ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৫


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (January 6, 2024)
     

    খোকার জন্ম

    দুই মেয়ের পর আবার গর্ভবতী হলাম। বড় মেয়ে বিমলা। তার দু’বছরের মাথায় মেজমেয়ে ঊর্মিলা। আজ আবার এই খোকা জন্মাল দুই মেয়ের পর, তিন বছর পার করে। আমার বয়স আন্দাজ বাইশ। উঠোনের কুয়ো থেকে কয়েক বালতি জল তুলে স্নান করতে করতেই পেটে  ব্যথা উঠল। সেটাই যে প্রসব যন্ত্রণা প্রথমে তা বুঝতেই পারিনি। স্নানের পর ভিজে কাপড় ছেড়ে পেতলের খালি কলসিটা নিয়ে সদরের বাইরে গিয়েছিলাম; খাবার জলের নতুন যে ‘কোম্পানির কল’ রাস্তায় বসেছে, সেখান থেকে এক কলসি জল ভরে আনতে। একটু হেঁটে এসে রাস্তার ওপরেই তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে যে বাঁধানো রোয়াক, সেখানে উঠে সদর দরজাটার কাছে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুরু হল গর্ভ-জল ভাঙা। কোনও রকমে বড় মেয়ের নাম ধরে, ‘বিমলা’ বলে চিৎকার পেড়ে, একতলার প্রথম ঘরটায় ঢুকে এলাম; জলভর্তি কলসিটা মাটিতে নামিয়ে, খোলা জানলা দুটো কোনও রকমে ভেজিয়ে, দেহের সমস্ত বল হারিয়ে, জানলারই শিক ধরে বসে পড়লাম মেঝেতে। দর দর করে ঘাম ঝরছে; ঝরছে গর্ভ-ভাঙা জল; আর বত্রিশ-নাড়ি ছিঁড়ে সেই জলে যোনিপথ সাঁতরে এসে জন্ম নিচ্ছে, আমার তৃতীয় সন্তান। প্রসব বেদনায় ছিন্নভিন্ন, আমার চিৎকার শুনে, ঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে পাঁচ বছরের বিমলা— আমার বড় মেয়ে। হতচকিত হয়ে সে দেখছে যে, আমার ছড়ানো দু’পায়ের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে একটা ছোট্ট মাংসের গোলা; হাত পা মুখের আদলে যেন একটা পুঁচকে মানুষই, ঠিক যেন তার পুতুলের মতোই; কিন্তু রক্তে মাখামাখি। বিমলাও চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ভয়ে।  

    চেতনা হারাবার আগে ক্লান্ত অবসন্ন আমি শুধু বলতে পারলাম, ‘তোদের ‘রাঙামা’কে ডেকে আন; আর বল যে, শরি-দাইকে খবর দিতে।’  

    বাড়ির লাগোয়া নাপিতের ঘর থেকে ফকিরের মা, মানে শরি-দাই এসে গেছে দেখে, আশ্বস্ত হলাম। ক্লান্তিতে জড়িয়ে গেল দু-চোখ। তার কথাগুলো তবুও যেন আবছা আবছা ভেসে আসতে লাগল কানে।

    শরি বলে চলেছে, ‘তিন মালসা গরম জল… আর একটা সরা চাপা দেওয়া খালি মালসা… সেঁকের সরা… ধোয়ামোছা কলাপাতা… খান চারেক নতুন হাত-গামছা… নতুন মার্কিন-থান… কাঠকয়লার তোলা আঁচ… খড়, তোশক, ওয়াড় দেওয়া কম্বল… হ্যাঁ, একটা মাদুরও!’   

