খেলার নীতিবাক্য
আমরা আফগানিস্তানেরও কেউ না, অস্ট্রেলিয়ারও কেউ না, কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আফগানিস্তান অস্ট্রেলিয়াকে হারালে আমাদের অকৃত্রিম ফুর্তি। কেন? কারণ ওই দলটাকে তো কেউ পোঁছে না, হিসেবেই আনে না, দুচ্ছাই করে; আর অস্ট্রেলিয়া হল মস্তান, মুরুব্বি, মহাকায়। তার মানে, এখানে আসলে হ্যাভ-নট জিতছে হ্যাভ-এর বিরুদ্ধে, গরিব জিতছে বড়লোকের বিরুদ্ধে, সৎ-মুখচোরা জিতছে জোচ্চোর-হামবাগের বিরুদ্ধে, সোজা কথা আমি জিতছি আমার বাড়িওয়ালা, বস, মার্সিডিজ-হাঁকড়ানো বন্ধুর বিরুদ্ধে। তলিয়ে দেখলেই মালুম, এ অ্যাক্কেরে টোটাল অবান্তর আবেগ-খরচা। যেখানে আমার দেশ খেলছে, তাকে হাঁউমাঁউ সমর্থন করব, এর মানে তবু বোঝা যায়। কিন্তু অন্য দল খেললে, খেলাটা উপভোগ করার বাইরে আর কিছু নিয়েই উথাল-পাথালের যুক্তি নেই। তবু আমাদের মনটা নিরন্তর ও-ধারাবাহিক অপমানে এমন চির-চেপটে থাকে, প্রতিটা ডেভিড নাম গলায়াথকেই আমরা ঘনিষ্ঠ নিজস্ব সংগ্রাম ধরে নিই। অথচ আফগানিস্তান যদি পৃথিবীর সামনে কোনও কারণে উজ্জ্বল হয়ে ঝলকায়, রাজনৈতিক ভাবে তা কুশ্রী। যে-রাষ্ট্র মানবাধিকারকে দলে পিষে তন্দুরি কাবাব বানিয়ে এ-গালে ও-গালে ঠুসেছে, যেখানে নারীদের দাসীবাঁদি হিসেবে ব্যবহার-প্রহার-নির্যাতন নিত্যপালনীয় কাজ, যে-দেশ শিক্ষা প্রগতি ও সভ্যতার প্রায় সব ক’টা সংজ্ঞাকে নিজেদের ধর্মগোঁয়ার্তুমির মুষলে থেঁতো করতে ব্যস্ত, সেই দেশের হয়ে কোনও উল্লাস মচাতে লজ্জা বোধ করা উচিত। সন্দেহ নেই, আমরা সাধারণত খেলার দলকে তার দেশের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ধরি না, কিন্তু মাঝেমধ্যে ধরিও। নইলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ এমন আত্যন্তিক উচ্চ-ভোল্টেজে কেমনে চিড়বিড়োয়? ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ কেন থরথরিয়ে কাঁপে (এবং মারাদোনা প্রথম গোলটা হাত দিয়ে করে আরও পাঁচ হাজার গুণ তক্কাতক্কি আমদানি করেন)? রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর টেনিসের বড়-বড় গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টে রাশিয়ার খেলোয়াড়দের নামের পাশে তাঁদের দেশের নাম লেখা হয় না। ২০২২-এ উইম্বলডনে তো রাশিয়ান ও বেলারুশিয়ান (রাশিয়ার সমর্থক ছিল) খেলোয়াড়দের খেলতেই দেওয়া হয়নি। আর হিটলারের সামনে জেসি ওয়েন্স-এর অলিম্পিক্স-জয়ী লংজাম্প ও তিনটে দৌড় (১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪ x ১০০ মিটার রিলে) মিলিয়ে চারটে স্বর্ণপদক অনেকের কাছে হিটলারের আর্যশ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বের মুখে বিরাশি সিক্কার থাবড়া। তাই ‘জয় আফগানিস্তান’ চিল্লালে, যে-নারীরা চাকরিহীন কলেজক্লাসহীন মর্যাদাহীন নিরাপত্তাহীন স্বাধীনতাহীন হয়ে পুরুষপ্রভুর পদসেবা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের আঘাত লাগতে পারে। এ-দেশ যেখানেই সম্মান পাবে, সেখানেই তালিবানদের কাজকম্মের দু’ছটাক হলেও বৈধতা জোগানো হবে। তাই ব্যাপারটা হয়তো স্রেফ রাঘব-বোয়ালের সঙ্গে সরলপুঁটির ইচ্ছাপূরণ-রূপকথায় বাঁধা না-ও থাকতে পারে।
ইউরো কাপ-এ সব দলই সব দলের সঙ্গে পেল্লায় লড়ছে, ক্রমশ ফুটবল-মানচিত্রে পিটিয়েছাতু ও দুধুভাতু মার্কা ব্যবধান কমে আসছে, কিন্তু একটা ব্যাপার দেখলে বিস্ময় রোধ শক্ত : সকলেই ফাউল করে এমনভাবে হাত তুলে নিজ নির্দোষিতার পোস্টার দিচ্ছেন, যেন খেলাধুলো ও ল্যাং মারার সংযোগ আদৌ হতে পারে তা-ই কখনও তাঁর চিদাকাশে ভ্রমণ করেনি। রেফারির উত্তোলিত হলুদ-কার্ডের দিকে এমন আন্তরিক বিস্ময়ে তাকাচ্ছেন যেন গোড়ায় ভেবেছিলেন গ্রিটিংস কার্ড। রিপ্লে-তে দেখা যাচ্ছে, একদম হিসেব কষে মেরেছেন, ফেলেছেন, ধাক্কা দিয়েছেন। এই মিথ্যাচার ও অস্বীকার একেবারে আবশ্যিক শরীরভাষায় ঢুকে গেছে। ভাবলে আমাদের বিস্ময়নেত্র স্ফারিত হতে পারে, কিন্তু আপাদমাথা খাঁটি খেলোয়াড় তো ফাউল করাকে একটা পালনীয় কৌশল হিসেবেই মনে করবেন না। একটা লোককে শৈলীতে হারাতে না পেরে আমি তাকে শারীরিক আঘাত করে থামাতে গেলাম, এটা ক্রিকেটে ঘটলে যেমন সাংঘাতিক কুৎসিত লাগবে— বোলারের স্পিন সামলাতে না পেরে তাকে গিয়ে ব্যাট দিয়ে এক গদাম ঘা, বা উঁচু ক্যাচ তুলে তা ধরতে উৎসুক উইকেট-কিপারকে কিলবিলে কাতুকুতু— সমান কদর্য লাগা উচিত ফুটবলেও। কেউ কি ভাবতে পারে, দাবায় প্রতিপক্ষের চালে মাত হতে-হতে আমি মরিয়া হয়ে তার ঘাড়ে রদ্দা হাঁকিয়ে চেয়ার থেকে ফেলে দিচ্ছি? ফুটবলে লোকটা যদি আমাকে কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, তার শরীর-দুলুনিতে ও পায়ের কাজে আমি পরাজিত হই, কেন আচমকা জোরে জুতো দিয়ে মেরে তার দৌড়কে ব্যাহত করব? সে-কাজের কোনও অধিকারই তো আমার নেই। যদি-বা খেলার ম্যানুয়াল তার অনুমতি দেয়, যদি-বা কনট্যাক্ট স্পোর্টে হরদম ধাক্কাধাক্কির অনুমোদন থাকে, আমার ব্যক্তিগত নীতি আমাকে এই কাজ থেকে প্রতিহত করছে না কেন? ফাউল মানে তো ভুল, অন্যায়। ইচ্ছাকৃত ভুল এক-আধবার তবু হতে পারে, কিন্তু খেলার প্রতি আধ-সেকেন্ড অন্তর নিয়ম হিসেবে প্রবাহিত হবে কেন? ফুটবলের এক মহাত্মা গান্ধী যদ্দিন না আসছেন, এ-প্রশ্নটাই ওঠার সম্ভাবনা নেই, সকলেই হাত উলটে বলবে, যাব্বাবা, গোল বা ফ্রি-কিকের মতোই, ফাউল তো ফুটবলের অঙ্গ! কিন্তু এ তো বক্সিং নয় রে ভাই, খেলাটা তো বলের কারুকাজের, মারধরের নয়। রেফারি দেখতে না পেলেই যদি বে-আইনি, অন্যায় কম্ম করাটা আমার নিজের কাছে দিব্যি ও বৈধ হিসেবে জ্বলজ্বল করে, তাহলে বলতে হবে আমার ভেতর খেলার নিয়মগুলো কোনও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাই করতে পারেনি। তাহলে আমি খেলাটার প্রতি (এবং মানবিকতার সাধারণ সূত্রগুলোর প্রতি) শ্রদ্ধাশীল থাকলাম কি?
সদ্য শেষ হওয়া ফ্রেঞ্চ ওপেন দেখে (এবং যে-কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম দেখে) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় : যে-কোনও মানুষ, সে তিনি যত বড় বীর ও যোগ্য হোন না কেন, উদ্ভট গর্তে পড়তে পারেন। এবং যে-কোনও মানুষ, মনের জোর ও প্রতিভার জোর জড়ো করে যদি চেষ্টা করেন, ভয়ানক বিপদ থেকে ফিরতি লাফ দিয়ে জয়ী হতে পারেন। প্রায় প্রতিটি বড় টেনিস টুর্নামেন্টে এমন খেলা হয়, যেখানে বিশ্বের সবাই নিশ্চিত এই লোকটা হারবে। শুধু সেই লোকটা নিশ্চিত হয় না। সাধারণত অবশ্য সে লোকটার পদবি হয় জকোভিচ। বিখ্যাত ইংরেজ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার একবার ফুটবলের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন : ‘ফুটবল হচ্ছে এমন খেলা, যেখানে নব্বই মিনিট ধরে বাইশটা লোক বল নিয়ে কাড়াকাড়ি করে ও শেষে সবসময়ে জার্মানি জয়ী হয়।’ সেভাবেই টেনিসেরও সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে, টেনিস একটা এমন খেলা যেখানে র্যাকেট হাতে অবিশ্বাস্য সব কেরদানি প্রদর্শিত হয় এবং যে যতই কায়দা প্রদর্শন করুক, শেষে জকোভিচ জয়ী হন। এই ফরাসি ওপেনে, যে-খেলায় তাঁর হাঁটু গুরুতর জখম, বেশ কিছু সেটের বেশ কিছু অংশ ভাল করে নড়তে পারছেন না, সে-খেলা অবধি জিতে নিয়ে চলে গেলেন। জন ম্যাকেনরো বললেন, কম বছর তো আমি খেলছি না ও ধারাভাষ্য দিচ্ছি না, এ-জিনিস কখনও কল্পনা করতে পারিনি। অবশ্য তারপর জকোভিচ টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন, হাঁটু অপারেশন করাতে হবে, কিন্তু এই শিক্ষা তিনি পৃথিবীকে বারে বারে দিয়েছেন, যখন সকলে, প্রত্যেকে, এমনকী সব হিতৈষী বলছে তোমার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব, তুমি সেটাকে বেমালুম উপেক্ষা করে নিজের বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে ঝাঁপাও। এ-শিক্ষা সব খেলাতেই বহু মানুষ আমাদের অনেকবার দেন; টেনিসেই নাদালও দিয়েছেন, ফেডারারও, এমনকী জকোভিচের বিরুদ্ধেই আলকারাজ-ও। ক্রিকেটে গত (৫০ ওভারের) বিশ্বকাপে দিয়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, তার আগে কেউ জানতই না এক পায়ে ক্রিকেট খেলা যায়। ফুটবলে তো নির্ধারিত নব্বই মিনিট শেষ হওয়ার পর, ইনজুরি টাইমও যখন গতপ্রায়, কত গোল হয় ও খেলার ভাগ্য ঘুরে যায়। কিন্তু জকোভিচ যেন ইন্দ্রজাল-কমিকসোচিত অবিশ্বাস্য মোড় ঘোরানোকে ট্রেডমার্ক করে নিয়েছেন। জকোভিচের প্রতিদ্বন্দ্বী একেবারে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর প্রেসের সামনে গিয়ে তবে নিশ্চিত হতে পারেন, যাক, এ-যাত্রা জিতেছি, কোনও অতিমানবিক কাণ্ড ঘটিয়ে জকোভিচ ফের বিশ্বকে ‘আঁক!’-অলঙ্কৃত করেননি। এই গ্রহে কেউ কখনও ফেডারারের হাতে উইম্বলডনের ম্যাচ-পয়েন্ট দিয়ে (খেলার স্কোর তখন ৪০-১৫) জেতার কথা ভাবতে পারেন? তবে শুধু জকোভিচ নয়, এই ফরাসি ওপেনে মেয়েদের সিঙ্গলস জয়ী ইগা সোইয়াতেক দ্বিতীয় রাউন্ডে নেওমি ওসাকার সঙ্গে নিশ্চিত হারছিলেন (প্রথম সেট হাড্ডাহাড্ডি লড়ে জিতেছিলেন ৭-৬, পরের সেট হেরেছিলেন ১-৬), শেষ সেটে ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে, পর পর পাঁচটা গেম জিতে খেলা শেষ করেন। ম্যাচের আগে সবাই নিশ্চিত ছিলেন ইগা জিতবেন, নেওমি বহুদিন খেলার বাইরে, ইগা র্যাংকিং-এ এখন পৃথিবীর ১ নম্বর আর নেওমি ১৩৪ নম্বর। তারপর খেলায় নেওমির প্রতাপ দেখে তাঁরা বোঝেন, বিরাটদের সম্পর্কে পূর্বধারণা নিয়ে খেলা দেখতে বসা যায় না। এবং এ-ও : বিরাটরা এতটুকু অসতর্ক হলেই, ভয়াবহ পাঁকে পড়ে যেতে পারেন (এক্ষেত্রে ইগা)। তারপর প্রত্যেকে যখন নেওমির নিশ্চিত জয়ের অপেক্ষা করছেন, আর মনে-মনে এই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডের উপযোগী ইন্সা-পোস্টের বয়ান ভাঁজছেন, ইগা ২-৫ হারছেন আবার নিজের সার্ভে ০-৩০, কিংবা পরে, নেওমি ৫-৩ জিতছেন এবং অ্যাডভান্টেজও তাঁর, তখন ইগা সসাগরা ধরণীকে স্তম্ভিত করে ম্যাচ জিতে নেন। এ প্রায় নদীর ঝুঁটি ধরে স্রোতমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া। এই লোককথাগুলোর নীতিবাক্য একটাই : খেলা ঘোরে। দিন বদলায়। সত্যি বদলায়, সিনেমায় নয়, মহাপুরুষের কোটেশনের সেমিকোলনের ভাঁজে নয়, বাস্তবে, প্রকাণ্ড প্রতিকূলতার একেবারে সম্মুখে দাঁড়িয়ে, পাহাড় ভাঙার মিরাকল-মণ্ডিত হয়ে, বদলায়। শুধু ইচ্ছাশক্তিটাকে সারা গ্রহের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওযার ইস্পাতটা সংগ্রহ করো। তা কক্ষনও সোজা নয়, আকুল সাধনার ফল, নইলে তো ময়রা-মুদি চক্ষু মুদি নিজের ভেতর থেকে জকোভিচ বা চোয়াল-ব্যান্ডেজ-কুম্বলে প্রসব করতে পারত, কিন্তু তা যে বাস্তবে সম্ভব, এবং বারে বারে সম্ভব, প্রায় এক-একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামে বারদুয়েক সম্ভব, তা আমাদের কাছে সহস্র সেল্ফ-হেল্প বইয়ের চেয়ে অধিক জ্বলজ্বলে।