ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ধর্মঘট


    সৌগত রায় (May 25, 2024)
     

    এখন আর ধর্মঘটের তেমন মাহাত্ম্য নেই। ভোটের বাজারে টেলিভিশনের গরমাগরম আলোচনা কানে আসছিল তাপসের। খাবার টেবিলে বসে সে এই কথাই ভাবছিল যে, রাজনীতি কত রকম ভাবে বদলে গেল! যেমন, ধর্মঘট আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে না। ধর্মঘট আর কোনও কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না কেবল স্মৃতি ছাড়া। অথচ, তাপসের কলেজ-যৌবনে তো বন্‌ধ ছিল রাজনীতি আর প্রতিবাদের প্রতীক। এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে জমায়েত। লক্ষ লোকের জমায়েত। অ্যাম্বুলেন্স তখনও আটকে যেত, এখনও যায়!

    তাপসের মনে পড়ল সেই উত্তেজিত ভাষা, যা দিয়ে হয়তো তোলপাড় হত তাদের দিনগুলো। হয়তো! কিংবা… ‘বন্ধুগণ! কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা, অপশাসন, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, বেতার ও দূরদর্শনের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির প্রতিবাদে এবং চাকুরির অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের দাবিতে ভারতবর্ষের সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক সংগঠন কাল যে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, তোমরা, আমার ভাই, বন্ধু ও বোনেরা, সেই গণআন্দোলনের শরিক হয়ে একে সফল করে তোলো। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দালাল কিছু বিপথগামী ছেলে এই গণআন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা করতে পারে, ক্লাসে না যাওয়ার জন্য তোমাদের ভীতি প্রদর্শন করতে পারে, এমনকী বলপ্রয়োগও করতে পারে; কিন্তু তোমরা এই ঐতিহাসিক ধর্মঘটের ব্যাপক গুরুত্ব বিবেচনা করে, বাংলার ছাত্রসমাজের সংগ্রামী চেতনার ঐতিহ্যের কথা স্মরণে রেখে, তাদের এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করবে। একদিন কলেজে ক্লাস না হলে হয়তো সবার পড়াশুনার সামান্য ক্ষতি হবে। তবু এতগুলো বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য, আমাদের এই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে— এটাই মানবসভ্যতার চিরন্তন ঐতিহ্য। কাল তোমরা সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে ভারত বন্‌ধ সফল করবে এই আশা রেখে এবং, সবাইকে রক্তিম অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’

    কলেজের মেন বিল্ডিংয়ের সামনের চত্বরটা দ্রুত ফাঁকা হতে শুরু করল। আবার কেউ বক্তৃতা শুরু করার আগেই হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার তাগিদ, লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে। ছাত্র সংসদের প্রধান সহকারী সম্পাদক তাপস, তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু আবেগদীপ্ত বক্তৃতাটি শেষ করে, অতীনের কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইল। সিগারেট ধরিয়ে, দুটো সুখটান দিয়ে, ধোঁয়ার রিংয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বলল, ‘অতীন, কাল আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। দেবাশিস, তন্ময়, মৃগাঙ্করা এবার সহজে ছেড়ে দেবে না, একটা গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করবে; বহুদিন পরে ওরা ছাত্র সংসদে সিট জিতেছে, ওরা এবার মরিয়া হয়ে লড়বে।’

    অতীনও ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তাপসের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে, দীর্ঘ একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং বানানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে চিন্তিত গলায় বলল, ‘ও নিয়ে তুই ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি অন্য কথা ভাবছি— চিন্তাটা বেশ ক’দিন ধরেই আমার মাথায় ঘুরছে, কিছুতেই তাড়াতে পারছি না।’

    ‘কী চিন্তা?’ তাপসের গলায় উদ্বেগের সুর।

    ‘আচ্ছা তাপস, কী লাভ বল তো, দুদিন অন্তর এই ধর্মঘট করে? আমাদের পড়াশুনার ক্ষতির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম; কিন্তু এই যে মাঝে মাঝেই কলকারখানা, বাস-ট্রাম, অফিস-কাছারি, ইস্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে জনজীবনকে স্তব্ধ করে দেওয়া, দেশের কোটি-কোটি টাকার উৎপাদন ব্যাহত করা, বিক্ষোভের নামে জাতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তোলা— আমার কেমন যেন অনর্থক মনে হয় সব কিছু।’

    ‘ধর্মঘট আমাদের সংগ্রামের হাতিয়ার। শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানানোর এর থেকে বড় অস্ত্র আমাদের হাতে নেই। তা ছাড়া, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ছোট-ছোট ক্ষতি তো স্বীকার করতেই হবে।’ তাপস জোরের সঙ্গে বলল।

    ‘বৃহত্তর স্বার্থ! কার স্বার্থ, কীসের স্বার্থ? এই যে আমরা এতগুলো দাবি নিয়ে ধর্মঘট ডেকেছি, তুই কি ভাবিস, ধর্মঘট সফল হলেই সব দাবি আদায় হয়ে যাবে? হবে না, কোনও দিন হয়নি, এবারও হবে না। আসলে এসব রাজনীতির দাবার চাল, আর আমরা রাজনীতিকদের হাতের বোড়ে মাত্র। ওদের অঙ্গুলিহেলনে বোকার মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়ছি। ধর্মঘট এখন আর সংগ্রামের হাতিয়ার নেই, অনর্থক ও বহুব্যবহারে ওটা জীর্ণ, ধারহীন হয়ে গেছে।’ বলতে-বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে অতীন। দপ করে জ্বলে উঠল তাপসের কোমল চোখদুটো। অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় হিসহিসিয়ে উঠল, ‘একটা জিনিস ক’দিন ধরেই লক্ষ করছি অতীন, তোকে বলব বলব করেও বলা হয়নি। কিছুদিন হল তোর মধ্যে বুর্জোয়া চিন্তাগুলো হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দেবাশিসদের সঙ্গে তোর মেলামেশাও ইদানীং ভীষণ বেড়ে গেছে— এসব ভাল লক্ষণ নয়। তুই তো জানিস, তোর কাজকর্ম, কথাবার্তা এসবের সঙ্গে আমাদের সংগঠনের স্বার্থও জড়িত। তাই তোর আচরণ এমন হওয়া উচিত নয়, যা সংগঠনের ক্ষতি করে। তুই যদি সতর্ক না হোস, সেক্ষেত্রে কঠোর হওয়া ছাড়া আমাদের কোনও উপায় থাকবে না।’        

    শেষের দিকে তাপসের স্বর সামান্য বিষণ্ণ শোনাল। বিস্ময়ে, ক্ষোভে, দুঃখে অতীন বিমূঢ় হয়ে গেল— তাপস বলে কী! যে-ছেলেটা ক’টা বছর আগেও রাজনীতির নাম শুনলে চমকে উঠত, মিটিং-মিছিলকে সযত্নে এড়িয়ে চলত, যে-তাপসকে সে-ই প্রথম ইউনিয়ন অফিসে নিয়ে এসেছিল, সংগঠনের সদস্য করার জন্য সুপারিশ করেছিল, সে কিনা আজ সংগঠন-বিরোধী কাজের জন্য তাকে সাবধান করছে! তাপসের যোগ্যতা আছে— এ-লাইনে পরে এসেও অনেককে টপকে সে ছাত্র সংসদের সহকারী সম্পাদক হয়েছে, এজন্য অতীনের মনে কোনও ক্ষোভ বা ঈর্ষা নেই, তাই বলে একটা…!  

    আহত, অপমানিত, ক্ষুব্ধ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উদ্‌গত কান্নাটাকে চাপতে-চাপতে, কোনও রকমে রুদ্ধ স্বরে অতীন বলল ‘চলি রে, পরে দেখা হবে।’  

    তাপস প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া জ্বলন্ত সিগারেটের বাটটা মাটিতে ফেলে, পা দিয়ে পিষে ফেলে ইউনিয়ন অফিসের দিকে এগিয়ে গেল। তার এখন অনেক কাজ।  

