সাধনার চারাগাছ
ছবির শুরুতেই লোকটা ঘুম থেকে ওঠে। তার গোটা রুটিনটা আমরা দেখি। আমরা বুঝি, তার কাজ হচ্ছে টোকিওর কিছু জন-শৌচাগার পরিষ্কার রাখা। সে সেই কাজ অতিরিক্ত যত্ন নিয়ে করে। তার একজন তরুণ সহকর্মীকে দেখি এই নিয়ে ব্যঙ্গ করতে। আমরাও একটু অবাক হই, লোকে যাতে পেচ্ছাপ-পায়খানা করে, সে-জিনিস হাত দিয়ে অমন ঘষে-ঘষে পরিষ্কার করছে একটা লোক সেধে? এমনকি যেখানে মানুষের চোখ যাবে না, সেখানটাও আয়নায় দেখে নিয়ে পরিষ্কার রাখে। তার নিজস্ব কিছু যন্ত্রপাতি অবধি আছে, এই কাজ ভালভাবে করার জন্য। টিফিন খায় সে একটাই গাছের তলায় বসে। একই টিফিন খায়, স্যান্ডউইচ। রোজই এই সময়ে গাছটার কিছু ছবি তোলে সে, গাছের পাতা, আর তার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া রোদের টুকরো তার ক্যামেরায় বসে যায়, সে আবার গাছের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে একটু ধন্যবাদ দেয়। কাজের শেষে সে একটা খাবার দোকানে যায়, কী খাবে তাও একেবারে বাঁধা, সেখানে টিভিতে রোজই রাগবি ম্যাচ চলে। বাড়ি ফিরে লোকটা বই পড়ে, পড়তে-পড়তে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন তার স্বপ্নের ছিটেফোঁটা আমরা দেখতে পাই, সেগুলো বিরাট কিছু নয়, হয়তো সারাদিনে যা দেখেছে তারই খুচখাচ। পরের দিন আবার একেবারে একই সময়ে, রাস্তার ঝাঁট দেওয়ার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়।
প্রায় কোনও কথাই বলে না লোকটা। তার কথা বলার কেউ নেইও, আর যাতায়াতের পথে যদি-বা কেউ তার সঙ্গে কোনও কথা বলে, সে হেসে বা হুঁ-হাঁ করেই সেরে দেয়। মনে হয়, সে যেন তার জীবনটাকে একটা সাধনার মতো করে নিয়েছে। যখন-তখন সে এক টুকরো আকাশ দেখতে পেলেই, এমনকি বাথরুমে কাচের মধ্যে দিয়েও, তাকিয়ে থাকে এবং মুখে প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বাইরে প্রথম পা রেখেই সে ওপরদিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় ও মৃদু হাসে। কাজে যাওয়ার ও ফেরার পথে গাড়িতে গান শোনে ক্যাসেট চালিয়ে। আগেকার ক্যাসেট, আগেকার গান, ষাট বা সত্তর দশকের। রোববার দিন সে তার তোলা ছবিগুলো ডেভেলপ করতে দেয়, আর আগের ফোটোগুলো নিয়ে আসে, তারপর ঝাড়াই-বাছাই করে। জামাকাপড় কাচতে দেয়। নিজে পরিষ্কার হয় একটা গণস্নানের জায়গায়, সেখানে দুজন বৃদ্ধ প্রায়ই তার সঙ্গেই স্নান করে। কাজের দিন সে যখন টিফিন খায় পার্কের বেঞ্চে বসে, তখন পাশের বেঞ্চেই এক তরুণী রোজ টিফিন খায়, তার মুখ দেখলে মনে হয় এখুনি কেঁদে ফেলবে, খুব একটা দুঃখের কথা বলার আছে, দুজনের চোখাচোখি হয়, কিন্তু কেউই এগিয়ে কথা বলে না। লোকটাকে দেখলে মনে হয়, গাছ তার বন্ধু, আকাশ তার বন্ধু, কেউ যাকে পাত্তা দিচ্ছে না সেই রাস্তাঘাটে অঙ্গভঙ্গি করা পাগলটা তার বন্ধু, এবং সে এইটুকুতেই তুষ্ট। বা, সে এটাকে ‘এইটুকু’ মনে করে না। পৃথিবীটাকে রোজ দেখতে পাওয়া ও বেঁচে থাকা তার কাছে এক অনবদ্য উপহার। সেই মনোভঙ্গির অনুশীলনই তার সাধনা।
লোকটার বাড়িতে টিভি নেই। মোবাইল ফোন একটা আছে, তা শুধু কাজের সূত্রেই ব্যবহৃত হয়। লোকটা যে-বই পড়ে, তা খুব তরল নয়, তা লিখেছেন উইলিয়াম ফকনার, প্যাট্রিসিয়া হিগস্মিথ বা আয়া কোডা। বাড়িভর্তি বই। আমরা তার অতীত সম্পর্কে কিচ্ছু জানতে পাই না, কিন্তু আমাদের মনে হয়, লোকটা সামান্য নয়। প্রথমত, দরিদ্র লোকের বহু ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক, এ-লোকটা যেন প্রসন্নতার ব্রত নিয়েছে। আবার হাসিখুশি লোক বলতে আমরা বুঝি সারাক্ষণ আড্ডা মারবে, এর-তার পেছনে লাগবে, এখানে-সেখানে চরকিপাক খাবে। এ-দিনের প্রায় পুরো সময়টা চুপ করে থাকে। যদিও একটা বার-এ গিয়ে মাঝে মাঝে মদ খায়, এবং সেখানকার মালকিন তার সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলে, কিন্তু সেখানেও একটু মুচকি হাসি ছাড়া বিশেষ ভাব-বিনিময় তাকে করতে দেখা যায় না। সে ‘স্পটিফাই’ কাকে বলে জানে না, সে কোনও চলতি বিনোদনে নেই, সে প্রকৃতির অনন্ত সম্ভারে খুশি, এবং সে বস্তুগত প্রাচুর্যকে ও তার আকাঙ্ক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে। তার কিছু গাছ আছে, কোনও বিপন্ন চারাগাছ দেখলেই সে তুলে এনে বাড়িতে রাখে, আর তাদের জল দেওয়ার সময়েও তার স্পষ্ট স্নেহ বোঝা যায়। ‘পারফেক্ট ডেজ’ ছবিটি (চিত্রনাট্য: উইম ওয়েন্ডার্স ও তাকুমা তাকাসাকি, পরিচালনা: উইম ওয়েন্ডার্স, ২০২৩) প্রথাগত কৌটো তুবড়ে একটি চরিত্রকে দাঁড় করায়, যে মেথরের কাজ করে হাসিমুখে, এবং যে ইন্টেলেকচুয়াল বই পড়ে প্রতিদিন।
একদিন তার ভাগ্নি আসে তার সঙ্গে থাকতে, আসলে মা’র সঙ্গে ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছে। সে মামার সঙ্গে সকালে বেরোয়, মামাকে দ্যাখে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে কমোড পরিষ্কার করছে, বা কেউ বাথরুম ব্যবহার করতে এলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে বিনীত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছে, ফের গিয়ে পরিষ্কার করবে। মামার সঙ্গে বসে সে বাগানে স্যান্ডউইচ খায়। মামার বইগুলো পড়ে। আমরা কথাবার্তায় বুঝতে পারি, লোকটার বোন তাকে মোটে পছন্দ করে না। ভাগ্নি বলে, তোমার কথা উঠলেই মা কথা ঘুরিয়ে দেয়। মা বলে, তোমার জগৎটা একেবারে আলাদা। লোকটা বলে, অনেক জগৎ আছে। কখনও তারা কাছাকাছি আসে, কখনও দূরে যায়। ভাগ্নি বলে, এই নদীটা কোথায় গেছে মামা, সমুদ্রে? যাবে? মামা বলে, পরের বার। ভাগ্নি বলে, তার মানে কবে? মামা বলে, পরের বার মানে পরের বার, আর এখন মানে এখন। এসব কী? জেন দর্শন? কে জানে! কিন্তু আমরা বুঝি, লোকটা কিছু বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকছে, এবং সেখানে তার রক্ষণ খুব দৃঢ়। বোন যখন মেয়েকে নিতে আসে, আমরা দেখি সে গাড়িতে এসেছে, এবং একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। মানে, বোন বেশ বড়লোক। সে দাদাকে বলে, বাবার এখন স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, কাউকে চিনতে-বুঝতে পারছে না, বাবা আর আগের মতো ব্যবহার করে না। তুই একবার নার্সিংহোমে দেখতে যাবি তো? লোকটা না-বাচক মাথা নাড়ে। বোন এও জিজ্ঞেস করে, তুই কি সত্যিই বাথরুম পরিষ্কার করিস? লোকটা হ্যাঁ-বাচক মাথা নাড়ে। ওরা চলে যাওয়ার পর, লোকটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। সিনেমায় এই প্রথম।
কেন? তবে কি তার রক্ষণ গলে ঢুকে পড়ে অনুতাপ বা হতাশা? তবে কি তার অতীতে প্রবল বেদনার ক্ষতের সেলাই খুলে গেছে? কী হয়েছিল? বাবার সঙ্গে ভয়াবহ মতবিরোধ ও ঝগড়া? প্রেমের সংকট? কোন প্রবল অভিমানে সে সচ্ছল জীবন কর্তন করে একটা সামাজিক সম্মানহীন জীবনে প্রবেশ করেছে? কেন তার এই সন্ন্যাস-প্রতিজ্ঞা? সে কি একজন অধ্যাপক ছিল, বা লেখক, এখন শুধু বই ও গাছের ছবি অবলম্বন করে যে নিজের বাঁচাটা তৈরি করে নিয়েছে? এ-ই কি তার চর্চা: নিতান্ত যা প্রয়োজনীয় তার বাইরে হাত বাড়াব না, সব অতিরেকের বিরুদ্ধে থাকব? আমরা লক্ষ করি তার নিজ কাজের প্রতি প্রাণপণ নিবেদন, আর অবাক হই। এত তুচ্ছ কাজ, ঘৃণ্য কাজ, শারীরিক ভাবে যা বিশ্রী প্রতিক্রিয়া জাগায় এমন কাজ, তাকে এই অতন্দ্র মনোযোগে ও অনাবিল আনন্দে করে যাওয়ার মধ্যে কি ধ্যান ও প্রায়শ্চিত্ত মিলেমিশে আছে? অথবা নিজেকে শিক্ষিত করার এক টানা দৈনন্দিন প্রকল্প চলেছে? নিজেকে সংযত ও নিরভিমান করার, নিজেকে ত্যাগী ও অনাসক্ত করার ব্যায়াম? অবশ্য অনাসক্ত বলা ঠিক নয়, বলা যায় চলতি সম্পদে নিরাসক্ত, প্রতিষ্ঠিত হুজুগের প্রতি নিস্পৃহ। হয়তো ওই যৎসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে যাপনের মধ্যে চলতি পথ ছেড়ে যাওয়ার ও নিজ পথ খননের (এবং তাতেই স্থিত থাকার) প্রয়াস। কিন্তু শেষ শটে দেখা যায় গাড়িতে গান চালিয়ে লোকটা কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে। একটা টানা জয়ের গল্প তাহলে নয় এটা? এতে এক স্বেচ্ছানির্বাসিত মানুষের অল্পময় জীবনের একবগ্গা জয়গান গাওয়া হয়নি? সেও একটা নশ্বর মানুষ, যার স্মৃতি এসে হানা দেয়, যাকে পূর্বজন্ম থেকে অন্য লোকেরা এসে ফের বিক্ষত করে দিয়ে যায়, সে তার প্রায়-দৈব ভারসাম্য হারিয়ে মাঝেমধ্যে পড়েও যায়?
