ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মেগা ম্যাগাজিন : পর্ব ৭


    সুস্নাত চৌধুরী (May 18, 2024)
     

    গ্রান্টা

    পত্রপত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে কেবল মৈত্রীই গড়ে ওঠে, তা তো নয়— মতান্তর ও মনান্তরও জন্ম নেয়। কখনও সেসব ছাপিয়ে পত্রিকাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব আড়ে-বহরে বেড়ে আকার নেয় সংঘর্ষের। কিংবা এমন যদি হয়, বিতর্কের জেরে একটিমাত্র সংখ্যা প্রকাশের পরেই বন্ধ করে দিতে হয় কোনও পত্রিকা— আর সেই পত্রিকাই ভিন্ন নামে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে কালক্রমে গড়ে দেয় ইতিহাস— আবার সেই নতুন নামটি নিয়েও উঠে আসে প্রতিশোধপরায়ণতা ও কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ! কতকটা টান-টান থ্রিলারের মতো সেই চাপান-উতোরের সাক্ষী হয়েছিল সোয়া শতকেরও বেশি আগের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়।

    ১৮৮৮ সালের শেষ দিক। কেমব্রিজের ট্রিনিটি হলের এক আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট পড়ুয়া মারি গাথরি বের করলেন একটি পত্রিকা— ‘গ্যাডফ্লাই’। গাথরি মূলত আগ্রহী ছিলেন লঘু চালের সাংবাদিকতায়। সম্ভবত সেই প্রবণতারই প্রতিফলন ঘটে সংখ্যাটিতে। গোলমালের সূত্রপাত ওই সংখ্যায় মুদ্রিত অস্কার ব্রাউনিঙের একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে। তৎকালে কেমব্রিজের কিংস্ কলেজের ফেলো ছিলেন এই অস্কার ব্রাউনিং; তবে হাবে-ভাবে ছিলেন মহল্লার দাদা-গোছের! এহেন ব্রাউনিঙের কাছে ওই সাক্ষাৎকারের প্রকাশিত রূপটি অত্যন্ত আপত্তিকর ঠেকে। শোনা যায়, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই নাকি কর্তৃপক্ষ ‘গ্যাডফ্লাই’ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। প্রথম সংখ্যাতেই যাত্রা শেষ হয় ওই পত্রিকার।

    কিন্তু এই শেষই ছিল আসল শুরু! হতাশ গাথরি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ‘ফুল’ নামে নতুন একটি পত্রিকা শুরু করার। সেই সময়ে কেমব্রিজ অঞ্চলের স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে ব্রাউনিঙের কাছে প্রস্তাব আসে একটি পত্রিকা সম্পাদনার জন্য। ব্রাউনিং রাজি হন। পরিকল্পনা করতে থাকেন মূলত শিক্ষা বিষয়ক প্রকাশিতব্য সেই পত্রিকার খুঁটিনাটি সম্পর্কে। ঘটনাচক্রে গাথরি-র সঙ্গে এক কথোপকথনে আসন্ন পত্রিকাটির কথা তিনি জানান। গাথরি জানতে চান, পত্রিকাটির নাম। ব্রাউনিং বলেন। দিন কয়েক পরেই তাঁর চোখে পড়ে কয়েকটি পোস্টার, তাতে নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশ পেতে চলার সংবাদ। পোস্টারে পত্রিকার নামটি দেখে ব্রাউনিঙের বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না! ক্রমে টের পান, তাঁর উপরে প্রতিশোধ নিতে গাথরি এক মুহূর্ত বিলম্ব করেননি। তাঁকে ‘ফুল’ বানিয়ে, পত্রিকার জন্য নিজের ভাবা নাম বদলে ব্রাউনিঙের বাছা নামটিই ব্যবহার করেছেন— রীতিমতো রেজিস্ট্রি করে পাকাপোক্তভাবে কাজ সেরে রেখেছেন।

    প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ১৮ জানুয়ারি ১৮৮৯

    ‘গ্রান্টা’। কেমব্রিজের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীর নামেই পত্রিকা বের করতে চেয়েছিলেন অস্কার ব্রাউনিং। কিন্তু ১৮৮৯ সালের ১৮ জানুয়ারি মারি গাথরি-র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে যায় ‘গ্রান্টা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা। তড়িঘড়ি ‘কেমব্রিজ রিভিউ’-এ পত্রাঘাত করে ক্ষুব্ধ ব্রাউনিং এ-বিষয়ে লেখেন— ‘an act of literary piracy’— তবে তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

    ‘গ্যাডফ্লাই’-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেজন্য গাথরি শুরু থেকে পত্রিকার মুদ্রণ ও প্রকাশের কাজকর্ম কেমব্রিজ থেকে সরিয়ে লন্ডনে নিয়ে চলে আসেন। তবে নিয়ম করে প্রতি শনিবার সকালে এক শিলিং দামের সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পাঠানো হতে থাকে। শুরু থেকেই গাথরি-র সঙ্গে সম্পাদনার কাজে হাত লাগান আরও দুই পড়ুয়া— লিয়োনেল হল্যান্ড ও রুডল্ফ চেম্বার্স লেম্যান। কিন্তু মাস কয়েকের মধ্যেই সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের জন্য সম্পাদনার কাজ থেকে অব্যাহতি নেন হল্যান্ড; আর গাথরি-ও ‘গ্রান্টা’ সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ক্রমে পত্রিকাটির শুরুয়াতি পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন আর সি লেম্যান। প্রথম পাঁচ-ছ বছর একটানা দায়িত্বে থাকেন তিনি। পত্রিকা পরিচালনার ক্ষেত্রটি আবার ফিরিয়ে আনেন কেমব্রিজে। অল্প সময়েই লোকমুখে ‘the father of all the Grantas’ হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়!

    প্রোফেসর জেব-এর হন্টন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫

    ‘গ্রান্টা’ ছিল আদ্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা। কেমব্রিজের ঘটনা নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে মজার কথাবার্তা বা কার্টুন, ছাত্র-রাজনীতির খবরাখবর ইত্যাদি সেখানে ছাপা হত। সৃজনশীল সাহিত্যের জায়গাও ছিল। সে-সময়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একাধিক পত্রিকা বা জার্নাল থাকলেও ‘গ্রান্টা’-ই ক্রমে প্রধান মুখ হয়ে ওঠে। ‘পান্‌চ’ পত্রিকার যথেষ্ট প্রভাব সত্ত্বেও ‘গ্রান্টা’ নিজের স্বর প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল।

    নিজেদের নিয়েই কেমন মজা-মশকরা চলত ‘গ্রান্টা’ পত্রিকায়? ব্রিটিশ লেখক অ্যালান অ্যালেকজান্ডার মিল্‌ন তখন ট্রিনিটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯০২ সালের ১৮ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হল ‘গ্রান্টা’-র নামকরণের ইতিহাস নিয়ে তাঁর একটি ছোট রচনা। সে-লেখার শেষটি ছিল এইরকম— ‘… and men call it the Granta, which means, ‘Trying-to-be-humorous-once-a-week-thanks-to-the-Editor-who-writes-it-almost-entirely-by-his-wild-lone,’ but we call it the Granta for short. That’s the end of this story.’ কিংবা ১৯১২ সালের মে মাসের একটি সংখ্যায় ছাপা হচ্ছে এই ছড়াটি— ‘The Undergrad/With his little Dad/Who in his time/(Forgive my rhyme)/Was an undergrad/ With a little dad.’ সঙ্গে ব্রিটিশ শিল্পী হেনরি মায়ো বেটম্যান-এর আঁকা অসামান্য একটি কার্টুন।

    ছড়া ও কার্টুন, মে ১৯১২

    তৎকালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, যাঁরা ক্রমে হয়ে উঠছেন বা তখনই খানিক হয়ে উঠেছেন ইংরেজি সাহিত্যের তাবড় ব্যক্তিত্ব, এমন অনেকের লেখাই প্রকাশ পায় এই পত্রিকায়। ই এম ফর্স্টার, জে জে ব্রোনোউস্কি, সিলভিয়া প্ল্যাথ, টেড হিউজ—এই তালিকা নেহাত ছোট নয়। যদিও লেখক তালিকায় বিশিষ্টজনের এই আধিক্য সত্ত্বেও বিবিধ উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত যেতে হয়েছে ‘গ্রান্টা’-কে। মান ওঠা-নামা করেছে, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বন্ধ হতে বসেছে, আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। অন্তত প্রথম কয়েক দশকে এটি দৃশ্যত যতটা না বদলেছে, পত্রিকার অভিমুখ কিংবা প্রকাশিত লেখাপত্রের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়েছে ঢের বেশি।

    প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ ব্যবহার করে বছর কয়েক চলার পর ‘গ্রান্টা’-র দ্বিতীয় প্রচ্ছদ, ২১ অক্টোবর ১৮৯৯

    সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তনটা দেখা দিল গত শতকের সাতের দশকে। ধুঁকতে থাকা ‘গ্রান্টা’ এই সময়ে এসে প্রায় অস্তিত্বহীন একটি জায়গায় পৌঁছে যায়। আর ঠিক তখনই আদ্যন্ত ভোল বদলের শুরু! বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকার দীর্ঘকালীন পরিচিতি ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক ও আধুনিক লেখার মঞ্চ হয়ে উঠল ‘গ্রান্টা’। নতুন সম্পাদক হলেন বিল বুফোর্ড এবং পিট ডে বোলা। অবয়বে, আঙ্গিকে, আবেদনে এল পুরোদস্তুর নয়া রূপ। ১৯৭৯ সালের শরতে প্রকাশিত হল নবপর্যায়ের ‘গ্রান্টা’, প্রথম সংখ্যা।

    নবপর্যায়ের প্রথম সংখ্যা, শরৎ ১৯৭৯

    নতুন প্রকাশেও যে একেবারে শুরু থেকেই পথ মসৃণ হয়ে উঠল, এমন নয়। কিন্তু নতুন সম্পাদকদ্বয়ের নাছোড় চেষ্টা ও পরিকল্পনায় ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক সাহিত্যের জগতে আলোড়ন উঠতে খুব বেশি সময়ও লাগল না। সংখ্যাগুলির কেন্দ্রে রইল নির্দিষ্ট বিষয়। বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকেরা কলম ধরলেন, প্রতিশ্রুতিবান লেখকেরা চেনালেন নিজস্ব হাতের মোচড়। গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরীক্ষামূলক প্রয়াসে আমাদের সমসময়ের নানা কিছুর প্রতিফলন ঘটতে থাকল ‘গ্রান্টা’-য়। ফিকশন, নন-ফিকশন, ক্রিটিসিজম, ফোটোগ্রাফি— বিষয় ও উপস্থাপনার গুণে অনন্য শুধু নয়, এই পত্রিকার স্বর ক্রমে বিশ্বের একটা বড় অংশের কাছে হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণও।

    নবপর্যায়ের প্রথম সংখ্যাটির শিরোনাম ছিল— ‘New American Writing’। আর তৃতীয় সংখ্যাটির শিরোনাম— ‘The End of the English Novel’। ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক সাহিত্যজগতের স্থিতাবস্থাকে নড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই দু-টি সংখ্যার অভিঘাতই ছিল যথেষ্ট। পরবর্তী সময়েও সাহিত্যের নবতরঙ্গকে বারে বারে তুলে ধরতে চেয়েছে ‘গ্রান্টা’। ১৯৮৩ সালে শুরু হওয়া ‘Best of Young British Novelists’ শীর্ষক সিরিজ হোক বা ১৯৯৬ থেকে বেরোনো ‘Best of Young American Novelists’— উঠে এসেছে অনেক নতুন মুখ। তরুণ প্রজন্মকে জায়গা দেওয়া যে সাহিত্য-পত্রিকার প্রধানতম দায়িত্ব, ‘গ্রান্টা’ তা আরেক বার মনে করিয়ে দিয়েছে।

    ফিকশন ছাড়াও গত চার দশকে আমাদের সমাজজীবনের আপাত-পরিচিত বিবিধ বিষয়কে আলোচনায় নিয়ে এসেছে এই পত্রিকা। দেখতে চেয়েছে ভাবনার নতুন আলোকে। ‘Travel’ (বসন্ত ১৯৮৯), ‘History’ (গ্রীষ্ম ১৯৯০), ‘The Body’ (বসন্ত ১৯৯২), ‘The Womanizer’ (গ্রীষ্ম ১৯৯২), ‘Losers’ (বসন্ত ১৯৯৪), ‘Money’ (শীত ১৯৯৪) ইত্যাদি বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। ১৯৯৭ সালের বসন্তে ‘গ্রান্টা’-র সাতান্নতম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে। লেখেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অরুন্ধতী রায়, অনীতা দেসাই, অমিত চৌধুরী প্রমুখ। ২০১৫-র শীতে ভারতের উপরে আরেকটি সংখ্যা প্রকাশ করে তারা।

    ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, বসন্ত ১৯৯৭

    ‘গ্রান্টা’ আজও বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ পত্রিকাগুলির অন্যতম। নতুন লেখককে তুলে ধরা, পাঠককে ভাবনার খোরাক জোগানো, নিত্যনতুন নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া এখনও তার মজ্জায়-মজ্জায় হাজির। দীর্ঘ এই যাত্রায় সলমন রুশদি, মার্গারেট অ্যাটউড, কাজুয়ো ইশিগুরো-র মতো অনেক লেখককে একদা সুপরিচিত করেছে ‘গ্রান্টা’। তার মুদ্রিত পৃষ্ঠা উজ্জ্বল করে থাকা নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর ব্যতিক্রমী রচনার সংখ্যাও কম নয়। ১৯৮৯ সালে যে ‘গ্রান্টা বুকস’ প্রকাশনা শুরু হয়েছে, সেখানেও আছে জন বার্জার, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর মতো নাম। আবার চেখভ বা দস্তয়েভস্কি-র মতো সাহিত্যিকের রচনাও সযত্নে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। নতুন ও চিরনতুনের এই সহাবস্থানই ‘গ্রান্টা’-র স্বাতন্ত্র্য। বিশ্বজোড়া এই লঘু সময়েও সেই গভীর যাত্রা যে অব্যাহত, তা আশার কথা।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook