ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • লিপ-ইয়ারি কথা


    সৈকত ভট্টাচার্য (February 10, 2024)
     

    সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখনও নাজারেথ গ্রামের সেই আশ্চর্য শিশুর জন্মের প্রায় অর্ধশতাব্দী দেরি। জগতের সমস্ত সড়কের গন্তব্য তখন একটাই জায়গা— রোম। আর সেই রোমের অধীশ্বর হলেন ইতিহাস ছেড়ে কিংবদন্তিতে জায়গা নিয়ে ফেলা স্বয়ং জুলিয়াস সিজার! আমাদের গল্পের শুরু সেই সময়।

    জুলিয়াস সিজারের আমলে রোম তখন শিল্প, সংস্কৃতি, বৈভব সকল দিক থেকেই জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটা নিয়ে বসে আছে। দেশের মানুষ কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই, হিপ্পোড্রোমে রথের দৌড় দেখে সুখে-শান্তিতে দিন গুজরান করছে (মাঝেমধ্যে দুষ্টু দুই গল যে একটু ঝামেলা করে না, তা নয়, কিন্তু সে কথা আজ থাক)। তবে সমস্যা একটাই— সেটা হল সময়ের সমস্যা। মানে? রাজার সময়ের অভাব? নাহ্‌, তা নয়। তিনি দিব্যি আজ রোম, কাল মিশর করে বেড়াচ্ছেন। ক্লিওপেট্রার কাছে আদরযত্ন খাচ্ছেন, নীলনদের জলে জলকেলি করে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু মুশকিল হল দেশে যে ক্যালেন্ডার চালু রয়েছে, তার দিনক্ষণের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এমনিতে চান্দ্রবর্ষের হিসাবে তিনশো পঞ্চান্ন দিনে বছর হয় রোমানদের। কিন্তু দু’বছর বাদে-বাদে সুবিধা মতো বাইশ-তেইশ দিন করে জুড়ে দেওয়া হয় বছরের শেষে। ফলে নিজের বয়সেরই হিসেব থাকে না, বাকি সব তো ছেড়েই দিলাম! এমন ব্যবস্থা চলে আসছে গত পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। রোমের দ্বিতীয় সম্রাট শ্রীল শ্রীযুক্ত পম্পিলিয়াস চালু করেছিলেন এই ক্যালেন্ডার। তার আগে অবশ্য ব্যাপার আরও সঙ্গিন ছিল। প্রথম রোম সম্রাট রোমুলাসের সময় ছিল দশ মাসে বছর। মার্চ (ল্যাটিন নাম ছিল মার্শিয়াস) থেকে শুরু করে ডিসেম্বর। তারপর দু-মাসের লম্বা শীতঘুম। ওই বরফের চাদরের তলায় ঢাকা পড়ে থেকে কাজ-কাম কিছু হয় না। তাই সম্রাট বললেন, সেই সময় দিন, মাস, বছর এসবের হিসেব রাখার দরকারটা কী? হক কথা! ফলে বছরবাবু দু-মাসের শীতের ছুটির পর আবার ফিরে আসতেন মার্চে।    

    পম্পিলিয়াস রাজা হয়ে এই হাপিস হয়ে যাওয়া দু-মাসকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলেন। নইলে বাকি দুনিয়ার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য, কূটনীতি, দুর্নীতি সবেতেই বেজায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অতএব ওই দশ মাসের পর জুড়ে দেওয়া হল আরও দুই মাস— ইয়ানুয়ারিয়াস (অর্থাৎ কিনা জানুয়ারি) এবং ফেব্রুয়ারিয়াস (মানে ফেব্রুয়ারি)। তবে পম্পিলিয়াস ছিলেন বেজায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। জোড় সংখ্যাকে শুভ মনে করতেন না। রোমুলাসের ক্যালেন্ডারে ছয় মাস হত তিরিশ দিনের, বাকি চার মাস হত একত্রিশ দিনের। পম্পিলিয়াস ওই ছ’মাসের দিনসংখ্যা তিরিশ থেকে কমিয়ে করলেন ঊনত্রিশ। ফলে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের দিন সংখ্যা দাঁড়াল দুশো আটানব্বই। মার্চ আসতে বাকি পড়ে রইল সাতান্ন দিন। এবার এই সাতান্ন দিনকে দুই ভাগে ভাগ করলে কোনও একজনের কপালে জোড় সংখ্যা পড়বেই। সেই দুর্ভাগ্যের ভাগী করা হল ফেব্রুয়ারি মাসকে। কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যুর দেবতার উদ্দেশে কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করত রোমানরা। সুতরাং তার কপালে না হয় রইল একটু দুর্ভাগ্য। অতএব ফেব্রুয়ারি মাস হল আঠাশ দিনে।    

    কিন্তু মুশকিল আসান হল না। কয়েক বছর বাদে মার্চ মাসে ঠান্ডা পড়তে শুরু করল। যে সময় বরফ গলে বসন্ত আসার কথা সে সময় বরফ পড়ছে নতুন করে। এ কী অশৈলী কাণ্ড! পণ্ডিতেরা হিসেবনিকেশ করে রাজাকে বোঝালেন যে এমনি দু-মাস জুড়ে দিয়েছেন, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু এই ব্যাটা সূর্য যে মহারাজের কথা শোনে না। তাকে ধরে সিংহের মুখে ছেড়ে দেওয়াটাও একটু সমস্যার। অতএব অয়ন-চলনের হিসাবে প্রতি বছর দিন দশেক করে হাপিস হয়ে যাচ্ছে। তাই বছর তিনেক পরে গরমিলের হিসাবটা দাঁড়াচ্ছে প্রায় এক মাসে। ফলে মার্চ মাস এগিয়ে গিয়ে ফেব্রুয়ারির জায়গা নিচ্ছে। প্রকৃতি নিয়মে তো আর গোঁজামিল নেই। শাহেনশা বললেন বেশ তো, তবে প্রতি দু’বছর অন্তর বছরের শেষ মাস ফেব্রুয়ারির পরে দিন কুড়ি অপেক্ষা করে তারপর শুরু করো নতুন বছর। তাড়া কীসের? পণ্ডিত বললেন, আজ্ঞে জাঁহাপনার যেমন মর্জি। 

    এই ব্যবস্থা চলেছে তারপর অর্ধ সহস্রাব্দের বেশি। জুলিয়াস সিজারও পাল্টাতেন কি না জানি না, যদি না, ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়তেন। এমন অদ্ভুতুড়ে বর্ষপঞ্জি দেখে সে হেসেই আকুল। মিশরের ক্যালেন্ডারের তুলনায় অনেক ভাল। বছরে বারোটা মাস। প্রতিমাস তিরিশ দিনের। আর নতুন বছর শুরুর সময় পাঁচ দিনের বর্ষবরণ হয়, সেই পাঁচদিনের হিসাব ধরা হয় না ক্যালেন্ডারের পাতায়। ফলে তাদের চান্দ্র-ক্যালেন্ডার সূর্যের গতিবিধির সঙ্গে দিব্যি মিলে যায়। সিজার তলিয়ে ভেবে দেখলেন কথাটা ঠিকই— এর তুলনায় রোমান ক্যালেন্ডার ভারী গোঁজামিলের। ব্যবস্থাটা পাল্টানো দরকার। ক্লিওপেট্রাকেই শুধোলেন, হে বরবর্নিনী সুহাসিনী, তুমিই না হয় বলো উপায় কী? 

    মিশর-সম্রাজ্ঞী ব্যাঁকা হেসে বললেন, মরণ! তারপর গ্রীক জ্যোতির্বিদ সসেজেনিসকে ডেকে বললেন, দ্যাখো দিকি, এই মিন্‌সের জন্য একটা ক্যালেন্ডার বানিয়ে দিতে পারো কি না। 

    ওই যে ছয় ঘণ্টার কথা বলেছিলাম উপরে, যা চার বছরে বেড়ে দাঁড়ায় চব্বিশ ঘণ্টায়। আর সেই চব্বিশ ঘণ্টাই জন্ম দেয় ২৯শে ফেব্রুয়ারির; আসলে, ওটা ঠিক ছয় ঘণ্টা ছিল না। সসেজেনিস হিসাবের সুবিধার জন্য পাঁচ ঘণ্টা ঊনপঞ্চাশ মিনিটকে ধরেছিলেন ছয় ঘণ্টা।

    ব্যাস, তৈরি হল এক নতুন সৌর-ক্যালেন্ডার। নিজের নামে সিজার তার নাম রাখলেন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। কিন্তু এতদিনের গোঁজামিলের ক্যালেন্ডারের চক্করে মহাকালের কাছে বাকি পড়ে গেছিল প্রায়  চারশো পঁয়তাল্লিশ দিন। তাই একটা লম্বা-বছর পালন করে ৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে চালু হল নতুন বর্ষপঞ্জি। সসেজেনিস হিসেব করে সম্রাটকে দেখিয়েছিলেন যে আসলে আকাশের ঠিক একই জায়গায় সূর্যের ফিরে আসতে সময় লাগে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ছ-ঘণ্টা— অতএব বছর গোনা হোক তিনশো পঁয়ষট্টি দিনেই। প্রতি চার বছরে এই ছ ঘন্টা সময় যে বেড়ে গিয়ে একটা গোটা দিনে দাঁড়াবে, সেটাকে জুড়ে দেওয়া হবে বছরের শেষ মাস ফেব্রুয়ারিতে। এমনিতেই ফেব্রুয়ারির খাতায় কম দিন, ফলে প্রতি চার বছরে এই বোনাস দিন জুড়লে অসুবিধার কোনও কারণ নেই। ব্যাস, শুরু হল লিপ-ইয়ার!

    জুলিয়াস সিজার রোমান ক্যালেন্ডারকে ঢেলে সাজানোর সঙ্গে আর একটা কাজও করলেন, সেটা হল ১ জানুয়ারি থেকে বর্ষ গণনা শুরু করলেন। ফলে মার্চ হল তৃতীয় মাস। কিন্তু পুরনো হিসেব অনুযায়ী সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর সেই সপ্তম, অষ্টম, নবম আর দশম মাসের নামই বয়ে চলল।

    জুলিয়ান ক্যালেন্ডার রোমের জয়যাত্রার সঙ্গে সামিল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গোটা ইউরোপে, সেখান থেকে অন্যান্য জায়গায়। এমন বিজ্ঞানসম্মত বছর গণনার পদ্ধতি কেউ কোনও দিন দেখেনি; ফলে সকল দেশেই প্রচলিত হতে খুব বেশি সময় লাগল না। কিন্তু কেউ যেমন কোনও দিন ভাবেনি এমন সর্বশক্তিমান রোমান সাম্রাজ্যও একদিন কালরথের চাকায় পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যাবে, ঠিক তেমনই কেউ আশা করেনি সসেজেনিসের অঙ্কে একটা ছোট্ট ভুল রয়ে যাবে। অবিশ্যি একে ঠিক ‘ভুল’ বলা চলে না। বরং বলা ভাল, আসন্নমানজনিত ভ্রান্তি। ওই যে ছয় ঘণ্টার কথা বলেছিলাম উপরে, যা চার বছরে বেড়ে দাঁড়ায় চব্বিশ ঘণ্টায়। আর সেই চব্বিশ ঘণ্টাই জন্ম দেয় ২৯শে ফেব্রুয়ারির; আসলে, ওটা ঠিক ছয় ঘণ্টা ছিল না। সসেজেনিস হিসাবের সুবিধার জন্য পাঁচ ঘণ্টা ঊনপঞ্চাশ মিনিটকে ধরেছিলেন ছয় ঘণ্টা। ফলে প্রতি চার বছর অন্তর কালের হিসেবের খাতায় ধার হচ্ছিল এগারো মিনিট। এ আর এমনকী, বলে কেউ মাথা ঘামায়নি প্রায় দেড় হাজার বছরের বেশি সময়! অবশেষে ১৫৮২ সালে রোমান চার্চ নড়েচড়ে বসল। মহাবিষুবের ক্যালেন্ডারের তারিখ আর মহাজাগতিক হিসাব অনুযায়ী দিনের মধ্যে প্রায় দিন দশেকের ফারাক। অতএব ফের হিসেবনিকেশ। ধুলোটুলো ঝেড়ে পুরনো হিসাবের খাতা বের করে ধরা পড়ল এগারো মিনিটের ফাঁকি। প্রতি বছর এগারো মিনিট জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের শুরুর দিন থেকে জমে জমে হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় বারো দিনে। এই ফাঁক বোজানোর জন্য অক্টোবর মাস থেকে সে বছর কাটা গেল দশ দিন। ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসের ক্যালেন্ডার দেখলেই দেখতে পাবেন ৪ অক্টোবরের পর তারিখ সিধে চলে গেছে ১৫ অক্টোবরে। মাঝের দশ দিন ভ্যানিশ।

    আগের ভুল না হয় বোজানো গেল। ভবিষ্যৎ? পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির নির্দেশে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে একটা ছোট্ট বদল হল। প্রতি চারশো বছরে এই এগারো মিনিট বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন দিনে। ফলে নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শতাব্দকে যদি চারশো দিয়ে ভাগ করা যায় তবেই তা হবে লিপ-ইয়ার, নয়তো নয়। তাই ২০০০ সাল লিপ ইয়ার হলেও ২১০০ সাল লিপ-ইয়ার হবে না। অর্থাৎ তখন ২০৯৬ এর পর একেবারে ২১০৪ সালের ফেব্রুয়ারি হবে ঊনত্রিশ দিনের। লিপ-ইয়ারের হিসাব আপাতত এখানে শেষ হলেও, ‘প্রায়’ এর সংখ্যা শেষ হয়নি। চারশো বছরে ওই এগারো মিনিট দাঁড়িয়েছিল প্রায় তিনদিনে। আসলে তিয়াত্তর ঘণ্টা উনিশ মিনিট। এখানে তিন দিন ধরায় ফের ফাঁকি পড়েছে এক ঘণ্টা উনিশ মিনিটের। সহজ পাটিগণিতের হিসাবে ৭২৯১ বছরে এই এক ঘণ্টা উনিশ মিনিট বেড়ে দাঁড়াবে এক দিনে। তখন কি তবে সেই বিজোড় সংখ্যক বছরকে ঘোষণা করতে হবে লিপ-ইয়ার? অবিশ্যি তদ্দিনে মানবজাতিটাই থাকবে কি না কে জানে! সাধে কি পম্পিলিয়াস বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারি মাসটাই বেজায় গোলমেলে!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook