গাড়িটা গ্রাহামস্ ল্যান্ডের পাড়া ছেড়ে বড়রাস্তায় উঠল; তারপর ডানদিকে বাঁক নিয়ে, ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো ডান হাতে ফেলে সোজা চলল টলি ক্লাবের দিকে। সামনে তিন মাথার মোড় ধরে আবার ডানদিকে বাঁক নিয়ে ছুটল রাসবিহারি মোড়ের দিশায়। গন্তব্য আরও অনেকটা। ধর্মতলা, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ হয়ে শ্যামবাজার, তারপরে যশোর রোড ধরে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে সোজা বম্বে— আজকের মুম্বই।
গাড়ির মধ্যে তিনজন যাত্রী— কুড়ি-একুশ বছর বয়সি এক তরুণ আর তাঁর বাবা-মা। তিনজনের মুখেই কোনও কথা নেই। একদৃষ্টে জানালার বাইরের শহরটাকে যেন শেষবারের মতো, প্রাণভরে দেখে নিতে চাইছেন। বিশেষ করে তরুণটির বাবা, গাড়ির জানালার বাইরের দ্রুত সরে যাওয়া দৃশ্যপট দেখতে-দেখতে যেন তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে এল। প্রতিটি রাস্তা, সেসব রাস্তার সঙ্গে যুক্ত পাড়া, পাড়াগুলির গলি— প্রায় সবই তো তার মুখস্থ। বিগত তিন দশক ধরে, এই শহরে তিনি যে কত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন তা গুনে শেষ করা যাবে না। আর শুধু কি তাই? ছিল ছায়াছবির গানে সুর দেওয়া কিংবা গান করা। এবং তারই পাশাপাশি ছিল অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের আগামী দিনের গায়ক-গায়িকা হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব।
সব ফেলে রেখে, এক চাপা অভিমান নিয়ে অপরেশ লাহিড়ী শহর ছেড়ে চলেছেন বহুদূর। পাড়ি দিচ্ছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের শহর বম্বেতে— নতুন করে ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টায়। সঙ্গে চলেছেন তাঁর স্ত্রী বাঁশরী লাহিড়ী ও পুত্র অলকেশ— যে-পুত্র কিছু বছর পরে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করবে বাপ্পি লাহিড়ী নামে। তিনজনের এই পরিবার কলকাতার পাট চুকিয়ে চিরদিনের মতন চলে যাচ্ছেন। অথচ এই কলকাতা শহর এই পরিবারটিকে কত কিছুই না দিয়েছে! অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি— সবই। তা সত্ত্বেও এক লহমায় সব কিছুই যেন উলটে-পালটে গেল।
সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ার কথা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় শহর উত্তাল। সেই পরিস্থিতির আঁচ অল্পবিস্তর সকলের গায়েই এসে লেগেছিল— বিশেষ করে উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি শিকার হয়েছেন সেই রাজনৈতিক অবস্থার। এসবের হাত থেকে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষও বাদ পড়েননি— অপরেশবাবুও তাদের একজন।গ্রাহামস্ ল্যান্ডে তাঁদের নিজেদের তিল-তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের বাসা তুলে দিতে হল, এবং সেই বাড়ি ছেড়ে অপরেশবাবু ও তাঁর পরিবার চলে যেতে বাধ্য হলেন। কলকাতা ছাড়ার আগে ভি বালসারার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর অক্রুর দত্ত লেনের বাসায়। গিয়ে বলেছিলেন, ‘দাদা, আপনি বলেছিলেন লাইন লাগাবার কথা— চললাম বম্বেতে লাইন লাগাতে। জানি না কী আছে কপালে।’ বালসারা সাহেব কিছু বলতে পারেননি। একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন অপরেশের দিকে। তাঁর প্রথম গানে কণ্ঠ দিয়েছিল অপরেশ। শুধু ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘তা হলে আমরা আমাদের জায়গা পালটাপালটি করে নিলাম। আমি বম্বে থেকে এখানে এলাম, আর তুমি এখান থেকে বম্বে চললে। ঠিকই আছে, যাও তুমি। কী আর বলব, সাবধানে যেয়ো।’
চৌরঙ্গি ধরে গাড়ি হু হু করে ছুটছে দমদম অভিমুখে। জানালা দিয়ে বাঁ-দিকে তাকাতেই দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে গড়ের মাঠের একটা টুকরো চোখে পড়ল— যার পিছনেই আকাশবাণী ভবন আর তার পাশেই ইডেন গার্ডেন। অনেক কথা মনে পড়ে যায়, কারণ এই দুটি স্থানই অপরেশবাবুর স্মৃতির অনেকটা জুড়ে বিরাজ করে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুটো ঘটনাই তো এই দুটি স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে! তাঁর সংগীত জগতের সঙ্গে অনেকটাই সম্পৃক্ত এই আকাশবাণী ভবন। আর ইডেন গার্ডেন? সে আরেক মজার ঘটনা।
১৯৫৬ সাল। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে আয়োজিত হল এক বিরাট অনুষ্ঠান, যেখানে গান করবেন বাংলা ও বম্বের বহু শিল্পীরা। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গায়ক জুটি অপরেশ লাহিড়ী ও তাঁর স্ত্রী বাঁশরী লাহিড়ী। কিন্তু সেদিন তাঁদের সংগীত পরিবেশনে আরও একটি চমক ছিল— তাঁদের গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করবে তাঁদের চার বছর বয়সের পুত্র অলকেশ ওরফে বাপ্পি। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল সেই ছোট্ট শিশুর তবলাবাদন। কেউ-কেউ স্বীকার করলেন ‘এ হল বাবা মায়ের রক্তের প্রভাব’, কেউ সেটাকে জেনেটিক্সের ব্যাখ্যা দিলেন, আবার কেউ-কেউ বললেন, ‘এ-ছেলে জাতিস্মর না হয়ে যায় না।’ বাবা-মায়ের সে এক বড্ড গর্বের দিন।
গাড়ির সামনের সিটে বসে পুত্রও হয়তো সে কথা-ই ভাবছিল। সেদিনের সেই ঘটনা হুবহু না মনে থাকুক, কিন্তু কিছু-কিছু তো মনে আছে। কারণ সেই অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর। তিনি ছোট্ট বাপ্পির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমার গানের সঙ্গে তবলা বাজাবে?’; কিন্তু তিনি কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে, অপরেশবাবুর সন্তান, সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটির সুরে একদিন তিনি গানও করবেন?
টালিগঞ্জ থেকে দমদম এয়ারপোর্টের যাত্রাপথে, মনের চিলেকোঠায় সযত্নে রাখা স্মৃতির অ্যালবামের একটার পরে একটা পাতা উলটে দেখছিলেন অপরেশ লাহিড়ী…
অপরেশবাবুর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা বাংলাদেশ) পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালপুরে। তাঁর ছেলেবেলার পুরোটাই কেটেছে পাবনায়। পড়াশোনা ছাড়াও তাঁর প্রাথমিক সংগীতশিক্ষা পাবনাতেই। অবশ্য সে-কালে না জানি কোন মন্ত্রবলে, পাবনা হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতি জগতের সুতিকাগৃহ। অপরেশবাবু ছাড়াও, এই পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ধ্রুপদি সংগীতশিল্পী চিন্ময় লাহিড়ী। এমনকী গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্মও পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালপুরে। শুধু তা-ই নয়; জানা যায়, গৌরীপ্রসন্নবাবুর পিতা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারদের পরিবার অপরেশবাবুদের প্রতিবেশী ছিলেন।
দেশভাগের কিছু আগে, অনেক মানুষের মতোই অপরেশবাবুদের পরিবারও পূর্ববঙ্গের পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। নতুন করে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি শহরে। সেদিন হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে, সেই স্বাধীন ভারতে, পঁচিশ বছরের মাথায় তাঁকে আবার একবার স্থান পরিবর্তন করতে হবে। নতুন করে জীবন-জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে আরও একবার।
জলপাইগুড়ি শহরে বেশ কিছুটা সময় কেটেছিল অপরেশ-বাঁশরী জুটির। গানের জগতে বাঁশরীরও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল শাস্ত্রীয় গান আর শ্যামাসংগীতে। অপরেশ ও বাঁশরী লাহিড়ী অবিভক্ত বাংলায় বহু অনুষ্ঠানে, একই মঞ্চে গান করেছেন। যদিও তখনও দুজনে জুটি হিসেবে অনুষ্ঠান করেন না; বাংলার সংগীতজগতে স্বতন্ত্র শিল্পী হিসেবে দুজনেরই যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। পাবনার ছেলে অপরেশ লাহিড়ী এবং ময়মনসিংহের মেয়ে বাঁশরীর ছোটখাটো অনুষ্ঠান আর গান শেখানো— এই নিয়েই চলছিল সংসারধর্ম। আবার, সেই গানের অমোঘ আকর্ষণেই অপরেশবাবু সপরিবার চলে এলেন কলকাতায়। সালটা ১৯৫০ কিংবা ১৯৫১-র কোনও এক সময়।
২০০৭ সালে, কলকাতার এক নতুন এফএম স্টেশনে বলিউডের একটি ছবির গানের প্রোমোশনে এসে অনেক গল্প করেছিলেন অপরেশবাবুর সুযোগ্য পুত্র বাপ্পি লাহিড়ী। কিছু অন-এয়ারে এবং অনেক কিছু অফ-এয়ার আড্ডায় সরাসরি তাঁর মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই এফএম স্টেশনের অনেকের। বহু প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন হাসিমুখে।
‘বাপিদা, আপনারা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন কেন? এমন একটা সময়ে আপনারা গেলেন, যখন অপরেশবাবু বাংলা সিনেমা ও সংগীতজগতে বেশ ভাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন; এমনকী আপনিও একটা ছবিতে সুর দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।’
স্টুডিয়োর মস্ত কাচের জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন বাপি। ন’তলার নীচের রাস্তার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘এই রাস্তাটাই সোজা চারু মার্কেটের দিকে যাচ্ছে না? এখনও একই রকম মনে হয় রাস্তাটা দেখে। আরও খানিকটা গেলে টলি ক্লাব, তারপর কিছু দূরেই বাঁ-দিক ঘুরে ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো। তার পাশেই থাকতাম। গ্রাহামস্ ল্যান্ডে… হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন?’
‘আপনারা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন কেন?’
‘কলকাতা ছেড়ে গেলাম কোথায়? এই তো আমি… এনিওয়ে, জোকস্ অ্যাপার্ট; যে-সময়ে গিয়েছিলাম… ওই আর্লি সেভেন্টি’র কথা বলছি, তখন কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে আসা বাবার জন্য বড্ড জরুরি হয়ে পড়েছিল।’
‘কেন? ভালই তো ছিল!’
‘যাকগে, এসব অনেক পুরনো কথা। এখন আর ভেবে লাভ নেই।’
কথাগুলোর মধ্যে চাপা যন্ত্রণা ফুটে উঠেছিল। খুবই অন্তরঙ্গ কিছু আলাপচারিতা, সেদিন অনেক না-জানা কথা ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনি।
‘আপনার মামাবাড়ি তো জলপাইগুড়িতে? আপনার জন্মও তো সেইখানে, তাই না?’
‘একেবারেই না। আমার জন্ম কিন্তু কলকাতায়। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে আমাদের আত্মীয়স্বজন থাকেন জলপাইগুড়িতে, আমি এখনও সময় পেলে যাওয়া-আসা করি। তবে আমার বাবা পাবনার আর মা ছিলেন ময়মনসিংহের। দুজনের পরিচয়ও ঘটে পূর্ব বাংলায়, কোনও এক গানের অনুষ্ঠানে। শুনেছি সিলেট শহরে হেমাঙ্গবাবু, মানে হেমাঙ্গ বিশ্বাস আয়োজন করেছিলেন সুরমা মিউজিক কনফারেন্স বলে সে-যুগে একটা বিখ্যাত গানের জলসা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মণ, রাইচাঁদ বড়াল থেকে শুরু করে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়েত্রী বসু, নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং আরও সব বড়-বড় শিল্পীরা গান করতে আসেন। চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি, সিলেট শহরের উইমেন্স কলেজে সেই অনুষ্ঠান হয়েছিল। শুনেছি এইখানেই মা’র সঙ্গে বাবার পরিচয়। তারপর বিয়ে। দেশভাগের আশেপাশে ওঁরা উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে এসে বসবাস আরম্ভ করেন।’
জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসে অপরেশ লাহিড়ী তখন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একটা মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজছিলেন। সেই সময়ে আকস্মিক এক যোগাযোগ ঘটে গেল। বাঁশদ্রোণী নিবাসী, তাঁর পূর্বপরিচিত জনৈক চিকিৎসক ড. দেবেন্দ্র সিনহা, তিনি যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেখানে কথা বলে অপরেশবাবু ও তাঁর স্ত্রীর ভাড়াটে হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আজকের বাঁশদ্রোণী বাজারের খুব কাছেই, সেই বাড়িতে সুদীর্ঘ এগারো বছর তিনি কাটিয়েছেন। যে-অঞ্চলে অপরেশবাবু থাকা শুরু করলেন, সেখানে রীতিমতো ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের বসবাস। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন একদিকে ছবি বিশ্বাস, অন্য দিকে অভি ভট্টাচার্য। বাঁশদ্রোণী থেকে পাঁচশো মিটার দূরে, বড়রাস্তার ধারেই পাবনার আরেক সন্তান, সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি। খানিক দূরে, বাঁ-দিকে একটু ভিতরে, রিজেন্ট গ্রোভে এক প্রাসাদোপম বাসায় থাকতেন কানন দেবী! এমন এক পরিবেশে এসে থাকা শুরু করলেন অপরেশ লাহিড়ী; শুরু হল নতুন এক সংগীতমুখর যাত্রা। শুরু হল রেডিয়োতে গান; নিয়মিত জলসায় গান; সংগীত-শিক্ষার্থীদের গান শেখানো— এভাবেই ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়ছিল।
অপরেশবাবুর জনপ্রিয়তা কলকাতার শ্রোতাদের কাছে বাড়ার আরও একটা কারণ ছিল। তাঁর কণ্ঠে এবং গায়কীতে শ্রোতারা যেন কে. এল. সায়গলকে খুঁজে পেতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে সায়গলের অকাল প্রয়াণে, তাঁর গুণমুগ্ধ শ্রোতারা হারিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় শিল্পীকে। সে-ক্ষতিপূরণ কখনওই সম্ভব ছিল না; তবুও সে-যুগে শ্রোতারা বেশ কিছু শিল্পীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় সায়গল সাহেবকে। সে-যুগে সায়গল সাহেব ছিলেন আরও বেশ কিছু শিল্পীর অনুপ্রেরণা। শুধু অপরেশ লাহিড়ীই নয়, সায়গল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন কিশোর কুমার, মুকেশ এমনকী লতা মঙ্গেশকরকেও! সায়গল সাহেবের পদানুসরণ করতেন লতাজি, সে-কথা নিজের মুখেই বলে গিয়েছেন।
১৯৬৬ সালে পীযূষ বসু পরিচালিত ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে সুরকারের দায়িত্ব পেলেন অপরেশ; সেই ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে তিনি গাওয়ালেন সেই বিখ্যাত গান, ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’। অবশ্য এর প্রায় আট বছর আগে, ১৯৫৮-তে পথিকৃৎ পরিচালিত ‘ও আমার দেশের মাটি’ ছবিতেই তিনি লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন আরও একটি প্রচলিত লোকগান, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’।
সত্তরের গোড়ায় কলকাতা ছেড়ে চিরদিনের মতো মুম্বই পাড়ি দেওয়ার আগেও অপরেশবাবুর ওই শহরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তিনি মুম্বইতে কিছু হিন্দি গানও রেকর্ড করেন। ১৯৪৭ সালে অপূর্ব মিত্রর পরিচালনায় হিন্দি ছবি ‘ফয়সলা’-তে কানন দেবীর সঙ্গে ডুয়েট গান করেন ‘খুলি হওয়া মে উড়নেওয়ালা পঞ্ছি প্রীত না জানে’। ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে যৌথভাবে ছিলেন অনুপম ঘটক ও কমল দাশগুপ্ত। এ ছাড়াও, ১৯৫৪ সালে অমিয় চক্রবর্তীর ‘বাদশা’ ছবিতে তিনি শঙ্কর-জয়কিষণের সুরে গাইলেন, ‘জাগে মেরা দিল সোয়ে জমানা’। তারও আগে ১৯৫০ সালে, বিমল রায়ের পরিচালনায় নিউ থিয়েটার্সের হিন্দি ছবি ‘পেহলা আদমি’-তে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে অপরেশ লাহিড়ী আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেন, ‘তারোঁ কি রোশনি মে হম দুনিয়া নই বসায়ে’।
না, কলকাতার কাজকর্ম ছেড়ে বোধহয় অপরেশ লাহিড়ী ‘তারাদের দেশে’ যেতে চাননি। হাতছানিকে সহজেই অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। যখনই প্রয়োজন পড়েছে, তিনি কাজের ডাকে সাড়া দিয়ে মুম্বই চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর শিকড় কলকাতাই ছিল। কী করেই বা যাবেন! জন্মভিটে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, বাংলা গানের আরও বৃহৎ পরিসরে নিজের স্থান করে নিতে। জলপাইগুড়ি হয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তিনি মনে করতেন বাংলা গানের শ্রোতাদের যে-ভালবাসা তিনি পেয়েছেন, সেটা ছেড়ে তাঁর আর কোথাও যাওয়ার নেই! তা ছাড়া শুধু শ্রোতা কেন, কলকাতা শহর এবং আশেপাশে তাঁর যে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আছে, তাদেরকে ছেড়ে কেনই-বা যাবেন!
একজন শিল্পী তিন-তিনটে দশক বাংলা গানের সেবায় নিমগ্ন থেকেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অগুনতি শ্রোতাদের; কিন্তু তাঁর প্রাপ্তির তালিকায় সুযোগ্য এক পুত্র ছাড়া হয়তো তেমন বেশি আর কিছুই যুক্ত হয়নি। পঁচিশ বছর হতে চলল, তিনি সুরলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। স্ত্রী বাঁশরীও গত হয়েছেন, কেউ খোঁজ রাখেনি। ২০২২ সালে চলে গেলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র অলকেশ ওরফে বাপ্পি লাহিড়ী। একটা গোটা পরিবারের সংগীতময় যাত্রার ইতিবৃত্তি কোথাও সেভাবে নথিভুক্ত আছে কি না জানা নেই। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া থেকে আরম্ভ করে আন্তর্জালের সুবিশাল তথ্যভাণ্ডার— কোথাও তেমন আকরগ্রন্থ তো দূরে থাক, একটা চটিবইয়ের সন্ধানও পাওয়া গেল না, যেখানে সেই মানুষটার সম্পর্কে অল্পবিস্তর কথা বলা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে কোনও তথ্যের অভাব এক বিষয়; কিন্তু ভুল দিনক্ষণ-তারিখ সম্বলিত রচনার সম্ভার আরও বেশি পীড়াদায়ক। এ-বছর তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। বিগত কয়েক বছর এমন বহু শিল্পীরই জন্মশতবর্ষ নিঃশব্দে, নীরবে কেটে গিয়েছে। অপরেশবাবুও কি সেই দলে পড়েন? স্বনামধন্য শিল্পীদের পিছনে কি তিনিও ‘লাইন লাগাবেন’?