তা যেতেই পারে, সে কিছু সুপারহিরো নয়, কিন্তু তার এই জীবন নির্বাচনের মধ্যেই অনেকটা জয় রয়েছে, যাকে ওই তাৎক্ষণিক পরাজয় এসে টসকাতে পারে না। যে পড়াশোনা-জানা নাগরিক মনে করেছে: আমি সব আত্মীয় ও পরিচিতদের থেকে, সর্বক্ষণ কথা বলা মানুষদের কোলাহল থেকে, তথাকথিত মর্যাদাময় কাজ থেকে, পৃথিবী এখন যা নিয়ে ফুসকায়িত ও মাতোয়ারা তা থেকে, দূরে, নিজস্ব কুঠুরিতে, নিজের জীবন গড়ে তুলব একদম একার শর্তে— তার প্রস্থানই তাকে জয়ী করেছে। সিনেমা জুড়ে তার নিয়ত অবলোকন ও মুখে প্রায়ই হাসি ফুটে ওঠা বুঝিয়ে দেয়, তার এই অভিযান তাকে বিষাদের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়নি। এই ছবিটা এক স্বতন্ত্র মানুষের কথা বলে, তারই মতো ধীর, অনুচ্চ স্বরে, এবং চলেও তাড়াহীন, তারই মতো, কিন্তু শেষে তার মনখারাপ ও হাসি পাশাপাশি রেখে দেয়।
বাথরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ পায় লোকটা একদিন, একটু আড়ালে লুকিয়ে রাখা। তাতে কাটাকুটির ছক আঁকা, আর মধ্যিখানে একটা গোল্লা দেওয়া। লোকটা একটা ঘরে একটা ঢ্যাঁড়া দিয়ে কাগজটা আবার সেখানেই রেখে দেয়। পরেরদিন দ্যাখে আবার আরেকটা ঘরে গোল্লা দেওয়া। অদেখা দুই মানুষের এই খেলা চলতে থাকে। একবার সেই অচেনা লোক কাগজে লিখে তাকে ধন্যবাদও দেয়। হয়তো সেই লোকটি আরেকটি একা। হয়তো এই খেলা তাদর জীবনে একটা অপ্রত্যাশিত আলো। আবার যখন আমাদের লোকটার সঙ্গে আলাপ হয় বারের মালকিনের প্রাক্তন স্বামীর, যার ক্যানসার হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে, লোকটা দিব্যি ছোটদের মতো খ্যালে তার সঙ্গে, পরস্পরের ছায়াকে তাড়া করে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়ার খেলা। ঠিকই, যখন অফিস থেকে বলা হয় তোমাকে অন্য লোকের পুরো কাজটাও করতে হবে, দিনশেষে লোকটা রেগে ওঠে, বা বোন চলে যাওয়ার সময়ে বিকল্প জীবনের কথা ভেবে কেঁদে ফ্যালে, সে বীতস্পৃহ নিরুদ্বিগ্ন দুঃখজয়ী হতে পারেনি, কিন্তু বড় কথা তার চেষ্টা, তার স্রোতবিরুদ্ধ যাপন। তা ছায়াযুদ্ধ নয়। তার মধ্যে বেঁচে আছে খেলার আনন্দ, রোদছায়ার বিতরণের ছবি তোলার বিস্ময়, প্রতিদিন চোখ খুলে আরও একটি দিন বরাদ্দে পাওয়ার কৃতজ্ঞতা। তার সাধনার কারণ ও পূর্বেতিহাস বোঝাতে পরিচালক উৎসাহী নন, তিনি আমাদের এই উন্মত্ত ধাবমান বিশ্বে এক মানুষের একচর্যা দেখাতে উৎসাহী। যে সারল্য ও নিঃসঙ্গতার আয়ুধেই মালিন্যের মোকাবিলার পরিকল্পনা করেছে।