ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল : পর্ব ৩৩


    শ্রীজাত (February 17, 2024)
     

    লুকোচুরি

    বিকেল হয়ে এলে এক-একদিন কোথায় লুকোব ভেবে পেতাম না। আমরা জনা দশেক ছেলেমেয়ে মিলে বেশিরভাগ বিকেলেই লুকোচুরি খেলতাম তখন। কত আর বয়স হবে, বড়জোর দশ কি এগারো! ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হতই, কিন্তু সেসব খেলার কেতা আর ঝক্কি নেহাত কম নয়। স্কোর রাখো, উইকেট বসাও, নেট টাঙাও ইত্যাদি। তাই ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টনের দিনক্ষণ আমরা আগে থাকতেই ঠিক করে রাখতাম। রইল পড়ে বাকি দিনগুলো, সেসবে ইচ্ছেমতো সহজ খেলা হত। তার মধ্যে সম্ভবত সবচাইতে সহজ ছিল এই লুকোচুরি। ‘উবু দশ কুড়ি তিরিশ চল্লিশ’ গুনতে-গুনতে সকলের বুকে একটা করে আলতো হাতের ঠোক্কর, তারপর যে-চোর সাব্যস্ত হল, সে বেচারি পাঁচিলে মুখ ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকবে, এক থেকে দশ কি কুড়ি গুনবে, আর বাকিরা ততক্ষণে লুকোবে। এই তো হল মোদ্দা খেলা। জলের মতো সহজ। কিন্তু তার মধ্যেও যে কত রকমের আবিষ্কার লুকিয়ে ছিল, আজ ভাবি।

    প্রথমে বলি, যত ছোট থেকে বড় হচ্ছিলাম, ততই এই খেলার অঞ্চল বা যাকে বলে প্রেমাইস, বড় হতে থাকছিল। সেটাই খুব স্বাভাবিক। ক্লাস ফাইভে যে-বাগানে লুকিয়ে শান্তি পাওয়া যায়, সিক্সে উঠলে সেই বাগানকেই একটু ছোট মনে হয়। একই জায়গায় লুকোতে আঁতে লাগে। তখন মনে হয় পাশের বাড়ির পুকুরপাড় বা পিছনের কচুঝোপের আড়াল অনেক শ্রেয়। মানুষ বোধহয় এভাবেই নতুন দ্বীপ আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যায়, তখন মনে হত। তা সে যা হোক, আমরা যে-বাড়িটায় ভাড়া থাকতাম, লুকোচুরির গ্রাউন্ড হিসেবে তার চৌহদ্দিটা বেশ পোক্তই ছিল। বিশাল ছড়ানো দোতলা বাড়ি, সামনে বাগান, পিছনে মাঠমতো, তাতে দেদার আলোছায়া গাছের কাটাকুটি। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দরজা খোলা থাকলে তো আরও বেশ কিছু রাস্তা মিলে যেত লুকিয়ে থাকবার। এমনকী রোগা হবার সুবাদে আমি নারকেল গাছের গুঁড়ির পিছনে লুকিয়ে থেকেছি এবং আমাকে খুঁজে পেতে চোর বেশ বেগ পেয়েছে, এও ঘটনা।

    বাড়ির পেছন দিকটায় ছিল মস্ত লেবু গাছ। তার বুনোট এমনই জটিল যে, দেখলে মনে হত কেউ খুব বড়সড় একখানা নকশাদার সোয়েটার বুনে রেখেছে। তবে তার সারা গায়ে এত বেশি কাঁটা ছিল যে, আমরা লুকোতে ভয় পেতাম। তবুও, মাঝেমধ্যে মরিয়া হয়ে সে-গাছের ডালের এদিক-ওদিক আড়াল খুঁজেও লুকোনো হত। মজাটা তখন বাড়ল, যখন আমরা খেলার পরিখা বা পেরিফেরি বাড়ালাম। স্বাভাবিক ভাবেই টানা এক-দেড় বছর ওইটুকু এলাকায় খেলে-খেলে লুকোনোর নতুন জায়গা আর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ নতুন খেলাও আর নেই। তখন প্রায় এক সন্ধে জুড়ে একখানা গম্ভীর সভা ডেকে স্থির করা হল, এবার এই চার পাঁচিলের বাইরে পাড়ার নানান জায়গায় লুকোনো যাবে। কিন্তু পাড়া তো তখন আমাদের কাছে অসীম, অনন্ত একখানা অঞ্চল। তার মধ্যে কে কোথায় লুকিয়ে আছে, সে কি কারও পক্ষে খুঁজে বার করা সম্ভব? ফলে তারও একটা মোটামুটি চৌহদ্দি ঠিক করা হল। উত্তর দিকে টুসিদের বাড়ির পাঁচিল, পুবদিকে টোকনদার মুদির দোকান, পশ্চিমে বুবাইদের পোড়ো বাগান আর দক্ষিণে নস্করপাড়ার প্রথম সেলুনটা।

    এ-বয়সে এসে আমার লুকোচুরির জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেরই লেখা। অন্য কেউ তো খেলায় নেয় না, সেসব বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই আর, কবেই ছেড়ে চলে এসেছি সেই পুরনো পাড়া, পুরনো বাড়ি। কিন্তু লুকোচুরিটা ছাড়িনি। পুরনো অভ্যেস কি অত সহজে মরে? লিখতে-লিখতে যখন মনে হয়, আরে, এ তো নিজের চেনা চৌহদ্দির মধ্যেই পাক খাচ্ছি। তখনই বেরিয়ে পড়ি।

    এই বড় চৌহদ্দিতে খেলাটা শুরু হবার পর আগের চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট হয়ে গেল। প্রথমত, এক-একটা রাউন্ড শেষ হতেই অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে, কেননা ওই অত বড় এলাকা থেকে আট-ন’জনকে খুঁজে বার করা চাট্টিখানি কথা নয়। দ্বিতীয়ত, লুকোতে গিয়ে নিজেরই পাড়ায় কত অদেখা জায়গা যে আবিষ্কার করছি, তার ইয়ত্তা নেই। এক-একদিন মনে হচ্ছে, আরে! এমন একখানা গলি, এরকম একটা পাঁচিল, এই ধরনের কোনও পোড়ো বাড়ি আমাদেরই পাড়াতে ছিল এতদিন ধরে? কই, দেখিনি তো! অথচ কত-কত বছর ধরে এই পাড়ায় বাস করছি, এসব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর আসছি রোজ। অথচ তাদেরই আশেপাশে যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এমন সব জায়গা, তা লুকোতে গিয়ে টের পেলাম। সত্যি বলতে কী, খেলা কেমন হল না হল, তার চেয়ে নতুন লুকোনোর জায়গা খোঁজার আনন্দটাই বেশি হয়ে উঠল তখন। এক রকম নেশা হয়ে দাঁড়াল। কাল তো অমুক জায়গায় লুকিয়েছিলাম, আজ তাহলে ওইদিকটায় গিয়ে দেখি তো, কোনও নতুন লুকোনোর জায়গা পাই কি না! এইভাবে যে নিজেরই চেনা পাড়ার মধ্যে কত-কত নতুন অদেখা জায়গায় ঘোরা হল ওই খেলার এক-দু’বছর, তার ইয়ত্তা নেই। এখন তো বাচ্চাদের খেলাধুলোর ধরন বদলে গেছে অনেকটাই, তারা আর বিকেল হলেই দল পাকায় না, ছোটাছুটি করে না। যে-সময়ের যে-নিয়ম, তেমনটাই তো হবার কথা। এসবের জন্য বিচারকের আসনে বসে কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেসব মধ্যবিত্ত পাড়াই বা আর কোথায়, যেখানে রোজ নিত্যনতুন জায়গার খোঁজ পাওয়া যাবে?

    এ-বয়সে এসে আমার লুকোচুরির জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেরই লেখা। অন্য কেউ তো খেলায় নেয় না, সেসব বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই আর, কবেই ছেড়ে চলে এসেছি সেই পুরনো পাড়া, পুরনো বাড়ি। কিন্তু লুকোচুরিটা ছাড়িনি। পুরনো অভ্যেস কি অত সহজে মরে? লিখতে-লিখতে যখন মনে হয়, আরে, এ তো নিজের চেনা চৌহদ্দির মধ্যেই পাক খাচ্ছি। তখনই বেরিয়ে পড়ি। ভাবি, এবার পরিখাটাকে একটু বাড়িয়ে নিলে মন্দ হয় না তো! নিজের কবিতাকে নিয়ে, উপন্যাসকে নিয়ে সেইসব পথে হাঁটতে চেষ্টা করি, যেসব জায়গায় এর আগে যাইনি আমি। যেমন সব লেখা আমার হাতে আসেনি এর আগে। তাতে ফল ওই একই হয়। খেলাটা শেষ হতে অনেকটা সময় লেগে যায়। কেননা নতুন পথ খুঁজতে হয়, সেইসব পথে যাওয়া-আসার রাস্তা বুঝে নিতে হয়, তবে তৈরি হয় নতুন লেখা। নতুন খেলা। লুকোচুরি। কী হয় বা কেমন হয় সেসব লেখা, আদৌ লেখাই হয়ে ওঠে কি না, তা আর ভাবি না তখন। কেননা নতুন জায়গা খোঁজার নেশা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

    আর যখন সত্যিই খুঁজে পাই নতুন কোনও কবিতাপথ বা গদ্যঠিকানা, লেখা হয়ে যাবার পর তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এইসব কথা, এরকম পংক্তি, এই ধরনের অভিব্যক্তি আমারই মধ্যে বাসা বেঁধে ছিল এতগুলো বছর? আর আমি তাদের দেখতেও পাইনি এতদিন? এই এত বয়সে এসে তাদের আবিষ্কার করলাম? অবাক লাগে নিজেরই। কিন্তু ভেবে মন ভাল হয়ে যায় এটুকুই যে, দেখা তো হল একখানা নতুন পথ, নিজেরই ভিতরে হেঁটে চলে! এতদিনে একখানা নতুন লুকোনোর জায়গা তো আবিষ্কার করলাম অন্তত, যেখান থেকে আমাকে খুঁজে বার করতে একটু হলেও বেশি সময় লাগবে! শিল্পের প্রাপ্তি তো এইটুকুই। এর বেশি যা কিছু বাইরে থেকে পাওয়া যায়, তার কোনও কিছুরই আনন্দ এই নতুনের আবিষ্কারের চেয়ে বেশি নয়, আজ বুঝি। আর বুঝি, পুরনো সেই পাড়াটাকে আজও নিজের ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। রোজ বিকেলে একাই বেরোচ্ছি, নতুন জায়গা খুঁজব বলে। কেবল বাইরে কেউ সেটা দেখতে পাচ্ছে না, এই যা।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook