তরঙ্গনাথ – সাত
তরঙ্গনাথ থেকে-থেকেই ভুলে যায় যে সে বিবাহিত; বাবা-মা-ভাই-বোন ছাড়াও, ও-বাড়িতে আরও যে-একজন আছে, সে তার বউ তরুলতা। তবে তরুর মুখটা মনে পড়লেই, তার চোখে ভেসে ওঠে বাঁশির মতো নাকে একটা ছোট্ট নোলক। আর মনে পড়ে, বউয়ের সাজে তরুর কানে পরা সেই গয়নাটি যার নাম— ‘কান’। ছোট্ট টুলটুলে মুখ আন্দাজে তরুর কান-জোড়াও বেশ লম্বাটে। কে জানে তরু একটু শান্ত হয়ে, লেখাপড়ায় মন দিয়েছে কি না! সেবারে দু’রাতের জন্য বাড়ি গিয়ে তো দেখল, সে তখনও সেই একই রকম ছটফটে; দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামে; বদুর হাত পিছলে জল তোলার বালতিটা কুয়োয় পড়ে গেলে, এক ছুটে বালতি তোলার কাঁটা নিয়ে এসে প্রবল উৎসাহে তা তুলেও দেয়; লম্বা লাঠি নিয়ে ছাদে উঠে হনুমান তাড়ায়। তরু যে শুধু ডানপিটে তাই নয়, একই সঙ্গে ভয়ংকর সাহসী এবং ঠান্ডা মাথা। কিন্তু সন্ধে হতে-না-হতেই ঘুমিয়ে কাদা। তবে মায়ের সঙ্গে থেকে সে যে অনেক কাজেই নিপুণ হয়েছে সেটা বোঝা যায় তার শাড়ি পরার ধরন, খাবার বেড়ে দেওয়া, জিনিসপত্র ঠিকানায় গুছিয়ে রাখা দেখে। কিন্তু তরঙ্গনাথ যে ঠিক তার কে— এ-বিষয়টা নিয়ে তরু একেবারেই ভাবিত নয়; তরঙ্গনাথ দু-একবার জানতে চাইলে তরু বলেছে, ‘তুমি তো আমার পুলিশ বর’; আর তা এমন অক্লেশে বলেছে যে, তনু তাতেই বুঝেছে ‘বর’ যে কী, ওই বালিকার মাথাতেই তা ঢোকেনি; তনুর কানে এসেছে, যখন তার আড়ালে মা- মাসিদের কাছে ঠাট্টা করে বাবা বলছেন যে, ‘তনু চলে গেলেই বউমার যেন পোয়াবারো; আবার সে খেলে বেড়াবে বদু আর রাণীর সঙ্গে’। মায়ের উত্তরটা শুনতে না পেলেও মাসিমার হাসির শব্দ তার কানে এসেছে। একটাই যা শান্তি তা হল, তরুর নামে নালিশ জানিয়ে মায়ের কাছ থেকে কোনও চিঠি আসেনি; এমনকী এ-বিষয়ে কোনও ‘তার’ও আসেনি তরুর বাপের বাড়ি থেকে। তবে তরঙ্গনাথ এটা খুব ভালভাবেই জানে যে, তরুকে নিয়ে তাঁর কোনও অপছন্দের কথাই মা অন্তত চিঠি লিখে তাকে জানাবেন না; সামনাসামনিও যে বলবেন তা-ও নয়; একমাত্র বাড়ি গেলেই সেটা নিজেই বুঝতে পারবে তরঙ্গনাথ। তবে তরঙ্গনাথ এটুকুই বুঝেছে যে তার বউ তরু হাতেপায়ে একটু দুরন্ত বা বালিকা সুলভ হলেও মুখরা বা বায়নাবাজ নয়। এইজন্যই হয়তো বাবার একটু বেশিই মায়া পড়ে গেছে তার ওপর।
তরঙ্গনাথ মাঝে মাঝেই ভাবে যে, এখানকার এই কোয়ার্টারে তরুকে নিয়ে সংসার পাতলে কেমন হত! সে কি পারত এতটা সময় একা-একা কাটিয়ে দিতে! হয়তো ছোটেলালের বউয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে স্নান করতে চলে যেত ওই দূরের নদীটায়! কিংবা হারিয়েই যেত মেলাতলায় গিয়ে! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে তনুর! দেশের যা অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, কোন দিক থেকে কীভাবে যে বিপদ আসবে কেউ জানে না! একদিকে নিশ্চিন্ত, তার শ্বশুরমশাই যে সপরিবার জলপাইগুড়ি চলে গেছেন। এরকম পরিস্থিতিতে তরুকে নিয়ে তাঁরা যদি শিবনিবাসে থাকতেন, তো ঘুম ছুটে যেত তনুর। রেলপথে কাটিহার থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়াও তুলনায় অনেক সহজ। তবে পুলিশ এবং তার পরিবারের সহায় কেউ নয়; সবাই শত্রু। গিরিডির মেসোমশাইও অনেকদিন আসেননি। মায়ের চিঠিতে তনু জেনেছে যে, তিন মেয়ের পরে, তাঁদের আবারও একটি মেয়ে হয়েছে। ফলে তাঁরা সপরিবার এখন ফুলিয়ায় তাঁদের পৈতৃক বাড়িতেই।
ঘোড়ায় বা জিপে চড়ে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি বা তল্লাশির কাজ সামলেও তনু খানিক সময় পায় বাগান করবার। মায়ের সাবধানবাণী মনে রেখে, সাহেবদের সঙ্গে ক্লাবে যাওয়া এবং নাচাগানা ব্যাপারটায় নামমাত্র জুড়ে থাকে; তার বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায় বাগান করে; নিজে-নিজেই ভেবে বার করেছে যে গারডেনিং বেশ সুন্দর একটা হবি; আর সাহেবরাও এটার চর্চা করে নিপুণভাবে। ধু-ধু মাঠের মধ্যে এই যে কাটিহার পুলিশচৌকি, এটার ভোল বদলে দিয়েছে সে; এ-অঞ্চলে এমন একটা পুলিশচৌকি খুঁজে পাওয়া বিরল। দেশি বাঁশের নিচু-নিচু বেড়া এবং বাহারি মাচা বানিয়ে দিয়েছে স্থানীয় লোকেরাই; ঢোকবার গেটের ওপর সেই মাচা জুড়ে ফুটে থাকে মধুমালতী। ছোটেলাল, অন্যান্য আর্দালি, এমনকী তার সহিসও খুঁজে পেতে এনে দেয়, নানা রকমের ফুল গাছ ও পাতাবাহার। মি. অগাস্ট পাঠিয়ে দেন তার বাংলোর খাস মালিকেও। বনেবাদাড়ে ফুটে থাকা লতানে গোলাপ, হাসনুহানা, দোলনচাঁপা, ঝুমকো জবা— এসবও ফোটে আকাশ আলো করে। তনুর যত্নে, আর ফোটে লাল-হলুদ-সাদা-গোলাপি বোগেনভলিয়া। এই গাছগুলোর জন্যই বাতাসও যেন ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে মসৃণ হয়ে বয়ে যায়। প্রজাপতি আর পাখিদের ওড়াওড়ির তাই যেন বিরাম নেই; তবে নিরাপত্তার কারণে বড়-বড় ঝাঁকড়া গাছ লাগাতে নিষেধ করেছেন মি. অগাস্ট। দিগন্ত অবধি নজর রাখতে গাছ যেন বাধা না হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গাছের উঁচু ডালে বসে সন্ত্রাসবাদীরাও যেন নিশানা করতে না পারে এ-থানার কাউকে। এটা তাই বাড়ির বাগানের মতো হয় না। ভোরবেলা বাগানের চারিপাশে ঘুরতে-ঘুরতে, তবুও তরঙ্গনাথ ভাবে যে, তরু এখানে এলে সে তাকে উপহার দেবে তার নিজে হাতে সাজানো কাটিহার থানার এই বাগানটাই। আবার ভাবে, তরু কি ফুল-গাছ আদৌ এসব ভালবাসে!
২.
ডিউটি রেজিস্টারে সই করে, পূর্ণিয়া সদরে বেরিয়ে যাবার আগেই, অফিসে তাঁর ঘরে তরঙ্গনাথকে ডেকে পাঠালেন মি. অগাস্ট। তরঙ্গনাথ সিঁটিয়ে আছে তার বদলির ভয়ে। বিহারের যেসব অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে সাহেবরা ঘেঁটে আছে, তার অন্যতম হল মজঃফরপুর। কলকাতা থেকে বদলি করে এখানে আনা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড সাহেবকে। তাঁর এজলাসের বিচারাধীন মামলায় তাঁর দেওয়া বিভিন্ন রায়ে খেপে উঠেছে বাংলার বিপ্লবীরা। তবে সমস্ত গোপন খবর কি আর দপ্তরে আসে? এদিকে আবার, সাহেবদের নেকনজরে থাকলেই পদোন্নতি এবং বদলি; সেটা অবশ্য তাঁদের নিজেদের ক্ষেত্রেও; তবে সাহেবদের মতো বেপরোয়াভাবে যেখানে-সেখানে গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এ-দেশের মানুষদের নেই। মোটের ওপর সবাই তারা বাড়ির জন্য সবসময় কাতর এবং মনে-মনে বিপন্ন; তরঙ্গনাথের সংকটটা আবার অন্য; তার ভয়ানক রাগ হয়, সাহেবদের নির্দেশে গুলি-বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এ-দেশের মানুষগুলোকে শায়েস্তা করতে; তার বয়সি কত যে যুবক জেলে বন্দি হয়ে পচছে! ফাঁসিতে লটকাচ্ছে তাদের তরতাজা জীবন।
মি. অগাস্টের ঘরে ঢুকতেই তিনি একখানি পত্র ধরিয়ে দিয়ে, বসতে ইশারা করলেন তরঙ্গনাথকে। চিঠিসমেত খামটা হাতে নিয়ে বসতে-না-বসতেই তিনি বললেন,
‘বাড়ি যেতে হবে তো! তোমার ওয়াইফ হয়তো উতলা হয়েছে। মা তাই চিঠি লিখে বাড়ি যেতে বলেছেন।’
‘পূর্ণিয়ার কেসটার হিয়ারিং চলছে স্যর!’
‘সে নাহয় আমি সামলে নেব। টানা প্রায় সাত-আট মাস তো এখানেই আছ। ওয়াইফ তো এখন একটু বড় হয়ে গেছে; এবার তাকে নিয়ে এসো।’
‘তাকে এখানে একা থাকতে মা-বাবা মনে হয় পাঠাবেন না স্যর।’
‘সেইজন্যই তো বলছি যে, বাড়ি গিয়ে পরামর্শ করো; একসঙ্গে থাকবার জন্য রাস্তা তো একটা বার করতে হবেই।’
‘আমি নিজে থেকে কিছুই বলতে পারব না; ওঁরা যা ভাল বুঝবেন তাই হবে।’
‘বাবা-মা তো তোমাদের সঙ্গে এসে থাকতে পারেন; অসুবিধে কী!’
‘তাঁরা কী করে আসবেন স্যর! আমার তো আরও দুটি ছোট ভাই-বোনও আছে!’
‘বুঝেছি বড় কোয়ার্টার লাগবে; এবং যার কাছাকাছি ভাল ইস্কুলও চাই।’
স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে এল তরঙ্গনাথ। মুখ-ছেঁড়া খামটা নিয়ে নিজের ঘরে এসে বসতেই আর্দালি এসে জল দিয়ে গেল। সেইসঙ্গে রাতের গাড়িতে কাটিহার থেকে হাওড়া ফেরার একটা টিকিটও; টিকিটের সঙ্গে আর একটা চিরকুটে লেখা, ‘আমার অফিসিয়াল ‘তার’ না যাওয়া অবধি এখানে আসার কারণ দেখি না; একান্ত প্রয়োজনে লালবাজারে খোঁজ নিতে পারো; এই অফিসের সঙ্গে জরুরি যোগাযোগও লালবাজার থেকেই কোরো।’
চিরকুটখানি পড়েই, ড্রয়ারে রাখা দেশলাই বার করে তখুনি সেটা পুড়িয়ে ফেলল তনু। কী একটা আশঙ্কা যেন গ্রাস করতে লাগল তাকে!
কাটিহার-হাওড়া যাতায়াত করতে-করতে তার বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে; তবে এবারে যাওয়াটা যেন একটু অন্যরকম; কারণ ফেরার দিনটা ক্যালেন্ডার থেকে উড়ে গেছে; এমনও হতে পারে যে কালকেই ‘তার’ এল ফিরে যাবার! হয়তো বসে থাকতে হবে উদ্বেগে যে, কবে তার ফিরে যাবার ‘তার’ আসে! ফলে বাড়ি যাবার আনন্দটা একেবারে পানসে লাগছে তনুর। তবে তার মধ্যেই সে মনে করে ব্যাগে ভরেছে, রাণী আর তরুর জন্য কেনা দু-খানা দেহাতি শাড়ি। বদুর জন্য মোটা র্যাপার। আর আলাদা ভাবে প্যাক করিয়েছে, বাবা-মায়ের কথা ভেবে কেনা বিছানায় পেতে শোবার চ্যাটাই। একবার সে ভেবেছিল যে, রাণী আর তরুর জন্য এক জোড়া লাল শাড়ি কিনবে; কী ভেবে যেন লাল বাদ দিয়ে একখানা নীল আর অন্যটা সবুজ শাড়ি নিল। রাতের খাবার গুছিয়ে দিয়ে ছোটেলাল বলল, ‘গাছ নিয়ে চিন্তা করবেন না বাবু; নিয়ম করে দু’বার জল দিয়ে দেব।’ তরঙ্গনাথ ঠিক বুঝতে পারল না যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য তার এই অনুপস্থিতির খবরটা ছোটেলালও জানে কি না। নিজের ঘোড়াটাকে আদর করে দু’বার চাবড়ে দিয়ে জিপে উঠে পড়ল তরঙ্গনাথ। এই প্রথম সে চলেছে উর্দিপরা ড্রাইভারের পাশে বসে, সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। কামরায় উঠে নিজের সব কিছু গুছিয়ে রেখে, সকালে পাওয়া খামটা এবার খুলে বসল তরঙ্গনাথ। মা নয়, বাবার চিঠি।
কল্যাণবরেষু নভেম্বর ১৯০৭
বাবা তনু,
তোমার মা জানাইতে চাহেন যে, বউমা ‘বড়’ হইয়াছেন, আজ কয়েক মাস হইল।
তোমারও এইবার সংসারী হইবার সময় হইয়াছে। সকল দিক বিবেচনা করিয়া সত্বর একবার বাড়ি আইসো। মনে রাখিও যে রাণীও বিবাহযোগ্যা; অচিরেই তাহার বিবাহ-ব্যবস্থা করিতে হইবে।
সে-বিষয়েও তোমার সহযোগ আশা করেন তোমার মা ।
আশা করি শরীর কুশল
আশীর্বাদক
বাবা
তনু বেশ মজা পেল এই ভেবে যে, এ-চিঠিতে লেখা ‘বড়’ শব্দটা পড়ে আমাদের অগস্ত্য-সাহেব ঠিক কী বুঝল কে জানে! বিড় বিড় করে শুধু বলল, ‘সাত সেয়ানার হাবিলদার’ এই মি. অগাস্ট!
৩.
বাড়িতে ঢুকতেই রাণী আর বদু একসঙ্গে ছুটে এলেও, তরুকে আর আগের মতো তাদের কাছাকাছি দেখতে পেল না তরঙ্গনাথ। দেখতে পেল না সকাল থেকে বিকেল অবধিও। রাতের খাওয়া খেয়ে নিজের ঘরে শুতে এসে, তরঙ্গনাথ প্রথমে দেখতে পেল তার রাঙাবউদিকে। ফিক করে হেসে রাঙাবউদি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সে দেখল যে খাটের এক কোণে বসে আছে তার সত্যি-সত্যি বড় হয়ে যাওয়া বউ তরু। নজর এড়াল না, তরুর শরীরে যৌবনের উদ্ভাস। সহজ ভাবেই বসে আছে সে; আসলে তাতে মিশে আছে সাবলীল অপেক্ষা আর নারী হয়ে ওঠার অভিমান— কেন আসোনি এতদিন! সুন্দর করে বাঁধা খোঁপায়, রুপোর কাঁটা-বাহার লাগানো; দু’পাশে দুটো কাঁটাকে মাঝখান থেকে জুড়ে রেখেছে এক হালি চেইন, যার নকশাটা আবার নূপুরের মতো, ঝুনঝুনি দেওয়া। মাথায় ঘোমটা নেই। শাড়ির আঁচলটাও এলিয়ে আছে তার হাতের ওপর। ঘরের আলো নেভানো; কোণে রাখা উঁচু একটা তোরঙ্গের ওপর লণ্ঠন জ্বলছে; সেই আলোতে মনে হচ্ছে যেন বায়োস্কোপ দেখছে তনু। তরুর ভাবটা এমন যে— তুমি তো সেই একই আছ! দেখো দেখি আমি কেমন বদলেছি! তনু গিয়ে তার পাশে বসল। নাকে এল তরুর গায়ের মেয়েলি গন্ধ; ঘন হয়ে এল অপেক্ষা। ধীরে-ধীরে এদিকে মুখ ঘুরিয়ে তনুর চোখে চোখ রাখলে অবাক হয়ে সে দেখল, তরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে যে লাবণ্য তা যেন দিঘির মতো টলটল করছে তার দুই চোখে আর ঠোঁটের পাপড়ি-জোড়ায়; গভীর ভাবে চুম্বন করল তরঙ্গনাথ; তরুও ডুব দিল তার অধর এবং ওষ্ঠ নিয়ে। তরঙ্গনাথ অনুভব করল তরুর সেই দৃঢ় বাহুবন্ধন এবং একইসঙ্গে দামাল উচ্ছ্বাস। তনু যেন ভারমুক্ত হয়ে সঁপে দিল নিজেকে। তরুর আশ্রয়ে নিজেকে ভীষণ নিরাপদ মনে হতে লাগল তার।
আজ আর ঘুম নেই তরুর চোখে।
আলিঙ্গনে সম হয়ে তরু শুধু বলল, ‘তোমার গায়ের গন্ধে তোমাকে যেন আমার একেবারে নিজের একজন বলে মনে হয়। তুমি পুলিশ নয়, শুধুই আমার বর।’
কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল ভেবে পেল না তনু; ভোররাতে দুজনে গিয়ে বসল ছাদের মধ্যিখানে; সূর্য উঠতে দেরি আছে; আকাশের তারাগুলো যেন হিরের মতো জ্বলছে। তনু ভাবল নীরবতাও এমন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে! বাতাস হয়ে ওঠে এত উদ্বেল; ঠিক যেমন গঙ্গাটা! বয়ে চলেছে কিন্তু চোখে দেখা যাচ্ছে না! অন্ধকারে কেমন ডুব দেয় চরাচর! দিগন্তরেখা মুছে গিয়েও জেগে থাকে শুধু অপেক্ষা; আবার একটা দিনের অপেক্ষা। একেই কি বলে যাপন! তরুর চপলতা গাঢ় হয়ে বিছিয়ে পড়েছে আমোদিত যৌবনে; আর তনুর গাম্ভীর্য মোড়কের পর মোড়ক খুলে বেরিয়ে আসছে এক দামাল আবেগে। এ তো বড় অদ্ভুত রসায়ন! বুঝে ওঠার আগেই নাগালের বাইরে যেন ঘটে যাচ্ছে কত কিছু! আজ প্রায় বছর খানেক পর গান গেয়ে উঠল তনু। গানের প্রথম অংশটা মনে আসছে না। তাই সুরটা গুনগুন করতে করতে মাঝখান থেকেই সে ধরল—
‘বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়—
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে
……………………………………………………..
আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়’।
আমি তনু, মানে তরঙ্গনাথ। আমার বিবাহিত স্ত্রীটি সহবাসযোগ্য হয়েছে। বাবার চিঠিতে এ-কথা জেনে বাড়ি এসেছি; কিন্তু আমার বউ এই তরু, বয়সে-অভিজ্ঞতায়-এমনকী উচ্চতাতেও আমার থেকে প্রায় হাতখানেক ছোট হয়েও যেন জাদু করেছে আমায়; সঙ্গ-সুখ ছাপিয়ে সে আমাকে দিয়েছে এক প্রগাঢ় নিরাপত্তা বোধ। আমি বুঝতে পেরেছি যে, এই মেয়েই পারবে আমার মনের সব সংকোচ এবং দ্বিধা কাটিয়ে দিতে। আমার পদ বা বীরত্ব নয়; সে এসে দাঁড়িয়েছে আমার জীবনের একেবারে ভিতর-অলিন্দে। এ এক মস্ত জোর এবং অশেষ প্রাপ্তি।
এদিকে কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠছে অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে এবং তার ভাই বারীনের সাংগঠনিক তৎপরতায়। মি. অগাস্টের কাছেই ভাসা-ভাসা যে-নামগুলি শুনেছি, তারা সব বড়-বড় পদাধিকারী সাহেব এবং বেপরোয়া। সকলের পরিচয় না জানলেও নামগুলো মনে গেঁথে গেছে। Andrew Fraser, B. Fuller, Douglas Kingsford, F. Duke, Edward Baker। যেভাবেই হোক এদের হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, ‘যুগান্তর’ দলের সক্রিয়তায়। চন্দননগর, আসাম, সিলেট, বরিশাল এবং কলকাতার মুরারিপুকুর অঞ্চলে সংঘটিত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা। সিস্টার নিবেদিতা-ঘনিষ্ট, স্বামী বিবেকানন্দের বিপ্লবী-ভাই, সেই ভূপেন দত্তকেও জেলে পুরেছে পুলিশ। অরবিন্দকে গ্রেফতার করে জামিন দিলেও, আবার তাকে আটক করার ব্যবস্থা করছে এই কিংসফোর্ড। যাচ্ছেতাই রকমের দুর্মুখও এই সাহেব; বিপ্লবীদের সম্পর্কে তার যে আক্রোশ, সেসব বেরিয়ে আসে তার কথাবার্তা এবং আচরণে। তা ছাড়াও অল্পবয়সি যাদেরই ধরছে, আটক আইনে পুরে রাখছে বছরের পর বছর। ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই সশস্ত্র হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এরা। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে কংগ্রেস দলের ভাঙনও; একদিকে রাসবিহারী ঘোষ, অন্যদিকে তিলক; মাঝখানে সমঝোতাপন্থীরা— কে যাবে কার দলে!
কাটিহারে থাকতে যত না খবর পেতাম, বাড়ি ফিরে বাংলা কাগজ পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি; মাঝে মাঝে লালাবাজার যাতায়াত করে এ-অনুমান আরও দৃঢ় হচ্ছে যে, ভয়ানক এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে আমাকে। কারণ শুধু সাহেব নয়, তাদের তাঁবেদার নেটিভ-পুলিশ এবং রাজসাক্ষীদের মারতেও পিছপা হবে না তারা।
তারই মধ্যে আরও এক খবর এই যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মনের মতো একটি ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় গড়ে তুলতে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে থাকতে শুরু করছেন বোলপুরে। দেশবিদেশের শিক্ষিত-শহুরে সমাজ ত্যাগ করে, প্রিন্স দ্বারকানাথের নাতি শেষে কিনা ওই অজপাড়াগাঁ বোলপুরে! বঙ্গভঙ্গের ফলে, নতুন হওয়া ইষ্টবেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং বাবা দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুই কি তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ!
বুঝতে পারছি না যে মি. অগাস্ট কি এই জন্যই আমাকে নিজের বাড়িতে থেকে, লালবাজারে যাতায়াত জারি রাখতে বললেন! তবে কি কলকাতায় পোস্টিং হবে আমার? আর কি ফেরা হবে না কাটিহার? আমার ঘোড়ায় চড়া, জিপ চালানো, লতানে গোলাপের বাগান, আর্দালি-ছোটেলাল, গ্রামের মেলা, কালচে সবুজ আলোয় ঘেরা জঙ্গল, পাথুরে নদী— সেসব কিছুই কি দেখাতে পারব না তরুকে!
অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই! তরুকে দেখে কি শিখিনি কী ভাবে অপেক্ষা করতে হয়!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র