পুনরভিনয় মানে পুনঃপাঠ। পুনঃপাঠ মানে পুনর্বিবেচনা। এভাবেই শুরু করা যেতে পারে মুখোমুখি প্রযোজনার ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চায়ন নিয়ে দুটি-একটি কথালাপ। সাম্প্রতিক এই প্রযোজনাটির নির্দেশক এবং দৃশ্যবিন্যাসকারী বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রীসুমন মুখোপাধ্যায়। প্রযোজনাটি অবশ্য বিশেষ কোনও নাট্যদল বা গ্রুপ থিয়েটারের নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই স্বনামধন্য নাট্যচর্চাকারী, কয়েকজন ইতোমধ্যে বাংলা নাট্যমঞ্চে জনপ্রিয় এবং নক্ষত্রতুল্য। প্রসঙ্গত, মনে রাখা ভাল, নাটকটি উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১২ অগাস্ট ১৯৭১ সালে পিপল্স লিটল থিয়েটারের প্রযোজনায় রবীন্দ্রসদন মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়। পিপল্স লিটল থিয়েটারের এটিই ছিল প্রথম প্রযোজনা। পরে জাতীয় সাহিত্য পরিষদ ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নাটকটি প্রথম প্রকাশ করেন। প্রায় পঞ্চাশ-চুয়ান্ন বছর পর বাংলা নাটমঞ্চের ‘বাণিজ্যিক’ পরিসরে এই নাটকের পুনরভিনয় এবং পুনর্মঞ্চায়ন ঘটল। মাঝখানে অবশ্য বহু অপেশাদার গোষ্ঠী বা প্রাক্তনী সংসদ এই নাটককে ছোট-ছোট বৃত্তে পরিবেশন করেছেন। আমি নাটকটি দেখেছি ৩১ মার্চ ২০২৪, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে। নাট্য পরিবেশনা বা যে-কোনও লাইভ পারফরম্যান্স প্রকৃতপক্ষে প্রতি উপস্থাপনায় পুনর্নব এবং প্রতি শো-তেই সামান্য আলাদা। কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র, গ্রন্থ বা ফ্রেমে বাঁধা চিত্রকলা সকলেই প্রদর্শনীর ভাস্কর্যের মতো ‘স্থির’ বা ‘স্থাণু’। ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান তেমন ‘ক্লোজড ভার্সন’ নয়। সেসব কারণে কোন দিনের নিরিখে আমার বক্তব্য পেশ করছি, সেই দিনক্ষণ জানিয়ে রাখা সমীচীন।
২
‘টিনের তলোয়ার’ যখন উৎপল দত্ত মঞ্চায়িত করেছিলেন, তার অভিঘাত তৎকালীন বিদ্বৎমহলে ছিল বিপুল। সেই দেশদুনিয়ার রাজনৈতিক-সামাজিক উত্তুঙ্গ মুহূর্তে এ-নাটক জনপ্রিয় যেমন হয়েছিল, অন্যদিকে এর প্রয়োগপদ্ধতির অভিনবত্ব নিয়েও চমকিত হয়েছিল নাট্যামোদী দর্শকসমাজ। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মঞ্চায়ন হয়েছিল আগে, নাট্যমুদ্রণ পরে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের আপসরফা ‘প্রতিসরণ’ অবশ্য শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৭৭ সালে গ্রামাফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া এই নাটকের দু-খণ্ডে একটি অডিও-ক্যাসেট প্রকাশ করে। সে-যুগে তার কাটতিও ছিল বিপুল। পরে, এর থেকেই তৈরি হয়েছিল দুটি সিডির একটি প্যাক। ২০০৯ সালে। নাটক ছাড়াও ‘বোনাস’ হিসেবে সারেগামা কর্তৃপক্ষ সিডিতে যোগ করে দিয়েছিলেন, উৎপল দত্তের কণ্ঠে চারটি আবৃত্তি। মোবাইল ফোন আসার পরে, পূর্বপ্রকাশিত রঙিন কিছু স্থিরচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয় টুকরো-টাকরা চলদৃশ্য। মূল নাট্যপ্রয়োগের একটা আন্দাজ তৈরি হয়। লেখা বাহুল্য, সত্তরের সেই প্রযোজনা দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা এখন হাতে-গোনা। নতুন প্রজন্ম মূলত অডিওটিই শুনেছে। তবু, অভিঘাতের বিস্তারের কথা ভাবলে, সুমনের চ্যালেঞ্জ বেশ কঠিন ছিল। আরও যোগ করে দিই, সংগীত পরিচালক প্রশান্ত ভট্টাচার্য সুরারোপিত গানগুলি অডিও-তে গেয়েছিলেন মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত এবং অন্যান্যরা। যতই শ্রব্যমাধ্যম হোক না কেন, শোভা সেন, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর মজুমদার, ছন্দা চট্টোপাধ্যায় এবং স্বয়ং উৎপল দত্ত প্রমুখ অত্যুজ্জ্বল মঞ্চসিংহেরা দশকের পর দশক শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। বিভিন্ন মহলে, অ্যাকাডেমিয়ায়, আড্ডায়, তর্কে বা উল্লাসে (ব্যক্তিগত দ্বিরালাপেও!) ফুলকির মতো সংলাপগুলি ছড়াতে থাকত নতুন-নতুন বাস্তবতা বা পরিসরে। তরুণ মজুমদারের লিখন থেকে জানতে পারছি, মহানায়ক উত্তমকুমার এই নাটকের চলচ্চিত্রায়ণে বেণীমাধব কাপ্তেনবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করতে অতি আগ্রহী ছিলেন। নাট্যগ্রন্থের ভূমিকায় উৎপল দত্ত জানিয়েছিলেন, ‘বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষগুলিকে— যাঁহারা কুষ্ঠগ্রস্ত সমাজের কোনো নিয়ম মানেন নাই, সমাজ যাঁহাদের দিয়াছিল অপমান আর লাঞ্ছনা। যাঁহারা মুৎসুদ্দিদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীর মুখোস টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই। যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয়বেদনাকে দিয়েছিলেন বিদ্রোহ মূর্তি।…’
উৎপল দত্তের এমন সব স্বভাবসিদ্ধ হাইপারবোল বা অত্যুক্তির কথা মনে রেখেও বলা চলে, এই নাটকে বিন্দু-প্রতিবিন্দুর সংঘাত এবং ক্লাইম্যাক্স বা শিখরদেশ এতই চমকপ্রদ, নাচে-গানে কলানির্মিতিতে এতই তুখোড় যে, বিকল্পসন্ধানী মনে এর প্রভাব স্থায়ী হতে প্রায় বাধ্য। এমনকী, দু-একটি ছোটখাটো তথ্যগত সমস্যা এই জাদুতরঙ্গে মনের অগোচরে চলে যায়। শেক্সপিয়রের ‘দ্য টেমিং অফ দ্য শ্রু’, বার্নার্ড শ-এর ‘পিগম্যালিয়ন’ এবং সেই সূত্রে ‘মাই ফেয়ার লেডি’ সিনেমার সমান্তরালের কথা বলছি না (উৎপল দত্ত আবার, শুনেছি, এসব কথা জানতে পারলে মঞ্চেই নাটকের মাঝে সমালোচককে ব্যঙ্গে-বিদ্রূপে এক হাত নিতেন! পরে জন্মানোর কিছু সুবিধে তো আমরা পাব!)। প্রয়োগে একটু ব্রেখ্টও আছেন বইকি! সেসব নয়। বীরকৃষ্ণ দাঁ উঠে এসেছেন সরাসরি ‘হুতোম পেঁচার নক্শা’র প্রথম ভাগ (প্রথম সং ১৮৬১/ দি. স. ১৮৬২) থেকে। ‘কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা’য় বীরকৃষ্ণ দাঁ পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় উপস্থিত। শেষে ফরাসডাঙায় তার মৃত্যুর খবরও আছে। যদিও এটি ছদ্মনাম। ঢাকা শহরের প্রসঙ্গও সেই সূত্রে স্মরণীয়। অন্যদিকে, ছাতুবাবু বাজার (অনাথ নাথ দেব বাজার), যেখানে ময়না আনাজের ঝুড়ি রেখে এসেছে, সেটা স্থাপিত হয় ১৮৮১ সালে। এই নাটকের কেন্দ্রে যে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন, সেটি লাগু হওয়ার বছর ১৮৭৬। ব্রিটিশ সরকারের রাজদ্রোহমূলক নাট্য পরিবেশনা এবং কুশীলবদের নিপীড়নও প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে। সত্তরের একেবারে গোড়ার দিকে, এই গল্প উৎপল দত্ত কৌশল করে কেন শোনাচ্ছেন? অডিও-সিডির প্রাক্কথনেও তাঁর সম্পর্কে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ নাট্যকারের তকমা লাগানো আছে।
৩
১৯৭৫ সালে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি। গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৭৭ সালে। বীরসা মুণ্ডা এবং তাঁর আদিবাসী আন্দোলন তথা ‘উলগুলান’-এর কাহিনি সত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন এক প্রাসঙ্গিকতা পেল। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলন, আদিবাসী সমাজের গণজাগরণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম-সাম্যবাদ এবং নতুন সমাজের স্বপ্ন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, জরুরি অবস্থা, কবি-শিল্পী-নাট্যকর্মীদের আগ্নেয় অভিব্যক্তি এবং তাকে দমনের নানা পদ্ধতি— এইসবই পুনর্কথনের পশ্চাৎভূমি হিসেবে কাজ করে। মেটাফর থেকেই ১৯০০ সালে ব্রিটিশ জেলে অত্যাচারে-নির্যাতনে মৃত বীরসা মুণ্ডার সাতের দশকে উত্থান। একইভাবে শহর-পরিসরে দেখা দিল বেণীমাধব চাটুজ্যে, প্রিয়নাথ মল্লিক, ময়না আর বীরকৃষ্ণ দাঁ। মেটাফরকে জ্যান্ত করার তাগিদেই উৎপল দত্তের কলমে এঁদের আবির্ভাব। সাল-তারিখ-ইতিহাস-অনুপুঙ্খ সেখানে গৌণ। সেইভাবে দেখতে গেলে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিকল্পনাও, অনুমান করি, এই ঘনঘোর ঘৃণাকালে, একনায়কতন্ত্রের ছায়াতলে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের দাঁতনখের সামনে সমান্তরাল এক ‘মেটাফর’কেই পুনর্জীবিত করা।
শুরুর বাক্যে ফিরে যাই। পুনঃপাঠের এই আয়োজনে বেশ কিছু পুনর্বিচারের চিহ্নকও ফুটে উঠল সুমনের কাছে। মূল নাটকের সংলাপ তিনি একটুও বদলাননি। খুব চতুর কৌশলে শেষে অন্য নাটকের গান এবং একটি-দুটি ভাষণের বা বিবৃতির ঘোষণাকে যোগ করেছেন। আর নাটকের অন্তর্বস্তুর দৃশ্যায়নে কয়েকটি প্রশ্ন এবং মাত্রাকে সংযোজন করেছেন। সেসব প্রসঙ্গে পরে আসব।
পুনর্কথনের সমস্যা হল দোলাচল। নিজস্বতা, না কি প্রতিলিপির সন্ধান? এক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটল। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালে এ-নাটক বহুলাংশে ‘পিরিয়ড পিস’, তাকে শত চেষ্টা করলেও এই পণ্যবিস্ফারে আর যুক্তি-প্রযুক্তির রোশনাইয়ে প্রাসঙ্গিক স্পর্শটুকুতেও খাপে খাপ বসানো সম্ভব নয়। সুতরাং শেষের আরোপ এবং উদ্ভাবনই ভরসা। সেদিক থেকে দেখলে, পূর্বতনের মায়া খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। মঞ্চায়নে মাঝখানে চৌকো বেদি এবং সামনের স্পেসকে ব্যবহার যথাযথ। কেউ-কেউ, পুরনো দিনের দর্শক হিসেবে মনে করিয়ে দিয়েছেন, উৎপল উল্লম্ব ক্ষেত্রটিকেও ব্যবহার করতেন, যা সুমন করেননি। আমি তাতে দোষের কিছু দেখি না।
সাধারণত সুমনের দস্তখত উজ্জ্বল হয়ে থাকে দৃশ্যরূপ নির্মাণদক্ষতায়। এক্ষেত্রেও তার ধারাবাহিকতা বজায় আছে। ঢাল-তরোয়াল হাতে বহুস্বরিক এবং বহুঅর্থসমৃদ্ধ মুভমেন্ট বা নাচের ভঙ্গিগুলি অনবদ্য। নাটকের ভেতরে নাটকে ছায়াময় চলাচলে বেণীমাধব এবং মথুরের অধ্যাসকেন্দ্রিক (illusion) মঞ্চচিত্র বুকে ঘা দেয়। শেষাংশে মঞ্চ আর দর্শকাসনের উলটো যাতায়াতও চমৎকার। সুমনকে বিনীত প্রশ্ন, বেঙ্গল অপেরার নাট্যপ্রয়োগে কিছু দর্শক আরও আমদানি করা যায় কি? যুগনির্মাণে সেটা খানিক সহায়ক হতে পারে। এমনকী এখনকার প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের পেছন থেকে যদি কেউ-কেউ ঢোকেন, কখনও-কখনও ঈষৎ মাতলামি-সহ, হয়তো একটা ‘সেই সময়’ স্বাদ তৈরি হতে পারে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি টুপি খুলে অভিবাদন জানাতে চাই (আবার, উপনিবেশের ছায়া!) শ্রীমতী পৌলমী চট্টোপাধ্যায়কে, তাঁর অসামান্য অভিনয়ের জন্য। মঞ্চে তাঁর নড়াচড়া বা অভিব্যক্তিই নয়, তাঁর উচ্চারণভঙ্গিমাও তিনি শ্রমে-পরিচর্যায় কালোপযোগী করে তুলেছেন। কোনও প্রশংসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। অত্যন্ত ভাল আনন্দরূপা চক্রবর্তী এবং রাজু বেরা। রাজুকে অনুরোধ, কখনও-কখনও এখানে তাঁর চরিত্র খানিকটা ঝাঁঝ দাবি করে। তিনি একটু নীচু তারে বেঁধেছেন পুরো উপস্থাপনাকে। সেই স্টাইলাইজেশন কখনও-কখনও আন্দাজ করে ফেলা হচ্ছে।
নজর কাড়েন অসীম রায়চৌধুরী। সিরিও-কমিক অভিনয়ে তাঁর সিদ্ধি প্রশ্নাতীত। বেণীমাধব চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার আমার একজন প্রিয় অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও বলি, তিনি কখনও-কখনও ওইদিন একটু কম সাবলীল। তার কারণ কি উৎপল দত্তের বিপুল ওজনদার ছায়া? একইভাবে শঙ্কর চক্রবর্তী বেশ নবমাত্রাহীন। একে তো তাঁর সৌম্যকান্তি এবং সুদর্শন বহিরঙ্গ। ফলে, বীরকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রের ক্রূরতা, খলতা এবং বদমাইশি-বজ্জাতি আনা যথেষ্ঠ কঠিন। তার ওপর সংলাপহীন অংশে তিনি যথেষ্ট খলনায়কোচিত নন। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। সেজন্যই এই কথাগুলি বললাম। আলাদা প্রশংসা পাবেন মথুর চরিত্রে রজত নারায়ণ ভট্টাচার্য। যদিও, আনন্দরূপা (ময়না) এবং সুতপা অধিকারী (কামিনী) ছাড়া সকলেরই চলা-বলায় একটা সমকালীন উচ্চবর্গীয় শীলন এবং ‘আধুনিক’ ‘মার্জিত’ ‘ভদ্রজনীন’ ছাপ আছে। উৎপল দত্ত তাকে সেকালে তাকে কীভাবে এবং কতদূর রুখতে পেরেছিলেন, পুরোটা বলা মুশকিল। ওই প্রযোজনা আমি দেখিনি। তখন আমি নিতান্ত শিশু। শুনে অন্তত মনে হয়, বেশ অনেকটা পেরেছিলেন।
৪
সুমন মুখোপাধ্যায় অভিনব ভাবে শেষাংশে চারটি গান, একটি ভাষণের অংশ আর ছোট্ট একটি ঘোষণা জুড়েছেন। এ-কথা আগেই বলেছি। সবটাই তাঁর পুনঃপাঠ এবং পুনর্বিচারের স্বার্থে। সুমনের পরিপ্রেক্ষিত এবং বাস্তবতা বহুলাংশে ভিন্ন। সময়ক্ষতগুলি অধোরেখে দাগাতে তাঁকে একটু ঝুঁকি নিয়েই ‘সমকালীন’ সংকটের আভাস দিতে হয়েছে। সেই সূত্রে এসেছে ‘কল্লোল’, ‘নরক গুলজার’, ‘কবীর’ এবং ‘মারীচ সংবাদ’-এর চারটি গান। পরিস্থিতির হিংস্র চাপে এই ক্লাইম্যাক্সের সম্প্রসারণ নড়বড় করতে-করতে দাঁড়িয়ে গেছে। মনে রাখা ভাল, সকলেই এ-কথা যদিও জানেন, ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের শেষে ‘স্বদেশ আমার কিবা জ্যোতির্মণ্ডলী’ গানটি লিখেছিলেন ডিরোজিও, ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
সুমন, অনুষঙ্গের সূত্রে, এই নাটককে বাড়িয়ে দিলেন আরও দু-একটি ‘ক্ষমতা’ নির্মাণের ইতিহাস আর বর্তমানের দিকে। ফলে একইসঙ্গে ঢুকে পড়েছে ইন্দিরা গান্ধীর প্রণোদনায় ‘জরুরি অবস্থা’র ঘোষণা এবং লালকৃষ্ণ আডবাণীর সেই হিংস্রতাময় ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ চিৎকার। রামমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং তাকে ঘিরে নৃশংস বজরঙ্গবলী তথা সংখ্যালঘু পীড়নের হুংকারাচ্ছন্ন কালে পূর্ববর্তী উপস্থাপনার অভিমুখ ঘুরে যেতে থাকে। একই টানে আসে কবীরের গান। নজরটানের ঝোঁকে কলোনাইজেশন থেকে ‘কোকাকোলোনাইজেশন’ উদ্ঘাটন করে ‘মেরিবাবার গান’। টান-টান আবেগ মোচনের আরিস্ততলীয় সৌধটি বেশ খানিকটা বিনির্মিত হয়, প্রধানত সুজন মুখোপাধ্যায়ের ধর্মাচারী ধড়াচুড়োয় ‘ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না’ উচ্চারণে। ইচ্ছা করেই সুজন একটু মেলোড্রামার উঁচু তারে নাচটিকে-গানটিকে বেঁধেছেন; ‘অন্ধভক্ত’দের সামান্য উত্ত্যক্তই করতে চান তিনি। সুমনও মেরিবাবার নাচে অতিনাটকীয় মোচড়কে আনেন। কৌতুকের আড়ালে ব্রেখ্টীয় একটা বিশ্লেষণে ঠেলেন উপস্থাপনাকে। ভেঙে দেন, ‘মূল’ নাটকের শেষাংশে দমবন্ধ উত্তেজনা থেকে মোচনের উচ্ছ্বাস! উৎপলের পরিকল্প থেকে এক ধরনের ডিপারচার বা সরণ ঘটে। কোনও সন্দেহ নেই, এ-যুগের অন্তহীন ইমেজ নির্মাণের বেলায়, অবসন্ন দর্শককে কোনও শিল্পিত দৃশ্যরূপই ততদূর আক্রান্ত বা উজ্জীবিত করতে পারে না। ফলে সুমনের ধাক্কাটা হয়তো প্রয়োজনই ছিল। তার ওপর দেশজুড়ে এখন চলছে সংসদ নির্বাচনের রবরবা!
৫
ঈসকাইলাস আর শেলি। একজনের হাতে বন্দি প্রমেথিউস আর অন্যজনের হাতে মুক্ত। ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঈসকাইলাসের ট্র্যাজেডিতে বন্দি হন তিনি, আর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে শেলির কাব্যনাট্যে মুক্ত হন। দর্শক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, উৎপলের পরিকল্পের সঙ্গে সুমনের মূল টানা-পড়েন কলকাতার তলায় থাকা ‘মথুর’কে নিয়ে। উৎপলে যে ছিল বিবেকের মতো এক পার্শ্বচরিত্রমাত্র, নাটকে মাত্র দু-বার সে কিছু কথা ছুড়ে হারিয়ে যায়। তার মুখেই অবশ্য ‘টিনের তলোয়ার’ শব্দটি শোনা যায়। কলকাতার তলা থেকে মথুর চরিত্রকে সুমন যেন আংশিক ভাবে বার করে এনেছেন নাটকের কেন্দ্রে। তার শরীর, তার অঙ্গভঙ্গি, তার নড়াচড়া, নিম্নবর্গায়িত স্বরযোজনা। নিম্নবর্গের দেহময় উপস্থিতি। কিছু প্রশ্ন। শেষে কার্টেন কল-এও, ‘মথুর’ চলে আসে কেন্দ্রে। বেণীমাধবের নাট্যবিদ মনকে মথুর ক্রমাগত অস্বস্তিতে ফেলে, খোঁচায়, তোলপাড় করে। ধ্রুপদী পরিসরকে বাখতিনীয় ‘নিম্নাঙ্গ’-এর দৈহিকতা দিয়ে আঘাত শুধু নয়, ছিন্নভিন্ন করে। ‘স্থূল’-এর ব্যঙ্গে টলমল করে ‘রুচিশীল’ শিল্পসৌধ। এও এক প্রত্যাখ্যানের ভাষা। মথুর যেমন সোজাসাপটা জানায়, ‘বাবু’দের এইসব সং সেজে নাচাকোঁদা তার কাছে অর্থহীন। কোনওদিন এসব দেখবে না সে। সে বিষ্ঠা ছোড়ে কাপ্তেনবাবুর গায়ে। তার উপস্থিতি তথা প্রত্যাখ্যানের মেটাফরটি সুমন পুনঃপাঠে চমৎকার সংযোজন করলেন। অন্যদিকে, একটুও চোট না দিয়ে মূল নাটকটিকে, কোথাও যে দু-এক বিন্দু নিটোল সংলাপ হল মথুর এবং বাঘারুর। শেষে অবশ্য মথুর আবার ফিরে গেল তার খাঁচায়। আমি, ব্যক্তিগতভাবে তারিফ এবং দীর্ঘশ্বাসে সে-মুহূর্তে সুমনকে বন্দিত করলাম।
বৃহত্তর একটা প্রশ্ন অবশ্য তুলেই ফেলি। শুধু সুমনকে নয়, এক্ষেত্রে আরও বড় বৃত্তের কাছেই আমার অবলোকনটি ভয়ে-ভয়ে নিবেদন করি। বহু উদ্যাপিত একটি প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ সুতীক্ষ্ণ যুক্তি, তথ্য এবং তত্ত্বের প্রয়োগে ছিন্নভিন্ন করে দেখিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বদীর্ণ অবস্থান। শেষপর্যন্ত তা হল শাসকপ্রভুর প্রতি নতজানু ভক্তিপ্রদর্শন। Neel‐Darpan: The image of a peasant revolt in a liberal mirror শীর্ষক প্রবন্ধটি ১৯৭৪ সালে (যখন উৎপলের নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে) প্রকাশিত হয় Journal of peasant studies-এ। বিস্তারে কথা বলার পরিসর নেই, শুধু মনে করাব, সে-নাটকে ‘ইংরেজিশিক্ষিত’-‘ভদ্রলোক’-‘জমিদারতনয়’ নবীনমাধবই নায়ক হয়ে ওঠে। এই ছিল পরবর্তীকালের ‘রায়বাহাদুর’ দীনবন্ধুর ঈপ্সার রূপায়ণ (উচ্চবর্গের লেখা সাহিত্যে আক্চারই এমন ‘ঘটে থাকে’!)। নিম্নবর্গ তোরাপ সেখানে ‘নেতা’ হয় না, পার্শ্বচরিত্রের সামান্য পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট জায়গা পায় মাত্র। তারপর হারিয়ে যায়। ‘প্রকৃত’-‘প্রতিবাদী’ ‘নেতা’ হিসেবে নবীনমাধব এবং তার পারিবারিক ট্র্যাজেডি চলে আসে কেন্দ্রে। আসলে মতাদর্শগত রাষ্ট্রিক কল (ISA) নির্ধারিত। এই নাটক শেষপর্যন্ত ‘কৃষক বিদ্রোহ’ নয়, নবীনমাধবকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ‘হিন্দু কলেজ’ প্রশিক্ষিত নাট্যকারের পক্ষে যা স্বাভাবিকই। যদিও এই নাটককে নিয়ে উচ্ছ্বাস ছিল এককালের আইপিটিএ-রও! রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, এ-নাটকে ‘The blacker the planters, the whiter the regime.’ উৎপল দত্তও কি এ-নাটকে ‘নেতা’ হিসেবে প্রিয়নাথ মল্লিককে একই ধারায় সৃষ্টি করলেন না? ‘দরবারি’ মার্কসবাদের ঘরানা কি এক্ষেত্রেও অটুট রইল না? কে নায়ক? প্রিয়নাথ না মথুর? নাটকের বিকল্প পাঠ সেক্ষেত্রে পুরো বয়ানকেই উৎক্রম বা সাবভার্সনে ঠেলে দিতে পারে। পুনর্বিবেচনায় সেজন্যই কি সুমন কলকাতার তলায় ফেরত পাঠালেন মথুরকে? তবে, ‘নিম্নবর্গ’ নির্মাণের এই চিরন্তন এলিট প্রয়াসকে কটাক্ষ করলেন সুমন। চিহ্ন তার রইল। আমার এই সূত্রে মনে পড়ে গেল হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে লেখা দেবব্রত বিশ্বাসের চিঠি। মনে পড়ে গেল শহুরে বাবুদের তৈরি ‘কৃষকের গান’— ‘আর দেব না আর দেব না রক্তে বোনা ধান…’— যা কোনও কৃষক কখনও গায়নি। বাবুদের নিম্নবর্গ নির্মাণের সূত্রে বাবুরাম সাপুড়েকে মনে পড়ে। ‘সেই সাপ জ্যান্ত/গোটা দুই আন্ তো।’ সুমন সেই প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন। উলটোটাও তো হতে পারত!
ছবি সৌজন্যে : সুমন মুখোপাধ্যায়