পায়ে পায়ে
পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত হব, এ-কথা প্রায়শ ভাবে। কিন্তু সাদা পোশাকের পরি-র অভাবে প্রাণ ভরিয়ে ওড়া হয় না রাতের আকাশে। তবে কি তার ডানা কাটা বলে কবি তাকে চিনতে পারে না? এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই বনের মধ্যে, পথের ধূলায়, নদীর পাড়ে! কোনোদিন কবে তার দেখা পাবে কি পাবে না জানা নাই, তবু প্রতিদিন গেঁথে চলে বুনোফুলের মালা। ধুস শালা, পরি-র বিরলে এই শীতকাল আর ভালো লাগে না তার। তবে সেই মরমিয়া আশা একেবারে হারিয়ে ফেলে না। গ্রীষ্মে-ক্লান্ত মঙ্গলবারের পর বৃষ্টি-স্নাত বুধবারেও সে আরও একটি কবিতা লেখে। কিন্তু ফেসবুকে দেয় না। কোনো ক্ষুদ্রপত্রিকায় ছাপা কিংবা সরাসরি বই হয়ে প্রকাশিত হবে। বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে যাবে সেই পরি, ডানা কাটা বলে তুমি যাকে কোনো দিবস অথবা রাতে কিছুতেই চিনতে পারোনি। এলোমেলো ঘুরে বেরিয়েছ বনের মধ্যে, পথের ধূলায়, নদীর পাড়ে।
১ ফর্মার বই
আয়, তোকে কোলে তুলে নিই। শ্বাসগন্ধ অনুভব করি ধূসর কাগজের। যে লিখেছে ১ ফর্মার বইটি, হয়তো সে থাকে বাঁকুড়া অথবা পুরুলিয়ার কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তার টালির চাল মাটির ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় দূরের সবুজ পাহাড়। বিনয় মজুমদারের কবিতা সে বার বার পড়ে। গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে সাইকেল চালায়। তরুণের এক ছোটো বোন আছে, দশম শ্রেণির। মায়ের হাতের রান্না আর বকুল গাছের ছায়া ভালো লাগে খুব। তার সবচেয়ে প্রিয় রং হল পলাশের লাল। বিকেলে সে টিলার উপরে বেড়াতে গিয়ে পাথর, প্রজাপতি আর গাছের সঙ্গে কথা বলে। সে তার নিজের সমূহ স্বপ্ন লিখেছে স্বল্প দৈর্ঘ্যের সব অপূর্ব কবিতায়। প্রচ্ছদে রয়েছে আকাশের নীল। লিটল ম্যাগাজিন মেলার ৩০০ নম্বর টেবিল থেকে ঝোলায় পুরে আমি নিয়ে এসেছি তোমাকে। আজ রাতে খুব ভালোবাসব বলে।
জগতের রহস্য
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় যে আকাশের নীল, একদিন তোমাকে দেখাব, আজও মনে মনে এরকম ভাবি। কিন্তু তুমি আর নেই সে তুমি। ব্যাঙাচি থেকে এখন ব্যাঙে পরিণত হয়ে গেছো। থাকো একটা পরিত্যক্ত কুয়োর মধ্যে। আমি ঘুরে বেড়াই নানা দেশ। কত পাখি দেখি। প্রজাপতি। বট ফল। রাত্রি যাপন করি পাহাড়চূড়ায়। তরী নিয়ে ভেসে যাই মাঝ দরিয়ায়। মেঘেদের সঙ্গে উড়তে উড়তে তখন তোমার সাদা পোশাকের কথা মনে পড়ে। ভাবি সেইসব পানশালাদের কাঠের দেয়াল, যেখানে যেখানে আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। বরফ পড়ছিল, আমরা যখন বেরিয়ে আসছিলাম ডিকি’স বার থেকে। বৃষ্টি হচ্ছিল, যখন আমরা সান্দাকফু থেকে রিম্বিকের দিকে নেমে আসছিলাম। রাজস্থানে গিয়ে আমরা ছিলাম মরীচিকা লজ-এ। টেন্ট পেতে ছিলাম ভ্যালি-তে ভ্যালি-তে। মাতাল হয়ে তুমি বুকে জড়িয়ে ধরতে আমাকে। ভাত খাইয়ে দিতে মাছের সমুদ্র দিয়ে। কিন্তু তুমি আর নেই সে তুমি। তাই মল্লভূম থেকে উড়ে চলে গেছি ধলভূমগড়। আমি ঘুরে বেড়াই নানা দেশ, কিন্তু জগতের রহস্য কিছু বুঝতে পারি না।
স্বপ্নের মুহূর্তে
গরম পড়েছে, তাই শীতঘুম থেকে উঠে আমি কবিতা লিখছি। আমার গায়ে দেখা দিচ্ছে অল্প অল্প ঘাম। কবিতা লেখার মাধ্যমে শ্রমের রহস্য বুঝতে পারছি। হাওয়া কেন এত ভালো লাগে আমাদের? ভালোবাসতে এত ইচ্ছা করে কেন? গাছ দেখলেই কেন জড়িয়ে ধরতে চাই তার মায়া আর আকাশ দেখলেই মন আমার পাখি হয়ে উড়ে যেতে চায়! পৃথিবীর কপালে আমি পরিয়ে দিয়েছি চাঁদের টিপ। বৃক্ষে বৃক্ষে পাখিদের সব বাসা আমার রচনা। আমি নিজে রান্না করে খাই। আগুন আমার ভাই। আমি গাই জগতের জয়গান। শুনি বাউলের, ফকিরের, পাখিদের। প্রয়াত বন্ধুর কণ্ঠে ভেসে আসে রবীন্দ্রসংগীত। দেখি রং-তুলি দিয়ে আঁকা সব ছবির বাড়িতে রক্তমাংসের মানুষের বাস। ধোঁয়া ওঠে খড়ো চাল রন্ধনশালার। শিশুদের খিদে-পেয়েছে-কান্না শোনা যায়। মনে হয়, কাছে গিয়ে দোলনা থেকে কোলে তুলে নিই। একটা প্রজাপতির দিকে ছুটে যাই আমি, দেখব বলে অপরূপ পাখার বাহার। এসব স্বপ্নের মুহূর্তে ভুলে যাই আমি এক সামান্য শ্রমিক, মধু-গন্ধে ভরা বাংলা কবিতার।
কাঠামো
মৃত্তিকা ধুয়ে গেছে বরষার জলে। অন্তহীন আকাশের নীচে খড় আর বাঁশের কাঠামো শুধু জেগে আছে। ক্ষয়িষ্ণু হাত দিয়ে কাছে ডাকি তোমাদের। ডাকি আকুলভাবে, মনের বেদনায়। কিন্তু তোমরা ফিরেও দ্যাখো না এই জঙ্গলের দিকে। মুন্ডুহীন ধড় নিয়ে বার বার ডাকি তোমাদের। আশা ও প্রত্যাশায় ডাক দিই তোমাকেও, যখন আটপৌরে শাড়ি পরে জল নিতে যাও ঘাটে। তবে মুখের উপর অতটা ঘোমটা নামানো থাকলে কীভাবে দেখবে আমার ডাক? রাখাল বালক বাঁশিতে এমন বিভোর, সে-ও চোখ বুজে বুজে পথ চলে। শিকারির দৃষ্টি, খালি শিকারের দিকে। পাখি দেখতে যে এসেছে বনে, সেই চোখ শুধু ঊর্ধ্বচারী। হে পথিক, ও পর্যটক, কোনো এক গাঁয়ের বধূ, তোমরা সচেষ্ট হও, কাছে দূরে যদি পাও কোনো মৃৎশিল্পীর সন্ধান। সে এসে আবার আমাকে ফিরিয়ে দেবে মাটির শরীর। দেবে তেলরঙের পালিশ। অনির্বাণ আশা নিয়ে কেটে যাচ্ছে দিনের পরে দিন। অথচ মুন্ডুহীন ধড়ের এই আর্তনাদ তোমরা শুনতেই পাচ্ছ না! আমার মর্মভেদী হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে বয়ে চলেছে পতিতপাবনী গঙ্গা…
ডাক আসে
পাখির ডাকের দিকে যাব। নদীর ঢেউয়ের পানে। শীতল হব অঙ্গে মেখে পাহাড়চূড়ার বরফ। উটের পিঠে চেপে আমি পৌঁছে যাব এক মরুকন্যার তাঁবুর পর্দায়। আমার সামনে খুলে যাবে গ্রন্থাগারের দরজা আর গভীর বনের পাতা-ঝরা শুঁড়িপথ। আকাশ পেরিয়ে, উচ্চতর মহাকাশে ভাসমান অনুভূতি পাব। তার আগে দোয়েল পাখির সঙ্গে দেখা হবে। কত কত দিন পরে, শত শত গান সে আমাকে শোনাবে। শোনা যাবে তোমাদেরও বাড়ি থেকে, জানলা খোলা রেখো। আমি কখন আসব, যাব, তার কি কিছু ঠিক আছে! দরজা তখন খুলে দিয়ো। চাপিয়ে দিয়ো ভাতে ভাত, কলাপাতায় খাব। যখন অরণ্যের আহ্বানে আমি বায়নাকুলার হাতে চলে যাব, তুমি প্রীতি ও শুভেচ্ছা নিয়ো। পাখির ডাকের দিকে যাব আমি। আমার ঠিকানা হবে এক নিবিড় বনানী।