সমালোচনা— সিনেমা, ‘লাপাতা লেডিজ’
মুখ্য চরিত্র— রবি কিষেণ, ছায়া কদম, স্পর্শ শ্রীবাস্তব প্রমুখ
পরিচালনা— কিরণ রাও
লাপাতা লেডিজ’— মানতেই হয়, চমৎকার ছবি। উপভোগ্য ছবি। ভাল চিত্রনাট্য, দক্ষ হাতে পরিচালনা, অভিনয়ে সকলেই দুর্দান্ত— রবি কিষেণ তো যাকে বলে ফাটিয়ে দিয়েছেন! একটা ছবিকে দর্শকদের কাছে ভালো লাগাতে আর কীই-বা লাগে! এবং শুধু উপভোগ্যতাই নয়, সঙ্গে এই ছবিতে গভীর সামাজিক বার্তাও রয়েছে। কিন্তু… ছবিটি নিয়ে এতখানি উচ্ছ্বাসের বাজারে কিছু ‘কিন্তু’-র কথা লিখে রাখাটা জরুরি বলে মনে হল।
ছবির মূল বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ! কিরণ রাও বিষয় নির্বাচনের কারণেই বাহবা পেতে পারেন। মুখ ঘোমটায় ঢাকা হোক বা বোরখায়— তথাকথিত যাবতীয় প্রথা-সংস্কৃতিই মেয়েদের আড়ালে রাখতে চায়। পরিচিতি (আইডেন্টিটি) গোপন করার এমন অভ্যেস মেয়েদের তৈরি করে দেয়, যাতে শেষমেশ সেই পরিচিতি বাইরের জগতে তো দূর, তাদের নিজেদের কাছেও অজানা রয়ে যায়। আরেকদিকে পুরুষের স্থান অনেক উঁচুতে। বিয়ের পর নিজের স্বামীর নাম মেয়েদের মুখে আনাও পাপ। ছবিতে এসব কথা আছে। কথাগুলো শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে হয়তো খানিক অজানা ঠেকবে, কিন্তু সেখানেও তো মেয়েদের যাত্রাপথে খুচরো বাধা তৈরি করা থাকে— জীবনের দৌড়টা ছেলেদের পক্ষে যদি সমতলে সাধারণ দৌড় (ইঁদুরদৌড় হলেও) হয়, তাহলে মেয়েদের পক্ষে তা হার্ডল রেস কিংবা স্টিপল চেজ। এই সত্যিটা ভুক্তভোগী মেয়েরা তো জানেনই, চোখ-কান-খোলা পুরুষেরাও কথাটা মানবেন। ঘরে-ঘরে সব পুরুষ ছবির প্রশান্তর মতো গায়ে হাত না তুললেও, বিরক্তি-শ্লেষ-শীতল চাহনি ইত্যাদির শিকার হওয়াটা মেয়েদের অভিজ্ঞতার মধ্যেই পড়ে। সুখী দাম্পত্যেও তার অন্যথা হয় না। আর এসব এড়িয়ে যেতে-যেতে, সংসারের সুখ-শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে-করতে, তথাকথিত সুখী মেয়েটিও কোথায় যেন বদলে যেতে থাকে— অনেক-অনেক দিন বাদে নিজের মুখ আয়নায় দেখতে গিয়ে চমকে যায়, এটা কি সত্যিই আমি! সেই মুহূর্তে ঘোমটা/বোরখার আড়ালে থাকা মুখগুলোর সঙ্গে ‘সুখের সংসার’ যাপন করা মেয়েটিরও খুব একটা ফারাক থাকে না। সুতরাং, কিরণ রাও-এর ছবির চিত্রনাট্যের যে মুখ্য উপপাদ্য— মেয়েদের ‘লাপাতা’ হয়ে যাওয়া (না কি ‘লাপাতা’ হয়েই বেঁচে থাকা!)— তা শ্রেণি-নির্বিশেষে সত্য।
এই নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার যে-প্রবাহ, তার বিপরীতে পরিচালক দাঁড় করিয়েছেন মঞ্জু মাঈ-কে (এই ভূমিকায় ছায়া কদম কী অনবদ্য অভিনয়-ই যে করেছেন!)। সমাজের নীচের সারির পরিবারে যে-ছবি খুবই সাধারণ— মেয়েরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে রোজগার করেন, পুরুষটি রোজগার করুক বা না করুক বউ/মায়ের রোজগারের টাকা মদ-জুয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করে না, শেষে বাড়ির মেয়েটিকে মারধরও করে— যে-গল্প আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা গৃহসহায়িকাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারি— মঞ্জু মাঈ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। স্বামী-ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে একা থাকেন, স্টেশনে চায়ের দোকান চালান। বিয়ের পর ট্রেনজার্নির সময়ে স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নববধূ ফুল কুমারী আশ্রয় পায় মঞ্জু মাঈ-র কাছে, জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষাও সে সেখানেই পেয়ে যায়। ছবির শেষাংশে, স্বামীর নাম মুখে আনা পাপ এমন ভাবনায় বিশ্বাসী ফুল কুমারী যখন জনবহুল রেলস্টেশনে স্বামীকে দূর থেকে দীপক বলে চীৎকার করে ডেকে ওঠে, সে এক আশ্চর্য উত্তরণ। যে-উত্তরণ দর্শকের মুখে হাসি ও চোখে জল এনে দেয়— দর্শককে আবেগতাড়িত করে নিঃসন্দেহে— কিন্তু ততখানি ভাবাতে পারে কি? প্রশ্নটা গোলমেলে, তবু ‘পঞ্চায়েত’ জাতীয় ওয়েব-সিরিজ উপভোগ্য হলেও সেই মিষ্টি গ্রামীণ গল্পের মধ্যে এদেশের গ্রামের রূঢ় বাস্তব ধরা পড়তে পারে না (ধরার চেষ্টা, সম্ভবত, পরিচালক সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন) এ-কথা যদি মানেন, এবং একইসঙ্গে এও বিশ্বাস করতে (ও করাতে) চান যে ওই ধরনের গল্পের থেকে ‘লাপাতা লেডিজ’ আলাদা কিছু, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা জরুরি।
যেমন ধরুন, মঞ্জু মাঈ যখন ফুল কুমারীকে বলেন, একবার যদি নিজেকে ভালবেসে ফেলা যায়, তাহলে আর একা থাকাটা সমস্যা নয়— প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই অবস্থান কি মঞ্জু মাঈ-এর, না কি অনিবার্য শ্রেণি-অবস্থানবশত ছবির পরিচালকের? বাজার-সভ্যতা ব্যক্তিকে একক হতে শেখায়— শেখানো জরুরি, কেননা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, নিজের যাপন, নিজের সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য নিজেই যথেষ্ট এটুকু বিশ্বাস করা না গেলে অবিরাম কিনে চলাতেই জীবনের মোক্ষ, যাপনে তার বাস্তবায়ন ঘটানো মুশকিল— যে-দর্শন শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত আপন করে নিয়েছে। এর ঠিক উলটোদিকে দাঁড়িয়ে দেখতে চাইলে প্রয়োজন নিজস্ব বৃত্তের সংকটগুলোকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে রেখে দেখা, সমস্যায় পড়লে একা বোধ না করে আরও কয়েকজন মিলে সমাধানের চেষ্টা করা, আবার অপরের সংকটে নিজে এগিয়ে সেই সংকটের ভাগীদার হওয়া, পরস্পরের হাতে হাত রাখা— যে-অভ্যাস নিম্নবর্গের মানুষ এখনও পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেননি (যদিও অবিরাম বিলাসী যাপনের হাতছানি এবং তজ্জনিত অপ্রাপ্তি ও হতাশাবোধ তাঁদেরও ধীরে-ধীরে একাকী যাপনের দিকে টানছে, সঙ্গে লাগাতার বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ভারতে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার অসহায়তা তো আছেই— মোবাইল আঁকড়ে তাঁরাও উত্তরোত্তর একা হয়ে পড়ছেন)— মঞ্জু মাঈ-এর পক্ষে তো এমন করে সমগ্রের মধ্যে বাঁচতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। ছবিতেও তো তিনি সবাইকে নিয়েই বাঁচেন— ছোটু থেকে শুরু করে চাটনি-চেয়ে-বকুনি-খাওয়া খরিদ্দার— তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা-প্রশ্রয়ের বৃত্তটি তো কম বড় নয়— তিনি অজ্ঞাতকুলশীল অসহায়কে ঘরে আশ্রয় দেন, আবার সে কালাকাঁদ বানালে তাকে পারিশ্রমিকও দেন, তার জীবনের প্রথম উপার্জন— নিজেকে ভালোবাসতে পারাই যথেষ্ট বোধ করার মধ্যবিত্ত/উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনশিক্ষা কি এমন যাপনের সঙ্গে মেলে?
আদতে তলিয়ে দেখলে, যে-কোনও শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রেই স্রষ্টার জীবনদর্শন ও জীবনবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্রষ্টা যখন নিজের শ্রেণিযাপনের বাইরের জগতের কথা বলতে যান— এক্ষেত্রে শ্রেণিগত দূরত্বের সমস্যা ভৌগোলিক দূরত্বের চাইতে কম কিছু নয়— তখন তো আরও বেশি করে কথাটা সত্য। কলম ও কল্পনাশক্তির জোরে বিভূতিভূষণ আফ্রিকায় অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখে ফেলতে পারেন— আফ্রিকা থেকে বহুদূরের বাঙালি পাঠকের কাছে সে-গল্প বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মানদীর মাঝিদের জীবনের গল্প লিখেছেন দূর থেকে সেই জীবনকে দেখেই, বাকিটা মানিকের কল্পনা ও জীবনবোধ। এই জীবনবোধ ও কল্পনাশক্তি— দুইয়ে মিলেই, হয়তো, সৃজন-প্রতিভা। তাই ঋত্বিক-সত্যজিৎ-মৃণাল-সথ্যুরা যখন সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে ছবি করেছেন, তা এতটুকু আরোপিত বলে মনে হয় না, অথচ কিরণ রাও-এর এই ছবির অনেক অংশই তেমন ঠেকে। যেমন, দীপকের বাড়িতে জয়া-র অনেক সংলাপ তো অধুনাবিস্মৃত সেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ নির্মিত প্রচারচিত্রের স্বাস্থ্যকর্মী-দিদির মতো শোনায়।
আবারও বলি, ছবিটি চমৎকার। অবশ্যই দেখুন। কিন্তু বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সাতের দশকের রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চনের ছবিগুলো সমস্যার যতখানি গভীরে প্রবেশ করেছে (এবং সমস্যার সুরাহার যতখানি সৎ প্রয়াস সেখানে দৃশ্যমান), এ-ছবিও ততখানিই— তার খুব বেশি কিছু অতিরিক্ত নয়। তা সত্ত্বেও অবশ্য ‘দিওয়ার’-‘কালিয়া’-‘অগ্নিপথ’ আমরা উপভোগ করেছি, কিন্তু উপভোগের বেশি কিছু প্রত্যাশা রাখিনি— ‘লাপাতা লেডিজ’-এর ক্ষেত্রেও ওই একই কথা।
ছবিতে রবি কিষেণ অধস্তন দুবেজি-র ‘দিমাগ’-এ লিমিট লাগানো আছে বলে ঠাট্টা করেন, কিন্তু কথাটা তো এখন আরও অনেক-অনেক বেশিজনের ক্ষেত্রেই সত্যি। গভীরে যেতে পারার প্রত্যাশাটা এই সময়ে দাঁড়িয়ে, সম্ভবত, সেভাবে ট্রেন্ডি নয়। এমন আশ্চর্য সময়ের পক্ষে, কে বলতে পারে, হয়তো, ‘লাপাতা লেডিজ’-ই অত্যন্ত গভীর সমাজভাবনামূলক ছবি!