সমকালীন ভারতীয় শিল্প-আঙিনায় অন্যতম চর্চিত শিল্পী পুষ্পমালা এন। বরোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ধীরে-ধীরে ফোটো পারফরম্যান্সকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বলা যায়, দেশে ফোটো/ভিডিও পারফরম্যান্সের অন্যতম পথিকৃৎ তূরীয় নারীবাদী পুষ্পমালা। শুধু তাই নয়, conceptual art নিয়ে নয়ের দশকে যেসব ভারতীয় শিল্পী কাজ শুরু করেন, পুষ্পমালা তাঁদের একজন। শিল্পমণ্ডিত রাজনৈতিক মতামতের স্বাচ্ছন্দ্যে ভাস্কর্য থেকে ফোটো পারফরম্যান্স— সবদিকেই তাঁর যাতায়াত। নিজেকে সোচ্চারে নারীবাদী ঘোষণা করলেও, লিঙ্গ-রাজনীতি তাঁর একমাত্র বিষয় নয়। বরং পারিপার্শ্বিক, সর্বজনীন রাজনৈতিক বিষয় তাঁকে যথেষ্ট ভাবায়। তার প্রতিফলন ঘটে কাজে। বছর তিনেক আগে Atlas of Lost and Rare Alphabets এবং ‘নারা’ শীর্ষক দুটি ভাস্কর্যের প্রদর্শনী করেন। তামার পাতে লেখা আদেশ অনুশাসন, ব্যবসায়িক এবং জমি-সংক্রান্ত নথি দেশীয় ইতিহাসের যে-সাক্ষ্য বহন করে, এখন সেই নথি-বার্তা উদ্ধারে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। তাছাড়া এই নথির সঙ্গে জড়িয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া ভাষার ইতিহাসও। বর্তমানেও ভাষা-রাজনীতি তার সামাজিক পরিসর বাড়িয়ে ক্রমে রাষ্ট্রনৈতিক রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাম্রশাসনের অনুকরণে প্রাচীন লিপি তামার পাতের উপর বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করেন পুষ্পমালা। সেখানে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন লিপির সঙ্গে ঢুকে পড়ে কিছু আধুনিক অনুষঙ্গ, চেনা প্রতীক। তা দেখলে মনে হবে এও যেন কোনও সন্ধ্যাভাষা। তার আড়ালে রয়েছে রাষ্ট্রনীতি নিয়ে এক নারীর আদ্যন্ত শিল্পিত রাজনৈতিক বয়ান।
পুষ্পমালার কাজের মূল সুর নেশন/রাষ্ট্র। ‘ভারতমাতা’ সিরিজও সে-কথাই বলে। ঔপনিবেশিক ভারতে স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অবনীন্দ্রনাথ ‘ভারতমাতা’ সৃষ্টি করেন। ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে সে-ছবি নিঃসন্দেহে যুগসন্ধিক্ষণের এক নতুন বাঁক। কিছুদিন আগে দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুরের এক শিল্প উৎসবে তিনি Gauri Lankesh’s Urgent Saru-ও উপস্থাপন করেন। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত কন্নড় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের তাঁকে দেওয়া একটি পদ দর্শকদের সামনে রান্না করেন। তা করতে গিয়ে তিনি অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’-র অনুসরণে নিজেকে উপস্থাপন করেন। মজার ব্যাপার হল, পদটির রং গাঢ় লাল এবং তা ভাতের সঙ্গে দর্শকদের পরিবেশন করা হয়। পারফরম্যান্সটি দেখতে-দেখতে গৌরী লঙ্কেশ, টকটকে লাল ‘সারু’, অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’র হাতে ধরা ধানের ছড়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে গোটা পারফরম্যান্সটি ভীষণভাবে রাষ্ট্রের ইমেজ গঠনের ইতিহাসের দ্যোতক হয়ে ওঠে। সেই উপস্থাপনার আগে পুষ্পমালার সঙ্গে কথা বললেন স্রোতা দত্ত।
শুরু করি খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন দিয়ে। আপনার পরিবারে আপনার সব থেকে কাছাকাছি কে?
সে-অর্থে আমি কারোরই কাছের নই। আমি যে-দূরত্ব বজায় রাখি, তা হয়তো নয়; তবে ওই আর কি! আমার মা-বাবা পরলোকগত। আমার দাদা একজন ইঞ্জিনিয়ার। সে এইসব শিল্পচর্চার ধারেকাছে নেই। তাই…
আপনার মা তো নাটক করতেন, পুরুষ সেজে অভিনয় করতেন, আপনার মা কি কোনওভাবে আপনার অনুপ্রেরণা?
শুধু পুরুষ হিসেবে নয়… আসলে মা, অ্যামেচার থিয়েটার ভালবাসতেন। তাঁদের পেশাদার অভিনয়ের অনুমতি ছিল না। তাই লেডিজ ক্লাবের মধ্যেই অ্যানুয়াল ডে বা কোনও উৎসব… এই দুর্গাপুজোর মতো, যেখানে নাটক করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা সর্বসাধারণের জন্য নয়। সেখানে অন্যান্য মহিলারাও পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। মা বেশ লম্বা ছিলেন। তাই পুরুষের ভূমিকায় বেশি অভিনয় করতেন। কিন্তু সবটাই মহিলামহলে সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়াও মা ‘ভারতীয় নারী’, ‘ভারতের সেরা নারী’, ‘ভারতের পোশাক’ কিংবা ‘ভারতীয় কনে’র মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। আমাদের এসবের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতেন। তাছাড়া আমি নিজেও আমার ছোটবেলায় নানা রকম কাণ্ডকারখানার আয়োজন করেছি। তার মধ্যে নাটকও ছিল। তবে অভিনয়কে কোনওদিনই সিরিয়াসলি নিইনি।
এভাবে নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কি আপনাকে কোনওভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে? বিশেষত পরে যখন আপনি ফোটো পারফরম্যান্সকে নিজের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন?
সে-অর্থে উদ্বুদ্ধ করা যাকে বলে, তা হয়তো বলা যাবে না। ’৮৫ সালে পাশ করে বেরনোর পর, ’৯৫ বা তার আরও পর অবধি আমি ভাস্কর্য করে গেছি। ফোটো পারফরম্যান্স এসেছে অনেক পরে। আসলে সেভাবে দেখতে গেলে… আমার এমএ থিসিস সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মাস্কারেড, প্লে অ্যাক্টিং এইসবও আছে। আমি ভাস্কর্যই করছিলাম। নয়ের দশকের মাঝামাঝি, বলা ভাল ’৯৬ সাল নাগাদ আমার বন্ধু আর্শিয়া লোখণ্ডওয়ালা, তাঁর একটা গ্যালারি ছিল, সিনেমার কোনও একটা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সে প্রদর্শনীর কথা ভাবছিল। ও বম্বের শিল্পীদের সিনেমার উপর একটা করে কাজ দেওয়ার আবেদন জানায়। তখন আমি বম্বেতে থাকি। সে-সময়ে আমার ‘ফিয়ারলেস নাদিয়া’, তিন-চার দশকের হিন্দি সিনেমার মহিলা স্টান্ট ফিল্মস্টার, তাঁকে দুর্দান্ত লাগত। আমি তাঁর কয়েকটা ফোটো দেখেছিলাম কিন্তু একটাও সিনেমা দেখিনি। তো, নিখাদ মজার জন্য আমি ভাবলাম, আমি ওঁর মতো করে পোশাক পরে পোজ দিয়ে ছবি তুলব। আমার এক বন্ধু, তরুণ ফোটো-জার্নালিস্ট সে-সময়ে ফ্রিলান্স করত। ফোটো শ্যুটের জন্য একদিন আমরা গেলাম শিরিন গান্ধির গ্যালারিতে। আমার বন্ধু মিতা বশিষ্ঠ আমার মেক-আপ করে দিয়েছিল। এরা সবাই ফিল্ম-জগতের বন্ধু। আমার প্রাক্তন স্বামী ফিল্ম হিস্টোরিয়ান আশিষ রাজাধ্যক্ষক মোটামুটি দশ বছরের বিবাহপর্বের গোটাটাই ভারতীয় সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়ার কাজ করছিল, ফলে সিনেমা-জগতের প্রচুর বন্ধু ছিল। অবশ্য ব্যাঙ্গালোরেও ফিল্ম-দুনিয়ার বহু বন্ধু ছিল। অবশ্য সে-সময়ে আমি আবার সিনেমা একেবারে পছন্দ করতাম না। খুব বিরক্ত লাগত। বিরোধিতা করতাম। মনে করতাম শিল্পের সব ফর্মের থেকে সিনেমা নিজেকে বড় ভাবে। সব মাধ্যমকে একত্রে এনে একটা জগৎ তৈরি করে। যাই হোক, আমি সে-সময়ে কয়েকটা ফিল্ম রোল তুলি। পাশাপাশি, ব্যাঙ্গালোরে আমার স্টুডিও তৈরি হয়ে গেছিল, দুজনেই ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়ও করে ফেলেছিলাম। কয়েকটা ফিল্ম রোল তুলেই আমরা ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাই। কন্ট্যাক্ট প্রিন্ট দেখে আমার মনে হয়, প্রদর্শনীর জন্য শুধু একটা ছবি কেন? বরং এটাকে আরও বাড়িয়ে একটা সিরিজ করা যাক। ভাবছিলাম, কী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়! এখানে তো ছবিতে আমি একাই! ব্যাপারটা বেশ একঘেয়ে। এটার একটা গল্প দরকার। সেই সময়ে, মানে আটের দশকের শেষ দিক অবধি ‘হারিয়ে পাওয়া যমজ’ মার্কা ছবি বম্বে ফিল্মে একটা জনপ্রিয় বিষয় ছিল। ঠিক করলাম, এটাই হবে আমার গল্প। আমিই দুটো চরিত্র উপস্থাপন করব। এক বড় এবং নির্দয় শহরে তার জুড়ু্য়া, যে খারাপ, সেই ভ্যাম্পকে খুঁজতে আসে ফ্যান্টম লেডি। পুরনো হলিউড ফিল্মের নামানুসারে নাম দিয়েছিলাম, ‘দ্য ফ্যান্টম লেডি’। ছবি তোলা হলেও, আমি কিন্তু কোনও অক্ষরমালা ব্যবহার করিনি। তবে বম্বের সমস্ত আইকনিক জায়গাগুলো, বিশেষ করে বম্বের কেন্দ্রে, শহরের বৈশিষ্ট্যগত পুরনো অনেক স্থাপত্যে শ্যুট করেছিলাম। শিরিন গান্ধির একশো বছরের পুরনো পার্সি বাড়ি ও তার পাশের বাড়ি, এখন যেটা শাহরুখ খানের ‘মন্নত’, তখন খালি ছিল। ওটাও এক পার্সি পরিবারের। বলা যেতে পারে, বম্বে শহরকে উৎসর্গ করে এই কাজটা করেছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত যেটা হল, প্রদর্শনীর জন্য যে-ছবিটা করেছিলাম, একটা দুর্ঘটনার জন্য সেটা আর দেওয়া হল না। তবে পড়াশুনো, গবেষণা, স্টাইল— সেসব নিয়ে আশিসের সঙ্গে চিন্তাভাবনা-আলোচনা চলছিল। একটা ছিল অ্যাকশন ফিল্ম। নাদিয়ার ছবিগুলো প্রায় সবই কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো সেট আর প্রায় আলোহীন বি-গ্রেডের অ্যাকশন ফিল্ম। সেটা মাথায় ছিল। আর একটা, ফিল্ম নোয়া… ডিটেকটিভ থ্রিলার স্টাইল। মজার ব্যাপার হল, ইনডোর শ্যুটিং, কম আলো ইত্যাদি মিলিয়ে ফিল্ম নোয়া স্টাইল (এক বিশেষ ধরনের নেতিবাচক, ধবংসাত্মক সিনেমা, গত শতকের পাঁচের দশকে আমেরিকায় এই ধরনের থ্রিলার, গোয়েন্দা ছবি তৈরি শুরু হয়) পছন্দ হল। এটা সাইকোলজিকালও তো, ফলে ছবিতে অনেকগুলো পর্যায় তৈরি করে; তাই ভিলেন, ভ্যাম্প, নাচিয়ে, একটা অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার। সেই অর্থে এর কোনও ‘শেষ’ নেই যদিও!
বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষত যখন রামমন্দির নিয়ে এত মাতামাতি— সেই সঙ্গে এক দেশ-এক ভোট, এক ভাষা, এক ধর্ম… সবেতেই প্রায় রোডরোলার চালিয়ে একীকরণের রাজনীতি চলছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনার ‘ভারতমাতা’ সিরিজকেও কি hidden transcript, যাকে বাংলায় বলে সন্ধ্যা ভাষা, বলা যেতে পারে?
আসলে ভারতমাতাকে আমি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছি। বেশির ভাগই ভারতমাতার ঐতিহাসিক উপস্থাপন। আমার মনে হয়, গোটা দুনিয়ায়, ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে দেশমাতৃকা বা দেশের দেবীর এত রূপ। অন্যান্য বেশির ভাগ দেশেই তার একটাই ছবি বা চরিত্র। এখানে কালী ভারতমাতা, অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’, দুর্গারূপী ভারতমাতা, কোথাও গোমাতারূপী ভারতমাতা… এরকম বহু আছে। দ্যাখো, ভারমাতার ইমেজকে এভাবে ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট সমালোচনা হয়। অনেকেই মনে করে যে, এভাবে ভারতমাতা-সংজ্ঞাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিশেষত গৌরী লঙ্কেশের ক্ষেত্রে, ওঁকে তো খুন করে হিন্দুত্ববাদীরই! কিন্তু আমার জন্য ভারতমাতা এখন খুব ক্লিশে। সবাই একে ব্যবহার করে। অবনীন্দ্রনাথের নয়, কিন্তু জনপ্রিয় ভারতমাতা রানির মতো। মাথায় মুকুট, স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। কখনও সিংহের সামনে, কখনও ভারতের ম্যাপের সামনে। ভরতনাট্যম নাচের মতো কস্টিউম। আসলে এটা দেশকে চিনে নেওয়ার একটা সহজ জনপ্রিয় ইমেজ। আমিও এই বিভিন্ন রূপকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেছি। ফলে, হ্যাঁ। বলতে পারো, এটাও এক রকমের hidden transcript।
আপনার এক পারফরম্যান্সে দেখা যায়, স্টুডিও ব্যাকড্রপে আঁকা এক জমকালো রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। ভারতমাতার চার হাতের দু-হাতে পতাকা, দু-হাতে তিনি লাল উল বুনছেন। পাশে কন্নড় কবি মমতা সাগর দলিত-অবহেলিত মহিলা কবির কথা, তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা, গোটা দেশ জুড়ে যে-আধিপত্যবাদের হাওয়া উঠেছে, তার কথা বলছেন। আর ভারতমাতারূপী আপনি হাতের পাশে সাজিতে রাখা চূড়ান্তভাবে জট-পাকানো লাল উলের জট ছাড়াচ্ছেন। বর্তমান কালক্রমে এই গোটা পারফরম্যান্সকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ভারতমাতার হাতে পতাকাটা আমার সংযোজন (হাসি)। মূলগতভাবে এটা সমালোচনা। আসলে বিষয়টা যথেষ্ট জটিল। এটা ভারতমাতার ইমেজেরও সমালোচনা। একটা ধুন্ধুমার সেটে এক পৌরাণিক চরিত্র, যদিও ভারতমাতা মোটেই পৌরাণিক চরিত্র নয়। যাই হোক, সেই কবি (মমতা) এবং সে একজন স্কলারও, সে ভারতমাতাকে নিয়ে এসে স্থাপন করে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে মমতা প্রাণচঞ্চল, আধুনিক, নানা ভাবে, নানা ভঙ্গিমায় কথা বলে। সে ভারতমাতাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করে জিজ্ঞাসা করে ভারতমাতা কেন রানির মতো (যদিও আমি মনে করি না এই ইমেজ সবসময়ে রানির মতোই)। সেই সঙ্গে দেশে মহিলাদের অবস্থান, পরিস্থিতি ইত্যাদি। তারপর সে কন্নড় ভাষার প্রথম মহিলা জাতীয়তাবাদী কবি নাঞ্জাগুড় তিরুমালাম্বা সম্পর্কে বলে। তিরুমালাম্বা আলাদা কর্ণাটক রাজ্য (স্বাধীনতার পর), ভারতমাতা, কন্নড়মাতা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে কবিতা লিখেছেন। উনি বালবিধবা হওয়ায় নিঃসন্তান ছিলেন; স্কুলে পড়াতেন, দু-তিনটে পত্রিকার সম্পাদক, গোয়েন্দা গল্প লিখতেন। খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। পরে কী হল, পাঁচের দশকে এক পুরুষ লেখক প্রকাশ্যে তাঁর লেখাকে অপমানজনকভাবে নস্যাৎ করেন। চরম অপমানিত হয়ে তিনি অন্তরালে চলে যান। বহুদিন তাঁর খোঁজ মেলেনি। ধরে নেওয়া হয়েছিল, তিনি মৃত। আটের দশকে কয়েকজন কন্নড় নারীবাদী রীতিমতো অনুসন্ধান করে যখন তাঁকে পুনরুদ্ধার করে, তখন তাঁর বয়স নব্বইয়ের কোঠায়। এই ঘটনার কথা… দেশে মহিলাদের অবস্থার কথা… তাছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে নেহেরু প্রশ্ন তুলেছিলেন, ভারত তো দরিদ্র, তার প্রতীক এত সম্পদশালী, বিত্তবান হয় কী করে! পারফরম্যান্সটা এভাবে শেষ হয়। তো দেখা যাচ্ছে যে, এটা আসলে একটা আদর্শ। সবাই তাঁর মতো হবে, তাঁর মতো সাজবে, চলবে। কিন্তু আমার ভারতমাতা বসে-বসে নির্বিকারভাবে উল বোনে।
উলের রং লাল কেন?
এই মাদার ইন্ডিয়াটা তো অনেকদিন ধরেই চলছে! ভারতমাতা লাল রঙের উল বুনছে, এভাবে নিজেকে দেখার ইচ্ছে ছিল। ভাবলাম একটা এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য লাল রংটা ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত। এই বিপ্লব নিয়ে তো বহু গল্প আছে! মহিলারা বসে আছে… গিলোটিন… তাই লাল উল। কিন্তু দেখার পরে লোকেরা বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছে। কেউ বলেন উল বোনা ব্যাপারটাই তো ঔপনিবেশিক; এ তো ভারতের নয়, বোনার কাজটা তো বিদেশের ব্যাপার। কেউ বলেন, দেশ কী করে গৃহবধূর মতো কাজ করে! প্রশ্ন উঠে গেল, এই ভারতমাতা আসলে কে? ইতিহাস তো আসলে ধারাবাহিক রক্তারক্তির ইতিহাস। সেভাবে লালা উল বোনাটা ইন্টারেস্টিং হয়।
আপনি ‘Body Politic’ নিয়ে কী বলবেন?
ওটা আসলে আমার একটা প্রদর্শনীর নাম। তবে এ-ব্যাপারে আমি একটা কথা বলতে চাই। আমার মনে হয়, আমার সব কাজকেই ‘বডি পলিটিক’ বলা যায়। এটা শব্দ নিয়ে খেলা, যেখানে আমার শরীর অর্থাৎ বডি এক রাজনৈতিক আমি। আর সমাজ বডি পলিটিক।
জানি না ঠিক বোঝাতে পারব কি না, তবে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, ‘বডি’ বলতে কি আপনি নারীত্ব বোঝেন না কি নারীবাদ?
ধরতে পারছি না অবজেক্ট বলতে কী বোঝাচ্ছ। নারীবাদ সবসময়ে একটা সাবজেক্ট। পারফরম্যান্সটাই তো সাবজেক্টিভিটির। পারফরম্যান্সের কারণটাও তাই। নারীবাদী পারফরম্যান্সটা দাঁড়িয়ে আছে এর আগে পুরুষদের করা যত কাজ হয়েছে, তার বিপ্রতীপে। সেখানে নারী তো বস্তুই। এখন তাঁরা বিভিন্ন সময়ের মহিলা শিল্পীদের ‘আবিষ্কার’ করছেন। কিন্তু যখন এক নারী নিজে ‘বিষয়’ হয়ে ওঠে, তখন সে তো শুধু বস্তু নয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে আমি শিল্পী এবং চরিত্র। আসলে সে-অর্থে যে-কোনও ‘টাইপ’, মানে এই ধরো আর্কিটাইপ, স্টিরিওটাইপ… যে-কোনও বর্গবিন্যাস আমাকে আকৃষ্ট করে। যা ঐতিহ্য-পরম্পরা বলে আমরা জানি, শিল্পী হিসেবে সেগুলোকে নানাভাবে নাড়া দিয়ে অস্থির, বিনির্মাণ করতে ভাল লাগে। দ্যাখো, আমি যখন নিজেকে নারীবাদী বলছি, তার মানে কিন্তু শুধু নারী নয়; তবে হ্যাঁ নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আছে। আমার সাম্প্রতিক ভাস্কর্যের বিষয় কিন্তু মহিলা সম্পর্কিত কোনও বিষয় নয়। এটাও এক ভিন্ন ধারার বডি পলিটিক। শিল্পী হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা, ক্লাসঘরের নারীবাদ (academic feminism) আর আন্দোলনমূলক নারীবাদ (activist feminism) আমাদের কাছে খুব সীমাবদ্ধ আর পীড়াদায়ক। এ-বিষয়ে আমাদের নিজস্ব একটা ঘরানা আছে। আমাদেরটা অনেকটাই আলগা এবং মজার। মেয়েরা শিকার, এ-ব্যাপারটা আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। আমার কাজ শ্লেষাত্মক, রসিকতায় মোড়া। সত্যি-মিথ্যা, আসল-নকল— এ সবই থাকে। কোনওটাই প্রাতিষ্ঠানিক মত অথবা বাদ নয়। সবটাই আমার নিজের কথা। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক-রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। কোনও রাজনৈতিক বা নারীবাদী দল থেকে আমি শত হস্ত দূরে। কারণ প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য সমস্যা। যাঁরা সত্যিকারের কাজ করেন, তাঁদের কথা বলছি না, তবে একাধিক নারীবাদী সংগঠন আসলে শিল্পীদের খুব একটা পছন্দ করে না। সারাক্ষণ একটা টানা-পড়েন চলে। আমাদের এলিটিস্ট মনে করা হয়। কিন্তু যদি হঠাৎ টাকার দরকার পড়ল বা কিছুর আয়োজনে ফান্ডিং দরকার, তখন আমাদের কথা মনে পড়ে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদ নারীর অধিকার, বঞ্চনা, স্বাধীনতা, স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন করতে-করতে কি কোথাও পিতৃতন্ত্রকেই ঘুরিয়ে সাহায্য করে? বিশেষত যখন বহু পুরুষও এই পিতৃতন্ত্রের শিকার? আপনি কী মনে করেন?
চারপাশে কী ঘটছে সে-ব্যাপারে আমি সজাগ। এর নানা দিক আছে। তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি, কোভিডের সময়ে, যখন অনলাইন কথাবার্তা বেশ ভাল রকমের চলছিল, তখন আমি একদিন তিনজন দলিত নারীবাদীর আলোচনা শুনছিলাম। বিষয়টা ছিল উচ্চবর্ণের নারীবাদ। তাঁরা তেড়ে গালাগাল দিচ্ছিলেন। আমি উচ্চবর্ণের। তো আমি দেখলাম, খুব একটা আজগুবি ব্যাপার চলছে (হাসি)। উচ্চবর্ণের নারীবাদকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার কথা চলছিল। হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রাম না কোথায়, চন্দ্রশেখর আজাদ (ভীম আর্মি) ও সাঙ্গপাঙ্গদের গোঁফ মোচরানোর ছবি, এক উচ্চবর্ণের নারীবাদীর মতে, একটা হুমকি। কারণ উত্তরপ্রদেশে দলিত পুরুষের গোঁফ রাখা সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। সে-ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই তিন নারীবাদী আরও তেড়ে বলতে লাগলেন, এসব বলার তিনি কে, দলিতদের ব্যাপারে নাক গলানোর উনি কে ইত্যাদি। কথা হল, কেউ কারো সাহায্য বা সমর্থন প্রত্যাখ্যান করতেই পারে। সমালোচনাও করতে পারে। কিন্তু নস্যাৎ করাটা? বিষয়টা সব দিক থেকে বিবেচনা করা উচিত। আমার কাজ, Native Woman of South India করতে গিয়ে জনজাতি-উপজাতি-বর্ণ নিয়ে যে-রাজনীতিটা চলে, তা নিয়ে খুব সতর্ক ছিলাম। তবে একটা কাজ যেভাবে করা হয়, তা তো সবসময়ে সেভাবেই গ্রহণীয় হয় না! আমি জানি, কালো রং নিয়ে সমস্যা আছে। জানো তো যে, পশ্চিমে সাদা লোকের কালো মেক-আপ করা একেবারেই চলে না। কিন্তু বাদামি চামড়া নিয়ে সে-সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তো আবার সে-রঙেও আপত্তি। আমি কিন্তু কিছুকে অসম্মান করছি না। আমি যখন নিজেকে এক নিম্নবর্গের চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করি, আমি সেই নিম্নবর্গের ইতিহাসে আলোকপাত করার চেষ্টা করি। এই কাজে আমি আত্ম-ঔপনিবেশিকতার কথা বলেছি। নিম্নবর্গের ইতিহাস কিন্তু শুধু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যে-উপনিবেশবাদ চলছে, আমি দুটোকেই ধরার চেষ্টা করেছি।
সমকালীন নারীবাদী শিল্পীদের সম্পর্কে আপনার মত কী?
সোজা কথায়, যে-মহিলা ছবি আঁকছেন বা অন্য কিছু করছেন, তিনিই নারীবাদী শিল্পী। তাঁরা শিল্পচর্চায়, নারীবাদী শিল্পীদের ইতিহাস বহন করছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের নারীবাদী শিল্পী হিসেবে ঘোষণা করেন না। আমি মনে করি, কোণঠাসা হয়ে যাবেন ভেবে অনেক শিল্পী নিজেকে ‘নারীবাদী’ বলেন না। তবে আমি তা করি না। প্রথম থেকেই আমি নিজেকে নারীবাদী বলেছি। মনে করি, আমি চর্চার কেন্দ্রে। বেড়ার ধারে নই। আসলে দেশে পুরো ব্যাপারটাই বেশ উৎসাহজনক। কেউ যদি ভাল কাজ করে, তার কাজ নিয়ে চর্চা হবে। আমরা পরস্পরের সাহায্যে সবসময়েই এগিয়ে আসি। নানাভাবে সাহায্য করি। এসব কথা কেউ জানতেও পারে না।
তাহলে আপনি যে ‘গোদি আর্টিস্ট’-দের কথা বলেছেন?
হ্যাঁ! বলেছি। অনেকেই আমাকে বলেছেন, যাঁদের কথা আমি বলেছি, তাঁরা অনেকেই তো আমার খুব ভাল বন্ধু, তাহলে তাঁদের এত কঠোর সমালোচনা কেন? আমার কথা হল, আমি স্তম্ভিত! কারণ ওরা আমার ভাল বন্ধু। এ-ব্যাপারে ছোট-ছোট ছেলেপিলেরা বলেছে, এইসব শিল্পীদের বয়কট করা উচিত। কিন্তু কীভাবে করবে? কারণ এদের অনেকেই প্রতিষ্ঠানের সুনজরে। অনেকেরই সেই রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না। ধরে নিয়েছিল, আর পাঁচটা প্রদর্শনীর মতোই এটা একটা। আমার ধারণা, তাদের একটা শিক্ষা হয়েছে। আবার যদি করে, তবে আবারও কঠোর সমালোচনা হবে।
ছবি সৌজন্যে : পুষ্পমালা এন