তরঙ্গনাথ‑২
মনে তো হল যে মি. অগাস্ট বেশ সজ্জন অফিসার। ট্রেনিং পিরিয়ডে যেসব সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের থেকে কোথায় যেন একটু আলাদাও। মিতভাষী না হলেও অবান্তর বকেন না। অহেতুক গাম্ভীর্য দেখিয়ে সমীহ আদায়েরও চেষ্টা নেই কোনও। আবার অবাধে যে অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন, তাও নয়। তাঁর ব্যক্তিত্বে বাঁধন আছে। মনে-মনে তবুও আমি সময় নিলাম, আর একটু বুঝে নেবার। আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেও, প্রয়োজনবোধে কোন একটি জিনিসও আমি যোগ করিনি সে-তালিকায়; যদিও আমি জানি যে বললেই পাওয়া যেত, আরও একটু ভাল টেবিল-চেয়ার বা বাড়তি একটা আলমারি। কারণ, আমি জানি যে, এখানে আমার একমাত্র কাজই হল দায়িত্ব বুঝে নেওয়া; খাট, বিছানা ব আলমারি— এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর থেকে কাজের ব্যাপারে সুবিধে-অসুবিধে বুঝে নেওয়াটাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। ফলে মি. অগাস্টের সেই আকস্মিক প্রশ্নে যে চমকে উঠেছি, সেটাও বুঝতে দিলাম না তাঁকে।
‘কাল কেমন দেখলে! ওই নদীর দিকটা?’
‘বেশ নির্জন; বসতি প্রায় নেই বললেই চলে; কিন্তু মনে হল ভেতরে-ভেতরে লোক থাকে।
‘আর কিছু? মানে তোমার ফিলিং কেমন হল!’
‘দূর থেকে আমার ওপরেও নজর রাখছিল কেউ!’
‘কারা বলে মনে হয়! মানে এখানকার লোকেরা তো স্পিরিটেও বিশ্বাস করে; তেমন কিছু?’
মনে-মনে তারিফ করলাম সাহেবের বুদ্ধিকে; আমিও আর উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে মৃদু হেসে যেন সম্মতিই জানালাম। বলতে ইচ্ছে করল না যে, ক-জোড়া ধূর্ত চোখ আমি দেখেছি, তা আদিবাসী বা স্থানীয় মানুষদের হতেই পারে না; এ-চোখ ট্রেনিং-প্রাপ্ত পুলিশদেরই; তবে তারা কেউ ‘গোরা’ নয়; আমারই মতো নেটিভ এবং হয়তো অনন্যোপায়ও। ফলে অগাস্টের কাছে ‘জয়েন’ করে যেটুকু যা বুঝলাম— আমি যেমন তাঁর পদানত একজন জুনিয়র অফিসার, তেমনই আমাকে আমার জায়গাতেই পদাধিকারীও হয়ে উঠতে হবে। একজন নেটিভ পদাধিকারী মানেই হল, স্ব-জাতিদের ওপরেই হুকুম চালানো এবং পালটা নজরদারিও; আর এটাই করতে হবে সুকৌশলে। মনে পড়ল, মেসোমশাইয়ের বলা সেই কথা, ‘ডান হাতের কাজ, বাঁ হাতও যেন জানতে না পারে।’ বুঝলাম যে গোপনীয়তাকেও গোপন রাখতে হবে আজ থেকেই। সেই সঙ্গেই হিসেব করে ঠিক করে নিতে হবে, নিজের জন্যেও একটা নির্দিষ্ট আচরণবিধি; কারণ সকাল থেকে রাত অবধি, এমনকী ঘুমের মধ্যেও জারি থাকবে আমার ওপর নজরদারি। অর্থাৎ গতকালই শেষ হয়ে গেছে আমার সেই স্বাধীন মন, এতদিন যাবৎ যা আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। ফলে ওই বুনো গাছের সারি, ফুল আর পাতার ফাঁক থেকে ডেকে ওঠা অচেনা পাখির শিস, আখ আর সর্ষেক্ষেতের সবুজ-হলুদ রংবাহার, নদীতটে বিছিয়ে থাকা রোদ-পোহানো সাদা বালি, বারান্দায় উপচে পড়া জ্যোৎস্না— এসবই সরকারি এবং এক তীক্ষ্ণ নজরদারির আওতায়।
২.
মি. অগাস্ট যদিও বলে দিয়েছেন, ‘ফিল ফ্রি’; বলেছেন যে, যেমন খুশি ঘুরে বেড়াতে পারি এ-এলাকাটাতে; এমনকী ইচ্ছে করলে একাও। কোনও সাবধানবাণী বা আগাম সতর্কতাও জারি করেননি আমার চলাফেরার ওপর; নিষধাজ্ঞা তো নয়ই। তবু কয়েকটি বিষয়কে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে আমার; যেমন ‘এলাকা’; তার মানেই সাহেবেদের হিসেবে একটা পাড়া-বেপাড়ার ভাগ আছে। কিছু এলাকা হয়তো এদের কাছে উপদ্রুত অঞ্চল বলেই চিহ্নিত; তাহলে বাকিগুলিই বা কী বিচারে নিরাপদ! সেরকমই জোর দিয়ে বুঝতে হবে ‘ইচ্ছে’ ব্যাপারটাও। গতকাল রাতে এই যে আমার ইচ্ছে হল, বারান্দায় বসে গান করবার, সেটাতেও রাশ টানতে হবে আপাতত। রবি ঠাকুরের গানেও সেই স্বদেশ-চেতনার উদ্বোধন ঘটছে। সাহেবরা গানগুলো শুনে, খুব যে বুঝছে এমন নয়; কিন্তু রবি ঠাকুরের নামেই তো এখন সন্দেহ। তিনি এবং তাঁর পরিবারের অনেকেই তো মানুষকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছেন তাঁর গানে; আর শুধু কি গান! নিজেও গাইছেন এবং তাঁর লেখা নাটক-নভেল এবং কবিতাতেও তুলে ধরছেন স্বদেশভাবনার নানা দিক। হরশঙ্করদের মতো আরও বহু তরুণদের কাছে সেসবই হয়ে উঠছে ‘স্বদেশ-মন্ত্র’। সন্দেহ এবং নজরদারি চলছে আরও কিছু নামে; কিছু-কিছু নাম ঘিরে নেটিভদের সংঠিত হবার খবর এলেই হল! প্রশাসনিকভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে এক করে যে সাহেবি শাসন, সেখানেই সংকট দেখা দিয়েছে। সাহেবদের একবগগা পণ এখন টুকরো শাসনে। অথচ তা মানানো যাচ্ছে না শাসিতদের। যত প্রবল হয়ে উঠছে তাদের প্রতিরোধ, সাহেবরাও পিছপা হচ্ছে না, তাদের দুর্বিনীত প্রশাসনিক হুংকারে।
কাটিহারে জয়েন করার আগে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম, হরুর সঙ্গে কথা বলে এইরকম আঁচই পেয়েছি। একদিকে দেশীয় রাজাদের জিইয়ে রাখা এবং অন্যদিকে ব্রিটিশদের দখলদারি-শাসনের স্বার্থে ক্রমাগত প্রশাসনিক সংস্কার। পাশের পাড়ায় থাকা ভূতেশ নামে যে-ছেলেটি হরুর সঙ্গে, সেদিন এসেছিল নিজেকে পরিচয় করাতে; সে তো একেবারে মুগ্ধ। বেশি কিছু না বললেও তার সপ্রশংস চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছি যে, ব্রিটিশদের ঢাল হবার জন্য এ-ছেলেটি একেবারে প্রস্তুত। সে চলে যেতে হরুর সঙ্গে অনেক আলোচনা হল।
‘ধরপাকড় হয়েছে না কি এসব অঞ্চলে!’
‘না তনুদা! তবে তলে-তলে দানা বাঁধছে; নতুন সব গান বাঁধা হচ্ছে; বাংলা এবং ইংরেজি দু-ভাষাতেই পাওয়া যাচ্ছে লেখাপত্রও।’
‘তুই সে সব পড়ছিস! কোথা থেকে আসছে?’
‘এই সব… আলাপ… আলোচনা… বেলা হয়ে গেল, আজকে উঠি তনুদা!’
হরুর সেদিন তড়িঘড়ি উঠে পড়া দেখেই বুঝেছিলাম যে, এখন থেকে আমি যে শুধু ওর দাদা তাই নয়, একইসঙ্গে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশও। হরু আর আমার মধ্যে ‘আলাপ’ এবং ‘আলোচনা’ দুই-ই তাই হবে খুব সাবধানে। ভুলে যেতে হবে আগের সেই খোলামেলা আড্ডা, গান এবং মতামত বিনিময়। হরুকে অভিনন্দন জানালাম মনে-মনে; আন্দাজ হল যে স্বদেশিদের সঙ্গ করে সে খুবই উজ্জীবিত। বন্দুক চালানোর দিকে না গেলেও তার ওই ক্ষুরধার ইংরেজি ও বাংলা লেখার বাঁধুনিকে দেশের কাজে বিলিয়ে দেবে সে; ভূতেশ এবং হরশঙ্কর দুজনেই ভাল ছাত্র এবং বুদ্ধিমান কিন্তু এদের গতি ভিন্ন। ভূতেশ যখন যে-কোনও উপায়ে একটা সরকারি পদ পেতে মরিয়া, হরশঙ্কর তখন ডুবে যাচ্ছে ভারত স্বাধীন হবার স্বপ্নে; এরই সঙ্গে আবার বাংলার শিক্ষিত তরুণ সমাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসছে বিহার এবং উড়িষ্যার কৃষিজীবী এবং আদিবাসী মানুষজন। বেশ বুঝতে পারছি যে, জেল-হাজতের সংখ্যা কী পরিমাণে বাড়তে চলেছে; দু-তরফেই বাড়বে গুলি-বন্দুকের চর্চাও!
৩.
রুক্ষ মাটি; তবু উর্বরা। আমার কোয়ার্টার-চৌহদ্দি ঘিরে যদিও কাঁকর, বালি আর মাঝে মাঝে চাবড়া ঘাসের আভাস। ঘাসের থেকেও বেশি সেখানে শেকড়-বেছানো নেই-আঁকড়া বুনো ফুলের জালি লতা; তাতে ছোট-ছোট ফুটকির মতো বেগুনি ফুলের বাহার। বুট পরে মাড়াতেও কষ্ট হয়। এরা যেন আমাদের ওই স্বদেশি ছেলেগুলোর মতো; পুলিশের বুটের নীচে মাথা থেঁতলে মরবার সময়তেও বন্দেমাতরম বলে যাবে। সবসময়ে যে ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়াই তা নয়; এখনও তেমন শীত পড়েনি; ফলে ধুতির ওপর একটা পাঞ্জাবি গলিয়ে মাঝে মাঝেই চলে যাই বনের পথে। এই খানিক খোলা পথ, তো একটু পরেই বড়-বড় গাছে ঢাকা আকাশ; মনে হবে যেন মেঘ করে এল! আর বাতাস যে কী মোলায়েম! তেমন সুস্বাদু জল। মাঝে মাঝে বুনো মোষ এবং অচেনা মানুষ দুই-ই সামনে চলে আসে। অনেকেই এখন চিনে গেছে বলে, সাদা পোশাকে থাকলেও ভয়ে বা সম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাচ্চারা অবশ্য দৌড়ে পালায়; জানি না সেটা ভয়ে না লজ্জায়। এ-অঞ্চলটা তুলনায় ‘শুখা’ বলে লোকালয়গুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। প্রায় সব ক-টি বাড়ির খড়ের চালে লাউ কুমড়ো; বড় গাছে লতিয়ে আছে পুরুষ্টু ধুঁধুল। নানারকম শাকও ফলায় এরা। এত দারিদ্র্য যে, এসবেই চালিয়ে নিতে হয়। অথচ প্রকৃতি এখনে অকৃপণ। সব থেকে চোখে পড়ে এদের পরনের রঙিন জামাকাপড়। ছেলেরা পাগড়ির মতো করে মাথায় গামছা জড়ায়; মেয়েরা পরে কাচের চুড়ি। তবে জুতোর ব্যবহার নেই বললেই চলে; সারি-সারি শুধু খালি পা এবং জলহীন শুকনো মাটির মতোই ফাটা। এত নদী এবং ছড়ানো-ছিটানো এত জলধারা সত্ত্বেও, কী প্রবল জলকষ্ট! কোনও-কোনও লোকালয়ে কুয়ো থাকলেও মূলত নদীনির্ভর জীবন এদের। গাঁয়ের আশপাশে পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াই আর ভাবি, সরকার— স্বদেশি বা বিদেশি— কীভাবে পৌঁছোবে প্রত্যন্তে, এইসব মানুষগুলোর কাছে!
লোকালয় ছাড়িয়ে বেশি দূরে গেলে সবসময়ে পুলিশের উর্দি এবং বুট পায়ে ঘোড়ায় চড়েই যাই। ঘোড়াটাকেও ছুট করানো হয়, আর আমাকে নিয়েও সন্দেহের দাপট কিছুটা কমে। আরও একটা কারণ হল, অন্য সময়ে পরবার মতো শার্ট-প্যান্টালুন আমার প্রায় নেই বললেই হয়। তথৈবচ চপ্পলের অবস্থা; কাঁটা এবং সাপ এ-দুটো এড়াতেই সুবিধেজনক হল ইউনিফর্ম। ছিঁড়ে-ফেটে গেলে, দপ্তরে জানালেই আবার তা এসে যাবে। প্রকৃতি যে এখানে কী সুন্দর! বিশেষত এই নদীর পাড়টা। পুলিশ ছাড়াও পাটনা থেকে অনেকেই বেড়াতে আসে। বুনো হাঁস শিকার করে বনভোজন করতে। উড়ন্ত পাখির ঝাঁকে কী করে যে গুলি মারে! আলো পড়ে এলে ছোট-বড় সব পাখিকেই কালো-কালো লাগে; ডানা সাঁতরে বাসায় ফেরার জন্য সে কী তাড়া তাদের! তখন আর শিস দেয় না; এত দূর দিয়ে ওড়ে যে, সে-উড়ানও হয় নিঃশব্দে। এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মনে হয়, কী বাঙ্ময় এই নীরবতা! আমার দু-চোখের দৃষ্টিতেও যেন জেগে ওঠে বিরহ, আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তো এই ছবি হারিয়েই যাবে!
৪.
দুপুরে খাওয়ার দেওয়ার সময়ে আর্দালি ছোটেলাল অনুমতি চাইল কয়েক ঘণ্টার জন্য একটু নিজের গ্রামে যাবার। মাথা নেড়ে অনুমতি দিতেই সে বলল, ‘আজ সেখেনে মেলা বসবে; নদীর ওপারে— জঙ্গল পেরিয়ে গ্রাম।’
‘এখান থেকে কতদুর পথ?’
‘হেঁটে গেলে মাইল দশেক হবে; ঘোড়াতে অনেক কম।’
‘কত ঘর লোক থাকে!’
‘লোক আর কত থাকে! সব মিলিয়ে শ-খানেক; তবে অন্য গ্রাম থেকেও লোক আসে।’
‘হাট না মেলা?’
‘না বাবু, হাট নয় মেলা। নাচ গান হয়; কেনাবেচা চলে; আবার দেখাশোনাও হয়ে যায়।’
‘কারা নাচে?’
‘ছেলেমেয়ে সবাই! পরবের মতো।’
‘কোন-কোন জিনিসের কেনাবেচা চলে?’
‘যে যেটা বেশি করে বানায়, সেটা বেচতে আসে— ঝুড়ি, কুলো, মাটির কলসি; নানারকম বাজনা; মানে বাঁশি, ডুগডুগি; তা ছাড়াও মাছ ধরার জাল, বঁটি, কাটারি—’
‘তুমি কী বেচবে ছোটেলাল?’
‘বউকে নিয়ে ঘুরব; কাচের চুড়ি কিনবে; ভুট্টা খাবে।’
মাথা নিচু করে হাসছি দেখে একটু ভরসা পেয়ে বলল, মেলায় গেলে আপনারও ভাল লাগত বাবু! কী মনে হল, বললাম, ‘তুমি যাও; ইচ্ছে হলে একটু পরে যাব।’ ছোটেলাল চলে যেতে ব্যাপারটা মাথায় আসতেই সতর্ক হয়ে গেলাম; মেলায় গেলে আমার যে ভাল লাগবে সেটা ও কী করে বুঝল! বুঝলাম যে, চোখের দৃষ্টিতেও হতে হবে নিষ্পৃহ; এমনই আবেগহীন যে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সংশয় বা ভয় কিছুই ধরা পড়বে না; আর আক্রমক তো নয়ই। প্রথমে ভাবলাম উর্দি পরে ঘোড়ায় চড়েই যাব; মত বদলে ডিউটির বাইরে যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরি সেটাই গায়ে চাপিয়ে নিলেও, কোমরে গোঁজার পিস্তলটাও নিয়ে নিলাম জুত করে। আর নিলাম বাবার দেওয়া মানিব্যাগটা; যদি কিছু কিনতে ইচ্ছে হয়! বেশিরভাগ লোক মেলায় গেছে বলে, চৌকিদার ছাড়া বাড়তি লোক আজ আর তেমন চোখে পড়ল না; রাস্তায় এসে নামতেই দেখলাম, উলটোদিকে অন্য একটা দূরের পথ দিয়েও লোক চলেছে ছোট-ছোট দলে; নিরপদ দূরত্ব বজায় রেখে, সেই অল্প দূরের পথের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদেরই অনুসরণ করলাম। কিছুটা হাঁটতেই কানে এল দেহাতি তালে ঢোলের আওয়াজ। এদিক দিয়ে এসে, আগে পড়ল গ্রাম পেরিয়ে মেলাতলা এবং তার ওপারে নদী; এ ক-দিন যে-পথে এসে আগেই নদী পেয়েছিলাম, সেটাই আসলে দূরের পথ; ওদিকটা থেকেই শুরু হয়ে গেছে জঙ্গল। ভাবলাম, আর কিছু না হোক আরও একটা নতুন পথ তো পেলাম! কাছ থেকে দেখা হয়ে গেল, লতাপাতা আঁকা মাটির দেওয়ালে খড় বা টালি ছাওয়া ঘর-গেরস্থালি, নিকোনো দাওয়া আর দড়িতে বা ঘরের চালে মেলা লাল, সবুজ, হলুদ ও আসমানি এমন সব উজ্জ্বল রঙের মিলে ছাপা শাড়ি। অচেনা মানুষদের ভিড়ে মিশে গেলেও কাছে এবং দূরে দাঁড়ানো লোকজন ঠাওর করে দেখতে লাগল; আমার এই ছ-ফুট দু-ইঞ্চি ধ্যাদ্ধেড়ে আড়াটাও একটা মস্ত কারণ। আমার থেকে লম্বা একমাত্র এই শাল-মহুয়া গাছগুলো।
পুরো মেলাটা চৌকি দিতে গিয়েই নজরে পড়ল বেশ কিছু চেনা এবং সতর্ক মুখ; উর্দি ছাড়া সাধারণ পোশাকে এদের ঘোরাঘুরি দেখেই সতর্ক হয়ে গেলাম; স্বদেশিরাও কি তবে মিশে আছে! কে যে কার আততায়ী— এই ভাবনায় একটু কি বুক কেঁপে উঠল প্রাণের ভয়ে! ফিরে চলে না গেলেও, সচেতন হয়ে গেলাম যারপরনাই। মন এবং হাঁটাচলায় সমস্ত ভাব গোপন করে এগিয়ে গেলাম ডানদিক ঘেঁষে; দেখলাম যে ভিড় বেশি অথচ নজরদারি নেই; হাসিই পেল, কারণ ভিড়টা মেয়েদের। মাটিতে বসে পড়ে দু-হাত ভরে সব কাচের চুড়ি পরছে; তার সঙ্গেই বসেছে মাথার কাঁটা, চুলের ফিতে, আর কিছু পেতলের গয়না; একটা লোক রুপোর গয়না নিয়েও বসেছে, কিন্তু তার নকশাগুলো বেশ অন্যরকম; খুব ইচ্ছে হল রানী আর ছোট মাসির মেয়ে শুভার জন্য কিনতে। মেয়েদের জটলার মধ্যে গিয়ে কীভাবেই বা কিনব! দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ওইদিকে তাকিয়েই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি; হঠাৎই চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখি, ছোটেলাল; খেয়ালই করিনি যে কখন সে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! আবার সতর্ক হলাম; এ-চাকরিতে টিকে থাকতে হলে, নিজেকেও চৌকিদার হতে হবে; পাড়া-ঘরে রাসখোলার মেলায় দলবেঁধে ঘুরে বেড়িয়ে, জিলিপি খেতে-খেতে গুলতি বা মারবেল কিনে বাড়ি ফেরা নয়; জীবন হাতে করে প্রতিদিন বাঁচা এবং চাকরি বাঁচানো।
‘কিছু কি কিনবেন বাবু!’
‘মেয়েদের জটলাটা দেখছি; কী এত কিনছে?’
‘বেলোয়ারি চুড়ি, পিত্তলের চুড়ি-হার-কানের ঝুমক।’
‘সে তো এদিকটায়; কিন্তু ওইদিকে? ওগুলো কি রুপোর গয়না!’
‘না বাবু; চাঁদির মতোই; এখানে বলে রুপদস্তা; সিসার মধ্যে এক ছিটে চাঁদি মেশানো থাকে।’
আমি কিছু বলবার আগেই ছোটেলাল হাঁক দিল, ‘হিরিয়া, এ হিরিয়া!’ সঙ্গে-সঙ্গে একটা বউ উঠে দাঁড়িয়ে, মাথায় ঘোমটা টেনে এদিকে তাকাল। ছোটেলাল হাত নেড়ে ইশারা করতেই, পায়ে-পায়ে হেঁটে এসে, ঘোমটাটা আরও এক হাত নামিয়ে, জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল আমাদের সামনে; শীর্ণ দু-হাতে মেলায় পরা কাচের-চুড়ির ঝিলিক। বেশ কর্তৃত্ব জাগিয়ে, চড়া সুরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছোটেলাল বলল, ‘ও দুকানিকে বল, দারোগা ব্রাহ্মণবাবু কিছু দেখতে চায়; দুকানটা ইদিকটো লাগাতে।’
সেই হুকুম তামিল করতে, আবার ওদিকে চলে যায় হিরিয়া; ‘দুকানিকে’ বলাতেই, চটের ওপর সাজানো গয়না ক-টা সবসুদ্ধ তুলে নিয়ে এসে আমার সামনে সাজিয়ে দিল সেই ‘দুকানি’।
ছোটেলাল আবার হাঁক পেড়ে হিরিয়াকে ডেকে এনে বলল, ‘বাবুকে দেখিয়ে দে, কুনটো মাথার আর কুনটো কানে-গলায়-হাতে পরিস তোরা।’
দেখাবে কী, হিরিয়া তো হেসেই খুন। ভরসা পেয়ে আরও কয়েকটা মেয়ে-বউ, ইতিমধ্যেই পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে হিরিয়ার পাশে। ভাবলাম যে, এইসব ফুল দেওয়া মাথার কাঁটা, আঙুলের চুটকি, চাবি ঝোলাবার রিং, পায়ের নূপুর— এসবই তো মা-মাসি-বোনেরা ব্যবহার করে; কিন্তু সেসব তো খাঁটি রুপোর; এই রুপদস্তার জিনিস পেয়ে রাণী, শুভা এবং মা-ও হয়তো হেসে উঠবে ওই হিরিয়াদেরই মতো। তবু ডেকে এনেছে যখন, তখন অন্তত ছোটখাট কিছু একটা বা দুটো— নেব বলেই মনস্থ করলাম। দু-বোনের জন্য ভারী ঝুমুর দেওয়া দু-জোড়া মল, মায়ের জন্য ফুল লাগানো খোঁপার কাঁটার দিকে আঙুল দেখাতেই, হিরিয়া বসে গেল দেখে-বেছে পছন্দ করতে; আর ছোটেলাল নিজে নিচু হয়ে বসে, একটা পিকদানি তুলে এনে বলল, ‘এটো নিন; কর্তাবাবুর কাজে লাগবে।’
পাশে রাখা মুখশুদ্ধি রাখার ডিবের দিকে আঙুল দেখাতেই, তার মধ্যে থেকে কয়েকটা তুলে এনে জানতে চাইল, ‘এটো কী কাজে লাগবে ভাই-বাবুর?’
এবার নানা মাপের কয়েকটা খৈনির ডিবে এনে দেখাতেই হেসে উঠে বললাম, ‘না না! রেখে দাও; ওই আগের ডিবেতেই হয়ে যাবে।’
‘গোল ডিব্বাতে তো পরসাদই ফুল-তুলসী রাখে বাবু।’
‘সে-ও তো তাই রাখবে; ইস্কুল পাশ দেবার সময়ে, সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।’
হাতে সেলাই করা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানানো একটা থলে হিরিয়ার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে, সওদাগুলো তাতেই ভরে দিল ছোটেলাল; ‘দুকানি’কে দাম দেওয়ার তোয়াক্কা না করেই ছোটেলাল বলল, ‘এই নিন বাবু; আপনার সওদা।’
‘এগুলোর দাম ক-আনা হল জেনে নাও!’
‘দারোগাদের কাছে আবার দাম কি নেবে! চটসুদ্ধ তুলে না নিয়ে, আপনি যে সামান্য কয়েকটা বেছে নিয়েছেন, এই তো ঢের! তার ওপর এসব হল ঝুটা-চাঁদির মাল! দাম দিতে হবে না।’
‘তা তো হয় না; নকল হোক আর আসল— যা দাম হিসেব করে ওকে নিয়ে নিতে বলো।’
রানীর মুখের ছাপ দেওয়া চারটে এক আনার কয়েন ছোটেলালের হাতে দিলাম; ওদের দেহাতি ভাষায় দরদাম করে ‘দুকানি’র হাতে দু-আনা দিয়ে বাকি দুটো কয়েন আমাকে ফেরত দিল; ওই বাকি দু-আনা ছোটেলালের হাতে দিয়ে বললাম, ‘রেখে দাও, মেলার বখশিস।’
‘দুকানি’র চোখে জেগে ওঠা সেই কৃতজ্ঞ-চাহনি বিছিয়ে থাকল আমার কোয়ার্টারে ফেরার বাকি পথটুকু। আর, ‘দুকানি’র কাছে আমাকে সেই পরিচয় করানো, ‘দারোগা-ব্রাহ্মণবাবু’ বলে! তার মানে চেহারায় না চিনলেও, সদ্য আসা এই নতুন অফিসারটিকে ওরা এই নামেই চিনতে শুরু করেছে।
৫.
পরদিন দপ্তরে যেতেই ডাক এল মি. অগাস্টের ঘরে। অন্যদিন একটু বেলায় আসেন; আজ একেবারে দশটার মধ্যেই টেবিল আলো করে বসে আছেন; বললেন, ‘কফি আর লাঞ্চ প্যাক করে দিতে বলেছি; একটা জিপ পাওয়া গেছে পরিদর্শনের জন্যে; পূর্ণিয়ার দিকটায় যাব; তুমি আমার সঙ্গে যাবে।’
‘এখান থেকে কি আর কিছু নিয়ে যেতে হবে স্যর! কাগজপত্র বা ফাইল?’
‘সরকারি সীমানা দাগানো জমির সেই ম্যাপটা নিয়ে নিতে পারো; জানো তো কোথায় আছে?’
‘হ্যাঁ স্যর; ফাইলটাও সঙ্গে রাখব কি!’
প্রতিবারের মতোই সপ্রশংস হাসি দিয়ে কথা শেষ করলেন মি. অগাস্ট। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে গেলাম আমরা। সাহেব নিজে ড্রাইভ করবেন বলে আমাকে নির্দেশ দিলেন তাঁর পাশের সিটে বসতে; ছোটেলাল সমেত বাকি যে জনা-চারেক লোক এ-দপ্তরে কাজ করে, তাদের সকলের অবাক চাহনির মধ্যেই ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে গেল আমাদের জিপ।
তরঙ্গনাথ— আমার সঙ্গে তো আগেই পরিচয় ঘটেছে। এখন থেকে সবাই দেখবে তনু বা তরঙ্গনাথ থেকে ক্রমেই আমার ‘দারোগা-ব্রাহ্মণবাবু’ হয়ে ওঠা। আমার অনুমান, খুব অল্পদিনের মধ্যেই এবার আমাকে শিখে নিতে হবে গাড়ি চালানো; হয়তো আরও কিছু অস্ত্র চালানোও।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র