বড়খুকি – বিরজাবালা
হালকা বয়সে বিধবা হয়ে বাপের ঘরে ফিরে না এলে, বড়খুকি বিরজাবালার কদর হত সবচাইতে বেশি। বিদ্বান স্বামী এবং সম্পন্ন ঘর, দুই-ই তো সে পেয়েছিল। স্বামীর উৎসাহে লেখাপড়া শুরু করাতে তার স্বামী নাকি জাঁক করে বলতেন যে, এই মেয়ে ইংরেজদের ঘরে জন্মালে বই লিখে নাম করত। কালাজ্বরে যখন তার দুই দাদাই চলে গেল, তার কিছুমাস পরে ওই একই জ্বরে চলে গেল বিরজার স্বামীও। না হল সন্তান, না হল তার লেখাপড়া। স্বামী চলে যাওয়ার পর শ্বশুরঘরে থেকে যেতেই পারত, কিন্তু সে ফিরে এল বাপের ঘরে; আর সে-ই যে এল, কোনও দিন আর ও-মুখো হল কই! একই ঘরে থান পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল, দুই জা এবং এক ননদ; সকলেরই প্রায় একই বয়স, ওই আঠারো-উনিশের এদিক-ওদিক। শ্বশুরমশাই অবশ্য বাবাকে ডেকে পাঠিয়ে, স্ত্রী-ধন হিসেবে বিরজার বিয়ের সামান্য যা গয়না, সেগুলো তাঁর হাতে দিয়েও দিয়েছিলেন; এমনকী ওঁদের দেওয়া আশীর্বাদির দু-গাছা কঙ্কণ এবং অন্যদের দেওয়া মুখ-দেখানি গয়নাগুলোও; সেইসঙ্গে এককালীন কিছু টাকাও। বেশ কয়েক বছর যোগাযোগও রেখেছিলেন তাঁরা; বাগানের আম, চাষের চাল, সর্ষে, কড়াই ছাড়াও, বিরজার নাম করে একেবারে নিয়ম করে এ বাড়িতে আসত একজোড়া নতুন থান এবং গামছা। প্রথমবার পাঠানো ওই থান-জোড়া দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন বিরজার মা।
বিরজা ছিল ওই বাড়ির সেজোছেলে আদ্যনাথের বউ; বড় দুই ভাসুর উড়িষ্যার নীলগিরি এস্টেটে এক জমিদারের সেরেস্তায় কাজ করতেন; বাড়ি আসতেন ছুটিছাটায়। বিরজার স্বামী, ওই আদ্যনাথই যা বাড়িতে থেকে চাকরি করত। গারুলিয়া মিল ইস্কুলের মাস্টারি পেয়ে শ্যামনগরের পৈতৃক বাড়ি থেকে হেঁটেই যাতায়াত করত সে; সন্ধেবেলা স্ত্রী বিরজা এবং তার নিজের দুই দাদার ছেলেমেয়েকে নিয়ে পড়তে বসাত প্রবল উৎসাহে। বইপত্তর এবং স্লেট-খাতা, সে সবও নিজের খরচাতেই যোগাড় করত আদ্যনাথ। এমনই বাসনা ছিল আদ্যনাথের যে, তার বড়দার খোকা যখন ইস্কুল যাবে, সেই ক্লাসের পড়াগুলোই বাড়িতে বসে শিখে নেবে মেজদার খুকি এবং বিরজা। এমনকী এমন স্বপ্নও তার ছিল যে, খুকির বিয়ে হয়ে গেলেও, বিরজার পড়ায় যেন ছেদ না পড়ে। খোঁজে ছিল যে, বিরজাকে কোনও ভাবে প্রাইভেটে বি এ পাশ দেওয়ানো যায় কি না!
ঋতুমতী হওয়ার পর, স্বামীর ঘর করতে পাকাপাকি ভাবে বিরজা যখন শ্বশুরবাড়ি এল, আদ্যনাথ ভীষণ খুশি হয়েছিল এই দেখে যে, তখনকার সেই এগারো বছরের বালিকা বিরজা, বরের শেখানো লেখাপড়াটুকু একটুও ভুলে যায়নি। আদরে-সোহাগে আদ্যনাথ তাকে কাছে টেনে নিতেই, হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া লাবণ্যময়ী বিরজা তার আঁচলের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রুমালখানি বার করে দেখিয়েছিল; ছুঁচের ফোঁড়ে নকশা করে লেখা তারই নাম— ‘আদ্যনাথ’। বরের মুগ্ধ চাহনি দেখে বিরজা তার স্বামীর হাতখানি টেনে নিয়ে চুম্বন করে, নিজের ডান হাতের তর্জনী বুলিয়ে লিখেছিল— ‘আমার প্রাণনাথ’। স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যেমন সে শিখে নিচ্ছিল সন্ধি-সমাস কিংবা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ, তেমনই আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে বিরজা চিনছিল তার নিজের শরীরের বিহ্বল উচ্ছ্বাস; কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠার বর্ণমালা। মাঝে একবার বাপের বাড়ি গিয়েছিল বটে, কিন্তু ছটফট করে ফিরে এসেছিল আদ্যনাথের কাছেই। আদ্যনাথ কৌতুক করে বলেছিল, ‘পড়াশোনায় দেখছি বেজায় মন! লেখাপড়ার কামাই হবে বলেই না ফিরে এলে!’
‘তাই তো! খোকা-খুকির মাঝখানের আসনটা তো গুরুমশায়ের আবার ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকছিল!’
‘আমার ইস্কুলের ছাত্রদের যদি এর অর্ধেক দরদও থাকত এই গুরুমশায়ের ওপর, আহা!’
‘ঠিক আছে, কাল ভোর না হতেই দিয়ে এসো বাপের ঘরে।’
‘এসেই যখন পড়েছ তখন তো আর ছাড়ান নেই বউ! একটু-আধটু সংস্কৃতও শিখতে শুরু করো তা হলে!’
‘জানি জানি, তুমি একজন মস্ত পণ্ডিত; শুধু টিকিটাই যা নেই!’
‘শুধু কি টিকি! হাতে ছোপটি, নাকে নস্য, মাথায় টাক, গায়ে গামছা— এসব-ও তো নেই!’
লণ্ঠনের আলো নিভিয়ে দিয়ে, আদ্যনাথের মাথার ঘন চুলে আঙুল ডুবিয়ে, লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল বিরজা। বিরজাকে বুকের কাছে টেনে এনে চুম্বন করল আদ্যনাথ, তার ঘাড়ের কাছে লতিয়ে থাকা রেশম রেশম চূর্ণকুন্তলে; ঝুনঝুনি লাগানো কাঁটাগুলো একে একে টেনে বের করে, এলো করে দিল তার খোঁপার বাঁধন; একঢাল ঢেউ খেলানো চুলে সাজানো ছোট্ট কপালে, জ্বলজ্বল করছে তেলসিঁদুরের গোলা-টিপখানি; আদ্যনাথ দেখল যে, দিনান্তের কোনও ক্লান্তি বা নালিশের লেশমাত্র নেই বিরজার গভীর দৃষ্টিতে। বালিশের তলা থেকে একটা মোড়ক বার করে বিরজার হাতে দিয়ে আদ্যনাথ বলল, ‘গুরুমশায়ের দেওয়া ফার্স্ট প্রাইজ; তোমার জন্য আনিয়েছি এক সেট ‘ফাবার কাস্টেল’ রঙিন পেনসিল, বিলিতি।’
‘লাল, নীল কপিংয়ের সঙ্গে এমন গাঢ় সবুজ!’
‘বাংলা, ইংরেজি আর সংস্কৃত পড়া অভ্যাস করবে; এই লাল, নীল এবং কপিংয়ে…’
‘আর সবুজটা! ওটা দিয়ে কী লিখব?’
‘কেন! চারধারে বাহারি নকশা এঁকে তার মধ্যে গাঢ় সবুজে লিখবে, ‘আদ্যনাথ— যে আমার কেউ না!’
২.
বিরজার বিয়ে হয়েছিল শ্যামনগরে। সম্বন্ধ করেছিলেন হরশঙ্করের মা, হেমলতা কাকিমা। হেমলতা নিজে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে হলে কী হবে, তিনি তাঁর মায়ের মতোই লেখাপড়া ভালবাসেন; মায়ের ধারায় কবি না হলেও, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সকলের বিয়ের ছড়া লেখেন; বাচ্চাদের নামকরণ করেন; লাল শালু বাঁধানো খাতায় রোজকার হিসেবও লেখেন কী নিপুণ করে! অপূর্ব হাতের লেখায়, চিঠিও লেখেন অনেক; বিরজা অবাক হয়ে দেখত যে, তাঁর বাড়ির ডাকবাক্সটা নিত্য-আসা চিঠি এবং পত্রপত্রিকায় সব সময় কেমন উপচে থাকত। সম্বন্ধ করার সময়ে কথাচ্ছলে হেমলতা জানিয়েছিলেন যে, ওই পাত্র আদ্যনাথ শুধু যে ইংরেজিতে পাশ দিয়েছে তা-ই নয়, মুলাজোড়ের দর্পনারায়ণ কুশারীর ছেলে গোপীনাথের স্থাপন করা সংস্কৃত কলেজ থেকে আদ্য-মধ্য পাশ দিয়ে উপাধিও পেয়েছে। আশৈশব হেমকাকিমাকে কাছ থেকে দেখে, বিরজার বড় সাধ হত ঘরসংসারের পাশাপাশি ওইরকম ভাবেই লেখাপড়ার মধ্যে ডুবে থাকার।
তরঙ্গদার মা চারুকেশীও এই পাড়ার বউ এবং হেমলতার বড়দিদি; কিন্তু তিনি একটু গম্ভীর স্বভাবের; সহজে মেশেন না। বিরজা তার মায়ের সূত্রে হেমলতাকে কাকিমা বললেও, তাঁর দিদিকে কিন্তু মাসিই বলে; কারণ তিনি হরশঙ্করের বড়মাসি। সেই সূত্রেই তরঙ্গদা বা চারুমাসিমাকে সে চেনে মাত্র; তাঁদের বাড়িতে ভাই ভূতেশের যাতায়াত থাকলেও, বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে কিন্তু সে যোগাযোগ একেবারেই নেই; তাঁদের আদবকায়দা একটু সাহেবিও বটে। হেমকাকিমার ‘ডেপুটি’ বাবা কর্মসূত্রে পরিচিত ছিলেন আর এক ‘ডেপুটি’ বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গেও; তাঁর লেখা কিছু বই হেমকাকিমাকে পড়তেও দেখেছে বিরজা। হয়তো সেই সূত্রেই তিনি খোঁজ পেয়েছিলেন আদ্যনাথের। লেখাপড়ায় ভাল হয়েও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বা অফিসারের চাকরির দিকে না ঝুঁকে, ইস্কুলমাস্টার হতে চেয়েছিল সে; সাহেবদের উদ্যোগে এ অঞ্চলের উন্নতি শুরু হবার আগেই, দর্পনারায়ণ কুশারীর ছেলে গোপীনাথের উদ্যোগে এখানে ‘ব্রহ্মময়ী’ নামে কালীমন্দির স্থাপন করা হয়; কিন্তু ‘কুশারী’দের স্থাপন করা মন্দিরে পুরোহিতের কাজ করবেন না বলে বেঁকে বসেন ভাটপাড়ার পণ্ডিতেরা। জেদি গোপীনাথ যে শুধু বাঁকুড়া-বর্ধমান থেকে ব্রাহ্মণ পুরুত নিয়ে এলেন তা-ই নয়, এই মুলাজোড়েই স্থাপন করলেন একটি আবাসিক কলেজ, শুধুমাত্র সংস্কৃত চর্চার জন্য! এখান থেকে পাশ দিয়ে কিছু সময় সেখানেই কাজ করে আদ্যনাথ; পরে সে অবশ্য উচ্চ বেতনে যোগ দেয় গারুলিয়া মিল ইস্কুলে; ফলে হেমকাকিমার মতে আদ্যনাথ হল একজন মেধাসম্পন্ন, ব্যক্তিত্ববান এবং আদর্শবাদী পুরুষ। তা ছাড়াও তার পৈতৃক বাড়িটি একেবারে গঙ্গার পাড়ে না হলেও, ওই এলাকাতেই; পরিবারের পুরুষেরা সকলেই শিক্ষিতও বটে; বিরজার সঙ্গে যে আদ্যনাথের মনের মিল হবে এ-দিকটাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন হেমকাকিমা। আর তা তো হয়েও ছিল; এই আদ্যনাথ আর বিরজা— এরা দুজন যেন দুজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল। ফলে, তিনদিনের কালাজ্বরে আদ্যনাথের হঠাৎ মৃত্যুতে, ভয়ঙ্কর ভেঙে পড়েছিলেন হেমলতা; শুধু যে বৈধব্য-যন্ত্রণার কথা ভেবেই কাতর হয়েছিলেন তা নয়, ভেঙে পড়েছিলেন বিরজার সম্ভাবনাময় জীবনের চিরসমাপ্তি আন্দাজ করেই।
আদ্যনাথের দাহকাজ শেষ হলে, সিঁদুর মুছে, হাতের নোয়াগাছি-সহ গায়ে থাকা সব গয়না খুলে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে, স্নান সেরে, থান পরে যখন সে উঠে দাঁড়াল, চকিতে দেখল গঙ্গার ঢেউয়ে-ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে তার ওই সদ্য-বিধবা হওয়া চেহারাটা। তখুনি ইচ্ছে হল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে যেতে; পারল না বিরজা। আদ্যনাথকে মনে মনে তার ওই শ্বেতআঁচলে জড়িয়ে নিয়ে, ফিরে এল নিজের ঘরখানিতে। ভরা অন্ধকারে, জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সে; মনে হল যেন, যে-কোনও রাতের মতোই ভীষণ স্বাভাবিক চারপাশ; জ্যোৎস্না বা বাতাস কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি নেই কোথাও; বালিশে মাথা ঠেকিয়ে বিরজা ভাবল, যদি তার বর হঠাৎ এই ঘরে, তার কাছে এখন আসে, চিনতে পারবে তো তাকে! সাদা কপালে, সাদা কাপড়ে, অলঙ্কারহীন এই বিধবা বিরজাকে? টেবিলে রাখা লণ্ঠনটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল বিরজা; এ ঘরের দেওয়ালে আজ আর আদ্যনাথের ছায়া পড়ে নেই।
শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে যখন এই সিদ্ধান্তই হল যে, বিরজা ফিরে যাবে তার বাপের ঘরে, বিরজার যেন সব থেকে কষ্ট হল আদ্যনাথের লেখার ওই টেবিলটা ছেড়ে চলে যেতে; ওটাই তো তার গুরুমশায়ের আসন। চেয়ারটাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আদ্যনাথ বসত; আর দু পাশে খোকা আর খুকিকে নিয়ে, আদ্যনাথের সামনে তিনখানা আসন পেতে তারা বসত মেঝেতে। দেরাজের সামনে দাঁড়িয়ে, অভ্যেসবশে নিজের আঁচল থেকে চাবি খুলতে গিয়ে, বিরজার মনে পড়ল যে, পরনের থানের আঁচলে ওই চাবি সে আর বাঁধেনি; রেখে দিয়েছে আদ্যনাথের লেখার টেবিলের ড্রয়ারে। সেখান থেকে চাবিটা বার করে, দেরাজটা খুলে অনেক ক্ষণ যে বিরজা দাঁড়িয়ে থাকল তা কিন্তু নয়। কিছু একটা ঠিক করেই যেন সে দেরাজ খুলেছে। নিজের শাড়ি-জামা বা আদ্যনাথের ধুতি-চাদর কিছুই সে ছুঁয়ে দেখল না। আদ্যনাথের নাম লিখে, তার নিজের হাতে ফোঁড়-তোলা সেই রেশমি রুমালখানা বার করে, তাতেই সে জড়িয়ে নিল ‘ফাবার কাস্টেল’ পেনসিলের বাক্সটা। দেরাজ বন্ধ করে আয়নার সামনে এসে চাবি-বন্ধ তাকটা খুলে, তা থেকে বার করল ঝুমঝুমি দেওয়া খান-চারেক কাঁটা; বড় প্রিয় ছিল আদ্যনাথের। সম্পত্তি বলতে আর কী-ই বা নেবার আছে তার! তবে স্লেট-খাতা আর বই ক’খানা না নিয়েও তো সে পারল না। হ্যাঁ, আরও একখানা জিনিস যা সে লুকিয়ে নিয়ে যাবে সেটা হল, আদ্যনাথের শখের সেই প্যাশনেটা। নাই বা তা বিরজার হল! আদ্যনাথ কি তার থেকে পৃথক কেউ নাকি!
৩.
বাবার সঙ্গে বেরিয়ে আসবার আগের দিন, শাশুড়িমা একখানা তোরঙ্গ দিতে চাইলে বিরজা বলেছিল, ‘কী আর নেব মা! সবই তো কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়ে গেলেন তিনি।’
‘তবু তোমার ঘরে যা যা ব্যবহার করেছ, তার থেকে দরকার মতো নিয়ে নাও।’
‘নিয়েছি মা; স্লেট-খাতা আর এই বই ক’খানা; এইটুকুই তো দিয়ে গেছেন।’
‘বিয়ের চেলি, সিল্কের কাপড়— ছোটবোন তো পরতে পারবে!’
‘বিধবার কাপড় কি আর শুভ হবে মা? কারোর হাতে পাঠিয়ে, গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দেবেন।’
‘কী আর বলব তোমাকে! তবে থান কাপড়গুলো নিয়েছ তো মা?’
