২০১৭ সালে তৃতীয় পরিসর থেকে মৃন্ময় প্রামাণিকের অনুবাদে প্রকাশিত হয় শরণকুমার লিম্বালের ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব’। দলিত সাহিত্য কী, মার্কসীয় সাহিত্য ও দলিত সাহিত্যের তাত্ত্বিক অভিমুখ কীভাবে মিলে যায়, দলিত সাহিত্যের মূল রস কী, সমাজ আর রাজনীতির জটিল বৃত্ত কীভাবে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে প্রান্তিকের প্রতিরোধ— দলিত সাহিত্যচর্চার এরকম নানান গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে লিম্বালের এই বইতে। অনুবাদের জন্য ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব’ এ-বছর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছে। অনুবাদকের সঙ্গে ডাকবাংলা.কম-এর পক্ষে কথা বললেন বিজলীরাজ পাত্র।
মৃন্ময়দা, শুরুতেই আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই। শরণকুমার লিম্বালের ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব’-র ভূমিকায় আপনি এক জায়গায় বলেছেন যে, ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব ভারতীয় মাটি থেকে আবশ্যিক ভাবে উদ্ভূত একটা সাহিত্যভাবনা।’ দেশজ-ভাবনার প্রসঙ্গটা আরেকটু বিস্তারে বলবেন? একইসঙ্গে এই বইয়ের গড়ে ওঠার যাত্রাপথের গল্পটাও জানতে চাইছি।
প্রথমে জার্নিটা দিয়েই শুরু করছি, যেটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং। আমি যতদিন কলকাতায় পড়াশুনা করেছি, ততদিন আমার দলিত সাহিত্য সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। ২০০৯ সালে যখন আমি হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই এম.ফিল. করার জন্য, সেই সময়ে একদিন আমার কো-সুপারভাইজার অধ্যাপক টুটুন মুখার্জির টেবিলে দেখলাম প্রচুর বই রাখা। কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল, ওই সমস্ত বই-ই এক-একজন বাঙালি দলিত লেখকের লেখা। সেই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম, বাংলায় এত দলিত লেখক রয়েছেন। তখন ম্যাম একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অনুবাদের মাধ্যমে পূর্ব ভারতের দলিত সাহিত্যের একটা অ্যান্থলজি প্রকাশ করার। আমাকেও উনি ওই অনুবাদ-প্রকল্পে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। যদিও নানা কারণে অ্যান্থলজিটা প্রকাশিত হয়নি পরবর্তীকালে কিন্তু ওই সূত্রেই আমি দলিত সাহিত্যচর্চার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এছাড়া আরও একটা বিষয় ছিল, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত সাহিত্য এবং দলিত রাজনীতির বিশেষভাবে চর্চা করা হত। এই নিয়ে নানান কনফারেন্স, সেমিনারও হত। এইরকমই একটা সেমিনারে একবার লিম্বালে বক্তা হিসেবে আসেন। ততদিনে ওঁর Towards an Aesthetic of Dalit Literature বইটা আমার পড়া হয়ে গেছে। আরও একটা মজার ব্যাপার হল, এম.ফিল.-এ আমাদের একটা ভারতীয় ভাষা শিখতে হত। আমাদের ব্যাচে অফার করা হয়েছিল— মারাঠি এবং খাসি। মারাঠি নিয়েছিলাম বলে ততদিনে ভাষাটাও খানিক সড়গড় হয়েছে। এইসব নানা কারণে তখন লিম্বালেজিকে বইটা অনুবাদের কথা বলি। উনি খুশিই হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে এই বইটা অনুবাদের কাজে হাত দিই। সে-সময়ে মারাঠি এবং ইংরেজি অনুবাদ— এই দুটো পাঠ মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম, ইংরেজি অনুবাদটা মূল থেকে অনেক আলাদা। আলাদা এই কারণেই বলছি যে, ইংরেজির নিজস্ব যে অ্যাকাডেমিক ভাষা আছে, তা অন্য কোনও ভারতীয় ভাষায় নেই। লিম্বালের এই বইটা যিনি অনুবাদ করেছেন, তিনি কানাডায় বসে পশ্চিমের অ্যাকাডেমিক ঘরানার ছাঁচে অনুবাদটা করেছেন। অনুবাদটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট; কিন্তু যদি কেউ মূল মারাঠি বইটা পড়েন, দেখা যাবে তার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল। তবে, আমি যেহেতু অত ভালও মারাঠি জানতাম না, কিছু-কিছু জায়গায় অসুবিধে হত। তাছাড়া যে-ভাষা থেকে অনুবাদ করা হচ্ছে, তার অনেক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও অনেক সময়ে বোঝা যায় না। এই সমস্যার কথাটা লিম্বালেজিকে যখন জানাই, উনি আমায় পরামর্শ দেন হিন্দি অনুবাদটাও দেখতে। কেননা ভাষাগত জায়গা থেকে হিন্দি এবং মারাঠি খুব কাছাকাছি। ইংরেজি অনুবাদটা সরিয়ে রেখেই পরবর্তীতে আমি এই বইটা অনুবাদ করি; ফলে তিন বছরের বেশি সময় লেগে যায়! এই আর কি!
আর প্রথম প্রশ্নটার বিষয়ে যেটা বলার, আমাদের ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্বের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, সেখানে সংস্কৃত সাহিত্যতত্ত্ব এবং ফার্সি সাহিত্যতত্ত্বেরই চর্চা করা হয়। ব্রিটিশরা আসার পর, এই দুই সাহিত্যতত্ত্বেরই নতুন রকমের ব্যাখ্যা উঠে আসতে দেখা গেছে। দলিত সাহিত্যতত্ত্বের প্রসঙ্গে যখন আমরা এলাম, সেটা কিন্তু একেবারেই স্বাধীন ভারতের একটা স্বতন্ত্র সাহিত্যতত্ত্বের ধারা। এবং এই সাহিত্যতত্ত্ব কিন্তু প্রচলিত সাহিত্যতত্ত্বের যে-সৌন্দর্য, তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। দলিত সাহিত্য যখন লেখা হচ্ছে, তার মূলে রয়েছে যাপনের অভিজ্ঞতা। একটা সময়ে আমরা দেখলাম, আমাদের সামনে সাহিত্যের এমন একটা মানদণ্ড উঠে আসছে— যেখানে বঞ্চনার কথা বলা হচ্ছে, আইডেন্টিটির কথা বলা হচ্ছে, স্বতঃস্ফূর্ততার কথা বলা হচ্ছে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা সেখানে যাপনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যসৃষ্টির একটা আবশ্যিক শর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। যা কিছু অসুন্দর, তাকে ‘অসুন্দর’ হিসেবে না দেখে, দলিত নন্দনতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা বিকল্প সৌন্দর্যের ধারণাকে উঠে আসতে দেখছি। পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে, দলিত সাহিত্যতত্ত্ব কিন্তু মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাংস্কৃতিক উপাদান রক্ষার কথা যদি আসে, তাহলে দেখা যাবে, তা রক্ষা করে নীচুতলার মানুষ। নিম্নবর্গের মানুষের যেটা হয়, অন্য বর্ণের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তেমন থাকে না বলে, তার রচনায় সংস্কৃতি অনেক বেশি অপরিবর্তিত থাকে। দলিতরা যেহেতু এই নিম্নবর্ণের মানুষ, সে-কারণেই তাদের সাহিত্যতত্ত্ব প্রসঙ্গে এই ভারতীয়, লৌকিক, দেশজ— এই শব্দগুলো আসে।
আপনি বললেন, এখানে যতদিন আপনি ছিলেন, ততদিন দলিত সাহিত্যের কথা জানতেন না। এখন কথা হচ্ছে, শরণকুমার তাঁর বইতে বারংবার মার্কসীয় সাহিত্য এবং দলিত সাহিত্যের মধ্যে বেশ কিছু মিলের কথা বলেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এখানে যে দীর্ঘদিনের বামপন্থার ইতিহাস, বামপন্থী সরকার— সেখানে এত বছরেও ‘দলিত’ প্রসঙ্গটাকে সামনে নিয়ে আসা হল না কেন? এবং প্রশ্নটাকে যদি আরও একটু জটিল করতে চাই, তাহলে বলব, বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের উদ্যোগে তৈরি হল দলিত সাহিত্য আকাদেমি। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দ্যাখেন?
এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি নানা সময়ে নানা কথা বলেছি। অ্যাকাডেমিক পরিসরে শুধু এই প্রশ্নটাকে নিয়েই বড়ো কাজ হতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে মূল সমস্যা হল, যারা গবেষণা করে, তারা সবাই একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। এখন কথা হল, দলিত সাহিত্য এবং জাতপাতবিরোধী সাহিত্য— এই দুটোর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের একটা পার্থক্য আছে। বাংলায় জাতপাতবিরোধী সাহিত্যর ইতিহাস সুদীর্ঘ, অন্যদিকে দলিত সাহিত্য লেখা হচ্ছে সাতের দশকে শেষে এবং আটের দশকের গোড়ায়; যখন মহারাষ্ট্রে দলিত প্যান্থার আন্দোলন ঘটে যাচ্ছে। দলিতত্ত্বের যে রাজনৈতিক দর্শন, তা বাংলার দলিতরা কিন্তু জানতে পারছে মহারাষ্ট্রের এই আন্দোলনের পরেই। অর্থাৎ দলিত চেতনাও এই সময় থেকেই আস্তে-আস্তে বাংলায় জাগছে। ফলে দেবেশ রায় যখন ‘দলিত’ নামক বইটা তৈরি করছেন, তার ভূমিকায় কিন্তু বাংলার দলিতদের কথা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা এখন দলিত সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে প্রায়শই বলে থাকি, দলিত সাহিত্যের ইতিহাস একশো বছরের ওই ইতিহাস আসলে জাতপাতবিরোধী সাহিত্যের। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে জাতি-পরিচয়ভিত্তিক নানান পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে বটে, তবে তাতে তথাকথিত দলিতত্ত্বের কোনো ধারণা থাকছে না। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটা শুধু সরকারের বিষয়ও না, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দলিত সাহিত্য পড়ানো হয় কি? হয় না!
আরও একটা বিষয় আছে। বাংলার দলিত সাহিত্য গড়ে উঠছে মূলত দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধর প্রভাবে গড়ে ওঠা উদ্বাস্তুর অভিজ্ঞতা থেকে। ভারতের দলিত সাহিত্য গড়ে উঠছে জাতপাতবিরোধী গণ-আন্দোলন থেকে। বাংলায় কিন্তু সেই অর্থে কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি; এখানকার দলিতরা এক জোট হল যখন চুনী কোটাল আত্মহত্যা করল এবং পরে যখন ফুলন দেবীকে খুন করা হল। দেখা গেল দলিত সাহিত্য বলতে বোঝা যাচ্ছে দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। সমস্যা হল অন্য জায়গায়, গুণগত মান আলাদা হলেও এই একই অভিজ্ঞতা তো উচ্চবর্ণেরও আছে! ফলে এর কাঠামোটাই অত্যন্ত জটিল।
জাতপাতের প্রশ্নে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই মার্কসবাদীরা ওয়াকিবহাল, তা নিয়ে তারা ভাবিত ছিলেন না এমনটা নয়। তৃণমূল সরকারের আমলে যখন দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরি হল— তখন আমি শুরু থেকেই একটা কথা বলে আসছি, আমাদের একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, কোনও সরকার যখন প্রতিরোধের সাহিত্যর পৃষ্ঠপোষকতা করে, তখন সেই প্রতিরোধের সাহিত্যর বিপথে চালিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। ফলত দেখা যায়, যে মনোরঞ্জন ব্যাপারী আগে দার্ঢ্যর সঙ্গে কথা বলতেন, এখন আর তাঁর সেই জোর দেখা যায় না। সরকার দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরি করেছে বটে, তবে তাকে বেঁধে রেখেছে। দলিত সাহিত্যের নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে, এরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে কি এই আকাদেমির হাত ধরে? দেখা যাচ্ছে না। এবং আরও একটা মজার বিষয়, বৃহত্তর অংশের দলিত সাহিত্যিক দলিত আকাদেমির বাইরে রয়েছেন এবং দলিত আকাদেমির নানা পর্যায়ে বিরোধিতা করছেন। বিরোধিতা করার জায়গা একটাই যে, আর যাই হোক, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কখনও প্রতিরোধের সাহিত্য সৃষ্ট হতে পারে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, সেই অর্থে গোটা ভারতে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে দলিত চেতনাটা কিন্তু শুরুই হচ্ছে ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে। এই সময়ে প্রচুর ইংরেজি প্রকাশনা সংস্থা ভাবতে শুরু করে, এমন কোনও নতুন সাহিত্যের প্রকাশ করতে হবে, যা বাজারে নেই। ফলে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সাহিত্য প্রচুর পরিমাণে ইংরেজিতে অনূদিত হচ্ছে যেমন, তেমনই অনেক দলিত সাহিত্যও অনূদিত হচ্ছে এই সময়ে। ফলত আমি যা বলতে চাইছি, সেটা হল— এটা শুধু সরকারের বিষয়ই নয়, কোনো বিশেষ শ্রেণির সাহিত্য সম্পর্কে কখন একটা সচেতনতা গড়ে উঠবে তা কিন্তু বেশিরভাগটাই নির্ভর করে আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল এবং অ্যাকাডেমিক অভ্যাসের ওপর।
খুব সম্প্রতি আমি প্রথমা ব্যানার্জির আদিবাসী-সংক্রান্ত কাজ দেখছিলাম। সেখানে তিনি একটা কথাই বার বার বলেছেন যে, বৃহত্তর দলিতচর্চার পরিসরে নানান বর্গের মানুষের কথা যেভাবে উঠে এসেছে বা তাদের নিয়ে অ্যাকাডেমিক স্তরে যা কাজ হয়েছে, সেখানে আদিবাসীরা যেন আজও কিছুটা পিছিয়ে। তাদের নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ হয়নি বা এখনও হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হল, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘দলিত’ বলতে আপনি কী বোঝেন?
বেদের যুগ থেকে আমাদের সমাজে যে বর্ণ-বিভাজন (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) ছিল, সেখান থেকে এক সময়ে এল জাতপাত-বিভাজন। তবে বর্ণ-বিভাজন থেকে কীভাবে জাতপাত-বিভাজন গড়ে উঠল, সেই রাস্তাটা খুব একটা পরিষ্কার নয়। শূদ্ররা হচ্ছে আজকের ওবিসি, যারা সমাজের নানা রকম টেকনিক্যাল প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত। দলিত হচ্ছে অতিশূদ্র, যারা এই চতুর্বর্ণের মধ্যে নেই। ওইজন্য ওদের বলা হয় আউটকাস্ট। সমাজের নানান ঘৃণ্য কাজ কিন্তু আবশ্যিক— এই পরিষেবা যারা দিচ্ছে, তারাই এক কথায় দলিত। তাদেরকে ছোঁয়া যাবে না। শূদ্রদের কিন্তু ছুঁতে আপত্তি নেই, কেননা সে উচ্চবর্ণের ঘরে গিয়ে নানা কাজ করে। নাপিত যেমন শূদ্র, তাকে তো ছুঁতেই হবে! তবে এখানেও কতগুলো মজার ব্যাপার আছে। যেমন, বাংলার দলিতের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে নমঃশূদ্র, কিন্তু বাংলাদেশে নমঃশূদ্ররা নিজেদের দলিত বলে না। লক্ষ্মণ গাইকোয়াড়, মারাঠি সাহিত্যিক— তিনি আদিবাসী এবং তথাকথিত ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’-এর মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর সাহিত্যকে কিন্তু দলিত সাহিত্য বলে বিবেচনা করা হয়। এদিকে আদিবাসীকে কিন্তু কোনওমতেই দলিত বলা যাবে না; কিন্তু কোনো আদিবাসী যদি দলিতত্ত্বের ধারণা থেকে নিজেকে দলিত বলে দাবি করে, তাকে খারিজও করা যাবে না। রাজবংশীরাও যেমন নিজেদের দলিত বলে না, কিন্তু দলিতত্বের বোধ থেকে কেউ দাবি করতেই পারেন যে, তাঁর সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য বলে মেনে নেওয়া হোক, যেমন রাজবংশী মুসলমান হওয়ার কারণে মৌমিতা আলম করেছেন— সেক্ষেত্রে তো মেনে নিতেই হচ্ছে! ফলত ‘দলিত’ চিহ্নিতকরণে খানিক জটিলতাও রয়েছে।
আরও একটা বিষয় এখানে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে যে, কে দলিত সাহিত্য রচনা করতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’র কথা তো দলিত সাহিত্যিকরা বারে বারেই বলছেন! মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যকেও সেইভাবে পড়া যেতে পারে। তবে দলিত সাহিত্যিকরা এই ধরনের সাহিত্যকে বলছেন ‘সহানুভূতির সাহিত্য’, কিন্তু দলিত সাহিত্য হতে হবে ‘সমানুভূতির সাহিত্য’; অর্থাৎ যার ওই যাপনটা নেই, তার পক্ষে দলিত সাহিত্য রচনা করা সম্ভব না। এইখানে একটা রাজনীতিও আছে। যদি আজকে বলে দেওয়া হয় যে, দলিত সাহিত্য সবাই লিখতে পারে— তাহলে দেখা যাবে, মেধার কারণেই উচ্চবর্ণরা ওই সাংস্কৃতিক পরিসরটাকে দখল করে নেবে। ফলে, প্রান্তিক মানুষের যে-কণ্ঠস্বর, ক্রমশ তা হারাতে থাকবে। এটা থিম, কন্টেন্ট বা রসের প্রশ্ন নয়— দলিত সাহিত্যের মূল প্রশ্নটাই হচ্ছে রাজনৈতিক।
দলিত আন্দোলন বা দলিত চিন্তার তো নানা স্বর রয়েছে— সেখানে একটা স্বর মনে করে যে, ভারতীয় অন্যান্য ভাষার তুলনায় দলিতদের ইংরেজির দিকে যাত্রাটা বেশি জরুরি। এটা নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। এই প্রসঙ্গটা আপনার কাছে আরও বেশি করে জরুরি হয়ে ওঠে কারণ একদিকে আপনি যেমন দলিত নিয়ে চর্চা করেন, অন্যদিকে আপনি তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। এই তর্কটা নিয়ে আপনার ভাবনার কথা যদি বলেন…
শুরুতে বলতে হয় ব্রিটিশদের কথা। তারা এদেশে যেমন নানান বিভাজন ঘটিয়েছিল, তেমনই জ্ঞানচর্চার একটা গণতান্ত্রিক পরিসরও তৈরি করেছিল। সাবিত্রীবাঈ ফুলে এবং জ্যোতিবা ফুলেও যখন একাধিক স্কুল তৈরি করেছিলেন, সেখানেও ব্রিটিশরা সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ফলত, ঔপনিবেশিক সময় থেকেই ভারতবর্ষ কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজদের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে; এবং ইংরেজি যেহেতু ক্ষমতার ভাষা, তাই ইংরেজিতে জ্ঞানচর্চা করলে বৃহত্তর জ্ঞানচর্চার অংশীদার হওয়া যাবে— দলিতরা কিন্তু শুরু থেকেই বিষয়টাকে এভাবে দেখে এসেছে। এখন আমার যেটা মনে হয়, দলিত প্যান্থার আন্দোলনের পর যদি নীরবে কোনও আন্দোলন হয়ে থাকে পরবর্তীতে, তা কিন্তু ইংরেজি ভাষায় দলিত সাহিত্যের অনুবাদ। শিপ্রা মুখার্জির অনুবাদ এবং দ্য হিন্দু পুরস্কারের মাধ্যমেই কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে পাঠক চিনেছে। ভারতের পাঠক আগে, বাংলার পাঠক পরে। ইংরেজি প্রকাশনা সংস্থাগুলোর আরও একটা মজার দিক হচ্ছে এই যে, যখনই কোনও একটা বই ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়, তার উদযাপনটা হয় খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আনুষ্ঠানিক প্রকাশ থেকে শুরু করে বইয়ের সমালোচনা— সব ক্ষেত্রেই এই সেলিব্রেশনটা চোখে পড়ে।
পাশাপাশি ষাটের দশক থেকে ইংরেজি বিভাগগুলোও একটা সংকট অনুভব করে যে, পুরনো সময়ের সাহিত্য দিয়ে আর হচ্ছে না। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা— এখানকার সাহিত্য এই সময় থেকে ক্রমশ অনূদিত হতে শুরু করছে। বিদেশি প্রকাশনাগুলোও তাদের ভারতীয় অফিস খুলছে সে-সময়ে। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, জুবান, কথা-র মতো ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে উঠছে, যারা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছে ততদিনে। ইংরেজি বিভাগের সংকটের কারণে এই যে তারা নতুন সাহিত্যের খোঁজ করতে শুরু করল, ফলত ইংরেজি বিভাগগুলোতে কিন্তু দলিত সাহিত্য পড়ানো হয়। ২০১২-’১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি অনার্সে প্রথম দলিত সাহিত্য পড়ানো শুরু হয়। ইংরেজি বিভাগগুলোতে এটা পড়ানো সম্ভব হচ্ছে একটা কারণেই, কারণ তাদের দায় নেই বিশেষ কোনও শ্রেণির জাতীয়তাবোধ তৈরি করা। অন্যান্য ভাষার সঙ্গে ইংরেজির কিন্তু শিক্ষণপদ্ধতিগতও কিছু পার্থক্য আছে। আঞ্চলিক সংযোগের কারণে বাংলা বিভাগে দলিত সাহিত্য পড়ানো যতটা অস্বস্তিকর, ইংরেজিতে কিন্তু তা নয়। বাংলা অনার্সের ক্লাসরুমে নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করা ছাত্রের উপস্থিতির সংখ্যা যত বেশি, ইংরেজিতে তা নেই বললেই চলে। ফলত সেখানে পড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ততা বাধাপ্রাপ্ত হয় না।
আরও একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় রচিত দলিত সাহিত্য কিন্তু সেই ভাষার অন্যান্য সাহিত্যিকের রচনার সঙ্গে তুলনীয় হয়। ইংরেজিতে কিন্তু তা হয় না। সেখানে গুণগত মানের চেয়েও মুখ্য হয়ে ওঠে সাহিত্যিকের প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থান।
(চলবে)