    টের পেলাম, রাঙাদি-শরি আর বিমলার ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটিও…   

    এটাই যে আমার প্রথম-প্রসব তা তো নয়! তবু গা যেন ছেড়ে দিয়েছে একেবারে।      

    শিশুর কান্নায় চেতনা আসতে দেখি যে, আমার প্রসব-নাড়ি কাটার তোড়জোড় হচ্ছে; তখনও একনাড়িতে জুড়ে থাকা রক্তমাখা সেই সদ্যজাত শিশুটি রাঙাদির দু’হাতের পাঞ্জায়। নাড়ি কাটবার আগেই, ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে রাঙাদির হাতে ধরা শিশুটির ওপর, একফাঁকে শরিই বোধহয় ফেলে  দিয়েছিল একখণ্ড নতুন কাপড়। রাঙাদির হাত থেকে নিয়ে, বাচ্ছার ঠ্যাং দুটো ওপরে তুলে, তার পাছায় জোরে একটা চাপড় মারল শরি; আর সে যখন কেঁদে উঠল মানুষের গলায়, নিশ্চিন্ত হয়ে শরি বলল, ‘বংশে বাতি দিতে সোনার চাঁদ এলেন— পেটের শত্তুরই বড় শত্তুর… রক্ষে কর ‘রাধাকান্ত’… ‘রাধাকান্ত’। বুঝলাম যে ছেলে হয়েছে।   

    নাড়ি কাটতে, কচি বাঁশের ছোট ছোট কয়েকটা চ্যাঁচারি তো সে সঙ্গে নিয়েই আসে। সেগুলোকেই  ছুরির মতো ধারালো করে ছুলে, গরম জলে ফেলে, শুকনো করে মুছে তবে নাড়ি কাটে; আমার নাড়িটাও সেভাবেই একটানে কুচ করে কেটে দিল। রক্ত বন্ধ করতে, পাটের রশি দিয়ে বেঁধে দিল ক্ষতমুখ। তারপর যোনিপথে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে, ধীরে ধীরে বার করে আনল আমার শরীরে বেড়ে ওঠা গর্ভ-ফুল। মালসায় রাখা গরম জলে, নতুন গামছা ডুবিয়ে ডুবিয়ে সে মুছে দিতে লাগল রক্তে মাখামাখি আমার নিম্নাঙ্গ, ঊরু এবং পা’দুটো। আধবোজা চোখে রুইকেও তো এক ঝলক দেখলাম; শরির সঙ্গে আসা ওর বিধবা ননদ। তার বউদির নির্দেশ মেনে, আমার শরীর থেকে বের হওয়া সেই রক্তাক্ত গর্ভ-ফুলটা কলাপাতায় মুড়ে, আর একটা নতুন মালসায় তা রেখে, সরা চাপা দিল রুই; তারপরে, হাতে করে সেটা নিয়ে ঘরের বাইরে রেখে এল, পরে ওই সরা সমেত মাটিতে পুঁতে দেবে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুই আবার ফিরে এল, কাঠকয়লা-জ্বলা নরম আঁচের ছোট্ট একটা তোলা উনুন নিয়ে। তার ওপর মাটির সরা চাপিয়ে, উবু হয়ে বসে শরিই সেঁকতে লাগল ভাঁজ করা কয়েকটা কাপড়ের টুকরো। তাই দিয়ে শুরু হল আমার যোনিদেশ, ঊরু আর তলপেটে দ্রুত সেঁক। সেই সঙ্গে তদারকি করতে লাগল শিশুরও। এবার রুই এসে গরম জলে স্পঞ্জ করে করে পরিষ্কার করল, রাঙাদির কোলের মধ্যে শোয়ানো তার কচি শরীর। আরাম পেয়ে এবং দারুণ নিশ্চিন্ত বোধ করে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।       

    ঘুম ভাঙতে দেখি, সেই ভিজে শাড়ি-সেমিজ ছাড়িয়ে শুকনো কাপড় পরানো হয়েছে আমাকে। চুলগুলোও চুড়ো করে বাঁধা। খড়ের ওপর একটা পুরনো তোশক পেতে, তার ওপর চাদরের বদলে একখানা নতুন মার্কিন বিছিয়ে আমাদের মা-ছেলের যে বিছানা, সেখানেই এলিয়ে আছি আমি; আর কোলের কাছে নরম কাপড়ে মোড়া একটা পুঁটুলি— আমার খোকা। সে জন্মাল পোষ-মাসের হাড় কাঁপানো শীতে। শুরু হল আমার আঁতুড় এবং বাড়ির সকলের শুভ অশৌচ। বুঝলাম যে বেজায় খিদে পেয়েছে। মনে পড়ল, স্নান সেরে দুপুরের ভাত পেটে পড়বার আগেই তো এত সব ঘটে গেল। ভাবতে ভাবতেই বিমলাকে নিয়ে ঘরে এলেন শাশুড়ি-মা। একবাটি খুদ-ভাত আর আলুসেদ্ধ একটু দূর থেকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে নিও’; বিমলাকে বোধহয় বলা আছে মায়ের কাছে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি না করাতে। মাথা নিচু করে আদুরে স্বরে সে বলল, ‘আমি ওর নাম দিয়েছি— ‘ভাই’!’ বললাম, ‘লক্ষ্মী হয়ে থেকো; ঠাকুমার সব কথা শুনো, কেমন!’ বিমলা মাথা নাড়ল।

    দরজার কাছে দাঁড়িয়েই শাশুড়ি বললেন, ‘একতলার এই ঘরে আঁতুড় হওয়ায় সুবিধেই হল। পায়খানা যেতে তোমাকে আর ওপর-নীচ করতে হবে না।’   

    একটু থেমে আবার বললেন, ‘এ ক’দিন আর কুয়োপাড়ে যেও না। স্নানের জল বারান্দাতেই পাবে। এরপর আঁতুড় তোলার যেমন যা নিয়ম— সে সব পরে শরি এসেই করবে; তখন ওর সঙ্গে গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে নেবে।’  

    বুঝতে পারলাম যে এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব ব্যবস্থাই করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারলাম না যে, তাঁদের ছেলেকে খবর দেওয়া হয়েছে কি না! মনে পড়ল আজ তো রবিবার।   

    আমাদের চার বোন এক ভায়ের মধ্যে আমিই বড়। ভাই অবশ্য তখনও জন্মায়নি। সাত বছরের মেয়ের আর কী হুঁশ থাকবে! ইজেরের ওপর ফ্রক পরা একটা মেয়ে; আর কালো কার দিয়ে গলা থেকে ঝোলানো ছোট্ট একটা গুড়ের নাগরি— আঙুল ডুবিয়ে চুষে-চুষে খাওয়ার জন্য।

    এ তরফে আমার কত্তা তরঙ্গনাথ বা তনুই আপাতত এক ছেলে। এরা ছিলেন দুই ভাই। ছোট  ভাই অদ্রিনাথ (বদু) মারা যায় নিতান্তই অল্প বয়সে; বউ হয়ে এসে আমিও তখন এ বাড়িতেই; বিমলা জন্মে গেছে; ঊর্মিলা গর্ভে। বয়সে আমার থেকে বছর চারেকের বড় সেই ছোট দেওর মারা যেতে, শাশুড়ি-মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। আবার তার পরে পরেই তাঁদের একমাত্র মেয়ে, সধবা-রানিকে পাগল বলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে, তার স্বামীর আবার তড়িঘড়ি বিয়েও দেওয়া হয়। সন্তানহীন অবসাদগ্রস্ত সেই বয়স্থা ননদকে একমাত্র আমিই সামলাতে পারি। শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি-মা যে এখানে থাকেন, তা ওই রানির জন্যই। বড়মেয়ে বিমলা বরাবরই ঠাকুমার ভক্ত, তাই সে-ও এখানেই থাকে। আর এক মেয়ে ঊর্মিলা যাকে সবাই ইলা বলেই ডাকে, তাকে নিয়েই কত্তার সঙ্গে আমি থাকি পাটনায়। আমার স্বামীর পুলিশে চাকরি; এখন পাটনায় পোস্টিং। যখন-তখন ছুটি পান না। লোক দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ক’দিন এখানে থেকে বিমলাকে নিয়ে ফেরত যাবার কথা। পাটনার সদর হাসপাতাল থেকে নার্স এসে বাড়িতেই প্রসব করাবে, এমন ব্যবস্থাই কত্তা করে রেখেছিলেন; কিন্তু বিধি বাম! এখানেই প্রসব হয়ে গেল। জানি না, শাশুড়ি কবে যে আবার আমাকে সেখানে পাঠাবেন! তার ওপর আবার নাতি বলে কথা!

    ঘরে-ঘরে শাঁখ বাজছে মানেই সন্ধে হয়ে এল। মাঝেমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ছি; সময়ের হুঁশ আর রাখতে পারছি কই! চোখ মেলে দেখি, শরির ননদ রুই এসেছে; ঘরের বাইরে থেকে প্রদীপ দেখিয়ে, হাত দিয়ে দিয়ে এ ঘরে ধুনোর ধোঁয়া উড়িয়ে, ডিঙি মেরে তার এক হাত বাড়িয়ে ঘরের সুইচটা টিপে আলোও জ্বেলে দিল। একটু ঝুঁকে ঘরের কোনের দিকে সাবধানে ঠেলে দিল, ছোট একটা আংরার আগুন; শীতের রাতে, একতলার ঠান্ডা মেঝের এই ঘরটা সারারাত উষ্ণ থাকবে।  বেশ ক’বছর পর আবার আঁতুড় ঘর, আবার বুকের দুধ খাওয়ানো, বার বার দুধসাবু খাওয়া এবং আপাতত বন্ধ সেই ঘরজোড়া খাটে শুয়ে স্বামীর সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষিও। এসব ভাবনার মধ্যেই  একখান ছাড়া কাপড় পরে, আলগোছে হাতখোঁপা বেঁধে রাঙাদি ঘরে এল। এ ক’দিন অশৌচ বলে চুলে চিরুনি ঠেকাবে না, সিঁদুরও পরবে না; যেহেতু আঁতুড় তুলবে, তাই সে-ই একমাত্র এ ঘরে আমার কাছে আসতে পারবে। বিছানার পাশে রাখা মাদুরে বসেই রাঙাদি জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, খোকা তোর মাই টেনেছে? পেচ্ছাপ করেছে!’    

    বললাম, ‘ঘুমোচ্ছে তো! টানাব কী করে! আমিও তো ঘুমিয়ে পড়ছি বারে বারেই।’  

    রাঙাদি বলল, ‘উঠে বস দেখি! না বসলে টানাতে পারবি না।’  

    খোকাকে নেড়ে চেড়ে দেখেই বলল, ‘এই দেখ, পেচ্ছাপ করে শুয়ে আছে। ওঠ! ওঠ!’

    পুরনো ধুতি ছিঁড়ে বানানো খোকার কোলোট বদলাতে বদলাতে বলল, ‘কাল সকালেই টেলিগ্রাম চলে যাবে; দেখবি, মেজ-ঠাকুরপো হয়তো পরশুই এসে পড়বে!’

    বললাম, ‘কোথায়! কার কাছে? কে পাঠাল?’

    চোখের কোনে ঝিলিক খেলিয়ে বলল, ‘কোথায় আবার, পাটনায়! দেখবি তখন, বাড়ি এসেই কত না সোহাগ করবে তোকে!’    

    চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘তোর বড়ঠাকুর বলেছেন যে, কালকে সকালে শেয়ালদা পৌঁছেই, সেরেস্তায় ঢোকার আগে, ‘তার’ করে দিয়ে তবে কাজে যাবেন। আর তোর জন্য একটা ব্র্যান্ডির বোতলও আনতে বলে দিয়েছি। লুকিয়ে-চুরিয়ে রাখিস, রাতে দুধের সঙ্গে খেলে ঠান্ডা লাগবে না।    

    কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এল। মাস ছয়েক আগেই রাঙাদিরও ছেলে হয়েছে; চার মেয়ের পরে। আরও ক’জন অবিবাহিত ভাসুর, দেওর এবং এক বিধবা বড়-জা নিয়ে রাঙাদির বেশ বড় সংসার; লোক অনুযায়ী আয় তেমন নয়। ধান্যকুড়িয়ার সম্পন্ন ঘরের মেয়ে এই রাঙাদি, নাম উমারানি। লেখাপড়া জানা; মুখশ্রী খুব সুন্দর না হলেও ধপধপে গায়ের রং। আর অসম্ভব ভার-সওয়া এক মেয়ে। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সব সময় শান্ত। এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে রাঙাদিকে বড়-জা হিসেবে পেয়ে, আমি যে কী খুশি হয়েছিলাম! কেমন মিষ্টি করে ডাকে, ‘তরু’!

    শাশুড়ির নির্দেশে, রাতে এই ঘরে শোবার প্রস্তুতি হিসেবে ওপর থেকে মাদুর, বিছানা, কম্বল ও বালিশ নিয়ে রুই এসে ঘরে ঢুকল। ধরে ধরে নিয়ে গেল সিঁড়ির নীচে কলঘরে। শাশুড়ি রাতের দুধ-সাবু বিমলার হাতে পাঠিয়ে দিলে, আমাকে সেটা খাইয়ে দিয়ে রাঙাদি উঠে পড়ল। যাবার সময় বলে গেল, ‘দেখ, যদি তোর দুধ টানাতে না পারিস তো, আমার মিনি টানিয়ে দেব। আমার তপু তো টানছে; তোর খোকা কি আমার খোকা নয়!’

    কত্তা এলেন, ঠিক একদিন পর, মঙ্গলবার বিকেলের গাড়িতে; দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন; আমি জেগেই ছিলাম। পকেট থেকে বার করে, দুটো টেলিগ্রাম দু’হাতে তুলে ধরে দেখালেন। বুঝলাম যে আমার শ্বশুরমশায়-ও ‘তার’ করেছেন ছেলেকে; আবেগ চেপে রেখে বললাম, ‘ওপরে গিয়ে চা-জল খাও; খোকা ঘুমুচ্ছে।’

    চাপা হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘খোকার মা না থাকলে, খোকাকে কোথায় পেতাম!’

    কত্তার আসার সাড়া পেয়েই দুদ্দাড় করে নেমে এসে, বাপের কোলে উঠে পড়ল বিমলা। আমার দিকে আর একবার গভীরভাবে তাকিয়ে, বিমলাকে কোলে নিয়ে ওপরে উঠে গেলেন তিনি।

    দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে, ঘরে ঢুকে এসে রাঙাদি বলল, ‘কি রে তরু! কী বলেছিলাম!’

    আর সকলের মতোই আমার আঁতুড়ও উঠল— পর্বে পর্বে ‘পাঁচ-উঠোন’, ‘ষষ্ঠীপুজো’, ‘আট  কড়াই’ এমন সব নিয়ম মেনে; এবং আর সকলের মতোই সন্তানের স্বীকৃতি স্বরূপ আমিও হাতে পেলাম সেই কাগজখানি। খোকা যেদিন জন্মায়, সে দিনের পাঁজির পাতাটা ছিঁড়ে, তারই ওপর তার সেই মুক্তোর মতো সুন্দর হাতের লেখায়, বিলিতি ফাউন্টেন পেন দিয়ে শাশুড়ি-মা লিখে দিয়েছেন— ১৩ পৌষ, বেলা ১১.৪৫ মিনিট, অমৃত যোগ, কালবেলা, রবির জাতক— তনুর ছেলে, খোকা। গৃহদেবতা ‘রাধাকান্ত’র চরণ-তুলসী, এবার এই কাগজখানিতে মুড়ে পাঁচধাতুর মাদুলি করে পরানো থাকবে খোকার গলায়, যাতে রোগ, শোক আর অকালমৃত্যু তাকে কখনও না স্পর্শ করতে  পারে। এ হল একই সঙ্গে ঠাকুমার আশীর্বাদ এবং যম-দুয়োরে বাঁধন।

    : আমি তরু, তরুলতা। বিয়ে হয়েছিল আমার যখন বয়স সাত আর কত্তার বয়স উনিশ। পাল্টি-ঘর আর পুলিশের চাকরি দেখে বিয়ে হল। শাশুড়ি আনুলিয়ার মেয়ে। তার বাপের বাড়ির কাছাকাছি গ্রাম শিবনিবাসে আমার খোঁজ পেয়ে, শ্বশুরমশায়কে লোক দিয়ে পাঠানো হয় আমাকে দেখতে। খবর না দিয়ে আসায় আমাদের কোনও প্রস্তুতি ছিল না। আমার বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। আমাদের চার বোন এক ভায়ের মধ্যে আমিই বড়। ভাই অবশ্য তখনও জন্মায়নি। সাত বছরের মেয়ের আর কী হুঁশ থাকবে! ইজেরের ওপর ফ্রক পরা একটা মেয়ে; আর কালো কার দিয়ে গলা থেকে ঝোলানো ছোট্ট একটা গুড়ের নাগরি— আঙুল ডুবিয়ে চুষে-চুষে খাওয়ার জন্য। সেই ফ্রকের ওপরেই কোনও রকমে একটা চেলি জড়িয়ে তো আমাকে নিয়ে আসা হল শ্বশুরের সামনে; মা বলে দিয়েছিলেন, তাই প্রণাম করলাম; বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।     

    মাস কয়েক পর বিয়ে হল, ইয়া লম্বা বরের সঙ্গে; গ্রামের মেয়ে শহুরে আদব-কায়দা জানব কোথা থেকে! বরণ করে ঘরে তোলার সময় সে কী কান্না শাশুড়ির! একে তিনি শিক্ষিত, তায় পরমা সুন্দরী। তার ওপর আবার দাপুটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে! বুঝলাম যে আমাকে একটুও পছন্দ হয়নি তাঁর। সে সময়ের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পরে পরেই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বিয়ের মতোই আবার একটা অনুষ্ঠান হল, আমার প্রথম ঋতুস্নানের পর। প্রায় পাঁচ বছর পর পাকাপাকিভাবে এ বাড়িতে এলাম শ্বশুর-ঘর করতে; সেই যে আমার সেই তালঢ্যাঙা লম্বা বর, সে তখন মস্ত এক গোঁপ সমেত পূর্ণ যুবক এবং আরও একহাত লম্বা হয়ে প্রায় একটা ঝাঁকড়া গাছের মতোই। এ দিকে আমার শরীরে লাবণ্য এলেও মাথায় কিন্তু খাটোই রয়ে গেলাম আমি। প্রথম রাতেই বর বলল, ‘গান গাইতে পারো?’ মাথা নেড়ে না বলাতে বলল, ‘মা যখন তোমাকে আমার কাছে একা থাকতে পাঠাবেন, তখন তুমি মেমসাহেবের কাছে সেলাই শিখবে।’ আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘ইচ্ছে হলে সেতারও শিখতে পারো। পাটনায় বড় বড় ওস্তাদেরা বাড়িতে এসেও গান-বাজনা শেখান।’  

    সেই যে ভাব হল দুজনের, তা আর সারা জীবনে চিড় খেল না একটুকুও। গান আর ফুলগাছ-পাগল আমার এই পুলিশ বরের সঙ্গে থাকতে থাকতে, অনেক কিছুর সঙ্গে আমি কিন্তু সব চেয়ে ভাল শিখলাম বন্দুক চালানো। আর শিখলাম, সম্মান না খুইয়ে সৎ ভাবে বাঁচা। হাল ধরলাম এমন এক সংসারের যা আর পাঁচজনের থেকে একদম আলাদা। খোকার পরে আবার খুকিও কোলে এল। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে এক পরিপূর্ণ এবং সুখী দাম্পত্যে জড়িয়ে রইলাম দুটিতে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র    

      

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook