কারা যে হেসে ওঠে এমন সময়ে! একেবারে ছ্যারছ্যার করে হিসির মতন। এমনিতেই দু-পায়ে ব্যালেন্স করে দাঁড়াতে পারছিস না, তার ওপর হাসি! তার ওপর ঢঙের ব্যাগ! তার ওপর আবার তাস! হাসির ছিটে এর গায়ে-ওর গায়ে লেগে পুরো কামরায় ছয়লাপ। সাতটা পঞ্চাশের ট্রেন, সাতান্ন হতে চলল, তবু ছাড়ে না। কী পিরিত মাইরি! এরপর ঝোলাতে-ঝোলাতে যাবে।
সবই তো ঝুলছে। বিচি ঝুলছে, দেশ ঝুলছে, মা কালীর খাঁড়া ঝুলছে। ঝোলা ব্যাগের অনর্গল খোঁচা খেতে-খেতে অশোককুমার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ব্যাগটা এখানেই গুঁজে দাও না!’ বিস্ময় বালক কোথায় গুঁজবে বুঝতে না পেরে এক ছিটে হেসে দিল। বালকের মুখ থেকে হাসির ছিটে গিয়ে লাগল যার মুখে, তিনি হেডফোন গুঁজলেন। কেউ চেঁচিয়ে উঠল।
‘লিখলেই কবিতা! লিখলেই কবিতা!’
অমনি, ট্রেন ছাড়ল!
পাঁচটা বছর-চল্লিশ একসঙ্গে, ‘কোথায় গো সোনা! মুখটা একটু দেখিইইইই!’
‘এই যে দাদারা। ভাল-ভাল কলম পেয়ে যাবেন দাদারা। প্যাকেট তিরিশ, দুটো দশ, সিঙ্গল ছয়—’
‘পা রাখার জায়গা নেই, তুমি এখানে কবিতা মারাচ্ছ?’
দরজা থেকে আওয়াজ এল, ‘লাইনে নতুন? নতুন?’
দরজা থেকে আবার আওয়াজ এল, ‘চপ ভাজলেই তো ভাল করতে!’
এবার জানলার ধার থেকে, ‘ঠেলে ফেলে দিচ্ছেন না কেন?’
অশোককুমার ধমকালেন, ‘এবার ঠেলে ফেলে দেব! ব্যাগ সামলাতে পারো না, ট্রেনে ওঠো কেন? দেখতে পাচ্ছ না, আমি মুভি দেখছি!’
বালক উত্তর দিতে চেয়েও পারল না। কারণ আবার, ‘লিখলেই কবিতা! লিখলেই কবিতা!’
‘কে বে, তখন থেকে ক্যাজরা করছে!’
‘এই যে ভাই! আমায় দেখে বে-বে করা পাবলিক মনে হচ্ছে? ভদ্রভাবে কথা বলো!’
‘কাকা আপনি কি কবিতা-সবিতা করে ক্যাজরা পাকাচ্ছেন?’
রগড় জমছে। ট্রেনও বিধাননগর ঢুকছে। এ-গল্পে অশোককুমার, সন্ধে সাতটা পঞ্চাশের শান্তিপুর লোকাল, ঝুরিভাজা, কাঁচালঙ্কা— এরা আসলে কিস্যু না। হেডফোনের মতোই এদের জাস্ট গুঁজে দেওয়া হয়েছে। নির্ভেজাল ক্যাওস তৈরির খাতিরে। তাকে নিয়ে গল্প এগোতে পারে— অন্তত সম্ভাবনাটুকু উড়িয়ে দিতে পারছি না— অশোককুমারের পাশে যে-ঘেমো লোকটা আধখানা পাছা ঘরে-বাইরে করে বসার চেষ্টায় আছে। এই আশ্চর্য ঘষাঘষির প্লটে, সে বলল, ‘আমি নেব! আমি!’
ঠিক তখনই, কেউ নির্ঘাত, অদৃশ্য একটা গুলতি দিয়ে গাদা-গাদা মানুষকে টেনে রেখে অপেক্ষা করছিল শালা ট্রেন কখন বিধাননগরে ঢুকবে। তারপর সে ইয়ার্কি মারবে। মজা লুটবে। দরজা তাক করে সে এক গোছা করে মানুষ ছুড়ে-ছুড়ে দেবে— হরির লুট, হরির লুট— ঢাউস-ঢাউস নকুলদানার মতো তারা ছিটকে বেরোবে, কনুই দিয়ে, হাঁটু দিয়ে ঠ্যালা মারতে-মারতে মিশে যাবে ভিড়ে।
‘একটু ঢুকে দাঁড়ান না দাদা!’
‘জায়গা নেই, ভাই!’
‘আরে এক পায়ে ঝুলছি তো!’
যারা ঝুলছে, যারা ধুঁকছে, যাদের এই মুহূর্তে ট্রেনের হ্যান্ডেল এবং শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই— তাদের দেখে কানে-হেডফোন বলল, ‘মালগুলো সুযোগ পেলেই শুধু ঝুলে পড়ে!’ তারপর লঙ্কায় কামড় দিল।
তার মানে ঝাল ছড়াচ্ছে। হেলে যাবেন না দাদা। সিধা হয়ে দাঁড়ান। স্ট্রেট, স্ট্রেইইইট! ঘেমো লোকটা যখন দশ টাকা দিয়ে দুটো পেন কিনল, যখন তার সাধারণ চোখ দুটোবিস্মিত ও বিভ্রান্ত— গল্প তাহলে লাইনে আছে। একটু পরেই দমদম।
‘ঠিক বলছেন? লিখলেই কবিতা?’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছে রতন চাকী!’
‘লিখতে-লিখতে যদি মাঝপথে আটকে যায়, তখন? কী হল, চলে যাচ্ছেন কেন?’
‘লিখলেই কবিতা! আর কে লিখবে কবিতা? কে?’
‘কেউ চায় না।’ একজন বলল।
‘তাই বলে আপনি দরজা গার্ড করে দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
‘কোথায় গার্ড করেছি?’
‘নামতে না পারলে নামিয়ে দেব!’
‘কত কী নামাতে পারেন আমিও দেখছি!’
ভেতর থেকে আওয়াজ এল, ‘ছ্যা! আপনাদের লজ্জাশরম নেই?’
২
লজ্জাশরম আছে। ঢের আছে। আছে বলেই সাইকেল সারাইয়ের দোকানটাও আছে। নইলে কবে নিভে যেত তারা। তারাপদ দাশ।
যেবার পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সবাই ‘আকাশ ভরা, সূর্য-তারা’ গেয়েছিল, কেত মেরে সেদিন জামার কলার তুলেছিল সে। বার বার তুলছিল। বলছিল, ‘দেখেছ বাওয়া! আমার নামে গান আছে। আমি তারা। কোনও ঠাকুর-ফাকুর না, একেবারে স্টার।’
স্টার হওয়ার চক্করেই তারা চল্লিশ পেরোল। সিরিয়ালে একটা চাকরের পার্ট জুটল না। তারপর ফিনাইল আর ব্লিচিং পাউডারের ব্যবসা। ট্যাঁকে যেটুকু টাকাপয়সা এল, উড়িয়ে দিল। হিন্দি সিনেমা দেখে। শেষে ঠেকল সাইকেলের দোকানে। ঝাঁপের গায়ে ট্যারা-ট্যারা অক্ষরে লেখা— দাশের দোকান। নীচে ফোন নাম্বার। দোকান খোলা থাকলে নাম উপরে উঠে যায়। সন্ধেবেলা ঝাঁপ পড়লে তারার মতো নেমে আসে।
দাশের দোকান। ঝিকমিক করবে না কোনওদিন।
দুপুরবেলায় মানুষ একটু কমে যায়। সাইকেলও। ঘটাং-ঘটাং করে তারার ওপরে পাখা ঘোরে কেবল। ধুলো ওড়ায়। ধুলোয় সে গড়ায়। তারার ধুলো। চোখে ঢুকলেই ভোগে। গলার গামছাটা তাই মুখের ওপর মেলে রাখতে হয়।
আজ রাখেনি। বদলে মেলে রেখেছে একটা খাতা। সাদা ধবধবে খাতা নয় কোনও। গতকাল অবধি যে-খাতা ছিল কোনও রংমিস্ত্রির, রেশন দোকানের কিংবা তারার ছেলের— এখন, এই খাতা তারার একার। তারা ফোটার খাতা। এক মিনিট! সাইকেলের লিক না সারিয়ে সে খাতা নিয়ে পড়ল? আপনারা কেউ প্লিজ ওকে বলুন। অনেকক্ষণ ধরে একটা সাইকেল দোকানের সামনে ক্রিং-ক্রিং করছে। তারা শুনছে না।
‘ও কাকা! হাওয়া হবে না কি?’
‘হ্যাঁ?’
অল্প কেঁপে উঠল তারা। হাওয়া বইল। শন শন।
‘হাওয়া, হাওয়া! হবে? সামনে-পেছনে দুটোতেই লাগবে।’
‘ওই তো ঝুলছে। দিতে পারবে না একা-একা?’
পারবে না। চার টাকার হাওয়া দিল তারা। ফিরে এসে দেখল বিনে পয়সার হাওয়া ওলটপালট করতে-করতে খাতাটাকে যে-পাতায় এনে ফেলেছে, সেখানে সরল সুদের অঙ্ক কষে রাখা। এখানে কিছু লিখতে মন চাইছে না। লিখলে অঙ্কগুলো গোল্লা পাকিয়ে যাবে। তারার গা-ভর্তি জটিল অঙ্ক। কোথাও ছ্যাঁদা। কোথাও ওষুধের দোকানে ধার। কোথাও বাজারের ফর্দ। কোথাও ইনসিওরেন্স কোম্পানির ফোন নাম্বার। শুনশান একটা পাতা বেছে নিয়ে দুটো শব্দ লিখল তারা : হাওয়া হবে। মিনিটখানেক হাঁ করে তাকিয়ে দুটো শব্দই কেটে দিল। মুখে এক ছিটে হাসি। তারপর আবার দুটো শব্দ : হাওয়া বেচলাম। তারা কি হাওয়ার কারবারি করে?
ছেলেটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল সকালে। তারা ভুলে গেছে। আইসক্রিম! আইসক্রিম! তারার ফোকাস কবিতা থেকে আইসক্রিমের দিকে সরে যাচ্ছে হে পাঠক। এইভাবে হবে না। তারা বরং তিনটে সাইকেলের চেনে টাইট দিক, চারটে লিক সারাক, পাঁচটা বাজলে দোকানের সামনে ডিমের খোলা জ্বালিয়ে মশা বিদেয় করুক। লিখলেই কবিতা? ঢপের কথা সব! ফের যদি দেখা হয় লোকটার সঙ্গে, বুঝিয়ে বলবে। কী বুঝিয়ে বলবে? কবিতা? তারা এবার ছেলেমানুষি করছে। শেষ লেখা দুটো শব্দও ঘ্যাঁচ করে দিয়ে তারা যখন দোকান বন্ধ করল, বাংলা কবিতার তাতে কিছু এল-গেল না। শুধু ছেলের জন্য আইসক্রিম কিনতে ভুলে গেল সে। ধ্যাত!
৩
তারার ছেলে বিছানায় কুত্তার ল্যাজের মতো পাক দিচ্ছে। গোল-গোল রুটি বেলতে পারেনি বলে মেয়েটিকে আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। সিরিয়ালের কাঁদুনি। আইসক্রিমের কাঁদুনি। গুলিয়ে যাচ্ছে। টিভির সাউন্ড বাড়ছে না। তারার বউ মাথায় রিমোট ঠুকে বলছে, ‘সবই কপাল! সবই কপাল!’ কপালদোষেই কি তারার চায়ে রোজ চিনি কম হয়? বউকে আজ হেবি ঝাড়বে বলে সবে কায়দা মেরে দাঁড়িয়েছে, তারার ফোন বেজে উঠল। টিভিরও সাউন্ড বেড়ে গেল।
‘হ্যালো!’
‘আপনি জীবনানন্দ দাশ?’
‘কে বলছেন? হ্যালো? হ্যালো? এই যে! সাউন্ডটা কমাতে পারছ না!’
‘পারছি না।’ রমা বলল।
‘কথা শোনা যাচ্ছে না!’
‘শুনতে কে বলেছে?’
‘আমায় তো কেউ ফোন করেছে!’
‘আচ্ছা জ্বালা তো! বলে দাও পরে ফোন করতে।’
‘রমা—’
এরপরে টিভির সাউন্ড এতই বেড়ে গেল যে, আমি নিশ্চিত, আপনারাও নির্ঘাত শুনতে পাচ্ছেন জীবন মানে জি-বাংলা। জীবন মানে জীবনানন্দ হল না। তাই দৃশ্যের জন্মও হল না। জলের মতো একা-একা ঘুরে— তারার ফোনটা বাজছে। আবার। সে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
‘হ্যালো!’
‘হ্যালো? জীবনানন্দ দাশ বলছেন?’
‘কী?’
‘আমি কি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কথা বলছি?’
‘না, আমার নাম তারাপদ দাশ।’
‘দুঃখিত।’
আবার ফোন।
‘হ্যালো!’
‘জীবনানন্দ দাশ আছেন?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘তারাপদ দাশ আছে।’
ফোন কেটে যায়।
এইবার তারার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একজন চেঁচাল, ‘কেউ আছেন?’
‘কাকে চাই?’
‘জীবনানন্দ দাশ এ-বাড়িতেই থাকেন?’
‘কে?’
‘জীবনানন্দ দাশ। আপনি চেনেন না?’
‘অত আমার ঠ্যাকা পড়েনি!’
‘সত্যিই থাকেন না?’
‘কথা কানে যায় না? বললাম তো, এখানে তারাপদ দাশ থাকে। কোনও জীবন-টীবন থাকে না।’
আগন্তুককে দুচ্ছাই করে তারা শান্তি পেয়েছে। রমা সারাদিন খেটে মরে। সন্ধেবেলায় ওইটুকু সিরিয়ালই তো দেখে। কখনও দেখতে-দেখতে, কখনও কাঁদতে-কাঁদতে চায়ে চিনি দিতে ভুলে যায়। আহা বেচারি! ছেলেটা তখন থেকে পাক দিচ্ছে বিছানায়। ছি ছি! আপনারাই বলুন, নিজের ছেলে কখনও কুত্তার ল্যাজ হয়! এখনই একটা আইসক্রিম কিনে আনা উচিত।
পাড়ার দোকানপাট বন্ধ। সোমবার। আরেকটু এগিয়ে পৌঁছতে হবে চার মাথার মোড়ে। তারার ডানদিকে অন্ধকার একটা গলি। গলিতে নানা বয়সি প্রেম। নানা ছুতোয় হাতধরা। নানা রকমের যৌনতা। যে-গলির বাইরে দাঁড়িয়ে, একা, তার হৃদয় ঝরছে। নক্ষত্রের মতো। তারার চোখে তাকিয়ে আচমকা হেসে উঠল সে। দীর্ঘ বছরের পরিচিতের মতো। পাশাপাশি হেঁটে গেল আইসক্রিমের দোকান পর্যন্ত। সাইলেন্ট মোডে। শব্দ ছিল হাওয়ার। গাছের। মানুষের। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনিই জীবনানন্দ দাশ?’
‘ধ্যার শালা! কে জীবনানন্দ দাশ?’
‘আপনিই তো জীবনানন্দ দাশ! কত কবিতা লিখেছেন, গল্প—’
‘কবিতা?’
‘কবিতা। লেখেননি?’
‘আমি?’
প্যাকেট তিরিশ, দুটো দশ, সিঙ্গল ছয়। লিখলেই কবিতা। লিখলেই কবিতা… আইসক্রিম কিনে পকেট হাতড়ে মরছে তারা। কলম দুটো আছে। টাকা নেই। আনতে ভুলে গেছে। আইসক্রিম দোকানেই পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। গলে যায়— গলতে-গলতে ফের জমে যায়— তারার ছেলে কুত্তার ল্যাজের মতো পাক দেয়— রমা কাঁদে— কাঁদতে-কাঁদতে হেজে যায়— তারপর আবার কাঁদে— তারা মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খায়— মাঝেমধ্যে খাতায় লেখে : হাওয়া বেচেছি চার টাকায়— কাটে— আবার লেখে : হাওয়ার দাম মাত্র চার টাকা— হয় না— আবার লেখে :
হাওয়া বেচতে-বেচতে কখনও হাওয়া হব
নিজের দাম রাখব চার টাকা
বাংলা কবিতা বোমকে যায়— তারা নিজে বোমকে যায়— তারার কি ক্ষয় শুরু হয়? তারার মগজে কক্ষপথ—বৃত্ত-উপবৃত্ত-প্যারাবোলা জুড়ে জীবনানন্দ দাশ— কে এই জীবনানন্দ দাশ? সে ব্যাটা কি আকাশের কোনও তারা?
৪
গল্পটা আর লাইনে থাকছে না। শেষ তিনদিনে শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর। আপ-ডাউন। আপ-ডাউন। গতকাল ভোরে কাঁটাতার পেরিয়ে গেল। এরপর হয়তো সামলাতে পারব না। যে-কোনও সময়ে অ্যাক্সিডেন্ট।
বাংলাদেশ থেকে ফোন এসেছিল। আজ সকালবেলা। প্রথমে বিক্রমপুর। তারপরে বরিশাল। তারপর নাটোর।
‘কবিতা চাই।’
‘বনলতা সেনের ঠিকানা চাই।’
‘অন্ধকার চাই।’
‘মিশরীয় মদ চাই।’
‘হিজল গাছের চারা চাই।’
‘একবিংশ শতাব্দীর বোধ চাই।’
প্রতি ক্ষণে। প্রতি ফোনে। তারার ক্ষয় হয়। ভগবান এ কী ছ্যাঁচড়ামি করছে! যখন সাইকেলের লিক সারাতে যায়, টায়ার-টিউবে হাওয়া ভ’রে এক বালতি জলে চুবিয়ে দেয়। জলে বুদবুদ লাট খায়। ট্রেনের গায়ে ঝুলছিল যারা। ওদের মতো। আনলিমিটেড। জলের ওপরে এসেই ভেঙে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। গলে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে। পচে যাচ্ছে। আদ্যিকালের লোহার বালতি মানুষের মতো বুদবুদে ছেয়ে গেছে। কোন লিকটা আগে সারাবে তারা! সাধ জাগে, জলের বুদবুদ হয়ে যায়। বালতির খুব গভীরে লাফ মারে। মিশে যায় জলে। মানুষে। সেখানে কি জীবনানন্দ আছে?
‘ক’দিন এত ফোন আসছে তোমার!’
‘তা একটু আসছে।’
‘সেই আনন্দে কি দোকানটা লাটে তুলে দিলে?’
‘কাল আর আজই তো বন্ধ রেখেছি!’
‘কাল আর আজ তো রান্না বন্ধ হয়নি! হয়েছে?’
‘ধুর শালা!’
কবিতা লেখার খাতা নিয়ে বেরোয় তারা। একটা চায়ের দোকানে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ধুলো ওড়ে। হাওয়া বেচতে-বেচতে একদিন হাওয়া হব— মাথায় পাক খাচ্ছে। ছোটবেলায় যে-সাইকেলের সঙ্গে দোস্তি হয়েছিল, আজ তা হঠাৎ পিস-পিস করে বিকোচ্ছে। রাস্তার ধারে। কেজিদরে। দলা-দলা মাংসের মতো। কী বিকট মানুষের লাইন! রমা, সাইকেলটা বেচে দিল? পেট গুলিয়ে গেল তারার। চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হল : বমি। আচমকা গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিল কেউ। আর ঢেলে দিল বোতল-বোতল ফিনাইল। তারার সামনে টাকা উড়ছে। একগাদা শিমুলতুলোর মতো। ব্যাকগ্রাউন্ডে ইমরান হাশমি। তাকে ঘিরে সেক্সি হিরোইন, চিকেন প্যাটিস, কোকা-কোলা, সিনেমার টিকিট, চুলের নতুন ছাঁট আর একটা সাইকেল! ঠেলে বেরিয়ে আসবে শরীর থেকে। তারা হুড়মুড়িয়ে খাতায় লেখে :
জন্মের পর থেকে একটা সাইকেল চলেছে শরীরে
চল্লিশ বছর
ধাক্কা খেয়ে, হড়কে অথবা ব্রেকের ব্যবহার না জেনে
সামনের চাকা টাল, পেছনের চাকায় লিক,
প্যাডেলে চাপ দিলে এক মিনিট করে ক্লান্তি বেড়ে যায়।
সাইকেলের ছায়ায় জীব—
আটকে যাচ্ছে। পরের শব্দে যেতে পারছে না। কিছুতেই মন আর মাথাকে জড়ো করতে পারছে না। কারণ, টানা দশ মিনিট ধরে ফোন বাজছে। আর পারল না।
‘চিঠি চাই।’
‘সেলফি তুলতে চাই।’
‘গোপন ডায়রি চাই।’
‘বনলতা সেনকে চাই।’
‘ব্যক্তিগত ট্রাঙ্ক চাই।’
‘হিন্দুরাষ্ট্র চাই।’
‘সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তি চাই।’
‘চাকরি চাই।’
‘ভাত চাই।’
‘আর্ট চাই।’
‘আর্টের হাত থেকে নিস্তার চাই।’
‘সব চাই।’
‘শব চাই।’
গাদা ফোন আর গাদা মানুষ আর গাদা কথা! হারামিগুলো ধরেই নিয়েছে তারা আসলে জীবনানন্দ। অথবা জীবনানন্দর আপডেটেড ভার্শন! মওকা পেয়েই হামলে পড়েছে— ভোগের খিচুড়ি— ভোগের খিচুড়ি! অথচ শালা কেউ অবাক হল না। কেউ আমতা-আমতা করল না। কেউ শালা এক মিনিট চুপ করে শুনল না, তারার কীভাবে শ্বাস পড়ে। আর কেউ শালা এত অবাক হল যে, জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেল, কেমন আছেন! হেবি পপুলার হওয়া যায় এইভাবে। কবিতা হয় না। এইবার গল্পটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে।
লিখলেই কবিতা! লিখলেই কবিতা! আবছা কানে বাজছে তারার। কে যেন কলমদুটো দিয়েছিল? তারার ফোকাস কবিতায় ফিরছে না আর। এখনই তাকে হতে হবে একজন স্নাইপার। একজন বেহালাবাদক। একজন ব্রুটাস। একটা ঠুলি পরিয়ে দেওয়া উচিত তারাকে। এক মনে কবিতা লিখুক। জীবনানন্দকে খুঁজুক।
৫
সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলল তারা। দু’দিন পর। সব এক আছে। রেঞ্জ আর স্ক্রু-ড্রাইভারের বাক্সের ওপর। শুধু তিনটে বই রাখা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ‘মহাপৃথিবী’। ‘সাতটি তারার তিমির’।
দোকানের সামনে এক খণ্ড ভিড়। সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কিনবে একজন। একজন কিনবে নতুন সিট। কেউ মাডগার্ড লাগাবে। চেনে টাইট দিতে হবে। বল-বেয়ারিং বদলে দিতে হবে। সাইকেলের কেরিয়ার চাইছে কেউ। কেউ চেঁচাচ্ছে, ‘হাওয়া চাই! হাওয়া চাই!’ তারপর সব কেমন ঘেঁটে গেল। কিচ্ছু শুনতে পেল না তারা। উপুড় হয়ে পড়ে রইল। হাতে কবিতার বই।
শুয়োরের বাচ্চা! তোর জন্মই হয়েছে আমাদের সাইকেল সারাবি বলে! ভিড়ের ভেতর থেকে দাঁত আর নখ আর ঢিল। খুবলে খেতে আসছে। তারা আচানক উঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া দিয়ে। তারপর বইয়ের একটা-একটা পাতা উলটে— একটা-একটা মানুষ টপকে— একটা-একটা মানুষকে টোকা মেরে— মুখে পোড়া মবিল কিংবা প্লাস্টিকের ফুল গুঁজে— অল্প হেসে— অনেকটা কেঁদে— এক বগলের তলা দিয়ে— ওই পায়ের ফাঁক দিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল, স্লো-মোশনে সূর্য ডুবছে। সে জিজ্ঞেস করে : বুড়িচাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
‘আপনিই জীবনানন্দ দাশ?’
‘আপনিই তো? হাতে ওই খাতাটা কীসের?’
‘নতুন কবিতা?’
‘উপন্যাস?’
পোকামাকড় দেখামাত্র গিরগিটি ছুড়ে দেয় অব্যর্থ জিভ! তারার খাতার দিকে সেইভাবেই হাত বাড়িয়েছিল যে, তার গালে ঠাঁটিয়ে একটা চড়! তারা ক্ষেপে যাচ্ছে প্রচণ্ড। রক্তে আগুন লাগে। খুব ইচ্ছে হয় খুন করতে। শেষ এক সপ্তাহ। তারাকে বাজি ধরে কেউ জুয়া খেলছে। অনন্ত জুয়া। আর খিল্লি। কোত্থেকে শালা জীবনানন্দ এসে জুটল! কেন ওই কলমদুটো কিনেছিল! তারপর থেকে ইয়ার্কি। নিজেকে নিয়ে। লুপের মতো। সাইকেলের চাকার মতো। ঘুরতে-ঘুরতে-ঘুরতে-ঘুরতে… তারা শুধু জেনেছে, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতার বাইরে এসে কবিতা লিখতে হবে। অন্তত একটা।
‘গায়ে হাত দিলেন? অতি ভদ্রমানুষ বলেই জানতাম আপনাকে!’
‘নই আমি জীবনানন্দ দাশ! নই। আমার নাম তারাপদ দাশ। এর পরেও কি আমায় দু’মিনিট শান্তি দেবেন না আপনারা?’
তারা ভেবেছিল আরও দুটো চড় মারবে। তার আগেই হাতে হ্যাঁচকা টান। পালিয়ে আসুন। এরপর আর বাঁচতে দেবে না। এরপর ছুট। তারার এক হাতে কবিতার খাতা। অন্য হাত এক অচেনা হাতে। দুজন দৌড়চ্ছে। টেনে দৌড়চ্ছে। ওদের পেছনে তরুণ কবি। ওদের পেছনে গবেষক। সম্পাদক। প্রকাশক। সাংবাদিক। পুলিশ। আমলা। গ্যাংস্টার। প্রধানমন্ত্রী।
‘ওই মোড়ের মাথায় আপনাকে ছেড়ে দেব। তারপর অন্য একজন পথ দেখাবে।’
‘তুমি কে?’
‘মাল্যবান।’
তারা দৌড়চ্ছে। খুঁজছে একটা সাইকেল। মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করছিল নিখিল। তারার হাতটা চেপে ধরেই দৌড়। মাল্যবান কোথায় গেল? তারা ভেবে উঠতে পারে না।
‘আর্টের অত্যাচার সহ্য হবে আপনার?’
‘মানে?’
‘মানে কবিতা লিখতে হবে তো এরপর থেকে!’
নিখিলের হাত ছাড়তে সাহস পেল না। খুব দৌড়ল দুজনে। তারপর নিখিলকেও সে খুঁজে পেল না। হাত ধরল কল্যাণী। প্রথম এমন নারীস্পর্শ! রমাকে তার মনে পড়ছে না। মনে ভাসছে কল্যাণীর মুখ। অবসন্ন ঘামে ভেজা সফেদ দুটো গাল। খুব করে চেয়েও ছুঁতে পারল না তারা। হেমের হাতে তুলে দেওয়ার আগে, কল্যাণী শুধু বলেছিল, শান্ত-সরল একটা জীবন সইল না কেন আপনার? হেম থেকে সন্তোষ। সন্তোষ থেকে নিশীথ। নিশীথ থেকে উৎপলা। উৎপলা থেকে পূর্ণিমা… আর দৌড়তে পারছে না তারা। শক্তি ফুরিয়ে আসছে। তেজ ফুরিয়ে আসছে। আলো ফুরিয়ে আসছে। একটা তারা যখন মরে যায়…
এইখানেই গল্পটা অ্যাক্সিডেন্ট করল। রেললাইনের ধারে ছিটকে পড়ল তারার বডিটা। যারা ধাওয়া করেছিল, থ মেরে গেল। এক বিন্দু রক্ত নেই। থ্যাঁতলানো মাংসপিণ্ড নেই। আছে সুপারন্যাচরাল আকর্ষণ। রেললাইনের বড়-বড় পাথরগুলো, ঢুকে যাচ্ছে তারার শরীরে। সাতটা পঞ্চাশের শান্তিপুর লোকাল। গাছ। পচাপুকুর। রোগা শালিখ। সিনেমাহল। ভিখারি। আলো। ধুলো। শিল্পপতি। ইলেকট্রন। প্রোটন। নিউট্রন। সবাইকে গিলে-গিলে খাচ্ছে তারা। এক ভীষণ অন্ধকারে। তারার শরীরে কোনও সময় নেই। শব্দ নেই। গতি নেই। কিচ্ছু নেই।
যে-ছেলেটা ঢ্যামনামি করে একদিন, তারার বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, ‘দাশের দোকান’-এর ঠিক আগে চক দিয়ে লিখে দিয়েছিল মাত্র একটি শব্দ— জীবনানন্দ, সে একা, ছুটে এসে তারার কবিতার খাতাটা তুলে নেয়, শেষ কিছু লাইনে লেখা :
হাওয়া হয়ে যেমন খুশি উড়ব না
ভাঙা কোনও সাইকেল
নিলামে ওঠার আগে
টুকরো-টুকরো হওয়ার আগে
চাকায় ঢুকে পুনর্জন্ম দেব।
সে পাবে গতি, পাবে শান্ত একটা গলি
যে-গলিতে
চুমু খায় ইমরান হাশমি
যে-গলির বাতাসে
ফিনাইলের গন্ধ ওড়ে
এরপর ছেলেটা ফিরতে চায় না। খাতাসমেত ঢুকে যায় তারার শরীরে। ড্যাবড্যাব করে এ-দৃশ্যে তাকিয়ে থাকে প্রকাশক। গ্যাংস্টার। তরুণ কবি। প্রধানমন্ত্রী। পুলিশ। সাংবাদিক। আরও কেউ-কেউ।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র