তরঙ্গনাথ – ৬
বরযাত্রী-দলে মেয়েদের যাওয়ার রীতি নেই; কিন্তু তরঙ্গনাথের মা তাঁর কর্তাকে রাজি করিয়ে একরকম জোর করেই সেজোবউদিকে নেওয়া করালেন; স্ত্রী-আচার এবং কনের বাড়ির মা-কাকিদের দেখভাল যাতে ঠিকঠাক হয়। খুব নিকটজন ছাড়া কাকপক্ষীতেও জানতে পারল না যে তনুর বিয়ে এবং তা হতে চলেছে কাশীতে। সুখচরের বাড়ি থেকে যে যার মতো আলাদা আলাদা রওনা হয়ে, একে একে সবাই জড়ো হল শেয়ালদা স্টেশনে। নিশানাথকে নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন একদিন আগে; তাঁর কাশীবাসী শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করে, বিয়ের জোগাড়যন্তর ভাল ভাবে বুঝে নেওয়ার জন্য। তনুর মায়ের এমনই নির্দেশ। তনুর সেজোদাদা এবং সেজোবউদির সঙ্গে ভোরবেলা রওনা হয়েছে বদু; তার আর সেজোবউদির জন্য আলাদা কুপেও রিজার্ভ করা হয়েছে। তনুর আরও দুই জ্যাঠতুতো দাদা এবং ভাইও যাচ্ছে। আর যাচ্ছেন সুখচরে থাকা মেসোমশাই মানে নিশানাথ ও হরশঙ্করের বাবাও; হরশঙ্করের কোনও খোঁজ নেই। তার মেসের ঘরে নাকি এক মাস ধরে চাবি বন্ধ। তনুর মায়ের পরামর্শে মোটামুটি জনা-দশেক মিলে এই হল ‘নিরাপদ’ বরযাত্রীর দল।
কাটিহারে ফিরে ইস্তক তরঙ্গনাথের কাজের ধরন সম্পূর্ণ বদলে গেল। ড্রাইভিং শেখার কোনও নির্দিষ্ট সময় যে আছে এমন নয়; পূর্ণিয়া-কাটিহার এবং আশপাশের প্রত্যন্ত লোকালয় ও জলাজঙ্গলে উদয়াস্ত ডিউটি করে, মাঝরাতেও বেরোতে হয়েছে তাকে। মি. অগাস্ট তনুকে এটাই বুঝিয়েছেন যে পুলিশি-ড্রাইভিং কোনও শৌখিন বিষয় নয়; ঝড়-বাদল-অন্ধকার যুঝেই চালানো শিখতে হবে; এমনকী চলন্ত অবস্থায় যে-কোনও এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান এবং বাঁ— দুটো হাতেই গুলি-বন্দুক চালাতে হবে। আরও আশ্চর্য হয়েছে তরঙ্গনাথ এ কথা শুনে যে, প্রয়োজনে আততায়ীকে পিষে দিয়েও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। পুলিশ মারলে সেটা নাকি খুন বা অ্যাক্সিডেন্টের মামলার আওতায় পড়ে না; ফলে মূল্যবান বিদেশি গুলি-বারুদ বাঁচাবার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল ট্রেনিং-প্রাপ্ত গাড়ির ধাক্কা; নেটিভদের মেরে শেষ করে দেওয়ার কত যে কাণ্ডজ্ঞানহীন উপায় বার করেছে এরা! ড্রাইভিং ট্রেনিং-এর উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন দমে গেছে তরঙ্গনাথ। ফলে ড্রাইভিং শেখার উৎসাহটাও উবে গেছে তার মন থেকে। আগামীকাল থেকে তিন দিনের ছুটি; তার মধ্যেই বিয়ে সেরে ফিরতে হবে তাকে। নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন মি. অগাস্ট,
‘বাবু! তারপর কেমন বোধ হচ্ছে বলো! মনে মনে নিশ্চয় খুবই উদ্বিগ্ন?’
‘তিনদিন বাদেই তো ফিরছি স্যর। সেই মতোই সব ব্যবস্থা হয়েছে।’
‘ওয়াইফ তো বালিকা; তাকে রেখে আসতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না।’
‘বদলি চাকরিতে স্বামীকে ছেড়ে থাকাটাই আমাদের রেওয়াজ স্যর।’
‘শোনো, আগামী তিনদিন আমাদের এজেন্ডা হল তোমার বিয়ে এবং বিয়ে শেষ হলেই আবার এখানেই নিরাপদে তোমার ফিরে আসা।’
‘ইয়েস স্যর!’
‘আর নির্ঘণ্টটাও তোমাকে লিখে দিয়ে দিচ্ছি। কখন, কার সঙ্গে, কী ভাবে যোগাযোগ করবে সব লেখা আছে। লালবাজারেও বলা আছে। এই বন্দোবস্তের কোনও বদল যেন না হয়।’
‘ইয়েস স্যর!’
‘তোমার দেওয়া ঠিকানাগুলোই ফলো করা হয়েছে; প্রথমে, কাশীর ‘বাঙালিটোলায়’ তোমার গ্র্যান্ডমা-য়ের বাড়ি; সেখান থেকে অন্য একটা প্রাইভেট বাঙালি-হাউসে বিশ্রাম নিয়ে ‘হাভেলি’ যাবে বিয়ে করতে। পরদিন সকালে, বিশ্বনাথ-মন্দির দর্শন করেই কলকাতার ট্রেন; সকালে ক্রিক রো-তে ‘বিপিন সদনে’ বউভাত; ওই সকালেই অতিথি-আপ্যায়ন শেষ করে বউ সহ সুখচরে তোমার বাড়ি; পরদিন ভোর রাতে বেরিয়েই হাওড়া থেকে সোজা গিরিডি। ওখানে গাড়ি থাকবে। পৌঁছনোর দু’দিন পর রওনা দেবে এবং ফিরবেও নিজে চালিয়ে।’
‘একটা কথা স্যর! বিশ্বনাথ দর্শনের ব্যাপারটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন স্যর!’
‘ওহ্! ওটা তোমার পেরেন্টসদের রিকোয়েস্ট; রিচুয়ালস! তাই তো!’
‘আর একটা কথা স্যর।’
‘ওই গিরিডি হয়ে এখানে ফেরাটা তো! প্রশ্ন না করে অবসার্ভ করো মাই বয়! ওর্ডারলি সবসময় পাবে; তবে কোনও একজন যে নির্দিষ্ট এমন নয়; মাঝে মাঝে বদল হবে; ফলে সেটাও খেয়াল রেখো মি. অফিসার।’
মি. অগাস্টের দেওয়া তাঁর নিজের হাতে টাইপ করা ‘নির্ঘণ্ট’ সূচি হাতে নিয়ে, সাহেবকে স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে আসার সময়ে তরঙ্গনাথকে পিছু ডেকে, এবার মি. অগাস্ট বললেন,
‘আর একটা কথা। আজ রাতেই তোমার গাড়ি। ডিউটির উর্দি পরে স্টেশনে যাবে; তোমার গিরিডির আঙ্কেল সেখানে থাকবেন। একই কামরায় স্ট্রেনজারের মতো দুজনে দু’দিক দিয়ে উঠবে, সিটও আলাদা। কাশীতে নেমে, বাকি সব আঙ্কেল বলে দেবেন।’
‘ইয়েস স্যর।’
‘মনে রেখো যে, কাশীতে নামার পর থেকে শুধু তিন বা সাড়ে তিনদিন তুমি একজন বর; তার আগেপরে তুমি কিন্তু একজন সতর্ক অফিসার।’
‘ইয়েস স্যর। তাই হবে।’
২.
রাতের গাড়িতে উঠেই, ইশারায় মেসোমশাইয়ের নির্দেশ বুঝে, উর্দি ছেড়ে ধুতি-শার্ট পরেও, তরঙ্গনাথ অভ্যেস মতো, ধুতির গিঁঠে গুঁজে রাখল তার রিভলভারটাও। সারারাত শুধু জেগে জেগে, শুয়ে কাটাল তরঙ্গনাথ আর গিরিডি থেকে জিপে করে কাটিহার স্টেশনে আসা তার সেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মেসোমশাই। কাশীতে নেমেই এদিক-ওদিক কয়েকজনকে দেখামাত্রই তরঙ্গনাথের আন্দাজ হল যে, তারা নিশ্চিত পুলিশের লোক— একজন এসে চাপা নির্দেশ দিয়ে বলে গেল, বাইরে কোন ঘোড়ার গাড়িতে সে যাবে; হালকা চোখ বুলিয়ে, মেসোমশাইকে কাছাকাছি দেখতে না পেয়েও তরঙ্গনাথ এগিয়ে গেল। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময়ে দেখল মেসোমশাই গাড়িতেই; এবং সামনের সিটে আরও একজন যে তার আর্দালি। কেউ কোনও কথা না বললেও তরঙ্গনাথ এ-ও দেখল যে, কোনও রকম নির্দেশ ছাড়াই, সহিসের এক চাবুক খেয়েই গাড়িতে জোতা তাগড়াই সেই ঘোড়াটাও কেমন টক করে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদামাটা এবং পুরনো একটা একতলা বাড়ির সামনে। মেসোমশাই এবং তরঙ্গনাথ প্রায় একসঙ্গেই নামলেন এবং ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন একটা উঠোনে; অচেনা পায়ের শব্দে ছোটমাসিকে বেরিয়ে আসতে দেখেই সে বুঝল যে এটাই তার দিদিমার আস্তানা; নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে বিধবা ছোটমাসিও এ বাড়িতেই থাকেন।
বাবা এবং দিদিমাকে প্রণাম করেই সে গড়িয়ে পড়ল দিদিমার খাটে। আর একটা চেয়ার টেনে তরঙ্গনাথের বাবার পাশে এসে বসলেন মেসোমশাই; দিদিমার পায়ের কাছে রাখা একটা চৌকিতে গাঁঠরি খোলা অবস্থায় বেশ কিছু নতুন শাড়ি; ছোটমাসি তাঁর হাতে ধরা একটা ফর্দ থেকে বলছেন, আর বাবা সেগুলোই একটা একটা করে মিলিয়ে নিয়ে দিদিমার হাতে ধরাচ্ছেন; বাহার করে নাম লেখা একগুচ্ছ ছোট ছোট সাদা কাগজের টুকরো থেকে বেছে, একটা করে টুকরো প্রতিভার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন; আর দিদিমার পাশে বসা ছোট্ট প্রতিভা সেগুলোই ঢুকিয়ে রাখছে এক-একটা শাড়ির প্রথম ভাঁজে। এই গোছার থেকে কয়েকটা কাগজ চেয়ে, নিজের হাতে নিয়ে তরঙ্গনাথ দেখল যে, প্রতিটি প্রণামিতে নামে নামে ছড়া লেখা। খাগের কলমে ‘কপিং’ কালিতে ওই সুন্দর হাতের লেখাটা ছোটমাসির; তরঙ্গনাথ আগ্রহ নিয়ে পড়ছে দেখে দিদিমা বললেন,
‘ডাকে তোর মায়ের ফর্দখানি পেয়েই আমি আর তোর মাসি মিলে, বসে বসে এই ছড়াগুলো লিখেই ফেললাম। একখান বা দু-খান, যে ক’খানিই হোক, তত্ত্ব আবার ন্যাড়া যায় নাকি!’
উৎসাহ পেয়ে প্রতিভা বলল, ‘মা তো বিয়ের পিঁড়িতেও পদ্য লিখেছে।’
একটু অপ্রতিভ হয়ে ছোটমাসি বললেন, ‘পদ্য লিখেছি ঠিকই, কিন্তু শুভকাজের পিঁড়ি কি আর বিধবা মানুষ ছুঁতে পারে! নকশার হাত ভাল, এমন এক সধবাকে খুঁজেপেতে ধরে এনে, তাকে দিয়েই আঁকিয়েছি।’
পিঁড়ি দু-খানি সামনে এনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ছোটমাসি রাখতেই, তরঙ্গনাথ জোরে জোরে পড়তে লাগল। ছেলের জন্য বড় মাপের পিঁড়িতে, শঙ্খলতার আলপনার মাঝখানে লেখা—
‘অবুঝ দুটি সবুজ-হিয়া
সপ্ত-পাকের অঙ্গনে
যোগ করে দাও, এক করে দাও
হলুদ সুতোর বন্ধনে’
আর তুলনায় ছোট মাপের কনে বসবার পিঁড়িটাতে একই রকম ভাবে, অন্য আর এক ধারা নকশার মধ্যে লেখা—
‘সিঁথের সিঁদুর–রাঙা চেলি
বধূর রূপে চাঁদ উছলি’
অভিভূত তরঙ্গনাথ স্মিত হেসে প্রণামির ফর্দটা দেখতে চাইল। ছোটমাসির হাত থেকে নিয়ে চোখ বোলাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল, তার মায়ের হাতের লেখা এবং শব্দের বাঁধুনি দেখে।
শ্রী শ্রী রাধাকান্তের চরণ-ধন্য অগ্রজ পুত্র তরঙ্গনাথের বিবাহের নমস্কারির ফর্দ ও অন্যান্য কাপড়।
শ্রী শ্রী রাধাকান্তঃ দুধরং-কাতান জোড় এবং শ্রী রাধিকার রাঙারং-কাতান বেনারসি
১/ বধূমাতা: জামরঙা, ঠাসা বুটি, সোনা জরি, সরু পাছাপেড়ে, কাতান বেনারসি
২/ পাত্র তনু: ঘিয়েরঙা, সোনা জরি, সরু পেড়ে, কাতান জোড়
৩/ কাশীর দিদিমা: দুধরঙা, রুপো জরি, সরু পেড়ে, কাতান বেনারসি
৪/ কাশীর ছোটমাসি: ঘিয়েরঙা, রুপো জরি, সরু পেড়ে, কাতান বেনারসি
৫/ তনুর শাশুড়ি: ঘিয়েরঙা, সোনাজরি, চওড়া নকশা, লাল পেড়ে কাতান বেনারসি
৬/ রাণী: রুপো জরি, ভাসা বু্টি, সরু পেড়ে, দুধেআলতারঙা টিস্যু বেনারসি
৭/ প্রতিভা: ঐ
৮/ তনুর বাবা: পট্টবস্ত্র বা ধুতি-উড়ানি
ফর্দখানি ছোটমাসিকে ফেরত দিয়ে তনু বলল, ‘আর একখানি কাপড় ওতে যোগ করে দাও।’
৯/ তনুর মা: ঘিয়েরঙা, সোনা জরি, ভাসা বুটি, মাঝারি নকশা, লাল পেড়ে কাতান।
সোজা হয়ে উঠে বসে ব্যাগ হাতড়ে টাকার থলিটা তনু বের করতে গেলে, তার বাবা বললেন, ‘টাকা লাগবে না; মা সব গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।’
তনু ভেবে পেল না যে, তার মাইনে থেকে পাঠানো ওই সামান্য ক’টা টাকা থেকে কী করে মা এত গুছিয়ে রেখেছেন! তনুকে চুপ করে থাকতে দেখে মেসোমশাই বললেন,
‘এর থেকেও লম্বা এক প্রণামির ফর্দ মিলিয়ে, ফুলিয়ার শাড়ি আগেই চলে গেছে তোমাদের বাড়িতে; বড়দি মানে তনুর মা এইসব ব্যাপারে একেবারে এক-ঘর। তোমার বাবা সেগুলো আগেই নিয়ে আসায়, এতক্ষণে মনে হয় নামে-নামে সব গোছানোও হয়ে গেছে।’
তনুর বাবা গর্বে বুক ফুলিয়ে যোগ করলেন, ‘পুরুত–নাপিতের কাপড় এবং ছোট-বড় নানা মাপের গামছা সমেত…’
তনু একটু লজ্জাই পেল। মি. অগাস্টের নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই মাথায় রাখেনি সে। বিয়ের খরচ বাবদ কিছু টাকা তার তো আগাম পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
৩.
অচেনা এক নেটিভ সাহেবের বাংলোতে গিয়ে তনু দেখল যে, তার বিয়ে নিয়ে সেখানেও একটা ছোটখাটো আয়োজন। মুখার্জি সাহেবের বউ গায়ে-হলুদের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তরুর ছোটকাকা বসে আছেন, বরের গায়ে ছোঁয়ানো তেল-হলুদ নিয়ে যাবেন বলে; এই তেল-হলুদ ওই বাড়ি গেলে তবে কনের গায়ে-হলুদ হবে। মনে মনে তনু ভাবল যে, কোথায় তার সেই দিদি-বউদিদের মাতামাতি, আর কোথায় এই অচেনা সধবার দল! তারই মধ্যে ছোটমাসি আর সেজো মেসোমশাই মিলে তত্ত্বের ডালা সাজিয়ে ফেললেন; মায়ের হাতের দ্বিতীয় ফর্দটি হাতে নিয়ে সেজো মেসোমশাই একে-একে বলছেন আর ছোটমাসি সেগুলি সাজিয়ে রাখছেন। ফুলিয়ার ছেলে সেজো মেসোমশাই নিজেদের তাঁতির থেকে দেখেশুনে কিনে এনেছেন, বাছাই করা ধুতি, শাড়ি এবং গামছা। তত্ত্বে দেওয়ার মাছ, মিষ্টি, তেলের কলস আগেই কিনে রেখেছেন মুখার্জি গিন্নি। তাঁর জন্যেও আরও একখানি শাড়ির ব্যবস্থা রাখতে তনু তার ছোটমাসিকে কানে কানে বলে দিল ।
আর একটা প্রাইভেট মোটরে চেপে তত্ত্ব সমেত তরুর ছোটকাকাকে নিয়ে চলে গেলেন মেসোমশাই; সামনের সিটে মুখার্জি সাহেবের কোলে বসে নিতবর বদুও। এতক্ষণে বাবাকে একটু একা করে পেল তনু। মি. অগাস্টের নেটওয়ার্ক দেখে দুজনেই বেশ থমকে গেছেন।
এমনকী তনুদের পরিবারের নল-পুরুত এবং ধীরু-নাপিতও পুলিশ পাহারায় কাশীতে পৌঁছে গেছেন, তনুর বিয়ে দিতে। এ-কথা, সে-কথার পর হাসতে হাসতেই বাবা বললেন, ‘বিপ্লবীদের কাছে তোমার মাথার দর যে কত, তা আমি জানি না। কিন্তু সাহেবদের কাছে তোমার যে মেলা দর উঠেছে এটা বেশ বুঝতে পারছি।’
‘কী করে বলব বল! আমার তো আর আগের কোনও অভিজ্ঞতা নেই।’
‘সে তো বটে! বামুন-বাড়ির বাচ্চা অফিসারকে বিয়ে দিয়ে আনা! ওদের কাছেও এ বোধহয় এক নতুন ব্যাপার!’
‘ব্যাপার মানে রীতিমতো এক এজেন্ডা; এই দ্যাখো সাহেবের দেওয়া, তাঁর নিজে হাতে টাইপ করা নির্ঘণ্ট।’
‘আর সেই সঙ্গে আমার মেজদা, সেজো-সম্বন্ধী এবং তোমার মায়ের এই সমানেই মাথা ঘামানোটাও ধরো; দুজন স্বয়ং ডেপুটির সঙ্গে আরও এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বড়মেয়ে!’
‘সে তো বটেই! আর, এরা হল কেনা-বেচার জাত! তাই কানেক্টিভিটি ব্যাপারটা ওরা খুব ভাল বোঝে…’
‘সেই সঙ্গে সিকিউরিটিও; নিরাপত্তা মানে এলিমিনেশন অফ দেয়ার এনিমিজ!’
আর কথা না বাড়িয়ে দুজনেই স্নান সারতে চলে গেলেন, আলাদা আলাদা দুটো চানঘরে।
ইতিমধ্যে কনের বাড়ি তত্ত্ব নামিয়ে, নিজের বাংলোয় ফিরেই মুখার্জি-সাহেব তনুকে জানিয়ে দিলেন যে, বিকেলবেলা তনুর এখান থেকে যে বেরনো, তা কিন্তু মোটেই ফুল-সাজানো মোটরে চড়ে, বরবেশে যাওয়া নয়; বিয়ের সাজ করে নেবে, ওই বাড়ি পৌঁছে। ফলে তাঁরা দুজন উর্দি পরেই পুলিশের জিপে যাবেন। বাকিরা যাবেন, দুটি প্রাইভেট মোটরে; ছেলে-মেয়ে ভাগাভাগি করে। কথা শেষ করেই, গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন মুখার্জি সাহেব। এই গাম্ভীর্যের গুরুত্ব তনু অন্তত ভালই বোঝে!
নির্দেশ মতো সকলে তৈরি হয়ে নিল। মেয়েদের মোটরে দিদিমা, ছোটমাসি আর প্রতিভার সঙ্গে মুখুজ্জে গিন্নি; অন্য গাড়িটায় মেসোমশাইয়ের সঙ্গে বরকর্তা এবং নিতবরের বেশে বাবা আর বদু।
পুলিশ সেজে দাদা বিয়ে করতে যাচ্ছে বলে একমাত্র যে খুবই খুশি, সে হল নিতবর বদু।
তনু আশ্চর্য হয়ে দেখল যে, অন্য দুটো মোটরকে রওনা করিয়ে দিয়ে তাদের জিপটা ঘুরে গেল, একেবারে অন্য পথে। তনুর চোখদুটো কি ভিজে উঠল! গাড়িতে ওঠার সময় বড়দের প্রণাম করলেও বাদ রইলেন তার মা! মনে পড়ল তার বিয়ের কথায় মা শিখিয়েছিলেন, ‘বর বিদায়ের সময় মাকে কখনই বলবে না যে, দাসী আনতে যাচ্ছি; বলবে যে ঘরের লক্ষ্মী আনতে যাচ্ছি’।
আশঙ্কা এবং বিরক্তি চেপে এবার গম্ভীর হয়ে গেল তনুও।
৪.
সব সামলে, শেষ অবধি খালি গায়ে, উড়ানি চাপিয়ে, বরবেশে, ফুলের মালা পরে ছাঁদনাতলায় এসে দাঁড়াতে পারল তনু। এখন তার কোমরে রিভলভারটা গোঁজা নেই। সেটা আছে তরঙ্গনাথের ঘাড়ের কাছেই দাঁড়ানো, তার আর্দালির কাছে। তা অবশ্য ওই বিয়ের সময়টুকুই। শঙ্খধ্বনি এবং উলুর শব্দে বিয়েও হল তার। পানপাতার আড়াল সরিয়ে শুভদৃষ্টি হল লাল চেলি পরা, নাকে নোলক সেই বালিকার সঙ্গেও। তার মুখখানি ঠিকঠাক মনে না পড়লেও, বউয়ের সেই বাঁশির মতো তিরতিরে নাকখানি দেখেই চিনতে পারল তরঙ্গনাথ। আসর হল, বাসর হল, তবু কী একটা যেন কম বোধ হল তনুর মনে। ভোর না হতেই কালরাত্রি পড়ে যাবে, তাই অন্ধকার থাকতেই যাওয়া হল বাবা বিশ্বনাথ দর্শনে। কেউ না বুঝলেও তনু আন্দাজ করতে পারল সাদা পোশাকে তাদের ঘিরে অন্তত জনা দশেক পুলিশের উপস্থিতি। বেলাবেলি খাওয়া-দাওয়া সেরে হাওড়া ফেরার ট্রেন ধরল সকলে; তনুও উর্দি পরে আবার সেই পুলিশের জিপে। প্রথম কামরায় শুধু সে আর তার আর্দালি। বাবার সঙ্গে বাকি সকলে অন্য আর এক কামরায়। সেজো-মেসোমশাই শুধু কাশীতেই থেকে গেলেন, আরও কিছু ব্যবস্থা করার কারণে। শাশুড়িমায়ের কাছে একদিন থেকে, ওখান থেকেই গিরিডি ফিরে যাবেন তিনি।
ট্রেনের মধ্যেই কেটে গেল কালরাত্রি। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন লাগবার আগেই উর্দি ছেড়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে তরঙ্গনাথ। একলাফে স্টেশনে নেমেই সে দেখল যে, অন্য দরজা দিয়ে সার সার নামছে কনেযাত্রী এবং বরযাত্রীদের দল। দু-তিনটে প্রাইভেট গাড়িতে চেপে সোজা সেই ক্রিক রো, ‘বিপিন-সদন’; মেজো জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। নতুন বউকে বরণ করে মা ঘরে তুলতে, তবেই নিজেকে বিবাহিত মনে হল তনুর। বরণ শেষ করেই তনুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন তিনি। রাণী এসে জড়িয়ে ধরল নতুন বউ-দিদিকে। কোনও রকমে কনে-আশীর্বাদ শেষ করে বর-কনেকে স্নানে পাঠিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে অন্যান্য স্ত্রী-আচার এবং ‘হাতে-ভাত’ শেষ হল। খেয়ে নেবার জন্য সবাইকে তাড়া লাগালেন বাবা এবং মেজো জ্যাঠামশাই। সন্ধের আগেই প্রাইভেট মোটরে শিবনিবাসের কনে-যাত্রীকে রওনা করিয়ে দেওয়া হল শেয়ালদার ট্রেন ধরাতে। অন্য আর একটা প্রাইভেট মোটরে সুখচর যাওয়ার জন্য রওনা হলেন বাবা-মা-মাসি-সেজোবউদি আর নিশানাথ; তাঁদেরই কোলে কোলে প্রতিভা, বদু আর রাণী; বেশ কিছুক্ষণ পর আরও একটা প্রাইভেট মোটরে তার আর্দালি সহ তনুকে সঙ্গে নিয়ে জ্যাঠামশাই, ন-মেসোমশাই এবং সেজদাও এগিয়ে গেলেন সুখচরের রাস্তায়। নাপিত আর পুরুতরা আগেই ফিরে গেছে শেয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে।
বাড়িতে পৌঁছবার আগেই গৃহদেবতা রাধাকান্ত-মন্দিরে প্রণাম করানো হল বর-বধূকে; বাড়ির উঠোনে পা রাখতে না রাখতেই, বউ দেখতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল দিদি-বউদিদের। নতুন বউ নিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলেই, কাঁটা দিয়ে তনুর পথ আটকাল তারা। তনুর কাছ থেকে ‘দোর-ধরুনি’ বাবদ রুপোর টাকা আদায় করে, তবে দোর ছাড়ল তারা। নতুন কাপড়ে, বর-কনেকে আবার নতুন করে সাজিয়ে, একখানা নতুন ফরাশে দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে, শুরু হল রঙ্গরস। ফুলশয্যার আগে, নিশানাথের উস্কানিতে শেষে রাজি হতেই হল তনুকে। বদু তার হাতে এসরাজটা এনে দিতেই, সেটা বাজিয়েই তনু গাইল…
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাস নে—
ফুলের মুধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাস নে॥
আমি এখন বিবাহিত তরঙ্গনাথ। কিন্তু ফুলশয্যার শেষে, সকাল হওয়ার আগেই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হল গিরিডি যাত্রায়। সেই জামরঙা কাতান-বেনারসি জড়ানো ঘুমন্ত বউকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে বলে এলাম, ‘আমি আসছি; মায়ের কথা শুনে লক্ষ্মী হয়ে থেকো কিন্তু!’ পুঁটলির মতো গোল পাকানো ছোট্ট সেই বালিকা, চোখ বন্ধ করেই আঙুল চুষতে চুষতে বলল, ‘আমার মা-বাবা কোথায়?’ ব্যারাকপুর থেকে আসা পুলিশের জিপে কাকভোরে বেরিয়ে পড়লাম, আবার পুলিশ অফিসার সেজে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র