শাফিকা – চার
সংসারে যেন দম ফেলার সময় নেই শাফিকার; শেষ নেই বড়বিবির গঞ্জনারও; তার নিজের তিন ছেলেমেয়ের মাথা না গুনে, সব সময়ে সে খোঁটা দেয় শাফিকার দুই ছেলেকে নিয়ে; বছর-বিয়োনি বদনাম ঘোচাতে নিজেই সে হেল্থ সেন্টারে গিয়ে বাচ্চা না হওয়ার কলকাঠিগুলো ভাল করে বুঝে এসেছে; তার মিয়া যে দুই বউয়ের সঙ্গেই ‘পরিচয়’ করে, এটা জেনেই হেল্থ সেন্টারের নার্সদিদি তাকে সাবধান করেছে; পই-পই করে বুঝিয়েছে কেন তার বরের কন্ডোম ব্যবহার করা উচিত; হেলথ সেন্টারে কন্ডোম দেয় বিনা পয়সায়— এ-কথা জানামাত্র, প্যাকেটে মুড়ে তার ভাগের বরাদ্দ এক বাক্স কন্ডোম সে নিজে গিয়ে চেয়ে এনেছে; এবার তার দায় মিয়াকে বুঝিয়ে, তা ব্যবহার করানো; তাদের সমাজে সন্তান আসায় বাধা দেওয়া নিয়ে নানা বলাবলি আছে; তেমনই বাধা গর্ভপাত করানোয়। ফলে বুদ্ধি করে ইসমাইলকে বাগে আনতে হবে; খুব সহজে যে তা হবে এমন নয়।
গোয়াল ঘেঁষে ওই ঘরটাতেই শাফিকা থাকে তার দুই ছেলেকে নিয়ে; তবে ঘরটা একটু সারিয়ে দিয়েছে ইসমাইল; মানে ঘরের মধ্যে দিয়ে টালির নীচে একটা মোটা ত্রিপল টাঙিয়ে দিয়েছে যাতে বর্ষার জল না পড়ে। এই ত্রিপল টাঙিয়েই ফুটের ওপর দোকান সাজায় ইসমাইল এবং তার মায়ের মতো বাকি দোকানিরাও। এর বেশি আর ভাববেই বা কী করে! ইসমাইলের না আছে ট্যাঁকের জোর, না নতুন কিছু করার উদ্যোগ; তার ওপর আছে সমানেই বড়বিবির মন জুগিয়ে চলার হ্যাপা। শাফিকাকে বিয়ে করা-তক ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে ইসমাইল; ফলে তার দিকে থেকে কোনও জোর পাবার আশা শাফিকা করে না। একটাই যা শান্তি তা হল, শাফিকা বোঝে যে ইসমাইল তাকে বড় ভালবাসে। শাফিকা তাই মনে-মনে এটাই বুঝে নিয়েছে, যা কিছু ব্যবস্থা সেসব তাকেই করে নিতে হবে।
ইদানীং তার ঘরে আসাও কমিয়ে দিয়েছে ইসমাইল; দিনের বেলা ছেলেদুটোকে নিয়ে বড়বিবির ঘরের দিকে চলে আসে শাফিকা। বড় আম্মার বিছানাতেই ছোটটা ঘুমোয়, হাত-পা নেড়ে খেলা করে; সময় বুঝে ঘরে গিয়ে, তাকে বুকের দুধ দিয়ে আসে শাফিকা; আর বড়টা উঠোনময় ছুটে বেড়ায়, তার সেই একটু বড় দাদার সঙ্গে; বেলার দিকে ঘরে ফিরে তারিয়ে-তারিয়ে তা দেখে ইসমাইল। তখন আর তার মনে থাকে না, সংসারের কূটকচালে সমস্যাগুলো। সব জেনেও বোবা সেজে থাকাই হয়তো পছন্দ করে তার মিয়া। মেজো মেয়েটাকে এখানকার ইস্কুল ছাড়িয়ে তার মামাঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে বড়বিবি; এখানে থাকলে নাকি কাজের ঠেলায় পড়া হচ্ছে না। বড় মেয়েটার ইস্কুল যাওয়াও বন্ধ; কারণ এক ক্লাসে দু-বার পড়েও, উঁচু ক্লাসে সে আর উঠতে পারেনি। তাই এবার তার বিয়ের ব্যবস্থা না করলেই নয়! শাফিকা ঠিক আন্দাজ পায় না যে, এ-সব নিয়ে ইসমাইলের আদৌ কিছু ভাবনা আছে কি নেই!
এদিকে কয়েক দিন ধরেই শাফিকা লক্ষ করছে যে, তার বুকের দুধ যেন কমে আসছে; আগে বড়-ছোট দুজনে টানলেও তার ব্লাউজ ভিজে যেত। সেখানে ছোটটারই পেট ভরছে না; ইসমাইল লুকিয়ে-লুকিয়ে যে কৌটোর দুধ এনে দিত, তা খেয়ে ছোটটা আর রাতে জাগত না; কিন্তু এ-মাসে আজ দশ তারিখ হয়ে গেলেও সে দুধ আসেনি; পাতলা করে ময়দা জাল দিয়ে, তাতে চিনি মিশিয়ে শাফিকা যে খাওয়াচ্ছে, সেটা দেখেও যেন না দেখার ভান করছে বড়বিবি; ভাত-মাছ খাওয়া তার নিজের ছেলের জন্য এখনও যে কৌটোর দুধ মজুত থাকে, তা নাকি তার বাপ-ঘর থেকে আসে। শাফিকার স্বাস্থ্য বাড়াবাড়ি রকমের ভাল বলেই শাক-ভাত খেয়েও এতদিন টেনেছে। এবার একটা কিছু ব্যবস্থা না নিলেই নয়।
২
আজ বেশ মাসখানেক পর রাতে তার ঘরে এল ইসমাইল; বড়বিবির হয়তো ‘মাসিক’ হয়েছে; গা-গতর ভারী হলে সে আর ইসমাইলের সঙ্গে এক বিছানায় ঠাসাঠাসি করে রাত কাটাতে চায় না। বড়মেয়ে তাই হয়তো এ-ঘরে আর শুতে আসেনি। ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে যেন অনেক রাত; মেঘ-জমা আকাশে চাঁদ-তারার আলো নেই। গলা খাঁকারি পেয়ে ভেতর থেকে সুইচ টিপে বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল শাফিকা; ঘরে ঢুকেই দরজায় শেকল টেনে দিল ইসমাইল; আর তাতেই সে বুঝল, আজ তারা আবার একসঙ্গে ঘুমিয়ে থাকবে এই বিছানায়। তবে ইসমাইল রাতে শুতে এলে খোকাদের বিছানায় শুইয়ে মেঝেতে মাদুর-বালিশ পেতে বিছানা করে নেয় শাফিকা। পোকা-মাকড়-মশা তাড়াবার জন্য ঘরের বাইরেটায় জ্বালিয়ে দেয় শুকনো গোবরের সঙ্গে মেশানো রোদে শুকনো ছোবড়ার কুচি আর দু’মুঠো কাঁচা নিশিন্দে পাতা। এইটুকু যত্নেই ইসমাইলের চোখে ভেসে ওঠে অনুরাগ; ভিজে ফতুয়াটা খুলে দড়ির ওপর টাঙিয়ে মাটিতে পাতা বিছানাটায় আড় হয়ে শুয়ে, সে তাকিয়ে থাকল শাফিকার দিকে; ঘরের আলো না নিভিয়ে শাফিকা তাকে দেখাল সদ্য নিয়ে আসা কন্ডোমের মোড়কটা। বিস্তারিত বিবরণ শুনে নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে ইসমাইল বলল, ‘অপ্রেশন হয়ে গেলেই তো হয়; একেবারে ঝ্যামেলা মিটে যায়।’
‘সে তো তুমিও হতে পারো; বা আমরা দুজনেই একসঙ্গে… কারণ বড়বিবি আবার যদি পেটে বাচ্চা ধরে, তখন তো আর খাওয়া জুটবে না গো!’
‘ঠিক কথা; মানছি। কিন্তু বড়বিবির সন্দেহ আরও বাড়বে।’
‘সন্দেহ! কাকে?’
‘বাজারের মেয়েদের; তোকে বিয়ে করার আগে থেকেই সেটা ছিল; এখন তো আরও বেড়েছে।’
‘তুমি তো ওকে বোঝাতে পারো; সংসারের ভালমন্দ বুঝবে না?’
‘তা ছাড়াও অন্যেরা বলে যে অপ্রেশানে নাকি বল কমে যায়; পুরুষমানুষ যদি দুর্বল হয়ে যায় তখন তার আর থাকে কী! কী সুখ পাবি!’
‘তাই তো বলছি যে এই টুপি পরে নিলেই আর ঝক্কি নেই; বড়বিবির সঙ্গে না পরো, কিন্তু আমার জন্য তো পরো! আমাদের তো আর সন্তানের দরকার নেই; আল্লা তো ভরে দিয়েছেন।’
সেদিন আর মিলিত হল না তারা। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ইসমাইল। তবে শাফিকার নিজেকে বেশ তেজি এবং মুক্ত মনে হতে লাগল। কারণ সে বেশ জোরের সঙ্গেই বোঝাতে পেরেছে ইসমাইলকে; এমন কোনও অছিলাই খুঁজে পায়নি তার মিয়া যা দিয়ে শাফিকাকে কাছে টানা যায়। আধা-ঘুমন্ত ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল শাফিকার। নিজের আঁচল দিয়ে তার একহারা পিঠটা মুছে দিয়ে, গালে একটা আলতো চুমো ছুঁইয়ে, ইসমাইলের পিঠের দিকে চেয়েই আধো-অন্ধকারে বসে থাকল শাফিকা। কিছুক্ষণ পরে বুঝল যে বৃষ্টি থেমে সুন্দর বাতাস বইছে; বিছানা ছেড়ে উঠে একপাল্লার জানলাটা খুলে দিতেই প্রথমে ঢুকে এল মাটি গন্ধ মাখা জোলো বাতাস; তার পরে গাঢ় নীলের পরত কাটিয়ে ধূপছায়া রঙের মৃদু আলো, যা ধীরে-ধীরে বিছিয়ে গেল ইসমাইলের পাশমোড়া শরীরটায়।
মুগ্ধ শাফিকা মনে মনে ভাবল, কী সুন্দর একটা ফ্রেম!
ইসমাইলের পিঠের ওপর পড়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে শাফিকা; স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে ঘুম ভাঙতে দেখল বিছানায় উঠে বসে ইসমাইল তার দিকেই চেয়ে আছে। শাফিকা তাকাতেই তার ওপরে বিছিয়ে গিয়ে মিয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় রেখেছিস?’ ‘বালিশের তলায়!’ ভোরের আলোয় মিলিত হল ইসমাইল এবং তা শাফিকারই শর্তে। এত বছর ঘর করে এই প্রথম তারা জানল যে, অপরাধীর মতো শুধু ভারী-রাতে নয়, ঊষালগ্নেও মিলিত হতে পারে তারা। দুজনে যেন নতুন ভাবে দেখল দুজনকে। গা-ঝাড়া দিয়ে বসে ইসমাইল বলল, ‘একটু চা করে নিয়ে আয়; আজ এখানে বসেই সকালটা কাটিয়ে, তবে স্নানে যাব।’ শাফিকার চোখে খেলে গেল পরিণত সঙ্গিনীর উচ্ছ্বাস।
৩
অভাব-অনটনে জেরবার হয়ে শাফিকার মনে এল ‘বাবা’র কথা; মিয়ার হাত ধরে একবার কি দাঁড়াবে তাঁর দরজায় গিয়ে? যদিও মা এখন টুকটাক করে এটা-ওটা প্রায়ই পাঠিয়ে দেয় মিয়ার হাতে; নিজেও চলে আসে নাতিদের দেখতে। কিন্তু তার সামর্থ্য তো ওইটুকুই; ফুটপাথে সবজি বিক্রি করা ছাড়া, অন্য আর কোনও কাজ করেও যে আয় করা যায়, তার হদিশই বা সে জানবে কী করে! এদিকে ‘বাবা’ ছাড়া আর কাকেই বা চেনে সে! প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও রাজি হয়ে যায় মিয়া; কিন্তু শর্ত একটাই যে, শাফিকাকেও সঙ্গে যেতে হবে; ‘বাবা’র কাছে একা সে কিছুতেই যাবে না। এদিকে শাফিকাই বা কী করে যায়! বাচ্চাদের দেখবে কে! বড়বিবিকে বলে বেরোনোও সম্ভব নয়; অশান্তির একশা করে ছাড়বে। মাথা খাটিয়ে শাফিকাই ঠিক করল যে, তার মায়ের ঘরে যাবে বলে দুই ছেলেকে নিয়েই বার হয়ে, এখান থেকে ট্রেনে কলকাতা যাবে। মিয়ার সঙ্গে সকাল-সকাল বেরিয়ে গেলেই হল।
বাচ্চাদের স্নান করিয়ে তৈরি করে নিল। একখান ধোয়া কাপড় পরে মাথা আঁচড়ে দেওয়ালে টাঙানো ছোট্ট আয়নাটায় মুখ দেখল নিজের; ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তায় কেমন একটা যেন কালচে ছাপ তার সমস্ত মুখে; হয়তো ওই ছাপ তার বাকি শরীরেও। ভাগ্যিস কাপড় দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে ফেলা যায়! আয়নায় মুখ দেখার মতোই আজ কতদিন পর চটিজোড়ায় পা গলাল শাফিকা। নিজের ঘরে শেকল টেনে দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই দেখল ছোটটাকে কোলে নিয়ে মিয়া দাঁড়িয়ে আছে; বড়টার হাত ধরে মিয়ার পেছন-পেছন বেরিয়ে এল শাফিকা। বেরোবার সময়ে বড়বিবির খোঁজ করতে রসুইঘরের দিকে এগোলে, বড়মেয়ে তানি বলল, ‘আম্মা ঘরে নেই; পাশেই দাদির ঘরে গেছে তেল চেয়ে আনতে; না হলে রসুই হবে না।’ অপরাধীর মতো মুখ করে সদরের দিকে হাঁটা দিল তাদের দুজনের মিয়া ইসমাইল। কী যে ভাল লাগল রাস্তায় নেমে; কয়েক বছর পর পায়ে চটি গলিয়েও কই হাঁটতেও তো অসুবিধে বোধ হচ্ছে না! মনে হল যেন সে রাজ্য জয়ে বেরিয়েছে! কোথায় যে যাচ্ছে, সেটা ভুলে গিয়ে ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখতে লাগল, উড়ন্ত ঘরবাড়ি, গাছপালা, শান-বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম, চিল-ওড়া আকাশ আর রাশি-রাশি মানুষের ঢল— যারা কলকাতা চলেছে।
পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে ভেতর দিয়ে মিনিট কুড়ি হেঁটে গেলেই তালতলা; ফুটপাথে সবজি বিছিয়ে-বসা তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে তাকাল সুর্মাবিবি; ঘাড় উঁচিয়েই দেখতে পেল ছেলে-কোলে ইসমাইলকেও; ‘বাবা’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছে শুনেই তার চোখদুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে মিয়ার কোল থেকে ছোটটাকে নিজের কোলে নিয়ে আপনমনেই বলল, ‘ঘুমিয়ে কাদা’। বড়টার হাত ধরে তার সেই ‘ডিম বাবু-বাবা’র ঘরের দিকে নির্দ্বিধায় এগিয়ে যেতে লাগল শাফিকা। অনেকটা তফাতে তাকে অনুসরণ করতে লাগল, ইসমাইল। সে যেন জানতই যে, ‘ডিম-বাবু’র কাছে পৌঁছনোর সংযোগে সে শুধু শাফিকার পথটুকুই। বাকিটা শাফিকাই সামলে নেবে তার ‘বাবার’ সঙ্গে কথা বলে বা না-বলে। শাফিকার হেঁটে যাওয়াটা লক্ষ করে ইসমাইল বুঝল যে, নিজের বড়ছেলের হাতটা তার নিজের শক্ত মুঠোয় ধরা থাকলেও, হাত ছাড়িয়ে আসলে সে চলে গেছে একেবারে একা এবং নির্ভার। ইসমাইলের হাত ধরে ঠিক যতটা পথ পিছিয়ে গেছে শাফিকা, তার থেকে দ্বিগুণ পথ অতিক্রম করে সে পৌঁছতে চলেছে তার আসল গন্তব্যে। ইসমাইল এ-ও দেখল যে, শাফিকা শীর্ণ নয়, ছিপছিপে নির্মেদ, একেবারে পাকা বাঁশের মতো। আর কি বাঁকানো যাবে তাকে!
বেলা হয়ে গেলেও, ‘ডিম-বাবু’ স্নানে যাননি। দরজাটা খুলেই ঘরে বসে কাজ করছেন। ঘরের মধ্যে দাঁড় করানো গোটা দশেক প্যাক করা ক্যানভাস। নিশ্চয়ই কোনও প্রদর্শনীর তোড়জোড় চলছে। ইসমাইলের দিকে ছেলেকে ঠেলে দিয়ে শাফিকা একাই গিয়ে দাঁড়াল তাঁর দরজায়। শাফিকার ‘ডিম-বাবু’ বা ‘বাবা’ সুখবীর সিং নেহাল, দরজায় এসে কারোর দাঁড়ানোর আওয়াজ পেয়েই মুখ তুলে তাকালেন; শাফিকাকে দেখেই মুখ নামিয়ে, নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার মগ্ন হয়ে গেলেন নিজের কাজে। উচ্ছ্বসিত কান্নায় শাফিকাকে ফোঁপাতে দেখে, ছেলের হাত ধরে এবার সামনে এসে দাঁড়াল ইসমাইল; শাফিকাকে দরজার আড়ালে ঠেলে, ঘরের দিকে এক-পা এগিয়ে সে ডেকে বলল, ‘বাবা… শাফিকা নিজে এসেছে তার ছেলেদের দেখাতে; একবার ঘরে আসবে?’
‘ছেলেকে নিয়ে তুমি ভেতরে এসো ইসমাইল।’
‘শাফিকাকে ক্ষমা করুন; এই বিয়ে করায় ওর তো কোন দোষ নেই বাবা!’
‘এসব কথা থাক; কী জন্যে ওকে নিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছ?’
‘পেটের জ্বালায়; সংসার তো চালাতে পারছি না। দুজনে মিলে খেটেও…’
‘শাফিকাও সবজি বেচতে আসছে?’
‘না বাবা, বাড়িতে থেকেই বালতি-বালতি ঘুঁটে দেয়; তাই বিক্রি করে। যদি কিছু টাকা সাহায্য করেন… খেটে শোধ দিয়ে যাবে।’
ইসমাইল এ-কথাটা বলার সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের ভেতর ছুটে এসে ঢুকে, শাফিকা পা জড়িয়ে ধরে চিত্রী সুখবীরের। কাঁদতে-কাঁদতে বলতে থাকে, ‘কোনও টাকা চাই না; আমাকে কিছু কাজ দিন; ধার বা সাহায্য কিচ্ছু চাই না; রোজগার করে সংসারের আয় একটু বাড়াতে চাই; ছেলেগুলোর জন্য দুধ কেনার পয়সা…’
‘কী কাজ দেব! বাচ্চা নিয়ে অত দূর থেকে এসে তো আর আমার এই স্টুডিয়ো ঝাড়ুপোঁছার কাজ করতে পারবে না; আবার মায়ের সঙ্গে যে সবজি বেচবে তারও উপায় নেই।’
শাফিকার আচরণে হতভম্ব হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ইসমাইল। এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে তখনও কেঁদে চলেছে শাফিকা। বাচ্চাটা ঘুরে-ঘুরে এটা-ওটা হাতড়াচ্ছে আর মনোমতো না হলেই ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। ওরই দিকে স্থির হয়ে চেয়ে আছেন সুখবীর। স্নেহে ভিজে যাচ্ছে তাঁর চোখ। কিছুক্ষণ পরে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খোকাকে কোলে তুলে নিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখাতে লাগলেন তাকে; এটা দেখেই ইসমাইল বেরিয়ে গিয়ে, নীচের ফুটপাথে বসা সুর্মাবিবির কোল থেকে ছোটখোকাকেও তুলে নিয়ে সুখবীরের ঘরে এসে দাঁড়াল। তিনি যেন দেখেও দেখলেন না। শাফিকাকে বললেন, টেবিলের তলা থেকে খবরের কাগজের তাড়াটা বার করে আনতে। ইসমাইলকে বললেন এক কেজির বাটখারা সমেত একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসতে। এক দৌড়ে নেমে গিয়ে ইসমাইল সেটা নিয়ে এলেও, শাফিকার হাত সরল না টেবিলের নীচে রাখা কাগজের রোলগুলো টেনে বের করতে; কারণ সে জানে যে, এগুলো কুচিয়েই তিনি ছবির পর ছবি তৈরি করেন; শাফিকাকে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা লম্বা রোল ইসমাইলই টেনে বার করে আনল। সুখবীরের নির্দেশমতো তা থেকে খানিকটা কাগজ ছাড়িয়ে, এক কেজি মতো ওজন করালেন সুখবীর; ওই মাপ করা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে শাফিকাকে বললেন, এগুলো কাজে লাগিয়ে ঠোঙা বানিয়ে দেখো যদি দোকানে-দোকানে তা বিক্রি করা যায়। অন্তত চেষ্টা তো করো; সামান্য হলেও রোজগারের পথটা শুরু করা যাক। পাল্লা, বাটখারা এবং ওই কাগজের টুকরোগুলোর মধ্যেই শাফিকা কী যেন খুঁজতে লাগল। সেটা কি তার অনটনের হাত থেকে রেহাই পেতে শুধুই একটা মুক্তির পথ! নাকি পৃথিবীর হাঁ-মুখ ভেদ করে ছিনিয়ে আনা সেই আলো, যার রং— কালচে সবুজ!
সুখবীরকে প্রণাম করতে ভুলে গেল শাফিকা; ভুলে গেল ছেলেদের কথাও। কাগজের রোলটাকে নিজের আঁচল দিয়ে মুড়ে নিশ্চিন্তে সামনে এগিয়ে গেল সে; ছোটখোকাকে কোলে নিয়েও, বড়খোকার ডান হাতটাও শক্ত করে ধরা ইসমাইলের বাঁ হাতের মুঠোয়। ওই একতাড়া কাগজ পেয়েই কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগল তার অতি নিরীহ বিবি শাফিকা। একেবারে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে উদাসীন পা ফেলে-ফেলে হাঁটতে লাগল শাফিকা।
আমি শাফিকা। ইসমাইলের ছোটবিবি। অনটন জানাতে ‘বাবা’র কাছে এসেছিলাম। ইসমাইলের বুদ্ধিতে হাত পেতে টাকা সাহায্য না নিয়ে আজ যা পেলাম, তা একরকম মোহরই বটে। ইসমাইল না বুঝলেও আমি জানি যে, ওই কাগজগুলি বাবার প্রাণ; ওগুলো দিয়েই তো ছবি তৈরি করেন বাবা। ওই তাড়াটা ছোঁয়ামাত্র আমার পেটের মধ্যে যেন উড়তে লাগল রাশি-রাশি প্রজাপতি; মনে হল ছোট-বড় নানা মাপের ঠোঙাগুলোর মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে আসবে সতেজ অক্সিজেন। সকালবেলায় শিশিরে ভেজা-ঘাস-পাতা ফুলের মতোই। আমি যেন দেখতে পেলাম, গোয়ালঘরের পাশে আমার ওই একটেরে ঘরখানার দাওয়ায় একটা মাদুর পেতে বসে, আপনমনে ঠোঙা বানাচ্ছি আমি; আমার চৌকির তলায় রাখা আছে একটা কাঠের পিঁড়ে, টিনের কৌটোয় ময়দার লেই; তার মধ্যেই আঠা মাখাবার জন্য গুঁজে রাখা একটা বাঁশের লাঠি আর হাত মোছার জন্য পুরনো হলেও একখানা ধোয়া গামছা। আর আছে বাঁশের একটা ‘পেতে’ ঝুড়ি, হাতে বানানো ঠোঙাগুলো মাপে মাপে সাজিয়ে রাখবার জন্য।
ঠোঙা বানাবার এই আয়োজনটুকুতেই কেন যেন আমার মনে হতে লাগল যে, এবার আমার একটা স্টুডিয়ো হবেই। ‘বাবার’ মতো না হোক; তা হবে একেবারে আমার মতোই— ঘুঁটে, গোবর আর অনটনের গন্ধ মাখা। আর তারই পাশটিতে দুই ছেলের হাত ধরে বসে থাকবে আমার মিয়া, মুগ্ধ ইসমাইল।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র