‘নিয়েছি মা; ও-ক’খানা আর সাদা কামিজগুলো এই পুঁটলিতেই ধরে গেছে।’
বিরজা আর মুখ ফুটে বলতে পারল না আদ্যনাথের ওই প্যাশনে, এমব্রয়ডারি করা নকশার মধ্যে, বরের নাম লেখা রুমাল আর তার ‘গুরুমশায়ে’র দেওয়া ফার্স্ট প্রাইজ— সেই ‘ফাবার কাস্টেল’ পেনসিল সেটটার কথা। পুঁটলিটা বাবার হাতে দিয়ে, সবাইকে প্রণাম করে, চিরদিনের মতো ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বিরজাবালা। ভাই ভূতেশও সে দিন সঙ্গে ছিল বলে বাবা খানিক জোর পেয়েছিলেন। শোকে থমথমে বাপের বাড়িতে ফিরে এসে, বিরজা গিয়ে দাঁড়াল তার মায়ের ঘরে। এই প্রথম তার মনে হল যে, সে শুধু বরকেই হারায়নি; খুইয়েছে তার ঘরটাও। তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল নিভৃতি। একা মানুষের জন্য হাতের কাছে যা রইল তা হল, ধ্যানজপ আর চোখের জল।
এরই মধ্যে কাগজে মোড়া শক্ত গোছের কিছু একটা হাতে করে নিয়ে এসে মায়ের বিছানায় রেখে দিল ভূতেশ। মোড়ক খুলে বিরজা দেখল, আদ্যনাথের একখানা ফোটোগ্রাফ। ভূতেশ জানাল যে, বেরিয়ে আসবার আগে, আদ্যনাথের বড়দাদার ছেলে ‘খোকা’ এই ফোটোটা চুপিচুপি তার হাতে দিয়ে বলেছে, ‘বাড়ি গিয়ে কাকিমাকে দিও।’ ফোটোটার দিকে তাকিয়ে বিরজার মনে হল, এই বারো-তেরো দিন আদ্যনাথকে একবার-ও না দেখেও তো সে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে!
আমি বড়খুকি বিরজাবালা। আমার সধবা চেহারা এবং আমার বরের নাম ‘আদ্যনাথ’— এ দুটোই কেমন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সকলের মন থেকে; যে একজন শুধু মনে রেখে দিলেন, তিনি হলেন হেমকাকিমা। তাঁর বড় ছেলে হরুকে দিয়ে মাঝে মাঝেই ডেকে পাঠাতেন তাঁদের বাড়িতে; কতরকম ভাবে যে আদর করতেন বলবার নয়। তাঁর আর আমার গল্পের মধ্যে জেগে উঠত কখনও শ্যামনগর, কখনও গারুলিয়া, কখনও গোপীনাথ প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজ, আবার কখনও বা বঙ্কিম। মনে পড়ত ব্রহ্মময়ী বা মুলাজোড় কালীবাড়ি গিয়ে, পোষমাসে তিন জায়ে মিলে জোড়া জোড়া মুল দিয়ে পুজো ও মানতের সে কী ধুম!
এই হেমকাকিমার বাড়িতেই আলাপ হয় হরুর বন্ধু জয়নারায়ণের সঙ্গে। সে মাঝে মাঝেই আমাকে বলে যে, কলকাতায় নিয়ে যাবে। সব মেয়েদেরই নাকি একবার অন্তত দেখা উচিত ওই ‘সিস্টার’ নোবলকে; স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা হয়েও তিনি নাকি খুবই ঘনিষ্ঠ বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে; বাগবাজারে তাঁর তৈরি ইস্কুলে নাকি বিবাহিত মেয়েরাও পড়তে আসতে শুরু করেছে। মরাঠি মহিলা মাতাজি গঙ্গাবাইয়ের তৈরি আদি মহাকালী পাঠশালা এবং বেথুন সাহেবের সেই বেথুন ইস্কুলও আমাকে খুব টানে। নাকি, ইস্কুল তৈরির এইসব গপ্পো শুনতে শুনতেই আমার মনে পড়ে যায় আমার ‘গুরুমশায়’-বর আদ্যনাথকে!
তা হলে জয়নারায়ণকেই বা এত ভাল লাগে কী করে!কেন মনে হয় এটাই যেন আমার প্রথম প্রেম এবং ভালবাসা! কেন এত শিহরন আর উদ্গ্রীব অপেক্ষা! তা হলে আদ্যনাথ? আর ওই ‘ফাবার কাস্টেল’ সেটের মধ্যে গাঢ় সবুজ রঙের পেনসিলটা?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র