। ২০১০ সালে ৬৩, ২০০৮-এ প্রায় ৫০০, বেশির ভাগই শিশু। ২০০৫-এর শিকার ২৬৫। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র কখনও-বা হিমাচল। অগ্রদূত অবশ্য উত্তরপ্রদেশ আর উৎস সেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই। অসহায় মানুষ যে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, ধরতে চায় সহযোগিতার হাত, তা ভোলেবাবারা হাড়ে-হাড়ে বোঝেন। কিন্ত বিকৃত আর্থ-সামাজিক সম্পর্কে গডম্যানদের কাছে প্রকৃত জীবনের সন্ধানের পরিণাম সুখের হয় না। বর্তমান সংস্কৃতির বীভৎস মজায় এখনও যেহেতু মানুষ মাতোয়ারা আগামীতে তাই আবারও সৎসঙ্গ হবে। কারণ ধূপের গন্ধে, ঘণ্টার আওয়াজে, প্রসাদের স্বাদে, ভোলেবাবার দর্শনে আর তার পবিত্র পদধূলির স্পর্শে বুঁদ হয়ে আছে সিংহভাগ মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়। মুভি অফ দ্য উইক হবে হিংসায় ঠাসা সাম্প্রদায়িক কোনও সিনেমা আবার অন্যদিকে ভারত আবারও নিশ্চয়ই বাজেয়াপ্ত করবে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ। অতিরঞ্জিত মহিমায় ক্রিকেটাররাও তখন রক্তমাংসের ঈশ্বর। সে কাজে ইন্ধন দেবে বলিউড তারকাদের স্ক্রিপ্টেড গুণগান, বিশেষ মিডিয়ার একতরফা প্রচার। সুতোর টানে পুতুলের মতো নাচতে-নাচতে একের পর এক মানুষ জড়ো হতে থাকবে, আবার। তাই ধুলো নয়, লাখো উন্মত্ত ফ্যানের ভিড়ের মধ্যে, বিরাট মাপের কোনও এক ক্রিকেটারের ঘাড়ের ট্যাটু খামচে ধরতে গিয়ে সেবার হয়তো…।