    ধর্মঘট কথাটার উৎপত্তি কবে, কীভাবে হয়েছিল, আর কী করেই বা আক্ষরিক অর্থটা হারিয়ে গিয়ে প্রচলিত অর্থটা চালু হল, অতীন তা জানে না, জানার দরকারও পড়েনি। আসলে এসব নিয়ে ও ভাবেইনি কোনও দিন। এমনকী সকালে তাপসের সঙ্গে উত্তপ্ত আলোচনার আগে পর্যন্তও, ধর্মঘট নিয়ে তার ভাবনাটা খুব সিরিয়াস কিছু ছিল না। কিন্তু এখন সে ভাবছে, তাপসের ওই জ্বালাধরানো কথাগুলো তার চেতনায় যেন গভীর আঘাত করে গেছে। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে সে। তারপর ভোরের শুকতারাকে সাক্ষী রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—  এই শেষ, কালকের ধর্মঘটই তার রাজনৈতিক-জীবনের শেষ অনুষ্ঠান, রাজনীতি আর নয়!   

    আজ ভারত বন্‌ধ! কলকাতার উপকণ্ঠের এই আবাসিক কলেজে ছুটির আমেজ। কাছেপিঠে যাদের বাড়ি, অযাচিত ছুটি পাওয়ার আনন্দে তাদের অনেকে গতকালই বাড়ি চলে গিয়েছে। যারা হোস্টেলে রয়েছে, বেশির ভাগই অনেক রাত পর্যন্ত হইচই করে, শেষরাতে শয্যা নিয়েছে; সকাল দশটার আগে বিছানার মায়া ত্যাগ করা তাদের পক্ষে মুশকিল। তারই মধ্যে কিছু ছেলে, অন্যদিন প্রথম দুটো পিরিয়ড যাদের বিছানায় শুয়ে কিংবা ক্যান্টিনের টেবিলে আড্ডা মেরে কেটে যায়, আজ আটটা বাজার আগেই কলেজের মেন লবিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এদের কেউ অঙ্গীকার করেছে ধর্মঘট সফল করার, কেউ বা ভাঙার। ভাঙাগড়ার এই বিচিত্র খেলার শিকার হয়ে গেলেন কয়েকজন অধ্যাপক। তাঁরা কর্তব্যবোধে এসেছিলেন কাজে যোগ দিতে, একপক্ষের অনুরোধে অনেকেই ফিরে গেলেন, কেউ কেউ নীতিবোধের তাগিদে উপেক্ষা করতে চাইলেন সব কিছু। বাধল সংঘাত। প্রবল তর্কবিতর্ক, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, মৃদু ধাক্কাধাক্কি, অবশেষে প্রবলের কাছে দুর্বলের আত্মসমর্পণ।   

    কলেজে ধর্মঘট সর্বাত্মক এবং অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্ত। ধর্মঘটবিরোধী ছাত্র এবং কর্তব্যবোধে অবিচল অধ্যাপকদের প্রতি কিছু ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, সংগ্রামী চেতনায় জাগ্রত উপস্থিত ও অনুপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের লাল সেলাম ও সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে ছাত্র সংসদের সভাপতি অসীম একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিল। ইনকিলাব জিন্দাবাদ দিয়ে ঘোষিত হল ধর্মঘটের সাফল্য। এক দলের বিজয়বার্তা। সবার কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে, অতীনের কণ্ঠস্বরটা যেন বড় বেশি শোনা যাচ্ছিল। দলের কাজে এটা তার শেষ সক্রিয় অংশগ্রহণ, সেইজন্যেই বোধহয় তার উৎসাহটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি চোখে পড়ছিল। কালকে যে সন্দেহর বাতাবরণটা তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল, সেটা মুছে ফেলতে আজ অতীন বদ্ধপরিকর। তাপস একটু অপ্রতিভ, সামান্য লজ্জিত, খুশিও— অতীনের দ্বিধাটা দূর করতে পেরেছে সে।

    বেলা এগারোটার মধ্যেই সব শেষ। শান্ত কলেজচত্বর দেখে বোঝার উপায় নেই, কিছুক্ষণ আগেই এখানে রাজনীতি ও সমাজসচেতন দু’দল ছাত্র, মানুষের দুঃখদারিদ্র, অভাব-অনটন ঘোচানোর অধিকার নিয়ে চুলোচুলি করছিল। 

    তুই তো জানিস, তোর কাজকর্ম, কথাবার্তা এসবের সঙ্গে আমাদের সংগঠনের স্বার্থও জড়িত। তাই তোর আচরণ এমন হওয়া উচিত নয়, যা সংগঠনের ক্ষতি করে।

    বৈশাখের নিঝুম দুপুর। গঙ্গার উত্তপ্ত বাতাস ধেয়ে এসে কলেজ ক্যাম্পাসের ছায়ানিবিড় শীতলতা শুষে নিচ্ছে। হঠাৎ পাওয়া এই দ্বিপ্রাহরিক অবসরটাকে ছেলেরা শুয়ে, বসে, আড্ডা মেরে, তাস খেলে বিভিন্ন ভাবে উপভোগ করছে। হোস্টেলের সামনের আমগাছে চড়ে বসেছে কয়েকজন। কাঁচা আমের অম্লমধুর স্বাদ, বৃক্ষশাখায় অবাধ বিচরণ বাল্যের স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসছে ওদের। ভারতের বিদেশনীতির সার্থকতা সম্বন্ধে একটা বেশ সারগর্ভ বক্তৃতা দেওয়ার ফাঁকে তাপসের চোখে পড়ল অতীনের দিকে। গাছের ডালে বসে নির্বিঘ্নচিত্তে কাঁচা আম চিবিয়ে যাচ্ছে। গোল্লায় যাক ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি। কাঁচা আম আর নুনের স্বাদ— আহা!

    ‘এই অতীন, এদিকে একটা আম পাঠা।’  

    ‘জানালায় আয়, আমি ছুড়ছি, তুই লুফে নে।’ রাজনীতি আর তর্কবিতর্কে তাপস যতই পটু হোক, ক্রিকেট খেলায় সে নিতান্তই নবিশ। দু-দুটো আম সে ধরতে পারল না, নীচে গিয়ে পড়ল।

    ‘ধুর! তুই একটা ঢ্যাঁড়শ, তোর দ্বারা হবে না।’ সরু ডাল বেয়ে কাঠবেড়ালির মতো ঝুলতে-ঝুলতে আরও এগিয়ে এল অতীন।  

    ‘অত সরু ডালে চড়িস না অতীন, ভেঙে যাবে।’ উৎকণ্ঠায় তাপসের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

    কিন্তু কে কার কথা শোনে, অতীনকে তখন বীরত্বের নেশায় পেয়েছে। ও আরও এগিয়ে আসছে, আর একটু এগোলেই সে তাপসের হাত ছুঁয়ে ফেলবে।

    ‘না অতীন, তুই নেমে আয়, আমার আম খাওয়ার দরকার নেই, প্লিজ, তুই নেমে যা।’ তাপসের কণ্ঠে আর্তি।

    ‘আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? নে ধর, আরেকটু হাত বাড়া, আরেকটু, আহ্‌!’ 

    চোখ বন্ধ করে ফেলল তাপস— একটা আর্ত চিৎকার, পতনের শব্দ, সবার দৌড়ে যাওয়া, তাপসের মাথার মধ্যে সহস্র ড্রামের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। অতীনের কী হল?

    অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছে অতীন, মাথাটা থেঁতলে গিয়েছে, নিমীলিত চোখের উপর তাজা লাল রক্তের ঢল নেমেছে, রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, দুমড়ে-মুচড়ে ‘দ’ হয়ে যাওয়া দেহটা মাঝে মাঝে থরথরিয়ে কেঁপে উঠছে… হাতে তখনও ধরা রয়েছে সেই আমটা!  

    কলেজের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল অতীনকে; ডাক্তার দেখে বললেন একে এক্ষুনি বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তিনিই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফোন করতে গেলেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। দু-একবার চেষ্টা করে, বিরক্তিতে রিসিভারটা আছড়ে নামিয়ে রাখলেন, টেলিফোনটা ডেড। একদল ছেলে দৌড়ে গেল গাড়ির জন্য, কলেজের একটা গাড়ি আছে, সেটা যদি পাওয়া যায়। গাড়ি তো আছে, ড্রাইভার কোথায়? আজ যে ধর্মঘট!

    দৌড়ে বেড়াচ্ছে সবাই, ছাত্র সংসদের সভাপতি, প্রধান সম্পাদক, ছোট, বড় আরও অনেক ছাত্রনেতা— উদ্দেশ্য বন্ধ করা নয়, গাড়ির চাকা চালানো। মস্ত বড় বিপদ এখন ঘরে, অতীন মৃত্যুশয্যায়, সময় বয়ে যায়। গাড়ির ড্রাইভারকে ধরা গেল না। খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার ধর্মঘট সফল করার জন্য সবাই যখন কর্মক্ষেত্রের ছায়া মাড়ায়নি, সে-ই বা কেন কাজে আসবে! এ তো তার সংগ্রামী চেতনার প্রতি অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ।    

    অবশেষে গাড়ি মিলল— একজন অধ্যাপকের গাড়ি, তিনি নিজেই চালাবেন। আজ সকালে এই অধ্যাপকই অতীন-তাপসদের হাতে অপদস্থ হয়েছিলেন কাজে যোগ দিতে গেছিলেন বলে।    

    অতীনকে নিয়ে গাড়ি চলল। তাপসের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অতীন, রক্তে বুজে এসেছে চোখ। যন্ত্রণায় অতীনের ভেঙেচুরে যাওয়া মুখটার দিকে উদাস, বোধহীন শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাপস। মাঝে মাঝে অতীনের কাতরানির অস্ফুট শব্দে সংবিৎ ফিরে আসছে তার, তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠছে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, না রে?’ অতীনের দিক থেকে কোনও সাড়া নেই, অচেতনতার অন্ধকারে সে পথ হারিয়ে ফেলেছে।

    ‘এই যে মশাই, গাড়ি থামান! বন্‌ধের দিনে গাড়ি বের করেছেন যে বড়?’ কর্তব্যপরায়ণ পার্টিকর্মীদের চোখ এড়ানো চলে না।

    ‘দে, গাড়ির চাকার হাওয়া বের করে দে।’

    দু-চারটে পাথরের টুকরো সামনে পিছনের কাচের উপর এসে পড়ল।

    ‘দাদা, প্লিজ ছেড়ে দিন, অ্যাক্সিডেন্ট কেস, মেডিক্যাল কলেজে যাচ্ছি, দেরি হলে আর বাঁচবে না।’

    দাদাটি মহানুভব, গাড়ির ভিতর উঁকি মেরে অতীনের অবস্থাটা দেখে ছেড়ে দিলেন— ‘এদিকে বড়রাস্তায় বোমা পড়ছে। ফরসোর রোড দিয়ে ঘুরে যান।’

    এমন কতশত দাদাদের শ্যেনদৃষ্টির স্নেহবন্ধন এড়িয়ে অতীনকে যখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হল, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকার নামছে অতীনের চোখেও।    

    ওরা অতীনকে ও টি-তে নিয়ে গেল। তারপর শুধু প্রতীক্ষা। কী অসহনীয় সেই প্রতীক্ষা, সময় যেন কাটতেই চায় না। সবাই চুপচাপ বসে, শুধু অধ্যাপক মহাশয় অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন সবাই ভুলে গেছে, অতীনের প্রাণটা যেন সবার নিশ্বাসের সঙ্গে আটকে আছে।

    অপারেশন থিয়েটারের সবুজ আলোটা হঠাৎ লাল হয়ে গেল, প্রফেসরের মুখ থেকে ছিটকে বেরোল, ‘যাহ্‌’। ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন, মাথাটা আস্তে-আস্তে নাড়তে লাগলেন, ‘আমি সরি প্রফেসর, ঘণ্টাখানেক আগে হলেও…’

    ডুকরে কেঁদে উঠল তাপস।

    রাস্তায়-রাস্তায় সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পগুলো সব জ্বলে উঠেছে, আলোতে ঝলমল করছে কলকাতা মহানগরী। বিজয় মিছিলের উদ্দাম কলরবে সূচিত হচ্ছে ধর্মঘটের সফলতা। মাইক্রোফোনে ঘোষিত হচ্ছে অভিনন্দনবার্তা, বিপ্লবের জয়গান। কর্মক্লান্ত অতীন তার শেষ ধর্মঘটের শেষে গভীর শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিপ্লবীচেতনার অত্যুজ্জ্বল আলোকেও সে-অন্ধকার দূর হওয়ার নয়; পৃথিবীর সব প্রতিবাদী মানুষের সম্মিলিত চিৎকারেও অতীনের ঘুম আর ভাঙবে না।  

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook