ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • তখন প্রবাসে রবীন্দ্রনাথ: পর্ব ৩


    নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (July 9, 2022)
     

    প্রথম বিলেত: পর্ব ৩

    য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ বইয়ে প্রায় তিরিশ পৃষ্ঠা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ এক বিশেষ প্রজাতির বাঙালির ছোট্ট-ছোট্ট গল্প শুনিয়েছেন আর তাই নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। বিলেতে যাওয়া আর বিলেত-ফেরতা— এই দুই গোত্রের বাঙালির কাণ্ডকারখানার গল্প বলতে রবীন্দ্রনাথ তাদের সম্বোধন করেছেন ‘ইঙ্গবঙ্গ’ হিসেবে। বিলেতে গিয়ে কী করে এই ইঙ্গবঙ্গীয়রা? কী দেখলেন রবীন্দ্রনাথ?

    বিলেতে বাড়িওয়ালাদের অনুপস্থিতিতে বাড়িওয়ালিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে ইঙ্গবঙ্গীয়রা। সেইসব বাড়িওয়ালি যেন এক-একজন ‘জীবন্ত বিবি— জুতো-পরা, টুপি-পরা, গাউন-পরা।’ এরকমই এক বাড়িওয়ালি এক ইঙ্গবঙ্গকে নিয়মিত খুবই বিনীত ভাবে কী চাই-কী না চাই জিজ্ঞেস করতে আসত। ইঙ্গবঙ্গীয় তাতে খুবই আহ্লাদিত হত। তার মধ্যেই একজন একবার এক বিবিকে ধমকাতে পেরে খুবই গৌরব বোধ করেছিল এই ভেবে যে, সে অন্তত এক ইংরেজ বিবিকে ধমকাতে পেরেছে।

    রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, বিদেশের ডিনার টেবিলে তার পাশের মহিলার কানে-কানে খুব মৃদু, ধীর স্বরে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে বিবিসমাজে বাঙালি সহজেই জায়গা করে নেয় কিন্তু পুরুষদের মহলে মিশতে পারে না, কারণ তার জন্যে অনেক পড়াশোনার দরকার হয়। কিন্তু এইসব বলে রবীন্দ্রনাথ এ কী লিখলেন! ‘মহিলাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে আমাদের বড়ো শিক্ষার দরকার করে না…।’ যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ একটা গল্প বললেন। এক নবাগত বঙ্গ যুবক তার প্রথম নিমন্ত্রণসভায় গিয়ে ভাব জমাল গৃহস্বামীর যুবতী কন্যার সঙ্গে। সেই তনয়ার হাসিতে-হাসিতে তার হৃদয়ে উঠল ঢেউ। যুবক মেয়েটিকে বলল, কেন তার বিলেত ভাল লাগে, কেন দেশে ফিরে যেতে মন চায় না, ভারতবর্ষে কত কুসংস্কার— ইত্যাদি। এমন একটা ব্যাপার, যেন বিবিটির এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, যুবক নিজে এক অন্ধবিশ্বাসমুক্ত মানুষ। কয়েকটা মিথ্যে কথাও সে বলে বসল মেয়েটাকে। যেমন, একবার সুন্দরবনে সে বাঘ শিকার করতে গিয়ে অসম সাহসিকতার জোরে মরতে-মরতে বেঁচে গিয়েছিল। মেয়েটি অচিরেই বুঝল, তাকে এই যুবকের ভাল লেগে গেছে। মেয়েটি তার মিষ্টতম বাক্যবাণে যুবকের প্রাণে আঘাত হেনে চললেন। প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণ থেকে ফিরেই যুবক তার স্ত্রীকে চিঠি লেখা বন্ধ করলেন। এই গল্পের শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘এখন তোমরা হয়তো বুঝতে পারছ, কী কী মশলার সংযোগে বাঙালি বলে একটা পদার্থ ক্রমে বেঙ্গলো-অ্যাঙ্গলিক্যান কিংবা ইঙ্গবঙ্গ নামে একটা খিচুড়িতে পরিণত হয়।’

    রবীন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে বুঝলেন, বাঙালি আর ইঙ্গবঙ্গ যেন দুই ভিন্ন জাত। ইঙ্গবঙ্গ শুধু আকর্ষিত হয় বিলেতের বাহ্যিক চাকচিক্যে। যেমন একটা চকচকে বইয়ের মলাটের ভিতর তাদের আর ঢুকতে দেখা যায় না। তাদের চোখে কী পড়ে? চোখে পড়ে বিলেতের ভাড়া দেওয়ার প্রথা। কয়েকজন বাঙালির ইচ্ছা বিলেতের কায়দায় দেশে ফিরে ঘর ভাড়া দেওয়া। আর একজন বিলেতের সমুদ্রমন্থন করে বিলেতে স্ত্রী-পুরুষের একসঙ্গে নাচের মতো সম্পদ আহরণ করেছেন। সেই ইঙ্গবঙ্গ সমাজ-সংস্কারকের মনে হয়েছে, দেশের মেয়েদের না নাচাটাই প্রধান অভাব। তার বাতিক, সে দেশে ফিরে মেয়েদের নাচ শেখার বন্দোবস্ত করবে। একজন আবার আক্ষেপ করছিলেন যে, দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজাতে পারে না আর বিলেতের মতো অতিথিদের আমন্ত্রণ গ্রহণ আর প্রতি-আমন্ত্রণ জানাতে পারে না এই ভেবে। বিলেতে বসে এইসব শুনে রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল, একবার এক বাঙালি দেশের মেয়েদের প্রতি অভক্তির কারণ হিসেবে বলেছিল যে, বাঙালি মেয়েরা ইংরেজ মেয়েদের মতো বিচিহীন, সরেশ লেবুর আচার তৈরি করতে পারে না। আর একজন, ভারতীয়রা কত বর্বর তা প্রমাণ করার জন্য বলল, দেশের খাবারে মাছি ভনভন করে আর জুতো খুলে খেতে বসলে জুতো চুরি যায়। ডিনারের টেবিলে কাঁটা ছুরি উলটে ধরতে হবে কি না, মাছের পর মাংস খাওয়া হবে কি না, দস্তানা পরার সময় আগে থাকতে বুড়ো আঙুল গলিয়ে দেওয়া দস্তুর কি না, মাছ খাওয়ার সময় ছুরি ব্যবহার করা হবে কি না, শেরী খাবার গ্লাসে শ্যাম্পেন খাওয়া হবে কি না এইসব নিয়ে একজন ইঙ্গবঙ্গ এত উতলা হয়ে যায় যা বলার নয়। এর সঙ্গে লেগেই আছে দেশের নিন্দে। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, ‘বাঙালিরা ইংরাজদের কাছে যত আপনাদের দেশের লোকের ও আচার-ব্যবহারের নিন্দে করে এমন এক জন ঘোর ভারতদ্বেষী অ্যাঙ্গলো-ইন্‌ডিয়ান করেন না।’

    রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, অনেক ইঙ্গবঙ্গ, সুন্দরী বাড়িওয়ালির ঘর ভাড়া করেন। তাতে তাদের যথেষ্ট সুবিধা হয়। বাড়িতে পা দিয়েই তারা বাড়িওয়ালির যুবতী কন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে নেয়। দু-তিনদিনের মধ্যে তার একটা আদরের নামকরণ করা হয়, আর সপ্তাহ গেলে হয়তো তার নামেই একটা কবিতা লিখে তাকে উপহার দেওয়া হয়।

    রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, অনেক ইঙ্গবঙ্গ, সুন্দরী বাড়িওয়ালির ঘর ভাড়া করেন। তাতে তাদের যথেষ্ট সুবিধা হয়। বাড়িতে পা দিয়েই তারা বাড়িওয়ালির যুবতী কন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে নেয়। দু-তিনদিনের মধ্যে তার একটা আদরের নামকরণ করা হয়, আর সপ্তাহ গেলে হয়তো তার নামেই একটা কবিতা লিখে তাকে উপহার দেওয়া হয়। হয়তো কোনও সন্ধেবেলায় রান্না ঘরে গিয়ে সেই ইঙ্গবঙ্গ বাড়িওয়ালি, তার কন্যা আর বাড়ির দাসীটিকে বিজ্ঞান, দর্শন আর মনস্তত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করেন। তার লম্বাচওড়া কথা শুনে এরা ভেবে বসে, এই ইঙ্গবঙ্গ নিশ্চয় একজন কেষ্টবিষ্টুর মধ্যে পড়ে। ইঙ্গবঙ্গদের বিলেতের দাসীপ্রীতি খুবই খাটো চোখে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ। একদিন এক বাড়িওয়ালির মেয়ে এক ইঙ্গবঙ্গকে এক পেয়ালা চা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, চায়ে চিনি দিতে হবে কি না। ইঙ্গবঙ্গ হেসে বলল, ‘না নেলি, তুমি যখন ছুঁয়ে দিয়েছ, তখন আর চিনি দেবার আবশ্যক দেখছি নে।’ বাড়িওয়ালি, বিলেতের দাসীদের সঙ্গে এইসব সস্তার রসিকতা একেবারে ভাল চোখে দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন, ‘দাসীদের সঙ্গে তাঁরা বেশ অসংকোচে অভদ্রতাচারণ করতে পারেন। আসল কথা কী জান? শাদা চামড়ার গুনে তাঁরা দাসীদের যথেষ্ট নীচশ্রেণীর লোক বলে কল্পনা করতে পারেন না; একজন বিবি দাসী বলে মনে করতে পারেন। একটা শাড়ি পরা ঝাঁটা-হস্ত কালো-মুখ দেখলে তবে তাঁদের দাসীর ভাব ঠিক মনে আসে।’ একবার এক ইঙ্গবঙ্গ তার বন্ধুদের বাড়ি নিমন্ত্রণ করেছিল। খাবার টেবিলে জনাকয়েক বাড়িওয়ালি আর দাসীও ছিল। তাদের একজনের ময়লা কাপড় দেখে ইঙ্গবঙ্গ তাকে কাপড় বদলে আসতে বলায় সে বলেছিল, ‘যাঁকে ভালবাসা যায় তাকে ময়লা কাপড়েও ভালবাসা যায়!’ রবীন্দ্রনাথ বেজায় বিরক্ত হয়ে লিখছেন, ‘যে দাসী এরকম করে উত্তর দিতে পারে তাকে কতদূর স্পর্ধা দেওয়া হয়েছে মনে করে দেখো।’ রবীন্দ্রনাথকে এক সাহেবের বিধবা পত্নী একদিন বললেন, তিনি শুনেছেন বিলেতের বাঙালিরা অত্যন্ত ছোটলোকদের সঙ্গে মেশে আর একত্রে খায়। ‘একবার মনে করে দেখ দেখি কতকগুলো বেহারা ও দরোয়ানের সঙ্গে তোমরা একাসনে খাচ্ছ— সে কী বিশ্রী দেখায়!’ সে মহিলার মুখে এই কথা শুনে লজ্জায় রবীন্দ্রনাথের মাথা নীচু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় এইসব ইঙ্গবঙ্গদের কাণ্ডকারখানায় যেন তাদের শোনাতে চাইলেন উইলিয়ম মেকপিস থ্যাকারের এই কথা : ‘It may safely be asserted that the persons who joke with servants or barmaids at lodgings are not men of a high intellectual or moral capacity. To chuck a still-room made under the chin, or to send Molly the cook grinning, are not, to say the least of them, dignified act any gentlemen.’

    রবীন্দ্রনাথ দেখে অবাক হলেন, বিলেতে আসে ইঙ্গবঙ্গদের প্রায় কেউই কবুল করে না যে তারা বিবাহিত, কেননা অবিবাহিত পরিচয় দিলে তারা বিলেতের অর্ধেক আমোদ ভোগ করতে পারে না। বিবাহিতদের সঙ্গে যথেচ্ছাচারে রাজি হয় না কেউই। কাজেই অবিবাহিত পরিচয় দিলে আখেরে লাভই বেশি। এইসব গল্প বলে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমার নিতান্ত ইচ্ছা, ভবিষ্যতে যে-সকল বাঙালিরা বিলেতে আসবেন তাঁরা যেন আমার এই পত্রটি পাঠ করেন। বাঙালিদের নামে যথেষ্ট কলঙ্ক আছে; কিন্তু তাঁরা যেন সে কলঙ্ক আর না বাড়ান, তাঁরা যেন সে কলঙ্ক এ সাত সমুদ্র পারে আর রাষ্ট্র না করেন।’

    কভারের ছবি: ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথ
    ছবি সৌজন্যে: লেখক 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook