ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এই মৈত্রী, এই মনান্তর


    রূপক মিশ্র (January 27, 2024)
     

    একজন বিশ্বাস করেন ফুটবলের আস্তিক্য-দর্শনে।

    অন্যজন নাস্তির পূজারি।  

    প্রথমজনের কাছে ফুটবলে ‘পজেশনাল কন্ট্রোল’-ই সারাৎসার। পাস পাস আর পাস। মাঠের চতুর্দিক বরাবর পাসের ফুলঝুরিতে বিপক্ষের নাভিঃশ্বাস তুলে কোণঠাসা করার ক্রূরতায় বিশ্বাসী… তিনি জোসেপ গুয়ার্দিওলা— সংক্ষেপে ‘পেপ’… দু-অক্ষরের এই ছোট নামেই যাঁকে গোটা বিশ্ব চেনে।

    দ্বিতীয়জনের দর্শন আবার একশো-আশি-ডিগ্রি উলটো। তিনি রক্ষণের দৃঢ়তায় আস্থাশীল। তাঁর নির্দেশে একশো মিলিয়নের দুঁদে স্ট্রাইকারকেও প্রয়োজনে ডিফেন্স সামলানোর কায়িক শ্রম দিতে হয়। ইউরোপের ময়দানে চালু লব্জ ‘পার্ক দ্য বাস’-এর প্রবক্তা হয়েও তিনি ‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’… তিনি হোসে মোরিনহো।   

    না ঘরানায়, না নন্দনে— সর্বার্থে বিপরীত মেরুর এই দুই ফুটবল ম্যানেজারের বোধ ও বিশ্বাসে মিল খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুরূহ। অন্য অনেক কিছুর মতো ফুটবলও বাইনারির খেলা। ৪-৩-৩-এর আগ্রাসী কাউন্টারের বিরুদ্ধে মাটি কামড়ে লড়ে যায় ৫-৪-১-এর সুদৃঢ় প্রাচীর। ডিফেন্স-চেরা তীক্ষ্ণধার আক্রমণ-স্রোতকে মুহূর্তে নির্বিষ করে ফেলে ঠাসবুনোট জমাটি রক্ষণ। রূপকথার মোটিফের মতো ফুটবলের এই বাইনারি জন্ম দিয়েছে অজস্র মিথের। হাল আমলের মেসি বনাম রোনাল্ডো থেকে শুরু করে পেলে-মারাদোনা। ওয়েঙ্গার বনাম ফার্গুসন কিংবা ক্রুয়েফ বনাম বেকেনবাওয়ার। আদ্যন্ত দলনির্ভর খেলা হয়েও বিভিন্ন প্রজন্মে ফুটবলের জনপ্রিয়তার আঁচকে কয়দফা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত দ্বৈরথের সুস্বাদু সমস্ত আখ্যান। ফুটবলের দেবতা যদি কোনও দিন এই গল্পমালা শোনাতে বসেন, তাহলে তাঁর বয়ান, সত্যি বলতে অসম্পূর্ণ থাকবে মোরিনহো আর পেপের মৈত্রী-মনান্তরের ইতিবৃত্তটুকু না বললে। নিবিষ্ট শ্রোতার মতো এই ইতিকথা শুনতে শুনতে আপনিও চটজলদি বুঁদ হয়ে যাবেন আর খানিক বাদে অবধারিতভাবে ভাগবত পুরাণের বৃহস্পতি-শুক্রাচার্যের বৈরিতার কাহিনি আপনার চেতনায় ভেসে উঠবে।        

    এর প্রথম কারণ, কালের নিয়মে দুজনের পথ দু-দিকে বেঁকে গেলেও তাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একই গুরুগৃহে— গুরুকুল বার্সেলোনায়। সালটা ১৯৯৬। যখন ম্যানেজার ববি রবসনের অনুবাদক হিসেবে কাতালান ক্লাবে প্রথম পা রাখেন হোসে মোরিনহো। পেপ গুয়ার্দিওলা তখন দলের নির্ভরযোগ্য মিডিও। ক্লাবের তরফে পেশাদার দোভাষীর পরিচয় দেওয়া হলেও রবসনের তত্ত্বাবধানে আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন হোসে। সাংবাদিক সম্মেলন অনুবাদের পাশাপাশি প্র‍্যাকটিস সেশনের আয়োজন, ট্যাকটিক্সের খুঁটিনাটি আলোচনা, বিপক্ষের রণকৌশল কাটাছেঁড়া— সর্বত্র নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেন। সে-মরশুমে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে বার্সেলোনা; ইউরোপিয়ান ট্রফি সমেত তিনটি খেতাব ঘরে তোলে তারা।    

    ত্রিমুকুট জয় সত্ত্বেও পরের বছর ববি রবসন যোগ দেন নেদারল্যান্ডসের ক্লাব পি এস ভি আইন্ডহোভেন-এ। যদিও এবার মোরিনহোকে রবসনের পুচ্ছানুসরণ করতে হয়নি। বার্সেলোনা বোর্ডে জহুরির চোখ ততদিনে হোসের গুরুত্ব বুঝে গেছে। একাদিক্রমে চার-পাঁচটি ভাষায় স্বচ্ছন্দ, অসাধারণ ফুটবল-মস্তিষ্কের তরুণ সে-জমানায় গোটা ইউরোপে খুঁজে পাওয়া ভার। ১৯৯৮-এ নতুন ম্যানেজার হয়ে আসেন লুই ভ্যান হাল। মোরিনহোকে আর অনুবাদক নয়, বদলে সহকারীর ভূমিকায় জুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। অন্যদিকে দলের নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত হন পেপ গুয়ার্দিওলা। মাঝমাঠের ইঞ্জিন হয়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন তিনি। অন্যদিকে গেমপ্ল্যান তৈরিতে নিজস্ব ক্ষুরধার ফুটবল-বোধ কাজে লাগান মোরিনহো। পেপ-মোরিনহোর যুগলবন্দির জেরে সাফল্য আসে দ্রুত। দু’বছরে খান দুই লা লিগা (স্প্যানিশ লিগ) খেতাব জেতে বার্সেলোনা।

    চার বছরের মধুচন্দ্রিমা শেষে, ২০০০ সালে, মোরিনহো কেরিয়ারের প্রথম বড় সিদ্ধান্ত নেন। ছাড়েন বার্সেলোনায় সহকারীর আরামদায়ক কুর্সি। ফিরে যান নিজের দেশ পর্তুগাল। যদিও প্রসঙ্গ উঠলে দেশোয়ালি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানাতে ভুলতেন না, তাঁর পাখির চোখ স্পেন… বার্সেলোনার মসনদে বসা। কিন্তু তার জন্য নিজেকে আরও নিশ্ছিদ্র, আরও মজবুত করা জরুরি। বড় ময়দানের অ্যাসিড টেস্টে উত্তীর্ণ হতে হবে ৷ তবেই বার্সার মতো দানবীয় ক্লাবের ম্যানেজার হওয়ার আবেদন রাখবেন তিনি। তার আগে নয়।

    এই যাচাই-পরীক্ষার জন্য মোরিনহো যোগ দেন পোর্তোয়। আর দায়িত্ব নিয়েই ফুটবলের মঞ্চে ঝড় তোলেন। পর পর দুই মরশুমে উয়েফা কাপ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে পর্তুগালের এই ক্লাব। সঙ্গে সমস্ত ঘরোয়া ট্রফি আর তামাম ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ও। কিন্তু তখনও পুরোপুরি খুশি নন মোরিনহো। আরও বড় মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। চাই আরও জোরালো, নজরকাড়া সাফল্য। যার টানেই তিনি ২০০৪-এ চেলসিতে যোগ দেন। ক্লাবের নতুন মালিক রাশিয়ান ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচের চোখও তখন ইংল্যান্ড-জয়ের স্বপ্নে মেদুর। ৫০ বছর লিগ জেতেনি চেলসি। কিন্তু তাতে কী! তখন মোরিনহো ছুঁলেই সোনা। স্বপ্নের জাদুকর তিনি। অল্পদিনেই সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে অ্যালেক্স ফার্গুসন আর আর্সেন ওয়েঙ্গারের মৌরসিপাট্টায় থাবা বসিয়ে পর পর দু’বছর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জিতলেন মোরিনহো। ট্রফি ক্যাবিনেটে ঢুকল এফ এ কাপ, লিগ কাপ-ও ৷    

    ৯০-এর দশকে বার্সেলোনায় তখন দুজনে বন্ধু… পেপ ও মোরিনহো

    হোসের কেরিয়ার যখন অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটছে তখন পেপ নিভৃতে সলতে পাকিয়ে চলেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে অবসর গ্রহণের পর ২০০৭ সালে বার্সেলোনার বি-টিমের দায়িত্ব নেন তিনি। নিজের হাতে তৈরি করেন পেদ্রো, বুসকেত্‌সের মতো একঝাঁক তরুণ তুর্কিদের। গুয়ার্দিওলার গোকুলে তখন রং ছড়াচ্ছে আরও একটি নাম— লিয়োনেল মেসি। ম্যানেজারের মতো তিনিও স্রেফ সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছেন।  

    সুযোগ এল পরের বছর। ২০০৮-এর মে মাসে। বার্সেলোনার হট সিটে বসলেন পেপ। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত স্প্যানিশ ক্লাবের ইতিহাসের পাশাপাশি সমগ্র ইউরোপীয় তথা বিশ্ব ফুটবলের পটভূমিতে পালাবদলের সূচনা করল। কিন্তু এর-ই সূত্রে জন্ম নেয় এক অভূতপূর্ব দ্বৈরথ— ‘হোসে বনাম পেপ’। একদা সুহৃদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ-ই শুধু নয়, এই দ্বন্দ্বের রেশ কয়েক মাসের মধ্যে অবর্ণনীয় তিক্ততার সূচনা করে। গোটা চালচিত্রের নেপথ্যে ছিলেন যিনি, তিনি প্রবাদপ্রতিম ডাচ ফুটবলার, বার্সেলোনার কিংবদন্তি ম্যানেজার, কমপ্লিট ফুটবল-এর অন্যতম কাণ্ডারি— তিনি জোহান ক্রুয়েফ।    

    ঠিক কী ঘটেছিল সে সময়? রেকর্ড বলছে, পর পর দু’মরশুম (২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮) কোনও খেতাব জেতেনি বার্সা। ম্যানেজার ফ্র‍্যাঙ্ক রাইকার্ডের জমানা অস্তমিত-প্রায়। ক্লাবের হাল ফেরাতে ট্রফির খরা কাটানো জরুরি। বার্সেলোনা বোর্ড চাইছিল নতুন কোনও মুখ; প্রাচীনপন্থীদের পথে না-হেঁটে যে কিনা সাফল্য আর দৃষ্টিনন্দন ফুটবলকে এক সুতোয় গাঁথতে পারবে। স্বাভাবিকভাবেই নজর যায় মোরিনহোর দিকে। ব্রিটেনের ফুটবল মহলে ততদিনে আলোড়ন তুলেছেন তিনি। প্রেস মিটে তথাকথিত ব্রিটিশ ভব্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন। কখনও ওয়েঙ্গারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলছেন, ‘আর্সেন আসলে চেলসির প্রতি অবসেস্‌ড। ওঁর উচিত নিজের ক্লাবকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা।’ যদিও মোরিনহো আর ওয়েঙ্গার-এর দ্বৈরথের নেপথ্যে রয়েছে সেই দশকের আর্সেনাল ও চেলসির আর্থিক বৈষম্যের কাহিনি, সে গল্প অন্য কোনও দিন। কখনও বাকি ম্যানেজারদের একহাত নিয়ে বুক বাজিয়ে জানাচ্ছেন, ‘এই লিগে আমি এবং স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন ছাড়া আর কেউ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেনি। আমি কয়েকটা ম্যাচ হেরে ছাঁটাইয়ের চাপ নিতে যাব কেন?’ 

    শুধু কথায় হুল ফোটানো নয়, কাজেও ফুল ফোটাচ্ছেন বিতর্কিত পর্তুগিজ। গোটা মরশুমে মাত্র ১৫টা গোল হজম করে রেকর্ড সংখ্যক পয়েন্টে সমেত লিগ জিতছে চেলসি। বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, অল্প সময়ে অভাবনীয় সাফল্য— একজন উঠতি ম্যানেজারের পক্ষে এর চেয়ে ভাল বিজ্ঞাপন আর কী হতে পারে! এই সুযোগেরই তো অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। মিডিয়াতেও শোরগোল পড়ে যায়— মোরিনহো বার্সায় যোগ দিতে চলেছেন, ঘরের ছেলে শেষমেশ ফিরতে চলেছে ঘরে।

    ঠিক তখনই আসরে নামেন ক্রুয়েফ। ক্লাব প্রেসিডেন্ট জোয়ান লাপোর্তা মোরিনহোকে ম্যানেজার করা নিয়ে ডাচ কিংবদন্তির মত জানতে চাইলে, ক্রুয়েফ পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন। হোসেকে আনা ‘নিরাপদ পদক্ষেপ’ হতে পারে কিন্তু তা বার্সার ফুটবল আদর্শের পরিপন্থী— সাফ জানান তিনি। লাপোর্তাও সহমত পোষণ করেন। পরে একটি আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘বার্সেলোনার একটি নির্দিষ্ট স্টাইল রয়েছে, যা নতুন ম্যানেজার নির্বাচনের সময় মাথায় রাখা প্রয়োজন। বল পায়ে আমাদের দল একটা ম্যাচকে সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং এ ভাবেই আমরা জিততে চাই। এই আদর্শের সঙ্গে সহমত নয় এমন কোনও পেশাদার বার্সার কোচ হতে পারে না।’  

    বৈরিতা যখন চরমে… লা লিগায় বার্সা ও রিয়াল-এর হয়ে যুযুধান দুই চাণক্য

    অর্থাৎ, ‘প্রতিষ্ঠা-পরম্পরা-অনুশাসন’-ই সব৷ ক্লাবের ঐতিহ্যই শেষ কথা বলবে। যে-রণকৌশল চলে আসছে কয়েক দশক ধরে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শর্তে সম্মত হবেন যিনি, তিনিই দলের আগামী দিনের কাণ্ডারি। অন্য কেউ নয়। তোমার চিন্তাধারা সফল হতে পারে-কিন্তু তা বার্সার নীতি ও আদর্শের অনুসারী নয়-অতএব তুমি বাতিল! এবং ঠিক এই কারণে নিজের জাত চিনিয়েও প্রত্যাখ্যাত হলেন মোরিনহো। আর ক্রুয়েফের অনুমোদনে দায়ভার পেলেন তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র পেপ গুয়ার্দিওলা— কাতালান সংস্কৃতির বিশ্বস্ত অনুগামী, বার্সার প্রকৃত ‘ঘরের ছেলে’।      

    চেলসি ছাড়লেন মোরিনহো। গেলেন ইতালি। যোগ দিলেন ইন্টার মিলানে। অন্যদিকে বার্সেলোনার চেয়ারে বসে একের পর এক রদবদল ঘটালেন পেপ। রোনাল্ডিনহো, ডেকো, জামব্রোতা, এডমিলসনের মতো তারকাদের এক লপ্তে অন্য ক্লাবে বিক্রি করলেন। অন্যদিকে দলে এলেন দানি আলভেজ, কিয়েতা, পেদ্রো, জাফ্রান, বুসকেতস, জেরার্ড পিকের মতো আনকোরা মুখ। পরিশ্রম-নির্ভর ফুটবলে জোর দিলেন তিনি। পরম আত্মীয়তা ঢেলে ট্রেনিং সেশনকে করে তুললেন আকর্ষণীয়। রাইকার্ডের তারকা-খচিত টিমে যে-দুটি বিষয় প্রায় উধাও হয়ে গেছিল।   

    বার্সেলোনার ২০০৮-০৯ সিজন ক্লাব ফুটবলের নিরিখে অভাবনীয়৷ লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা দেল রে সমেত ঐতিহাসিক ত্রিমুকুট জিতল তারা। কেকের ওপর চেরির মতো সাজানো রইল চিরশত্রু রিয়াল মাদ্রিদ-কে তাঁদেরই ঘরের মাঠে ৬-২ গোলে পর্যুদস্ত করার রেকর্ড। পরের মরশুম তো আরও ঝলমলে। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৬-খানা ট্রফি ক্যাবিনেটে তুলল পেপ-বাহিনী ৷ সম্ভাব্য সমস্ত খেতাব জিতল— শুধু ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ সম্মান উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়া। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন বার্সার প্রত্যাখ্যাত সেই নায়ক, পেপের একদা-সুহৃদ— হোসে মোরিনহো ৷  

    শেষমেশ চ্যাম্পিয়নও হল তারা। ম্যাচ শেষে অবজ্ঞাজনক ব্যানারের বিরুদ্ধে ন্যু ক্যাম্পের সবুজ গালিচায় এক হাত তুলে হোসের প্রতিস্পর্ধী দৌড় ফুটবল-রূপকথায় লেখা থাকবে।     

    সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ইন্টারের ঘরের মাঠ সান সিরো স্টেডিয়ামে বার্সেলোনাকে ৩-১ গোলে চূর্ণ করার পর ফিরতি লেগে খেলতে বার্সেলোনার ক্যাম্প ন্যু-এ পা রাখলেন হোসে। দেখলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে স্টেডিয়ামের চারধারে টাঙানো হয়েছে প্রকাণ্ড ব্যানার। যেখানে জ্বলজ্বল করছে তিনটি মাত্র শব্দ— ‘হোসে: দ্য ট্রান্সলেটর’। বিপক্ষ কোচের অতীতকে কিঞ্চিত অপমানকর ভঙ্গিতে মনে করিয়ে দিতে কসুর করেনি বার্সা-সমর্থকেরা। ভাগ্যের পরিহাস— ফুটবল-দেবতা সেদিন  উপেক্ষিত মোরিনহোকেই জয়ী করলেন। যে-ডিফেন্সিভ ঘরানার জন্য বার্সায় তাঁর ঠাঁই মেলেনি, সেই কৌশলের টেক্সট-বুক অনুসরণেই বাজিমাত করেন মোরিনহো। লাল কার্ড দেখে থিয়াগো মোতা বেরিয়ে যাওয়ার পর ইন্টার-ব্রিগেড প্রায় ৭০ মিনিট ১০ জনে খেললেও বার্সেলোনা তাদের রক্ষণ ভেঙে এক গোলের বেশি দিতে পারেনি। ৩-২ গড় হিসেবে ফাইনালে উঠল ইন্টার মিলান। শেষমেশ চ্যাম্পিয়নও হল তারা। ম্যাচ শেষে অবজ্ঞাজনক ব্যানারের বিরুদ্ধে ন্যু ক্যাম্পের সবুজ গালিচায় এক হাত তুলে হোসের প্রতিস্পর্ধী দৌড় ফুটবল-রূপকথায় লেখা থাকবে।      

    কিন্তু লড়াই এখানেই থেমে থাকে না। বরং তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তিনটে খেতাব জিতেও পরের মরশুমে ইন্টার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন মোরিনহো। গন্তব্য? রিয়াল মাদ্রিদ! লা লিগায় বার্সার একাধিপত্য ঠেকাতে জন্মবিদ্রোহী হোসেকে ম্যানেজার করার সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। কিন্তু চটজলদি সাফল্য আসেনি। প্রথম মরশুমে তাঁকে টেক্কা দেন পেপ। ক্যাম্প ন্যু-এ পাঁচ গোলে পরাস্ত হয় রিয়াল। ততদিনে লড়াইয়ে বাড়তি রং জুড়েছে দুই উঠতি নক্ষত্র— ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং লিয়োনেল মেসি৷ তা ছাড়া বিশ্বখ্যাত ‘এল ক্লাসিকো’র রাজনৈতিক-সামাজিক তাৎপর্য তো ফুটবলপ্রেমীদের অজানা নয়। স্টেডিয়ামের একদিক মোড়া ব্যানার। তাতে লেখা— ‘ক্যাটালোনিয়া স্পেন নয়’। শুধু দর্শকাসনেই নয়, রাজতন্ত্রের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের আঁচ পড়ে স্টেডিয়ামের বাইরেও। ফলাফল যা-ই হোক; তাকে ছাপিয়ে রাজনৈতিক বার্তা মুখ্য হয়ে ওঠে। জঙ্গি সমর্থকদের নিরস্ত করতে কালঘাম ছোটে পুলিশের।      

    এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে ১৮ দিনের মধ্যে মোট ৪ বার মুখোমুখি হয় রিয়াল এবং বার্সা। ১৬ এপ্রিল, লিগে ম্যাচ ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকে ৷ ২০ এপ্রিল কোপা দেল রে ফাইনালে রোনাল্ডোর গোলে খেতাব জেতে রিয়াল। এরপর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় যুযুধান দুই পক্ষ। শেষ হাসি হাসেন পেপ ৷ কিন্তু নাটকীয় হাতাহাতিতে ঘটনাবহুল প্রথম লেগ হেরে সরাসরি রেফারির বিরুদ্ধে ফেটে পড়েন হোসে ৷ সাফ জানান, রিয়ালের বিরুদ্ধে অশুভ কালো শক্তি কাজ করে চলেছে। এ ভাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলে সেটা পেপ গুয়ার্দিওলার কেরিয়ারে বাড়তি ‘কলঙ্ক’ যোগ করবে ৷ এই টানাপোড়েন জারি থাকে পরের মরশুমেও ৷ কিন্তু ততদিনে স্প্যানিশ ফুটবলের ধাত চিনে ফেলেছেন ‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’। রোনাল্ডো-বেঞ্জিমা-ওজিলের ত্রিফলা জুটির সৌজন্যে রেকর্ড ১০০ পয়েন্ট নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ অবশেষে লিগ জেতে। ঘরে-বাইরে সমালোচনায় বীতশ্রদ্ধ গুয়ার্দিওলা বার্সার দায়িত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন; যোগ দেন জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ-এ। মোরিনহো ফিরে আসেন চেলসিতে।  

    দ্বিতীয় দফায় চেলসি, তারপর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এবং শেষমেশ টটেনহ্যাম হটস্পার-ফেরতা মোরিনহো এ এস রোমা-র দায়িত্ব নিয়ে ইতালি পাড়ি দেন। অন্যদিকে ২০১৬তে জার্মানি ছেড়ে ইংল্যান্ডে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-র গদিতে জাঁকিয়ে বসেন পেপ। মাথার উপর সৌদি আরবের ধনকুবের শেখ মনসুরের ধনাঢ্য বরাভয়। হাতে সার্জিও আগুয়েরো, ভিনসেন্ট কোম্পানি, দাভিদ সিলভা-সজ্জিত দু’বারের লিগ বিজয়ী টিম। দু’য়ের মিশেলে অল্প সময়ে চমৎকার ভাবে দল সাজিয়ে ফেলেন পেপ। পুরোনো মুখ ইয়া ইয়া তোরে, আলেকজান্ডার কোলারভ, জো হার্টদের জায়গায় রুবেন দিয়াজ, রিয়াদ মাহরেজ, এডিনসনেরা উঠে আসেন। প্রথম মরশুমে (২০১৬-১৭) হোঁচট খেলেও দ্বিতীয় মরশুমে সিটি দাপটের সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগ জেতে।

    ফুটবলের বর্তমান দুই দ্রোণাচার্য… ক্লপ ও পেপ

    কিন্তু সাজানো মালায় ফুলের সঙ্গে বিঁধে থাকে কাঁটা। ধারালো সেই কাঁটার নাম লিভারপুল। য়ুর্গেন ক্লপ-এর লিভারপুল। মোরিনহোর চ্যালেঞ্জ অপস্রিয়মাণ হওয়ার ফাঁকে গুয়ার্দিওলার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ান য়ুর্গেন নর্বার্ট ক্লপ— এর আগে জার্মানিতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড-এ ম্যানেজার থাকাকালীন সংবাদের শিরোনামে আসেন। দ্বৈরথের শুরুও তখনই। সর্বার্থে অপ্রতিরোধ্য পেপ-বাহিনীকে এই একটিমাত্র ক্লাব, লিভারপুল, সে বার নাস্তানাবুদ করে। ৪-৩ স্কোরলাইনে লিগে পরাজয়ের ধাক্কার রেশ কাটতে না কাটতেই উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে দু-দফায় ৫-১-এ হার! পেপ বুঝে যান, এ বার লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে। ক্লপের তত্ত্বাবধানে বুন্দেশলিগায় বরুসিয়া ডর্টমুন্ড খেলত ‘গেগেনপ্রেসিং’ স্টাইলে। জার্মান শব্দ, সহজ বাংলায় বললে, মাঠের যে কোনও প্রান্তে বলের পজেশন খোয়ানো মাত্র ডিফেন্সের খোলসে ঢুকে না গিয়ে অতি দ্রুত পজেশন ফিরে পাওয়ার কৌশল হচ্ছে গেগেনপ্রেসিং। ইংরেজিতে যার মর্মার্থ— ‘কাউন্টারিং দ্য কাউন্টার’ বা ‘কাউন্টার-প্রেসিং’। স্বভাবতই স্কিলের পাশাপাশি এর জন্য প্রয়োজন ক্ষিপ্র গতি, অটুট সংঘবদ্ধতা, অখণ্ড মনোযোগ আর ভরপুর প্রাণশক্তি।

    ডর্টমুন্ডে এই স্টাইলের ফলিত প্রয়োগ সফল হলেও ব্রিটিশ ফুটবলের জলহাওয়া মেপে ক্লপ গেগেনপ্রেসিং-কে কাটছাঁট করে ক্ষুরধার ‘কাউন্টার অ্যাটাক’-ধর্মী করে তোলেন। নিজেই, ঈষৎ মজার সুরে, সুরের জগৎ থেকে ধার করে এই নতুন রীতির নাম রাখেন ‘হেভি-মেটাল ফুটবল’; উলটো দিকে গুয়ার্দিওলার ‘পজেশন-বেসড’ টোটাল ফুটবল। লড়াই জমে ওঠে! শুধুমাত্র ডিফেন্সকে ঢেলে সাজাতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি খরচ করে সিটি। সেখানে ৪ বছরে ২৮ জন প্লেয়ারকে ছেঁটে ১৯ জন নতুন মুখ আনতে লিভারপুলকে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সামান্য বেশি ব্যয় করতে হয়!     

    অর্থাৎ, একদিকে প্রভূত আর্থিক বিনিয়োগে চটজলদি সাফল্য। অন্যদিকে সীমিত বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি বনিয়াদ তৈরির বাসনা। একদিকে খান চোদ্দো ইউরোপীয় ট্রফি জয়ের আভিজাত্য। অন্যদিকে আর্থিক বদান্যতার জোরে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ-দর্শনের গুমর। একদিকে সালংকার ঐতিহ্য। অন্যদিকে অপরিমেয় বিত্ত। ইউনাইটেডকে পর্দার আড়ালে রেখে ক্লপ ও পেপের দ্বৈরথ মার্সিসাইড-ম্যাঞ্চেস্টারের মধ্যে ফুটবল-যুদ্ধের নয়া সমীকরণ গড়ে তোলে।   ২০১৭-১৮ সিজনে সিটির মুকুটে যে-লিভারপুল কাঁটা হয়ে উঠেছিল, পরের মরশুমে তা-ই ক্ষুরধার অস্ত্রে পরিণত হয়। ৯৮ পয়েন্ট নিয়ে সিটি লিগ জিতলেও, মাত্র এক পয়েন্ট কম নিয়ে রেস শেষ করা ক্লপের টিম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দখলে নিয়ে বুঝিয়ে দেয়, পরের মরশুম তাদের হতে চলেছে!

    শেষমেশ হয়-ও তাই। ৩০ বছরের খরা কাটিয়ে ২০১৯-২০-র প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি অ্যানফিল্ড ক্যাবিনেটে ঢোকে। পরের তিন সিজন জোরদার টক্কর হলেও তিনবারই শেষ হাসি হেসেছেন পেপ। গত মরশুমে তাদের ইতিহাসে প্রথমবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জেতে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। সর্বসমক্ষে ‘আমাদের ইতিহাস নেই কোনও’ বলে একদিন খেদোক্তি করেছিলেন যিনি, সেই জোসেপ গুয়ার্দিওলা-ই আজ পালাবদলের পটভূমি এঁকে দিচ্ছেন; সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন ক্লপ-ও। ফুটবল-চাণক্যদের দ্বন্দ্ব-বৈরিতার চক্রে ময়দানি ইতিহাস হয়তো এ ভাবেই যুগান্তরের পথে পা বাড়ায়।

    ছবি সংগৃহীত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook