ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • রূপান্তর


    স্বর্ণেন্দু সাহা (June 1, 2024)
     

    ঋষভ ট্রেন থেকে নামল। পেল্লায় প্ল্যাটফর্মটা তাকে যেন গিলে ফেলল নিমেষে। কয়েক বছর আগেও আপৎকালীন প্রয়োজন ব্যতীত সে ট্রেন এড়িয়ে চলত। ইস্পাতনির্মিত সুদীর্ঘ একটা গাড়ি, নির্জীব সাপের খোলসের মতো পেতে রাখা দিগন্তবিস্তৃত লাইনের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, দৃশ্যটাই ভীতিপ্রদ। পেটের মধ্যে হাজার যাত্রী নিয়ে একরোখা ষণ্ডের স্টাইলে দৌড়নো এই যানকে সে মোটেই পছন্দ করত না। কিন্তু রোজ-রোজ কাঁহাতক আর ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া যায়! মানুষ বেড়ে চলছিল। প্রায়ই লম্বা-লম্বা যানজটে বাস, অটো, ট্যাক্সিরা গিট্টু পাকিয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকত ততোধিক দীর্ঘ রাস্তার গায়ের উপর। গাড়ির ভিতরের মানুষ নাকি চাকাওয়ালা বাহনেরাই একে অপরের উপর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, মাঝেমধ্যে গুলিয়ে গেলে কারও দোষ নেই। অগত্যা মনের জোর ঠেসে বুক ফুলিয়ে, লাগসই একটা জীবনবিমার পলিসি করে নিয়ে তার পর সে ট্রেনে চাপা শুরু করল। প্রথমদিকে বুক দুরুদুরু করলেও অভ্যাস হয়ে গেছে। গতিবেগের থেকে যানজটে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে সে সরে আসতে চেয়েছিল। অধিক যন্ত্রের মালিকানা, মালিকের থেকে আলগোছে মনুষ্যত্ব সরিয়ে নেওয়ার ফন্দি আঁটলে ঠেকাচ্ছে কে? ঢিমেতালে এগোনো ভিন্ন আকৃতির গাড়িদের এই শোভাযাত্রা এক ঝটকায় ম্যাড়মেড়ে করে দিতে সক্ষম যে-কোনও উজ্জ্বল ভোর বা অপরাহ্ণ। অপেক্ষা আর অলসতা এই শহরে যে কবে নিজস্ব স্টপেজ বানিয়ে নিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। খেয়াল এবং মনোযোগ দুই-ই দুর্লভ হয়ে উঠছে অধিবাসীদের স্বভাবের মধ্যে।

    ঋষভ প্ল্যাটফর্মের অস্থায়ী দোকান থেকে চিপ্‌স কিনে নিল। এখান থেকে হাঁটাপথ। রয়ে-সয়ে হাঁটলে মিনিট পনেরো। স্টেশনের সামনের জনবহুল রাস্তাটা পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে ঠিক যেখানে সে পা রাখল, ক্ষুধানিবৃত্তি করে সাময়িক উদাস এক ইঁদুর একটু আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে হাওয়া শুঁকছিল। ইঁদুর যে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য শতাংশ দখল করে নিয়েছে, তার পিছনে আদর্শ কিংবা অপরাধপ্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ না কি নয়, সে-সম্পর্কেও ভাবার আগ্রহ পায়নি কেষ্টবিষ্টু বা আমআদমির কেউ। কায়িক পরিশ্রমের মূল্য নিম্নমুখী হতে থাকায় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমের ফাঁকে-ফাঁকে যে ঘুম হয়, তা সাধারণত নিরবচ্ছিন্ন। আগ্রহ তৈরি হওয়ার জন্য জরুরি যে নির্দিষ্ট গড়নের একমুখী অনুপ্রেরণা, তা বিরল। মানুষদের সীমিত খাবারে মূষিকরাও লুকিয়ে-চুরিয়ে, কখনও-বা সগর্বে প্রকাশ্যে ভাগ বসানোর সংগ্রাম শুরু করে দেওয়ার ফলাফল হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই নিম্নবিত্তরা বিষাদগ্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হতে আরম্ভ করেছে। যাদের নিজেদের রান্নাঘর বা ছাপানো নোট নেই, তারা অন্যের সম্পদ হাতড়াবেই। ইঁদুরদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য না থাকায় চিন্তাভাবনা ও খাদ্যাভাবঘটিত অসুস্থতায় তারা আক্রান্ত হয় না। এই শহরে তাদের মোটামুটি পাকাপাকি ভাবে বাসস্থান গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করলে যে কানাগলিতে গিয়ে তল্লাশি ধাক্কা খায়, সেখানে আরাম করে গুলতানি করে ফাস্টফুডের ভুক্তাংশ। ভাত-রুটির বদলে বিরিয়ানি, চিপ্‌স, রোল, সফ্‌ট ড্রিংকস-এ মজে থাকা প্রজন্ম সমাজ ও নিজেদের আত্মিক চেহারা নিয়ে সমানভাবে উদাসীন। ইঁদুর হোক বা উড়োজাহাজ, কেউ তাদের নিজস্ব ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটে।

    চিপ্‌স ফুরিয়ে যাওয়ার পর প্যাকেটটা অবহেলাভরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্যান্টে হাত ঘষে নিল ঋষভ। ফেলে দেওয়ার আগের মুহূর্ত থেকেই সে ভুলে গেছিল ফেলতে যাওয়া প্যাকেট-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রসঙ্গ। ভাল ছিল জিনিসটা, আরেকটা খাওয়া দরকার। আশেপাশে সন্ধানী চোখে তাকাল সে। না, আর দোকানপাট নেই। অতিরিক্ত কিছু প্যাকেট আগেই কিনে রাখলে… যেমনটা সে করে থাকে সচরাচর। আজকে করা গেল না। সে পকেট থেকে ফোন বার করল। বাকি রাস্তাটা ফেসবুক করতে-করতে হাঁটবে। এই যা! ফোনে চার্জ নেই বেশি। এখন ফেরার পথের মিনিট-দশেক ব্যবহার করলে বাড়ি ফিরেই প্লাগ-পয়েন্টে গুঁজে দিতে হবে। বাড়ি পৌঁছে কিছুক্ষণ সোশ্যাল সাইট ঘাঁটা তার রোজনামচার মধ্যে পড়ে। তা আর হবে না! উঁহু। সে ফোনটা পকেটে রেখে দিল। এবং হয়তো বছরখানেক পর তাকাল চারদিকে। কিছু খুঁজতে নয়, চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে। অবশ্য সময় কাটানোর জন্য ফোন দেখাই যেত, পরিবেশ নয়। তবে এখন নেহাত বাধ্য হয়েই সে চোখ বোলাতে লাগল। তখনই খটকা আর ঝটকা লাগল তার।

    রাস্তায় লোকজন এত কম কেন? ব্যাপার কী? রাস্তায় এত আবর্জনাই বা ফেলে রেখেছে কারা? ঋষভ নাক সিঁটকোল হাঁটতে-হাঁটতে। ধুস, ফোনে ঠিকঠাক চার্জ থাকলে এসব দেখতে হত না। বিরক্তিটা গিলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে অল্প-অল্প মনে পড়তে থাকল। গত দু-বছরে একবারও বোধ হয় সে চারপাশের দিকে, স্রেফ চারপাশটা দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকায়নি। দু-বছর আগের জনবহুল পথের দৃশ্য ভেসে উঠল তার স্মৃতিতে। এরকম সাধারণ একটা সন্ধ্যায় ব্যস্ততার রেশ নেই কেন? মিলছে না স্মৃতির সঙ্গে। এতটা বদলে গেল?

    তার মনে পড়ল, তাদের অফিসেও একটা আজব ব্যাপার ঘটছে। আচমকা দু-একজন কর্মচারী অফিসে হাজিরা দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। ফোন করলে কখনও কেউ ফোন ধরেই না, আবার কখনও কেউ ফোন ধরে জানায়, সেই ব্যক্তি নাকি বাড়ি থেকেই নিখোঁজ! ফলে নতুন লোক রিক্রুট করতে হয়। এই নিরুদ্দেশের বেনিয়ম ঘটেই যাচ্ছে পর্যায়ক্রমে। এর ভাল দিকটা হল, এখন আর ছাঁটাই হওয়া নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করে না। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মীই যে জোগাড় হচ্ছে না!

    অদ্ভুত তো! অফিসের বাইরে অফিসের স্মৃতি মনে করে ঋষভ একটু বিরক্তই হল। হোক গে যা খুশি, সে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে ভাবল। শুধু তার অফিস নয়, শহর থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে মানুষেরা! আরে, ওগুলো কী? ইঁদুর না কি? সে আতঁকে উঠল। একটাকে লক্ষ করার পর পরই আলো-আঁধারিতে মিশে থাকা দলবলের নড়াচড়া ও ক্ষিপ্রগতির চলন তার নজরে এল। এত ধেড়েইঁদুর কোন মুলুক থেকে এসে জুটল এই আনন্দনগরীতে?

    আনন্দনগরী? মুখ বিকৃত করল সে। কোথায় আনন্দ? আনন্দের একটা শর্ত যদি পরিচ্ছন্নতা হয়, এই শহর নিঃসন্দেহে তার প্রাচীন শিরোপা খুইয়েছে। রংচঙে প্যাকেটজাত বিভিন্ন পণ্যের খালি মোড়ক ছড়িয়ে রয়েছে যত্রতত্র। ফুটপাথ ঘেঁষে ও ফুটপাথের উপরেই ডাঁই করা আবর্জনা। দেখতে-দেখতে ঋষভ নিজের ঘাড়ে অল্প দায়িত্ব ও অপরাধবোধের ওজন অনুভব করল। তেলচিটে নোংরা একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সচেতন হওয়ামাত্র গন্ধটা যেন তীব্রতা বাড়িয়ে তার নাকে ঝাপটা মারল। দু-আঙুলে নাক চেপে ধরে সে দ্রুত হেঁটে যেতে থাকল। না, তার দোষ কী? সে একা মোটেই দায়ী নয়! সবাই এরকম করে। তাতে কী এসে গেল! রাস্তা পরিষ্কার করা হয় না কতদিন ধরে? করছেটা কী, স্থানীয় সরকারি সাফাইকর্মীরা? না কি তারাও সদলবলে নিখোঁজ?

    নিজের অগোচরেই ঋষভকে কাঁপিয়ে দিল ভাবনাটা। ভাবনার বিষয়টা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে সে সক্রিয় হল। ফোনে পুরো চার্জ না দিয়ে বেরনো উচিত নয় একদম। ভবিষ্যতে এই ভুল আর কদাপি নয়।

    এই নিরুদ্দেশের বেনিয়ম ঘটেই যাচ্ছে পর্যায়ক্রমে। এর ভাল দিকটা হল, এখন আর ছাঁটাই হওয়া নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করে না। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মীই যে জোগাড় হচ্ছে না!


    অনেক উঁচু থেকে কলকাতার দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার তাকানোর জন্য কাউকে চট করে রাজি করানো যাবে না। আপাত ভাবে আলো-ঝলমলে হলেও এই শহরের চার কোনায় যেন টাঙানো রয়েছে এক ঝাপসা মশারি। তার ফাঁক দিয়ে শহরকে দেখায় ঘুমন্ত বিভীষিকার মতো। ভয় লাগে, এবং সেই ভয়টা ক্রমশ চারিয়ে যেতে থাকে দেহাভ্যন্তরের প্রান্তসীমা অবধি। দূর থেকে কালান্তক দেখানো শহরে বাস করা অধিবাসীদের কাছে সমগ্র পরিস্থিতিটা অতটা ধোঁয়াচ্ছন্ন বলে মনে হয় না। পরিবর্তন ধীরে-ধীরে হওয়ার কারণেই অভ্যাসের চোখে মানিয়ে গেছে বিষাদ-আবরণে ঢেকে যাওয়া কংক্রিটের জঙ্গলের পরিমণ্ডলটা।

    কংক্রিটের জঙ্গলের ছোট্ট একটা গুল্মের মধ্যে অবস্থান করা ঋষভ একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিল ঘরে ঢোকার পর থেকে। একটু আগেই দেখা সন্ধ্যার কলকাতার ভাবসাব তার নজরে খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ ঠেকেছে। কোথাও একটা সোজাসাপটা গরমিলের অঙ্ক ভাসছে, যা সে খেয়াল করতে সক্ষম হচ্ছে না। রাতে নিরুপদ্রব ঘুম হচ্ছিল না তার বেশ কয়েকদিন যাবৎ। বার বার যেন একটা পাতলা, মিহি দুর্গন্ধ তাকে ঘুমোতে বাধা দিচ্ছিল। আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষদের ঘ্রাণশক্তির উপর ভরসা বা নির্ভর করবার দরকার পড়ে না। ভোঁতা ঘ্রাণেন্দ্রিয় সময়সাপেক্ষে সমস্যা নয়, সুবিধা তৈরি করে। আধো-ঘুম-আধো-জাগরণ অবস্থায় সে বার বার ছটফট করছিল। আজকে সমস্যা বেশি। গন্ধ না কি গন্ধের স্মৃতি তাকে আগলে রেখেছে? অগোছাল ঘুমন্ত মস্তিষ্ক তাকে সঠিক ভাবে চিন্তা করার উপায় বা সিদ্ধান্তসুলভ কিছু গছিয়ে দিল না। অন্যদিন গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করলেও সে খেয়াল করে উঠতে পারে না। আজকে গন্ধ আর গন্ধের উৎস দুই-ই তার নজরে পড়েছে। সে-কারণেই জটিল রূপ ধারণ করেছে সমস্যা। এত লোক কম কেন রাস্তায়? না-চাইলেও প্রশ্নটা তার মস্তিষ্কের ভেতর সদর্পে ডিগবাজি খাচ্ছিল। ভয় নয় কিন্তু ভয়ের নিকটতম প্রতিবেশী কোনও এক অনুভূতি তাকে নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছে না। সে খাট ছেড়ে উঠল, জল খেল, এপাশ-ওপাশ করতে থাকল সারাটা রাতজুড়ে। তার ঘরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বন্ধ জানলার উপরে ভারী পর্দা ফেলা থাকায় বাইরের আলোও প্রবেশ করতে পারছে না।

    নিশুতি রাত্রে কুয়াশাচ্ছন্ন আলো-আঁধারির মধ্যে কোনও ফুটপাথে মানুষ নেই। পথে রাতযাপন করা হতদরিদ্র মানুষেরা কোথায় গেল, এই নিয়ে বিদেশি তথ্যচিত্র-নির্মাতারা উদ্‌বিগ্ন হতে পারেন। ছবিতে পেডিগ্রিওয়ালা ভিখারি না থাকলে পুরস্কার জোটে না। তবে এই শহরের লোকজন কারও না-থাকা নিয়ে চিন্তিত নয়। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চারপাশের পরিবর্তন চোখে না পড়া বড়ই স্বাভাবিক।

    এঁটোকাঁটা ভক্ষণ করে বেঁচে থাকা তুচ্ছ, অপাংত্তেয় প্রাণীরা তাদের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্রতিদিনের মতো। পেটের তাড়নায় বাতাস শুঁকতে-শুঁকতে তরতর করে এগোচ্ছিল তারা সুগন্ধের উৎসের দিকে। তাদের চলাফেরায় বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কেউ নেই বিরক্ত করার মতো। প্রচুর খাদ্যরাশির সম্ভার নিয়ে তারা ভুরিভোজে মেতেছে। বুভুক্ষুরা পেটের ফোঁকর জমাটি করে ভরিয়ে ফেলার পরেও খাবার ফুরোচ্ছে না। বছর দেড়েক আগেও এই মাপের স্বাচ্ছন্দ্য তারা কল্পনা করতে পারেনি। খাবারের পরিমাণ দিন-দিন বেড়ে যাচ্ছে। অর্ধেক চাঁদের আলোয়, অনুজ্জ্বল ল্যাম্পপোস্টের কিরণে মাখামাখি হয়ে থাকা শব্দহীন সময়ের প্রবাহে বয়ে যেতে-যেতে তারা খাচ্ছিল, নিজস্ব ভাষায় আলোচনা অথবা হাসাহাসি করছিল। বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল এদিক-ওদিক ইচ্ছামতো।

    ঘুম থেকে ওঠার পরেও পচা, তেলতেলে একটা গন্ধ ঋষভ টের পেল। বাতাস থেকে গন্ধটাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। ক্রমে-ক্রমে এটা যেন বাতাসের নিজস্ব গন্ধই হয়ে উঠতে চাইছে। প্রথমদিকে নাক কুঁচকে রাখলেও ফোনের স্ক্রিনে মন দেওয়ার পর তার নাক সংকুচিত অবস্থায় থাকার বিলাসিতা ঝেড়ে ফেলল। গত সন্ধ্যার স্মৃতি আর তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ওসব নিয়ে ভাবার দরকারই বা কী?

    ঋষভ পোশাক পরে, চুল আঁচড়ে রোজকার নিয়মমাফিক রাস্তায় পা রাখল। আরে, বাড়ির ঠিক সামনেই একটা নোংরাভরা বস্তা! কালকে ছিল না। ঘেন্নায় ও প্রতিবেশীদের প্রতি বিরক্তিতে সে এক দলা থুতু ফেলল। ইশ! ভুলে যাওয়া গন্ধটা নাছোড়বান্দা এঁটুলির কায়দায় সরীসৃপের মতো সড়সড় করে তার শরীর বেয়ে নাকে ঢুকে পড়ল যে! সে নিজের অজান্তেই নাক কুঁচকে ফেলল গন্ধের অনধিকার প্রবেশ আটকানোর জন্য। সে তাড়াতাড়ি পা চালাল ক্লেদাক্ত গন্ধটার তাড়নায়।

    বেশ কয়েক পা এগোনোর পরে আচমকা কোনও রকম কিছু জানান না দিয়েই দুর্গন্ধযুক্ত একটা অন্ধকার সযত্নে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার চোখের বিস্তার জুড়ে। সে তার পর আর কিছু জানে না।

    ওখানে ঋষভ বলে কারও বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব রইল না। তার বদলে একটা ছোট্ট আবর্জনার স্তূপ নিঃশব্দে কিছুটা জায়গা দখল করে ফেলল। রাস্তার পার্শ্ববর্তী অপরিষ্কার নালার জঞ্জাল ঘেঁষে খেলা করছিল দুটো বাচ্চা ইঁদুর। বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে তারা ছুটে এল স্তূপটার দিকে। সন্তর্পণে নাসারন্ধ্র প্রসারিত করে শুঁকল।

    আজকে ঘরের সামনেই খাবার। কী মজা! তারা বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে।

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook