ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বান্দরনাচ


    দেব রায় (December 9, 2023)
     

    পাড়ার ছোট্ট পার্কটায় লম্বা একটা কদমগাছে বসে কোকিলটা সমানে ডেকে চলেছে। ডেকেই চলেছে ননস্টপ। পাড়ার গণেশ মুদি বলল, ‘হাইবিট কোকিল, চাইনিজ মাল।’ রতন বলল, ‘কোকিলটার মাথায় বীর্য উঠে গিয়েছে।’ রতন ধাতু নিয়ে ঘোর চিন্তিত থাকে সবসময়। পাড়ায় চ্যাংড়া ছেলেপিলে ওকে শীঘ্রপতন রতন বলে খেপায়।

    অফিস-গেটে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছে। বিল্ডিং-এর নাম টেরাপলিস। লম্বা কাচের দেয়ালের ওপারে রিসেপশনের ওখানে তিন মানুষ সমান গণপতির মূর্তি বসানো। আমি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বায়োমেট্রিক চ্যানেলে দাঁড়ালাম চোখ বড় বড় করে, হাত রেখে। স্ক্যান করে তবে আপনা-আপনি খুলে যাবে ভিতরে যাওয়ার স্বয়ংক্রিয় কাচের দরজা। প্রতিদিন এই সময়ে আমার বুক গুড়গুড় করে। তুলিকে সে কথা বলতে বলেছে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত খোঁয়ারি। বায়োমেট্রিক মেশিনে বিপবিপ করে উঠল— অ্যাক্সেস ডিনায়েড! ফালতু ঝামেলা। রুমাল বের করে হাত মুছলাম, চোখ পিটপিট করলাম। একই কাণ্ড। গেটকিপার বেনারসি বলল, ‘হোতা হ্যায় কভি কভা। কুছ সময় বাদ টেরাই কিজিয়ে।’ গরমে বাইরে দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগলাম।

    মিরর গ্লাসে মোড়া বিল্ডিং। ভিতরে বরফের দেশ, আমার লকারে সোয়েটার, স্কার্ফ রাখা থাকে, কিন্তু বাইরে তো ফার্নেস। একটা সিগারেট আর পনেরো মিনিট পরে বেনারসির ভুরু কুঁচকে গেল। সে সিস্টেমকে ফোন করল। আমি দেখেছি যে কোনও ভাইটাল দিনে কিছু না কিছু গড়বড় হবেই। আজকের ডিলটা সালটে দিতে পারলে আমাকে আর পায় কে?  কিছুক্ষণ পর সিস্টেম থেকে লোক এল। এটা দেখল, সেটা দেখল, কন্ট্রোল রুমে ফোন করল। খানিক পরে সিকিউরিটি এসে জানাল সিস্টেম নিচ্ছে না, তাই ভেতরে যাওয়া যাবে না। আমি বললাম, ‘বা রে! টেকনিকাল ফল্ট, তার জন্য আমি কেন সাফার করব? আমার আজ ভাইটাল ডিল আছে।’ সিকিউরিটি তোম্বা মুখে বলল, ‘অর্ডার নেই স্যার।’         

    আমি সাক্সেনাকে ফোন করলাম। আমার ইমিডিয়েট বস। ফোন করে বললাম, ‘সাক্সেনা, ভ্যানচোৎ, ফাঁস গয়া রে ইয়ার।’ আমাদের কোম্পানিতে ইনফর্মাল সম্পর্কের ওপর খুব জোর দেওয়া হয়। মাঝে তাইওয়ান থেকে লোক এসে ওয়ার্কশপ করিয়ে গিয়েছে। সাক্সেনা বলল, ‘তু ফিকর মত কর চুতিয়ে, ম্যায় দেখতা হু।’ নিশ্চিন্ত হয়ে একটু দূরে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। আজকের ডিলটা করে ফেলতে পারলে টার্গেট নিয়ে আর ভাবনা থাকবে না। একটু দূরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ছেলেমেয়ে, বাপ-মায়ের লালু সন্তান। এরা এই রকম বিভিন্ন কোম্পানি কী কী ভাবে শোষণ করছে তাই নিয়ে পথনাটক, পোস্টারনাটক এই সব করে। সিদ্ধার্থ বলে একজন এখানে আমার সঙ্গে কাজ করত। মজার কথা বলত ছেলেটা। বলত, এদের মাথায় লেনিন, হৃদয়ে লালন, পরনে লিনেন, পাতে নলেন, কণ্ঠে লেনন! এদের মডেল মালালা ইউসুফজাই, আর রিফারে মালালা ক্রিম। এদের গণস্বপ্ন হল, পাহাড়ি কোনও গ্রামে স্কোয়াশের খেতি করে জীবন কাটানো, কলকাতায় নেহাত দয়া করে থাকছে।

    সিদ্ধার্থ হঠাৎ একদিন অফিস আসা বন্ধ করে দিল। কোথায় গেল কে জানে। আমিও আর যোগাযোগ করিনি। এই গ্রুপটা হঠাৎ দেখছি কেমন বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যদিন দেখলে গোগো বলে আওয়াজ দেয়— গোছানো গোপাল। আজ আমাকে দেখে মাঝের আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। আমি গরমে ঘামছি দেখে মজা পেয়েছে। সাক্সেনাকে আবার ফোন করলাম। ফোন লাগল না। অনলাইন মিটিং ছিল দুবাই-এর ক্লায়েন্টের সঙ্গে। অলরেডি পনেরো মিনিট লেট। আমি দেখলাম এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। সাক্সেনা হয়তো ফোন ফ্লাইট-মোডে রেখে মিটিং করছে। সবার চাপ থাকে বস। ফালতু এখানে বসে ওদের খোরাক না হয়ে বিল্ডিং-এর পিছনে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে বসি। একটা মেল করে দেব বসকে টেকনিকাল ফল্ট জানিয়ে। একটু চা খাওয়াও দরকার।         

    চায়ের দোকানের লোকটা চালাক-চালাক দেখতে। বলল, ‘টেরাপলিসের বাবু এয়েচে। ভিতরে বসা। এসি আছে।’ এই চায়ের দোকানের ভিতরে এসি বসার ঘর আছে ভাবিনি। যাক গে, ভেতরে ঢুকতেই আধো অন্ধকারে কালো চশমা পড়া একটা লোক কাছে এসে বলল, ‘হ্যাক চাই তো? মেন গেট দিয়ে ঢুকতে পারছেন না?’ আমি চমকে গেলাম! এই লোকটা কী করে জানল? লোকটা তার ফোনে একটা স্ক্যান-কোড খুলে বলল, ‘পঁচিশ ভরে দিন। কোনও চিন্তা নেই।’ পঁচিশ আমার কাছে কোনও ব্যাপার না। কিন্তু অচেনা-অজানা লোকটা আমাকে মুরগি বানালে সেটা খুব এম্ব্যারাসিং হবে। দিলাম। বলল, ‘ছোট গেটটা দেখেছেন?’ আবছায়াতে কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটা হাতে ধরে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখলাম লম্বা টানেল, নীল নীল টিউব জ্বলছে। বলল, ‘সোজা গিয়ে শেষে বাঁ-দিকের চেম্বার। প্রডিজি, উইথ ডিউ রেসপেক্ট।’ দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

    এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কী? গিয়ে বাঁ-দিকের দরজা ঠেলে দেখি সিংহাসনে একটা বছর এগারোর ছেলে বসে। দেখেই মনে হল ফেক। বলল, ‘মায়ের হলুদ-মাখা শাড়ির আঁচলের টুকরো নিয়ে আসতে পারবি? জিরে-মৌরির গন্ধ মাখা? মায়ের কপালের ঘামতেল-মোছা? তাহলে তোর আর চিন্তা থাকবে না।’ আমার মা চার বছর বয়সে আমাকে ফেলে মুক্তির খোঁজে চলে গিয়েছিল। এখন টিটাগড়ের কাছে কোনও একটা কমিউনের নেত্রী। একটা বাতিল চটকলের প্রকাণ্ড এরিয়া নিয়ে কমিউন। সভ্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই বছর বারো হবে। কিন্তু আমার জেদ চেপে গিয়েছে। এর শেষ দেখেই ছাড়ব। অ্যাপ-ক্যাব করব ভাবছি, প্রডিজি বলল, ‘ওটিপি তোর ফোনে চলে গিয়েছে।’ আমি বেরিয়ে ক্যাব-এ চড়লাম।  

    হাজার হোক একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দল। তাদের নিজস্ব প্রোটোকল থাকবে। হলামই বা আমি তাদের লিডারের ছেলে! এদের কাছে আমি বহিরাগত। মাথায় কালো গলা পর্যন্ত ঢাকা টুপি পরিয়ে আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। যেন একজিকিউশনে নিয়ে যাচ্ছে।

    বন্ধ চটকলে পৌঁছে দেখি সেখানে প্রবেশ নিষেধ। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কাঠের ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে আমি আমার মায়ের নাম বললাম, লতিকা লাহিড়ী। ওদের হিংস্র চেহারার গেটকিপার জানাল পূর্বাশ্রমের নামে এখানে কেউ কাউকে চিনবে না। নিজেদের মধ্যে কী সব গজগজ করল। তারপর ঘুলঘুলি টেনে বন্ধ করে চলে গেল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। বুনো গন্ধ আর ছায়া ঘেরা জঙ্গল। থেকে থেকে তক্ষক ডেকে উঠছে। জনমেজয় সর্পযজ্ঞ করেও নিস্তার পায়নি। তক্ষক এসে মাথায় দংশন করেছিল। ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিলাম। মাটির দাওয়ায়, শীতলপাটিতে। না কি এ রকম কোনও দিনই কিছু ঘটেনি! অন্য কারও গল্প আমার মাথায় চেপে বসেছে। আবার ঘুলঘুলি খুলতে, বিপদে পড়লে বাঙালি কত ফিলজফি করতে পারে টের পেলাম। নিজের ওপর হাসি পেল। হাজার হোক একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দল। তাদের নিজস্ব প্রোটোকল থাকবে। হলামই বা আমি তাদের লিডারের ছেলে! এদের কাছে আমি বহিরাগত।

    মাথায় কালো গলা পর্যন্ত ঢাকা টুপি পরিয়ে আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। যেন একজিকিউশনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পেটের ভিতর সিরসির করছে। মা বলে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। অনেকটা হেঁটে একটা জায়গায় এসে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। হাতে-পায়ে বিছুটি লেগে চুলকাচ্ছে। জলজ গন্ধ নাকে এল। হঠাৎ মায়ের গলা শুনি, ‘টুপি খোল বাবা। ভয় নেই।’ মায়ের গলাটা কেমন বিড়িখোরদের মতো হয়ে গিয়েছে। শ্লেষ্মা জড়ানো। আমি ইতস্তত করছি দেখে মা আবার বলল, ‘ভয় নেই। চোখ খোল।’ টুপি খুলে দেখি মা বিনাসুতো অবস্থায় একটা নৌকোয় বসে। বলল, ‘কী চাস?’ মাথা নিচু করে বললাম, ‘তোমার কপালের ঘাম-মোছা, বাটনা-বাটা, হলুদ-মোছা, জিরে-মৌরির গন্ধ মাখা আঁচল। তাহলে আমার প্রবলেম মিটবে।’ মা বলল, ‘দেখ, এটা একটা ন্যুডিস্ট কলোনি। আমি এখন ক্যানুডিং করছি। আঁচল কোথায় পাব বল?’ আমার হাত-পা এবার পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তুলি, টুবলুর কী হবে আমার চাকরি চলে গেলে। ভিশালকুঞ্জ হাউজিং-এর প্রিমিয়াম, ছাদ খোলা গাড়ির প্রিমিয়াম, ইউরোপ ট্যুর…। আমার গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল, ওই ঘাসের জঙ্গলে। মা নরম সুরে বলল, ‘তোর কিসের এত যন্ত্রণা? আয়, আমার গর্ভে চলে আয়। নিশ্চিন্তে থাকবি। কোনও প্রবলেম থাকবে না।’

    গলার কাছে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে আসছিল। মা জন্মদ্বার খুলে ডাকছে। আমি ভিতরে সেঁধিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, এ বাবা, একটা ন্যাড়া ছাদ, ছ-সাত তলা তো হবেই। কতগুলো ফড়ে চেহারার লোক বিড়ি টানছে। একপাশে এঁটোকাঁটা ডাঁটার ছিবড়ে পড়ে। একটা কানা ঘেয়ো বেড়াল শুঁকছে ওগুলো। লোকগুলোর মধ্যে লিডার টাইপের একজন বলল, ‘ওই তো স্যার এসে গেছেন। আমি সাজ্জাদ।’ আমি বললাম, ‘টেরাপলিস-এ তোমাদের কখনও দেখিনি তো?’ সাজ্জাদ বলল, ‘যে পাখা কারখানা বন্ধ করে টেরাপলিস তৈরি হয়েছে আমরা তার শ্রমিক। আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। আসুন।’ ডেকে ছাদের কিনারে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এখান থেকে ঝাঁপ দিন।’ আমি বললাম, ‘পাগল নাকি?’ টুবলু,তুলি আছে। সাজ্জাদ বলল, ‘কিচ্ছু ফিকর করবেন না। নিশ্চিন্তে ঝাঁপ দিন। কিছুদিন আগে সিদ্ধার্থবাবু ঝাঁপ দিয়েছেন। এখন বিন্দাস আছেন।’ আমি বললাম, ‘আমি ঝাঁপালে তোমাদের লাভ?’ বলল, ‘মুভমেন্টটা জোরদার হবে।’ আমি বুঝতে পারছি আর পিছিয়ে যাবার রাস্তা নেই। বললাম, ‘সত্যি বলছ, কিছু হবে না?’ সকলে বলে উঠল, ‘কোনও ভয় নেই। আমরা তো ঝাঁপ দিই।’

    আমি টুবলুর মুখ মনে করলাম। তুলির কথা ভাবলাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম ওই ছাদ থেকে। ঝাঁপ দিয়ে দেখি অবাক কাণ্ড— আমি পড়ছি না। ভেসে আছি। বলা ভাল, উড়ছি! আমি উড়তে উড়তে সবার আগে আমার বাড়ির কাছে এলাম। আমার ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের পার্কের কদম গাছে বসে, তুলির নাম ধরে প্রাণপণে ডাকতে থাকলাম। বললাম, ‘তুলি আমি তোমাদের ছাড়া বাঁচব না। টুবলু আর তুমি আমার সব!’ তুলি একবার জানলার কাছে এল। আমি ভাবলাম তুলি আমাকে দেখতে পাবে। তুলি জানলার পর্দা টেনে দিল। হয়তো সাক্সি এসেছে বিকিনি-ওয়াক্সিং করাতে। নাকি জিম-ইন্সট্রাক্টর সাকেত বাড়িতে আসছে আমি না থাকলে? আমি তারস্বরে ডাকতে থাকলাম। ডাকতেই থাকলাম…
    রতন বলল, ‘কোকিলটার মাথায় বীর্য উঠে গেছে।’ গনেশ বলল, ‘হাইবিট কোকিল, চাইনিজ মাল!’

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook