ঝামাপুকুরের সংকীর্ণ গলির মধ্যে ছোট্ট একটা বাড়ি। ভেতরে জ্বলছে বোতলের মুখে গোঁজা টিমটিমে মোমবাতি। করালীচরণ বক্সি তন্ময় হয়ে বই পড়ছেন। বাঁ-হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দুনিয়ায় নিজের বলে কেউ নেই তাঁর। থাকার মধ্যে শুধু জীর্ণ এই বাড়িটুকু। একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র এবং ‘গণিতে প্রথম শ্রেণির এম.এ.’ করালীকে, লোকে এখন বলে— পাগল, পণ্ডিত অথবা শয়তান। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ঠোঁটদুটি হেজে গেছে। সারা মুখে বসন্তের দাগ স্পষ্ট। এ-রোগেই একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। অবশ্য অপর সুস্থ চোখটা বেশি রকম প্রদীপ্ত, যেন দপদপ করে জ্বলছে। বই পড়া করালীর বড় নেশা, মূলত ‘ডিটেকটিভ’ উপন্যাস। সাসপেন্সের এক মুহূর্তে মিস মারগারেট যখন কার্নিসে ঝুলছেন, হঠাৎ সিগারেটের ছাই পড়ে গেল বইয়ের পাতায়। বিরক্ত করালীচরণ একবার ফুঁ দিয়ে ছাই পরিষ্কার করতে গিয়ে পড়লেন আর এক মহাবিপদে। ফুঁ-এর চোটে নিভে গেল মোমবাতি। অন্ধকারে চারিদিক হাতড়ে নানান ঠিকুজি-কুষ্ঠির কাগজ পাওয়া গেল বটে, কিন্তু কোনও দেশলাই মিলল না। অধৈর্য করালীচরণ এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। এমন সময়ে ভনটু এসে দেশলাই দান করে প্রাণ বাঁচাল। করালী সমস্ত দিন মদ খেতে পায়নি। বাধ্য হয়েই বসেছিল সে বইটা নিয়ে। করালীর কথায়: ‘[বইটা] ডিটেকটিভ আর পর্নোগ্রাফি কমবাইণ্ড। চমৎকার নেশা হয়, ওয়াণ্ডারফুল!’
ডিটেকটিভের বাংলা অনুবাদ মেরেকেটে ‘গোয়েন্দা’ করা গেলেও, ‘পর্নোগ্রাফি’র সামাজিক জীবন আখেরে বড়ই জটিল। কাকে বলে ‘পর্নোগ্রাফি’, এমন প্রশ্নের উত্তর বদলে যায় পাঠকভেদে। করালীর বয়ানে যা ‘পর্নোগ্রাফি’, তা যত না এক বিশেষ ‘সংরূপ’, তার থেকেও অনেক বেশি পাঠরূচি-নির্ভর অভিধা বিশেষ। তাই পর্নোগ্রাফি, যৌনতা ইত্যাদি বিশেষ সংরূপগুলি এই বিশেষ পাঠ-অভিজ্ঞতায় মিলেমিশে যায়। অপরাধ এবং যৌনতা বিষয়ের এহেন একনিষ্ঠ পাঠক করালীচরণকে বনফুল হাজির করেছেন ১৯৪৩-এ প্রকাশিত ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে।
সাহিত্য-সমালোচক লীলা রায় ১৯৫৩ সালে A Challenging Decade: Bengali Literature in the Forties গ্রন্থে অপরাধ কাহিনির প্রতি বাঙালি-পাঠকের আসক্তির কারণ খুঁজেছেন। ‘underworld’-কাহিনি-নির্ভর গল্প-উপন্যাসকে তিনি দেখছেন সমুদ্রের অদ্ভুত এবং গভীর জলের মাছের সঙ্গে মিলিয়ে। তাঁর পাঠ-অভিজ্ঞতায় মনস্তত্ত্বের দিকে যাত্রা অত্যন্ত মূল্যবান। মনস্তত্ত্বকে বাদ দিয়ে অপরাধের ইতিহাস একেবারেই অসম্পূর্ণ। তবে নিশ্চিতভাবে মনস্তত্ত্বের পথপরিক্রমা নানা জটিলতায় ভরা।
১৯৪০-এ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে বেরিয়েছিল বাঙালি অপরাধ-বিজ্ঞানী পঞ্চানন ঘোষালের ‘অপরাধ বিজ্ঞান: প্রথম খণ্ড’। এই চারের দশকেই ‘শ্রীআনন ঘোষাল’ ছদ্মনামে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে পঞ্চানন লিখে গেছেন অপরাধ-বিজ্ঞান বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ। ১৯৫৪ সালের মধ্যে ‘অপরাধ-বিজ্ঞান’ নিয়ে তাঁর গবেষণা আটটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকোলজি’ পত্রিকায় এম. এন. ব্যানার্জি জানান: পঞ্চাননের গ্রন্থ ‘অপরাধ-বিজ্ঞানের ওপর লেখা প্রথম বাংলা গ্রন্থ’। পঞ্চানন প্রবর্তন করেছেন নতুন এক চিন্তাধারা, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অপরাধীর বিশ্লেষণ। অপরাধ-বিজ্ঞানের গবেষণাকল্পে মি. ঘোষালের প্রস্তাব সমর্থন করেন এম. এন. ব্যানার্জি। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সি.আই.ডি) ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে মিলে যৌথ পরিষৎ গঠন করে, মনোবিশ্লেষক ও অপরাধ-বিজ্ঞানীদের আশুকর্তব্য অপরাধ-গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
ইতিপূর্বে ১৮৭০-এর দশকে ইতালীয় অপরাধ-বিজ্ঞানের প্রস্থানে গুরুত্ব দেওয়া হত নৃতত্ত্বকে। নৃতাত্ত্বিক অপরাধ-বিজ্ঞান তথা ‘Anthropological Criminology’-র জনক সিজার লম্ব্রজো প্রবর্তিত তত্ত্ব ‘জন্ম অপরাধী’ বা ‘Born Criminal’। লম্ব্রজোর ‘ক্রিমিনাল মানবতত্ত্ব’ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৯২ সালের ‘সাধনা’ পত্রিকায়। মানুষের দৈহিক-গঠন ও ঐন্দ্রিয়িক বিকারের ফল হিসেবে ‘অপরাধ’কে উল্লেখ করেছেন লম্ব্রজো সাহেব: ‘যেমন উন্মাদ একরকম রোগ, ক্রাইমও কতকটা সেইরূপ’। তেঞ্চিনি সাহেব কতকগুলি ‘অপরাধী’র শবদেহ নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। অপরাধীদের কনুইয়ের হাড়ে অনেকগুলির মধ্যে ছিদ্র দেখা যায়। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে ‘অপরাধ’কে বোঝার জন্য এই ‘নিয়ম’ খেয়াল রাখা জরুরি। লম্ব্রজোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হ্যাভলক এলিস ১৯০১ সালে লিখেছিলেন The Criminal।
ইতালীয় অপরাধ-বিজ্ঞান প্রস্থানের বিরোধী শিবিরের প্রবক্তা ইংরেজ মনস্তাত্ত্বিক চার্লস বাকম্যান গোরিং। ১৯১৩ সালে বেরোয় তাঁর গ্রন্থ: The English convict। গোরিং ‘criminal’-এর পরিবর্তে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলেন ‘convict’ শব্দের ব্যবহার। গোরিং-এর বয়ানে: একই বয়সি, সমান উচ্চতার, একই শ্রেণির এবং সমবুদ্ধিসম্পন্ন এক ‘অপরাধী’ ও এক ‘আইন-মান্যকারী’— উভয় ব্যক্তিরই শারীরিক ও মানসিক গঠনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ‘নৃতাত্ত্বিক ক্রিমিনাল টাইপ’ বলে কোনও বস্তু আদৌ হয় না। অর্থাৎ নৃতত্ত্ব দিয়ে খুঁজলে, পাওয়া যাবে না অপরাধের প্রকৃত কারণ। ১৯১২ সালে অপর এক ইংরেজ অপরাধ-বিজ্ঞানী থমাস হোমস লিখে ফেলেছেন Psychology of Crime। জন্মেই মানুষ অপরাধী হয় না, নির্দিষ্ট জাতি বা উপজাতি-কে অপরাধী বিবেচনা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক। অপরাধ-বিজ্ঞানে নৃতত্ত্বের খেল-খতম করতেই যেন গোকুলে বাড়ছিল মনস্তত্ত্বের সুনিপুণ যুক্তিবিন্যাস।
‘সাইকো-অ্যানালিসিস’-এর একনিষ্ঠ চর্চাকারী গিরীন্দ্রশেখর বসু ১৯৪৫ সালে, Everyday Psycho-Analysis গ্রন্থে Crime and Psycho-Analysis অধ্যায়ে লিখলেন: অপরাধের (যা একপ্রকার রোগ) সমাধান হিসেবে সিজার লম্ব্রজো দেখেছেন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন; এনরিকো ফেরি গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজ ও পরিবেশগত গুণ নির্ধারক এবং রাফায়েল গ্যারোফালো আলোচনা করছেন বিচারব্যবস্থা ও আইনগত মীমাংসা। কিন্তু এঁদের তত্ত্বে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব রয়ে গেছে শত যোজন দূরে। গিরীন্দ্রশেখর বললেন, একমাত্র ‘সাইকো-অ্যানালিসিস’ পদ্ধতির মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব অপরাধীর মন ও অপরাধের হাল হকিকত। গিরীন্দ্রশেখরের ছাত্র হওয়ার সুবাদে বিদ্যায়তনিক জগতের যাবতীয় কূটকচালি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন পঞ্চানন ঘোষাল। বনফুলের ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে যেমন এসেছে অপরাধ-সাহিত্যে বুঁদ পাঠক-করালীর গল্প; অপরাধ-কাহিনির প্রতি বাঙালির আকর্ষণের তত্ত্বকথা যেমন বর্ণনা করেছেন লীলা রায়; তেমনি পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে পঞ্চানন তৈরি করলেন তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান, বাঙালির অপরাধ-স্পৃহার স্বরূপ ও উৎস সন্ধান।
পঞ্চানন অপরাধ-তত্ত্বটি সাজালেন ‘অন্যায়’, ‘পাপ’ ও ‘অপরাধ’— এই তিন কার্যের বিচার বিশ্লেষণে। তাঁর কথায় গুরুতর অন্যায়কে পাপ এবং গুরুতর পাপকে অপরাধ বলা যায়। আবার যা কিছু অপরাধ তা পাপ ও অন্যায় উভয়ই। কিন্তু যা কিছু অন্যায় বা পাপ, তাদের অপরাধ বলা যাবে না। অপরাধ হল অন্যায় ও পাপের শেষ স্তর। অর্থাৎ পাপের মাত্রা পূর্ণ হলে, তা হয় অপরাধ। আরও সূক্ষ্ণ স্তরে বলা যায়, অন্যায়, পাপ এবং অপরাধ সমস্ত কিছুর মূলে মানবশরীর। এখান থেকেই উৎপন্ন হয় সকল প্রবৃত্তি। শরীরের ওপরই ধার্য হয় সমাজ, রাষ্ট্র এবং সভ্যতার বিধিনিষেধ। শরীরই ভোগ করে সকল প্রকার শাস্তি। অন্যদিকে শরীর রূপ সমাজে বাসা বাঁধা অপরাধ-রোগের পথ্যি যেন মূলস্রোত থেকে অপরাধীকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। সকল অপরাধী, গুন্ডা, মস্তান, চোর, ডাকাত কিংবা ফেরেব্বাজদের পৃথক এক অণুসমাজে বন্দি করা।
এই অণুসমাজের নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্য। সিজার লম্ব্রজো Criminal Man (১৮৭৬) গ্রন্থে দেখিয়েছেন দারিদ্র্য কীভাবে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। পেলাগ্রা, স্কার্ভি, গণ্ডমাল রোগ কিংবা মদ্যাসক্ত হয়ে বেছে নেয় তারা অপরাধের পথ। কিন্তু তার মানে এই নয়, ব্যাকরণ বইয়ে শেখা ‘সে গরিব কিন্তু সৎ’ গোছের বচনটির বৈধতা সিদ্ধ হল। বরং দারিদ্র্যের সঙ্গে অপরাধের সম্বন্ধ খোঁজা বৃহত্তর অর্থে একটি ঔপনিবেশিক প্রকল্পের আওতায় পড়ে। ১৮৯৩ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় (২য় বর্ষ) ‘অপরাধ’ ও ‘দারিদ্র্য’-র কার্যকারণ সম্পর্কে লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮০-’৯০-এর দশকে ইউরোপে চৌর্য-অপরাধের তালিকা প্রস্তুত করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমাণ করেন: ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সর্বাপেক্ষা ধনী দেশ, অন্যদিকে ইটালির ধন-সঞ্চয় সে-তুলনায় অতি অল্প। কিন্তু ইটালি অপেক্ষা ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের চৌর্য-অপরাধের সংখ্যা অধিক। দারিদ্র্য থেকেই অপরাধের উৎপত্তি এ-কথা যদি মেনে নেওয়া যেত, তাহলে ভারতবর্ষ অপরাধ-বিষয়ে অগ্রগণ্য হওয়ার কথা, যেহেতু ভারতের ন্যায় দরিদ্র দেশ অল্পই আছে। অপরাধ-তালিকা তুলনা করলে বোঝা যায় ভারতবর্ষ অপেক্ষা ইংল্যান্ডের অপরাধ-সংখ্যা পাঁচ-ছয় গুণ অধিক। আবার ভারতীয়দের ন্যায় আইন-ভীরু জাতি আর আছে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। অর্থাৎ শুধু দারিদ্র্যের উপর অপরাধের ন্যূনাধিক্য নির্ভর করে না। অপরাধ ও দারিদ্র্য নিয়ে এ-ধরনের তর্ক উনিশ শতকীয় চিন্তার জগতে এক আলোড়িত বিষয়। ১৮৮৫ সালে আমেরিকার বার্লিংটন অপেরা হাউসে ‘The Crime of Poverty’ বিষয়ক বক্তৃতায় হেনরি জর্জ উল্লেখ করেছেন, ‘সভ্য’ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়— গরিব হয়ে যেতে। সেজন্য উনিশ শতকীয় সভ্যতার অন্যতম সংকটের নাম ‘বেকারত্ব’। তবে অপরাধ, পাপ, অন্যায়ের আখ্যান ব্যতিরেকে দারিদ্র্যের ভিন্ন একটি রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে।
‘অপরাধ বিজ্ঞান’ প্রথম খণ্ডে (১৯৪০) পঞ্চানন ঘোষাল ‘ভারতীয় অপরাধী সমাজ’-এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন—
১. অপরাধ সমাজ অনেকটা ‘হিন্দু সমাজের অনুকরণে গঠিত’। অপকর্মের স্বরূপ অনুযায়ী অপরাধীসকল উচ্চ বা নিম্ন শ্রেণিভুক্ত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে ‘ডাকাত বা খুনেরা’ সর্বাধিক সম্মান পায়। অপরাধী সমাজে এরা ‘ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়’ হিসেবে গণ্য। খুনে ডাকাতের পর রয়েছে Burgler বা সিঁদেল চোর। এদের নীচে রয়েছে ছিঁচকে চোর। অপরাধ সমাজে ছিঁচকে এবং ঠগিদের স্থান সবার নীচে। আর নারীদের অত্যাচার করে জেলে এসেছে যারা, সকল শ্রেণির অপরাধীই তাদের অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করে।
২. এ-ধরনের জাতিগত বিভাজন অধিকতর লক্ষ করা যায় ‘অভ্যাস-অপরাধী’দের মধ্যেই। কিন্তু ‘স্বভাব-অপরাধী’রা এসব জাতিভেদের ধার দিয়েও যায় না।
৩. অপরাধমূলক কার্যকলাপেই গড়ে ওঠে যে ‘অপরাধ সমাজ’, তাদের অলিখিত সংবিধানে ক্ষমাহীন অপরাধের নাম ‘বিশ্বাসঘাতকতা’।
পঞ্চানন ঘোষাল বর্ণিত এহেন অপরাধ-সমাজের একটা অংশ থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জেল বা আধুনিক পরিভাষায় সংশোধনাগারে। ঔপনিবেশিক কালপর্বে জেলবন্দি বাঙালির আখ্যানগুলিকে জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষিত থেকে বোঝা হত। অপরাধ-বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি সেক্ষেত্রে ততটা গ্রাহ্য হত না। পঞ্চানন ঘোষালের কল্যাণে বাঙালির অপরাধ-জগৎ নিয়ে চর্চার নতুন এক ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। উৎসাহী হয়ে ওঠেন আরও অনেক গবেষক। বিশ শতকের ছয়ের দশকে পশ্চিমবাংলা ও বিহারের জেলখানা, পুলিশফাঁড়িগুলি ঘুরে-ঘুরে অপরাধ-জগতের ভাষা, সংস্কার কিংবা অর্থবহ ইঙ্গিতগুলি সংগ্রহ করেন ভাষাবিজ্ঞানী ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে অপরাধ-জগতের ভাষা ‘গোষ্ঠীভাষা’র অন্তর্গত। অপরাধীদের ভাষা খাস কলকাতার সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা নয়। বরং তা কলকাতা-ককনি জাতীয়। এই ভাষা দুই দিক থেকে বিস্তার ঘটেছে—
১. একটি ‘পেশাদার অপরাধী’দের ভাষা। চুরি, পকেটমারি, রাহাজানি, মদ চোলাই, মেয়ে বেচাকেনা ইত্যাদি এদের কাজ।
২. অন্যটি হল বখে-যাওয়া যুবক, উঠতি গুন্ডা ও মস্তানের ভাষা।
বাঙালির অপরাধ জগৎ বুঝতে হলে অপরাধীদের ভাষা এবং ইঙ্গিতগুলি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ১৯৬৫ সালে নবভারত পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় ভক্তিপ্রসাদ মল্লিকের গবেষণাগ্রন্থ: ‘অপরাধ-জগতের ভাষা’। ১৯৭৩ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয় গ্রন্থটি। ১৯৭১ সালে তিনি প্রস্তুত করেন অপর এক গ্রন্থ: ‘অপরাধ-জগতের শব্দকোষ’।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত ‘সমাজ সমীক্ষা: অপরাধ ও অনাচার’ গ্রন্থে ‘গুণ্ডা জগৎ’-এর সামাজিক ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন নন্দগোপাল সেনগুপ্ত। গ্রামীণ চুরি-ডাকাতির সঙ্গে শহরাঞ্চলের সংঘবদ্ধ গুন্ডাগিরির পার্থক্য দেখান তিনি। বন্দরে, গঞ্জে, কুলিখোলায়, বস্তিতে, ‘পতিতালয়ে’, শিষ্টসমাজ থেকে বহু দূরে, কানাগলির অন্ধকারে, শিক্ষা-দীক্ষা বিবর্জিত গ্রামের উপেক্ষিত কোণে লক্ষ-লক্ষ মানুষ কীভাবে দিনযাপন করে— এ-কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন বাঙালি সমাজে অপরাধপ্রবণতা কেন বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। নন্দগোপাল বলেন:
‘জন্মগত বৈকল্য ও বিকৃতির বশে অন্যায় করে [লম্ব্রজো তত্ত্বের ‘জন্ম অপরাধী’] অতি অল্প লোক। বেশীর ভাগই করে অভাব, অশিক্ষা ও অনগ্রসর সমাজ-চেতনার প্রভাবে। অর্থাৎ অপরাধের আদি-সূত্র নিহিত রয়েছে বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই। দুর্নীতিগ্রস্ত শ্রেণী-শাসন ও তার পৃষ্ঠপোষিত অধিকতর দুর্নীতিগ্রস্ত ধনতন্ত্র এই অনগ্রসর সমাজ-ব্যবস্থাকে আপন স্বার্থে জীইয়ে রেখেছে।… অন্যদিকে তাকে জেল, জরিমানা ও জুলুম-জবরদস্তি দিয়ে ঠাণ্ডা করার আয়োজন চলছে। জেলে এনে কয়েদীকে উর্দি-তক্তি পরিয়ে সরকার সেলাম করান, ঘানিতে, চাকিতে গুমটিতে, বাগিচায় খাটানো, সেই সঙ্গে কিছু আহার ও প্রচুর প্রহার দেওয়া, এ-ই হল অপরাধীদের সম্বন্ধে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের একমাত্র করণীয়। অথচ এদের আড়ালে দাঁড়িয়ে, এদের হাত দিয়ে, অথবা এদের ঘাড় ভেঙে, মেয়েচালানী, চোরাই মাদক, জাল, জুয়াচুরি ও শয়তানীর খেলা খেলছে যে শত-শত বুদ্ধিমান ক্ষমতাবান লোক। সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদের সম্পর্কে জেনে শুনেই উদাসীন রয়েছে।’
‘কয়েদী সমাজ’-এর আলোচনায় নন্দগোপাল কাঠগোড়ায় তুলেছেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুলিশি ব্যবস্থাকে। যে-মনস্তত্ত্বসম্মত উপায়ে সংস্কার ও সংশোধনের ব্যবস্থা থাকলে অপরাধীদের মূলগত প্রকৃতি পরিবর্তিত হতে পারত, ভারতের জেল-শাসনে তার কোনও আয়োজন নেই। ক্রমবর্ধমান অবদমনের চাপে অপরাধ-বৃত্তিই এদের উত্তরোত্তর আরও বলীয়ান, আরও বীভৎস হয়ে উঠছে। মহিলা এবং শিশু অপরাধীদের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও শোচনীয়। জেলখানাগুলি হল নিতান্ত আটকে রাখার খোঁয়াড়, সংশোধিত করার প্রতিষ্ঠান নয়। অপরাধীর মনকে বাদ দিয়ে, শুধু তার দেহকে বাঁচিয়ে রাখা হয় সেখানে। আর দেহের ওপর চাপানো হয় যাবতীয় সংশোধনের আয়োজন। ফলে আসল কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং জেলখানাগুলি হয়ে ওঠে অপরাধীকে আরও পাকা-অপরাধী বানানোর পীঠস্থান।
১৯৫৯ সালে মনোবিদ্যা বিষয়ক পত্রিকা ‘চিত্ত’-র শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যায় অপরাধের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে কলম ধরলেন কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মনোবিদ কমল মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, অপরাধ একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’। ‘মধ্যযুগ’-এ চিকিৎসা হত অঙ্গের আমূল ছেদন দ্বারা। কিন্তু এই চিকিৎসায় মানুষ দেখল বিপদ-মুক্তির তুলনায় বাড়ছে অঙ্গের বিকৃতি। ফলে নতুন-নতুন চিন্তাধারা এল। অপরাধের ক্ষেত্রটাও একইরকম। অপরাধী অপরাধ-প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে— পূর্বতন এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। বরং বলা যেতে পারে যে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। অপরাধী যদি অপরাধ নিয়েই জন্মাবে, তবে তাদের সংশোধন হয় কী করে? তাহলে দেখা যাচ্ছে অপরাধ এমন একটা ‘বিশেষ অসাধারণ মানসিক অবস্থা’ যা জন্মগত নয় এবং যা ‘মানুষেরই জীবনপ্রবাহের মধ্যে উদ্ভূত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত একপ্রকার ব্যবহারিক বিকৃতি’। বাস্তবিক অপরাধীদের বর্তমান ব্যবহার এবং তাদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাওয়া যাবে, ‘আবেগ-প্রবণতা’ অধিকাংশ অপরাধের মধ্যেই একটা বড় অংশ গ্রহণ করে। যদি বলা হয় যে, আজকের অপরাধের বীজ লুকিয়ে আছে তাদের শিশুকালের গঠনবৈচিত্রের মধ্যে, তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্নার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে— তাহলে বোধহয় ভুল বলা হবে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বহুদিনের পূর্বের সেই ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্না, আদর-আবদারের ইতিহাস আর আজকের এই অপরাধমূলক কার্যকলাপ— এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কিন্তু ব্যবধান সত্ত্বেও এদের যোগ নেই বললে ভুল হবে। আজকের ‘আমি’ তো শিশুকালের ‘আমি’-রই রূপান্তরমাত্র! অপরাধীদের জীবন-ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, অধিকাংশ অপরাধীই শিশুকালে তাদের পারিবারিক অভিভাবকের থেকে সুস্থ ব্যবহার পায়নি। তাদের ওপর নেমে আসত ‘লঘুপাপে গুরুদণ্ড’। কিছুজন অত্যধিক আদরে আবার ‘বিগড়ে’ যেত। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানসিক অশান্তি, স্নেহ-ভালোবাসার অভাব এইসব শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের মুখ্য ভূমিকা নেয়। এই কথাটুকু কি আমাদের ভুলে যাওয়া সাজে?