তরঙ্গনাথ – নয়
তরঙ্গনাথের জীবনমোড় ঘুরতে লাগল বড় বিচিত্র ভাবে। পাটনা সদরে ছবির মতো সাজানো বাংলোয় বাস করা জীবন। বড় মেয়ে বিমলা বা বিমির পর আর একটি মেয়ে হল— ঊর্মিলা বা ইলা। কিন্তু এই ১৯১১ তাঁর জীবনে নিয়ে এল অভাবনীয় সংকট। পাটনার ঠিকানায় টেলিগ্রাম এল রাণীর শ্বশুরবাড়ি থেকে। পত্রপাঠ-মাত্র, তাঁর বাবা সেখানে গিয়ে জানলেন যে, বিয়ের তিন-চার বছরের মধ্যেও সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়ায়, জামাইয়ের আবার বিয়ে দেওয়াই মনস্থ করেছেন তাঁর বেয়াই-বেয়ান। জামাই অরাজি হলেও বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে যাবার শক্তি তার নেই। বাবাকে দেখেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল রাণী। তার শাশুড়ি মা শান্ত ভাবেই বললেন, ‘কান্নার কী আছে? সতীন নিয়ে কি ঘর করে না কেউ!’ একটু সময় চেয়ে, মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এলেন তরঙ্গনাথের বাবা। রাণীর শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে, সোজা গিয়ে উঠলেন তাঁর সেজো শ্যালিকার বাড়ি। শ্যালিকার বাড়িতে দেখা হয়ে গেল তাদের বড়ছেলে হরশঙ্করের সঙ্গেও।
অনেক বদলে গেছে সে। জলপাইগুড়িতে থাকার সময়ে, হালে অবসর নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া হেনরি কটন নামে কোনও এক সাহেবের ওপর ইংরেজিতে আর্টিকেল লিখে, ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে সে পাঠায়। ওই লেখাটি ছাপা না হলেও, সাহেব এডিটর হরুকে একরকম ডেকে কাজ দেন তাঁর কাগজে। হরশঙ্কর এখন নিজের বাড়িতে থেকেই কলকাতার অফিসে যাতায়াত করে। তার মনে সবচেয়ে বড় সন্তোষ এই যে, কারোর কোনও সুপারিশ ছাড়াই তার একটা মনের মতো কাজ হয়ে গেছে। তরুর বাবা এবং তার ছোটকাকার সাহায্য এবং তরুর মায়ের আন্তরিক যত্নের কথাও সে বার বার উল্লেখ করতে ভোলেনি। সে-রাত্তিরটা শ্যালিকার বাড়িতে কাটিয়ে, পরদিনই পাটনা ফিরে গেলেন তনুর বাবা। নিজেকে কেমন যেন এক হেরে-যাওয়া মানুষ বোধ হওয়াতে নিজের বাড়ির দিকে আর গেলেনই না তিনি।
পাটনায় ফিরেই জানলেন যে, তাঁর ছোট ছেলে অদ্রিনাথ, মানে বদুর চিঠি এসেছে। বদুর চিঠিখানিতে চোখ বুলিয়ে, চোখের জল যেন ধরে রাখতে পারলেন না তিনি।
Krishna Chandra College, Hetampur
3rd July 1911
শ্রীচরণকমলেষু
বাবা, সেবকের শতকোটী প্রণাম জানিবেন। বাড়ি হইতে আসিয়া পর্যন্ত আপনাদের যে পত্রগুলি দিয়াছি, তাহার সকল পত্রেরই উত্তর পাইয়াছি। কিন্তু গত মাসে, যে তিনখানি পত্র পাঠাইয়াছি, তাহার একখানিরও উত্তর না পাইয়া যে কী পর্যন্ত ভাবিত আছি, তাহা আর এই সামান্য পত্রে আপনাকে কী জানাইব! আপনাদের জন্য একে আমার মন বড়ই অস্থির হইয়া আছে, তাহার উপর কোনও পত্র না পাইয়া চিন্তা বাড়িয়াছে। এখানে থাকিতে আমার অত্যন্ত কষ্ট হইতেছে। কিছুই সুবিধা নাই। সেসব কথা সাক্ষাতে খোলসা করিয়া বলিব। পুজোয় বাড়ি যাইতে হইলে, এখন হইতেই দরখাস্ত করিয়া জমা দিতে হইবে। দরখাস্ত সময়মতো না আসিলে, ছুটি মঞ্জুর হইবে না।
বাবা, আমার অত্যন্ত কষ্ট হইতেছে। সত্বর কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।
আপনার বিবেচনাধীন অধম
বদু
এ কী দুঃসময় ঘনিয়ে এল তাঁদের সংসারে! সবে যখন মনে হচ্ছে যে, সব যেন এবার একটু নাগালের মধ্যে, তখনই এমন বিনা মেঘে বজ্রপাত! চিঠিখানা হাতে নিয়ে, বারান্দার ইজিচেয়ারে চুপ করে বসে রইলেন তনুর বাবা। দিনের আলো নিভে আসছে; আরদালি বারান্দায় বাতি জ্বালাতে এলে, ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন তিনি। কান্নার শব্দ কানে যেতে, ডানদিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলেন, পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা তনুর মা-কে। ঘর থেকে বারান্দায় বেরনোর দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিও! এত যে নিবিড় সম্পর্ক তাঁদের, তবু কেউ যেন মুখোমুখি হতে পারছেন না নিজেদের। একজন দাঁড়িয়ে আর অন্যজন বসে; দুজনেই যেন চলনশক্তি হারানো অসাড় দুটি দেহমাত্র।
অথচ এ-সময়ে তনুর মা কার্পেট বুনতে বসেন; টুকটাক নির্দেশে ব্যবস্থা করেন সন্ধের জলখাবারের; বড় নাতনি বিমিকে ছড়া বলতে শেখান মুখে মুখে। আর তনুর বাবা বেড়িয়ে ফেরেন, কাছেপিঠে থাকা কয়েক ঘর শিক্ষিত বাঙালিদের সঙ্গে বিকেলের আড্ডা সেরে। এখন তো সন্ধ্যাহ্নিক সেরে তাঁর বসবার কথা, গিন্নির খাটের পাশেই রাখা ওই আরামকেদারাটায়। আরাম করে গড়গড়া টানবেন আর ভাববেন ডিউটি শেষ করে তনু বাড়ি ফিরল কি!
তিন বছরের বিমি এসে একবার দাঁড়াল। অন্ধকার বারান্দায় ঠাকুমা-দাদুকে একসঙ্গে দেখে ওইটুকু মেয়ে কী বুঝল কে জানে, কোনও কথা না বলে আবার ঘরের ভেতরে চলে গেল। বিমি যে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটা মনে হয় খেয়াল করেননি তাঁরা। অন্ধকার বারান্দা দিয়েই এবার হেঁটে এল তরুলতা; শাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঘরে চলুন মা! ওঁর আসবার সময় হয়ে গেছে।’ তরুর কাঁধে ভর দিয়ে, ধীরে-ধীরে ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তরু মনে-মনে ভাবল, এ কান্না কে থামাবে ঠাকুর! ঠাকুমার পায়ে-পায়ে ঘুরঘুর করা বিমিকে তাঁর মাথার কাছে বসিয়ে, বারান্দায় বসে থাকা শ্বশুরমশাইয়ের কাছে গিয়েও তাঁর কোনও সাড়া পেল না তরু; অস্থির হয়ে আরদালিকে ডাকাডাকি শুরু করতেই তরু দেখল, ডিউটি শেষ করে বাগানের গেট খুলে ঢুকে আসছেন তরঙ্গনাথ। চেতনাহীন বাবাকে কোলে তুলে নিয়ে, ঘরে এনে তিনি শুইয়ে দিলেন, তাঁর মায়ের খাটেই; তরুর এনে দেওয়া ঘটির জল চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতেই সংজ্ঞা ফিরে এল তনুর বাবার। আরদালি মারফত ডাক্তারকে ‘কল’ দিয়ে, ভেতরে গেলেন তরঙ্গনাথ, পুলিশের ‘ধড়াচুড়ো’ ছেড়ে ঘরের পোশাক পরতে। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালানোর আগেই তরঙ্গনাথের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে, ফুঁপিয়ে উঠল তরুলতা। তরুকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার গাল থেকে জল মুছিয়ে দিয়ে, তরঙ্গনাথ শান্ত হয়ে বললেন, ‘এমন করে ভয় পেলে চলবে কী করে তরু? বাবার তো জ্ঞান ফিরেছে; এখুনি ডাক্তার এসে দেখে যাবেন।’
‘তোমাকে তো আবার এখানে একা থাকতে হবে গো; বাবা-মা আর দুই মেয়েকে নিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে বাড়িতে; আর আমাদের একসঙ্গে সংসার করা হবে না গো!’
‘এত ভেঙে পোড়ো না তরু; দেখি কী হয়! আগামী সপ্তাহেই রাণীর ওখানে যাব বলে খবর পাঠিয়েছি।’
‘তুমি একা যাবে? ভাল-মন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে!’
‘শিবনিবাস থেকে তোমার ছোটকাকা আসছেন। হরুর সঙ্গে উনিও আসবেন সোদপুর থেকে। সেজো মাসিমাও হয়তো যাবেন।’
‘সঙ্গে একজন মেয়ে থাকা ভাল; সেজো মাসিমা যে যেতে রাজি হয়েছেন এই অনেক।’
‘সেসব হরুই করেছে। ওকেই তো তার করেছিলাম। কিছু খোঁজখবরও পেয়েছে রাণীর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে।’
‘কিন্তু ছোটকাকা এসবের মধ্যে কেন?’
‘উনি তো এখন হরুর বিশেষ বন্ধু; ওঁর হাতেই তো নিজের লেখাটা পাঠিয়ে, কাগজের অফিসের চাকরিটা হরুর হয়েছে।’
‘হরু তো তোমার বিয়ের সময়ে ছিল না; কোথায় আলাপ হল?’
‘কেন? জলপাইগুড়িতে। হরু তোমাদের ওই বাড়িতে থাকার সময়ে ছোটকাকা তো তোমার বাবার কাছে প্রায়ই জলপাইগুড়ি যান এবং দেখভালও করেন। মানুষটি খুবই বিচক্ষণ; উনি না থাকলে হরু যে কোথায় হারিয়ে যেত কে জানে!’
তরুকে তখনকার মতো শান্ত করে, জামাকাপড় ছেড়ে, বাবা-মায়ের ঘরে এসে বসলেন তরঙ্গনাথ। যেন ভয়ংকর এক ঝড়ের আভাস পেতে শুরু করলেন তিনি।
২
রাণীর শ্বশুরমশাই একা-ই বলে গেলেন তাঁর বক্তব্য। হরু এবং তরুলতার ছোটকাকার দু-একটা মন্তব্যে তাঁকে মাঝে মাঝে থামালেও, মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন তরঙ্গনাথ। আগে থাকতে খবর দিয়ে এসেও দেখা হল না ভগ্নীপতিটির সঙ্গে; সে নাকি সকালে বেরিয়ে তখনও অবধি বাড়ি ফেরেনি। সব দিক সামাল দিয়েই শ্বশুরমশাই গুণগান করে গেলেন রাণীর রূপ এবং গুণের; বলতে লাগলেন যে, রাণী যদি সতীন নিয়ে ঘর করতে চায় তো তাঁর সংসারে সে থেকে যেতেই পারে। তরঙ্গনাথের বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওঁরা একরকম ধরেই নিয়েছেন যে, রাণী আর ওই বাড়িতে থাকবে না। মনে পড়ল তরুলতার সাবধানবাণী, ‘ওকে কিন্তু ওই বাড়িতে রেখে এসো না; প্রাণে মেরে ফেলে দেবে তাহলে।’ তাঁদের তিনজনকে ঘরে এনে বসাবার সময় থেকেই, সেজো মাসিমাকে ওঁরা ভেতরে নিয়ে চলে গেছেন; রাণীকেও তাঁদের সামনে আনেননি একবারের জন্যেও। রাণীর বাপের বাড়ি থেকে আসা দানের বাসনেই সাজিয়ে খেতেও দিয়েছেন তাঁদের; আর কেউ চিনতে না পারলেও তরঙ্গনাথ তো চেনেন; মায়ের ফরমায়েশ মতো কাশী থেকে এসব কিনে ছোট মাসিমাই পাঠিয়েছিলেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে লাগার মুখে সবাই উঠে পড়বার উপক্রম করলে, পাশের ঘর থেকে নাকে কান্না কাঁদতে-কাঁদতে বেরিয়ে এলেন রাণীর শাশুড়ি; দেখা গেল যে, কালি-পড়া চেহারায় রাণীকে নিয়ে সেই ঘর থেকেই বেরিয়ে আসছেন সেজো মাসিমাও। রাণী যেন এক কঙ্কাল; শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতো। তরঙ্গনাথ এগিয়ে এসে রাণীর দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে শুধু বললেন, ‘চল, বাড়ি চল রাণী; তোর খুকি তো তোর বউদির কোলে বড় হচ্ছে রে!’ দাদার মুখের দিকে না তাকিয়ে, রাণী তাঁকে পায়ে-পায়ে অনুসরণ করল। গাড়িতে ওঠার সময়েও তাঁরা শুনতে পেলেন রাণীর শাশুড়ির বিলাপ, ‘ওগো তোমরা দেখো, পুলিশের ভয় দেখিয়ে কেমন তুলে নিয়ে গেল আমার ঘরের লক্ষ্মীকে…।’
কিছু দূর এগিয়ে, বড় সড়কের ওপর গাড়িটা যেতে-না-যেতেই কে একজন যেন ছুটে এসে হাত নাড়িয়ে গাড়ি থামাতে বলল। ড্রাইভার থামাতে না চাইলেও, তরঙ্গনাথের নির্দেশে গাড়ি থামল; অন্যেরা না চিনলেও দূর থেকে দেখেই ভগ্নীপতিকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি; তরঙ্গনাথ তাঁর গাড়ির দরজা খুলে, রাস্তায় নেমে দাঁড়াতেই সে প্রায় তাঁর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করল। তরঙ্গনাথ বললেন, ‘আমার সঙ্গে চলোই না একবার; ওখানে গিয়েই নাহয় সংসার করবে; কাজের ব্যবস্থা করে দেব তোমার; এত বড় অন্যায় হতে দিয়ো না।’ হাতজোড় করে কাঁদতে-কাঁদতে সে শুধু জানাল, ‘উপায় নেই দাদা; আমার সাহস নেই ওভাবে বাঁচবার।’ কিছুটা শান্ত হয়ে নিজের হাতে ঝোলানো একটা পুঁটলি তরঙ্গনাথের হাতে দিয়ে সে বলল, ‘রাণীর গয়নাগুলোই শুধু সরাতে পেরেছি; অন্য কেউ এগুলো পরুক তা আমি চাই না।’ পাথরমূর্তি রাণীর দিকে তাকিয়ে সে বলতে লাগল, ‘আমাকে ক্ষমা কোরো… ক্ষমা কোরো।’ এইবার ফুঁপিয়ে উঠল রাণী; আবার তরঙ্গনাথের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে, রাণীর বর বলতে লাগল, ‘আমাকে পুলিশে দেবেন না তো! হাজতে পুরবেন না তো আমাকে?’ তরঙ্গনাথের ইশারায় গাড়ি ছেড়ে দিল। পাকা রাস্তার ওপারে মিলিয়ে গেল রাণীর স্বামী এবং সংসার; সেজো মাসিমার কোলে মাথা রেখে, ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়তে লাগল রাণী। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকেই যেন ঘুম চলে গেল তরঙ্গনাথের। বুঝলেন যে, রাণী ফিরে এল চিরদিনের মতো এবং সর্বস্ব খুইয়েই। এমনকী খোয়া গেল তার স্বাভাবিক চেতনা ও বোধটুকুও।
সে-যাত্রায় সেজোমাসিমা এবং রাণীকে নিয়ে পাটনায় ফিরে এলেন তরঙ্গনাথ। প্রায় শয্যা নেওয়া বাবা-মায়ের শুশ্রূষা এবং নিজের দুই মেয়ের দেখভালের সঙ্গে রাণীকে দেখাশোনার দায়িত্বও তার নিজের হাতে তুলে নিল তরুলতা। সাহেবডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাণীর শরীর কিছুটা ভাল হলেও, স্বাভাবিক আচরণের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না তার মধ্যে। ইতিমধ্যে পুজো এসে যাওয়ায় এবং পুজোর ছুটিতে বদুর বাড়ি ফেরার দিনটা এগিয়ে আসাতে, বাবা-মা এবং তরুর ইচ্ছেতে এই সিদ্ধান্তই হল যে, সকলে মিলে আপাতত একবার বাড়ি ফেরা যাক। তরঙ্গনাথও সম্মত হলেন এই ভেবে যে, নিজের ঘরেদোরে ফিরে, চেনা মানুষজনদের মধ্যে থাকতে পেলে রাণী হয়তো আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। শুধু ভেবে পেলেন না, তাঁর স্ত্রী তরুলতা যে কী ধাতুতে গড়া। বাড়ি ফিরে যাবার তোড়জোড় না করে, সে শুধু গুছিয়ে যেতে লাগল সেইসব জিনিসগুলোই, কোয়ার্টারে একা ফিরে যেগুলো হাতের কাছে না পেলে তরঙ্গনাথের বড় মুশকিল হবে। কত না আনন্দ করে তাঁরা এসেছিলেন, সকলে মিলে হই হই করে থাকবেন বলে; আর এখন তিনি আবার উজান বেয়ে চলেছেন ভাঙাচোরা টুকরোগুলোকে কোনও রকমে জুড়েতাড়ে, একটা শূন্য বাড়িতে গুছিয়ে রেখে আসতে। মন শান্ত করতে তিনি ভাবলেন, এখন তো তাঁরা সবাই মিলে বাড়ি ফিরছেন; তাই মন খারাপ না করে আনন্দ করাই তো ভাল; মনের অবস্থাটা তখনই ঠিক বোঝা যাবে যখন, সবাইকে ওখানে রেখে, আবার তিনি একা ফিরে আসবেন এই কোয়ার্টারেই।
সোদপুরের বসতবাড়িতে ফিরে এসে, গুছিয়ে-গাছিয়ে বসতে-না-বসতেই, সত্যিই যেন আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁদের মাথায়; যা ঘটে গেল, সে তো প্রায় কল্পনারও অতীত! সকলে যখন অপেক্ষা করছেন পুজোর ছুটিতে বদুর বাড়ি ফিরে আসার, তখন প্রাণবন্ত ছটফটে বদুর বদলে, বাড়ি এল তার অচৈতন্য দেহ। সোদপুর স্টেশনে নেমেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়; চেনাশোনা কয়েকজনের চোখে পড়ে যাওয়ায়, তারাই ওকে ধরাধরি করে তুলে, কোনও রকমে একটা ঘোড়ার গাড়ি জোগাড় করে বাড়িতে নিয়ে আসে। আতঙ্কে সবাই দিশেহারা। তারই মধ্যে কেউ একজন গিয়ে পাড়ার শ্রীহরি কবিরাজকে খবর দিতে, তিনি এসে নাড়ি দেখে বললেন, ধুম জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেছে; জলপট্টি আর মাথায় জল ঢেলে রাতটুকু কাটুক; সকালবেলা হাসপাতালে না নিয়ে গেলে রক্ষা পাওয়া শক্ত। কান্নার রোল আর থামল না; কারণ মাঝরাতেই শ্বাস থেমে গেল বদুর; হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে, শুরু হল শ্মশানযাত্রার তোড়জোড়। রাণীর চোখে যাতে না পড়ে, বদুকে তাই নামিয়ে আনা হল একতলার একটা ঘরে। সেখান থেকেই নিয়ে যাওয়া হল শ্মশানে; বাড়ির কারোর সঙ্গেই আর দেখা হল না বদুর। তবে, সবথেকে কঠিন যে-কাজটা করতে হল তরঙ্গনাথকে, তা হল বদুর শ্রাদ্ধ। তরঙ্গনাথের জীবনে এই প্রথম, এমন এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং শ্রাদ্ধশান্তির আগেই তা করতে হল বদুর অকালমৃত্যুতে। চিরদিনের মতো হাসি মুছে গেল তাঁদের মায়ের মুখ থেকে।
আত্মীয়স্বজন কেউ বাদ নেই; বদুর পারলৌকিক কাজে সকলেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন; এমনকী কালীঘাটের সেই মেজো মাসিমাও। হাওড়ায় নেমে অসুস্থ বোধ করায়, যাঁর বাড়ি গিয়ে বদু ওঠে; ধুম জ্বরে কাহিল অসহায় বদুকে দেখেও, সংক্রমণের ভয়ে তখুনি তিনি লোক দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেন, শেয়ালদা থেকে তার নিজের বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে। ওই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে, সে-যাত্রায় বদু হয়তো বেঁচে যেত— এসব কথা তিনি নিজেই এসে বলতে থাকেন তাঁর দিদি-জামাইবাবুকে। জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গেই তো ফেরার কথা ছিল বদুর; কিন্তু ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় বদু অস্থির হয়ে পড়ে এবং জ্যাঠামশাইয়ের নিষেধ না মেনে, নিজেই সব ব্যবস্থা করে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দেয়। হায় রে! দু’দিন আগে আর পরে! নিজের নিষ্ঠুরতা ঢাকতে মেজো মাসিমা এখনও তাই দোষ দিয়ে চলেছেন বদুকেই। অপরাধীর মতো মুখ লুকিয়ে বসে থাকা বাবা-মায়ের সম্মানের কথা ভেবে তরু বা তনু কেউ-ই তেমন রা কাড়েনি। রাণী কিন্তু হঠাৎ তার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে, এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে মেজো মাসিমাকে। তার শরীরে তখন অসুরের বল; তরঙ্গনাথ না থাকলে কী হত কে জানে! রাণীকে টানতে-টানতে কুয়োতলায় নিয়ে গিয়ে, তরঙ্গনাথ অন্যদের বললেন তার মাথায় বালতি-বালতি জল ঢালতে। কিছুক্ষণ পরে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে-তাকাতে রাণী ঝিমিয়ে পড়ল তরঙ্গনাথের দু-হাতের মধ্যেই। এই ঘটনার পরে সত্যিই সে উন্মাদ হয়ে গেল; মেজো মাসিমার পরিবারের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে গেল সব সম্পর্ক; পাটনা থেকে এক মাসের ছুটির অনুমোদন পেলেও, তরঙ্গনাথের জীবনে এবার শুরু হয়ে গেল সোদপুর-পাটনা যাতায়াত। ফলে বয়স্ক এবং বিষাদগ্রস্ত শ্বশুর-শাশুড়ি, পূর্ণ উন্মাদ ননদ, এবং নিজের দুই শিশুকন্যাকে সামলানোর সব দায়িত্ব এসে পড়ল তরুর কাঁধে। তরঙ্গনাথ দেখতে লাগলেন কী অসম্ভব ভালবাসায় সে সামলে চলেছে রাণীকে। কারণ তরু ছাড়া আর কাউকেই তো কাছে ঘেঁষতে দেয় না রাণী। নিজের শাড়ি-ব্লাউজ খুলে ফেলে, এয়োতির চিহ্নে সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে, বদুর হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরেই সে বসে থাকে। বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে রাখা ঘরটাতেই মাঝে মাঝে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে উঠে, দূরের রাস্তার দিকে চোখ মেলে দেয় সে। এভাবেই দু’বছর কেটে গেলেও, আবারও সন্তান এল তরুর গর্ভে। এবারে একটি খোকা হওয়ায় বুক বেঁধে উঠে বসলেন মা এবং বাবা। তাঁদের যেন কেমন মনে হল যে, বদু কি তবে তাঁদের মধ্যেই আবার ফিরে এল!
৩
ডায়েরি লেখার নিয়মিত অভ্যাস না থাকলেও, কিছু-কিছু ঘটনা লিখে রাখতে ভালবাসেন তরঙ্গনাথ। তাই দেখবার মতো তাঁর গানের খাতাটি; এমনই নিখুঁত তাঁর শীত-বাগানের পরিকল্পনাও; ওই ডায়েরি দেখে গাছ লাগালে, যে-কোনও আনাড়িও বাগান সাজিয়ে ফেলতে পারবে। এরকম ভাবেই তিনি লিখে রাখেন কিছু-কিছু স্মরণীয় ঘটনা ও দিন। আজ সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে, কী মনে হতে, সেই ডায়েরিটা খুলে বসলেন তরঙ্গনাথ।
১৯১১— মেজোমেয়ে ঊর্মিলা-ইলা জন্মাল। মৃত্যু হল আমার একমাত্র ভাই অদ্রিনাথ— বদুর।
*ভাইসরয় হলেন হার্ডিঞ্জ; বঙ্গভঙ্গ আইন তুলে নিল সরকার; দুই বঙ্গ এক হলেও উড়িষ্যা এবং বিহারকে আলাদা করা হল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে। আসাম নিয়েও বিশেষ নাড়াচাড়া পড়েছে।
*কলিকাতা থেকে রাজধানী চলে গেল দিল্লীতে; পঞ্চম জর্জ সস্ত্রীক এদেশে এলেন Royal Visit-এ। দিল্লীতে ‘দরবার’ শেষ করেই তিনি নাকি শিকার করতে নেপাল যান; খবরে প্রকাশ যে, King killed 21 tigers, eight rhinoceroses and one bear. He later boasted how it was a ‘record’ that would be ‘hard to beat’.
*দার্জিলিঙের Roy Villa-তেই মারা গেলেন সিস্টার নিবেদিতা।
*ন্যাশনাল কংগ্রেসের কলিকাতার অধিবেশনে গাওয়া হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি নতুন গান— ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!’।
গানের কথা মনে পড়ে যেতেই, ডায়েরিটা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলেন তরঙ্গনাথ। আরদালিকে ডেকে বললেন, এসরাজটা দিয়ে যেতে। মনে-মনে ঠিক করলেন, রাঁচিতে গেলে মোরাবাদী হিলটা দেখে আসতে হবে। বছরখানেক হল, মানে ১৯১২ নাগাদ জ্যোতি ঠাকুর নাকি পাহাড়ের ওপর একখানি ঘর বানিয়ে ইদানীং সেখানেই থাকেন, একেবারে একা!
আমি তরঙ্গনাথ— সাল-তারিখ ধরে এগোতে-এগোতে আমার জীবনেও যেন তা দেগে বসল। ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দিন জন্মাল আমাদের বড়মেয়ে; আর মেজোমেয়ে জন্মাল সিস্টার নিবেদিতার মৃত্যু-বছরে; কিন্তু খোকার জন্ম-বছরে নোবেল প্রাইজ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। জানি না এর পরে কোন দিকে মোড় নেবে জীবন! কোন ইস্কুলে পড়ে, কোন শহরেই বা থেকে, বড় হয়ে উঠবে আমার আর তরুর ছেলেমেয়েরা!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র