কোলাজ ও শাফিকা
মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই আছি, দেওয়াল-জোড়া মস্ত একটা ফ্রেমের সামনে। ছবিটা অদ্ভুত। রংতুলি দিয়ে আঁকা নয়। কুচিকুচি কাগজ জুড়ে জুড়ে সে এক অপূর্ব বিন্যাস। আমি জানি যে এই মাধ্যমকেই কোলাজ শিল্প বলে। ইশকুলবেলায় আঁকার ক্লাসে আমিও তো একটু আধটু শিখেছিলাম। নানারকম রঙিন ও সাদা কাগজের টুকরো জমিয়ে রাখতাম একটা পুরনো ব্যাগে। সে সব তো কবেই হারিয়ে গেছে। রংতুলি তো দুরস্থান, পেন্সিল দিয়ে যখন-তখন স্কেচ করার যে অভ্যেস ছিল, সেও তো ছেড়ে গেছে আজ কত বছর হল! একটা নেশাই যা বজায় আছে, তা হল নিয়মিত ছবির প্রদর্শনী দেখা এবং তা একেবারে উদ্বোধনের দিনেই। কারণ, কোনও ছবি ভাল লাগলে আরও বার দুয়েক এসে, তা আরও নিখুঁত ভাবে দেখা যায়। তবে এই প্রদর্শনীতে উদ্বোধনের দিন এসেই বুঝেছিলাম যে, কয়েকটা ছবির কাছে প্রায় প্রতিদিনই আমাকে আসতে হবে। আজ শেষ দিন। প্রতিদিন না হলেও, গত একমাস ধরে যে কতবার এসেছি তার হিসেব রাখিনি কোনও; কারণ এখানে আসাটা বাদ পড়লেই বড় বঞ্চিত মনে হয়েছে নিজেকে। তাই না আসার দিনগুলি গুনলে বড়জোর পাঁচ কি ছ’দিন হবে।
এই শিল্পীর নাম শাফিকা। অনেকেই শুনেছে এর কথা। উদ্বোধনের দিন এসে তো নিজেই দেখে গেছি, শাফিকাকে ঘিরে প্রেসের মাতামাতি। গ্যালারিগুলো প্রায় মুখিয়ে থাকে ওর ছবির জন্য। ও কিন্তু বিন্দাস। সেসব সামলায় তার স্বামী। কোনও দিন হয়তো ওকে নিয়েও লিখব আমার নিজস্ব কলামে। আজ ওসবে না গিয়ে শুধু লিখি যে, এই একমাস ধরে কেন আমি প্রায় রোজ এই গ্যালারিতে এসেছি ওর কয়েকটা ছবি ক্রমাগত দেখব বলে। এখন আটকে গেছি একটা মস্ত ক্যানভাসের মোহে। ঝোপ আর জংলি লতাগুল্মে ঘেরা একটা পরিত্যক্ত অঞ্চল। হতে পারে কোনও গভীর জঙ্গলের ভেতর বা সাধারণ বসতি এলাকার আশপাশেই কোনও পোড়ো ডোবা। ফ্রেমটা খুব সরাসরি ধরেছে সে। সামনের ঝোপঝাড় সরিয়ে, কেউ যেন ডোবার জলে ছায়া পড়া শুধু ওই জঙ্গলটাকেই দেখাতে চাইছে। সবুজ জলে ডালপালা সমেত পাতার যে জাফরি, তার রং কালচে সবুজ। তারই ফাঁকে চিকচিক করছে সাদা আর ধূসর রঙের আকাশ; কিন্তু ওই আকাশটাই আবার উজ্জ্বল নীল হয়ে ভেসে আছে, গাছগুলোর মাথা ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে। আকাশের চালচিত্রে যে গাছপালা, সেগুলির রং আলোর মতো সবুজ। কবিতা হলে হয়তো মরকত শব্দটা মানিয়েও যেত। তবে পান্না লিখছি না এজন্য যে, মূল্যবান গয়নাগাটির অনুষঙ্গ অযথা এসে পড়ে মনটাকেই কোনও ভুল ঠিকানায় টেনে নিলেও নিতে পারে। এটা একেবারে জঙ্গুলে সবুজ। আঠা দিয়ে কুচিকুচি কাগজের কী নিপুণ জোড়া! অথচ জোড়ের দাগ নেই কোথাও। আমি তো প্রায় ছবিটার মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে দেখেই চলেছি। এটাও এক বড় সুবিধে যে, কাচের ফ্রেমের আড়ালও নেই। মনে হয় যে, আতস কাচ দিয়ে দেখলেও ধরা যাবে না যে, শাফিকা কী করে এমন জুড়ে গেছে এবং জুড়ে গেছে এবং জুড়েই গেছে। আসলে জুড়ে আছে শাফিকা নিজেই, তার দেহের খণ্ডাংশুগুলো নিয়ে; যেন ওই ডোবার জলেই গা ভাসিয়ে সে নিজেও মিশে আছে এক বেমক্কা সবুজে যা গাঢ়, কিন্তু উচ্চকিত নয়; তাই তা আবার আলোর মতোই উজ্জ্বল। চিত্রীরা কিন্তু সচরাচর ব্যবহার করেন না, এই রং। এই শেডটার একটা নাম আছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
ছবিটার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার আরও একটা কারণ হল, এর কম্পোজিশন আর রিলিফ। ওই বিশেষ সবুজের সঙ্গে রিলিফ এনেছে সে, অসংখ্য সাদা বকের বসে থাকায়। কত মাপের, কত ভঙ্গির বক! কিন্তু সব কটা আলাদা আলাদা। যতদূর মনে পড়ে যে উড়ন্ত বক প্রায় নেই-ই। হঠাৎ মনে হয় যেন সাঁঝবেলার ছবি। আঁধার হওয়ার আগে ঝুঁঝকো আলোয়, শব্দগুলো উড়ে উড়ে এসে শান্ত হয়ে বসেছে, জীবনানন্দের কলম থেকে। একই সঙ্গে আবার আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ভরদুপুর। জীবনের এমন এক উপত্যকা, যেখানে সকাল-সন্ধের ফারাক নেই কোনও। জোরালো আলোতেও উদাসীন স্তব্ধতা। বকগুলো ভীষণ নিশ্চিন্ত এই ভেবে যে, জলের ধারে উড়ে গেলেই মাছ-গেঁড়ি-গুগলি এমন কিছু না কিছু পাবেই। ভাগ বসাবার কেউ নেই আশেপাশে। সে সব পেয়ে এখন তাদের তাই বিশ্রাম-বিলাস।
ছোটবেলায় যখন শহরতলিতে থাকতাম, গঙ্গার পাড়ে প্রচুর বক দেখতাম। পলিমাটির ওপর বড় বড় জংলা ঘাস; তার ফাঁকে-ফাঁকে আটকে থাকত জল পেয়ে ফেঁপে ওঠা কুকুর-বেড়ালদের মরা শরীর। ক্বচিৎ কখনও জলে ফেলে দেওয়া সদ্যজাত মরা বাচ্ছা। শ্মশানের দিকে শকুন উড়লেও স্নানঘাটের কাছাকাছি শুধু বক। তখন গাড়ি চলা পিচ রাস্তার দুপাশের ধান খেতেও সাদা বক। মাঝে মাঝে পুকুর আর বিলের ধারে ধারেও। মেজাজ ভাল থাকলে একটা এয়ারগান নিয়ে বাবা ঘুরে বেড়াতেন। আর, উল্লাসে তাঁর পিছন পিছন দৌড়োত একদল কিশোর; গুলি খাওয়া সেই পাখিগুলো কুড়োতে। মরা বকদের কাঠি কাঠি হলুদ ঠ্যাংগুলোকে একসঙ্গে গোছা করে বেঁধে, তাদের মাথাগুলো নীচের দিকে ঝুলিয়ে, একটা ডানার ওপর অন্য ডানাটা মুড়ে, আমাদের বাড়ি নিয়ে আসত সেই ছেলেগুলো; রাস্তা দিয়ে ঝোলাতে ঝোলাতে। তাদের সাদা ডানার এদিকে-ওদিকে লেগে থাকত টাটকা রক্ত; কারোর বা ঠোঁটে বা গুলি লেগে উড়ে যাওয়া চোখে। একতলার সদর উঠোনে ফেলে, পালক ছাড়িয়ে ইটের ফাঁকে আগুন জ্বালিয়ে সেঁকা হত তাদের। অল্প-অল্প পোড়া ধরা, ধোঁয়া ওঠা সেই ঝলসানো মাংস ভাগ করে খেতে খেতে বাবা গল্প করতেন, কোন কোন পাখির মাংস সবচেয়ে উপাদেয়। বলতেন, বকের মাংস একটু তিতকুটে এবং ছিবড়ে। বাড়ির অন্যেরা সবাই যে খুব পছন্দ করত তা নয়। কিন্তু এই শরিকি-অন্য এবং পাড়া-প্রতিবেশী অন্যদের থেকে তিনি এতটাই আলাদা ছিলেন যে, তাঁকে সবাই ছাড় দিতেই ভালবাসত। সবটাই তাই মেনে নিত খেয়াল বলে।
বাবা মানে যেমন মগ্ন হয়ে ছবি আঁকা, তেমনই গুলি-বন্দুক-শিকার এসবও। এ ব্যাপারটা আপাতত তোলাই থাক, কারণ এ প্রসঙ্গটা পরেও তো ঘুরে-ফিরে আসবেই। এখন যেটা অনুভব করছি, শাফিকার বানানো এই কোলাজের সামনে দাঁড়িয়ে, তা হল এই যে— ওই বকগুলোর গুলির ভয় নেই। আমার দেখা বকগুলোর মতো একেবারেই নয়। আমি তো দেখেইছি যে পালক ছাড়ানোর পর, গুলি-খাওয়া বকগুলোর ক্ষত আরও গভীর হয়ে কেমন ফুটে উঠত; এয়ারগানের ওই মাছির মতো ছোট্ট সিসার গুলিও ছাঁদরা করে দিত— ঘন পালকে ঢাকা পাখিগুলোর এক টুকরো মাংসল দেহ, যা আমার একটা মুঠোর থেকেও ছোট। সাদা পালকের গায়ে ওই লাল রক্তের দাগগুলোই কি এখনও খুঁজে চলেছি! আমার দেখা বক-চরা ধানখেত বা ঘাস গজানো নদীপাড়ের থেকে, এ ছবির চরিত্রটা যেন কত আলাদা! বাবা যখন লাইফ-স্কেচ করাতেন এবং মন দিয়ে দেখতে বলতেন বকেদের পা ফেলার ভঙ্গি, আতঙ্কিত আমি শুনতে পেতাম বাবার এয়ারগানের ধাতব আওয়াজ। চোখে ভাসত রক্তমাখা সাদা পালক আর ঝলসানো মাংসের ধোঁয়া। মৃত্যুর নিষ্ঠুর চেহারাটাই আচ্ছন্ন করে রাখত আমার মন। আমি জানতাম যে, এক নিশানায় কেমন মুহূর্তে মেরে ফেলা যায়— উড়ন্ত পাখির সার বা ঝোপের মধ্যে লাফিয়ে পালানো বাদামি রঙের বুনো খরগোশও; এমনকী ঘুলঘুলির মধ্যে থাকা পায়রাগুলোও। পুকুরপাড়ে মাছ ধরার সময়তেও তাঁর পাশে থাকত এয়ারগানটা; হঠাৎ উড়ে আসা বটের বা তিতির মারার জন্য। খেয়াল করে নিশানা করতেন ডাহুক এবং ঘুঘুও।
শাফিকার আঁকা লতাপাতা ছাওয়া, এই জলাজমি বা ডোবাটার কেমন যেন একটা টান আছে। কোনও গাছেই বুনোফুল ধরায়নি সে। নিশ্চিন্তে ডানা মুড়ে বসে থাকা বকগুলোই যেন ফুলের থেকেও সুন্দর। আকাশি নীল আর সাদার মধ্যে জেগে আছে ঘন সবুজের মরকত-বাহার। বার বার তাই মনে হচ্ছে, জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি যেমন এক অনাস্বাদিত রহস্য জাগায়, শাফিকার এই আঁকাও যেন তাই; রহস্যময়। তার নিজস্ব চরাচরের একফালি গহন যেন বড় নিবিড় হয়ে ধরা দিয়েছে এই আয়ত ফ্রেমে।
এই একটা ছবির সামনেই অনেকক্ষণ ধরেই যে দাঁড়িয়ে আছি, অনেকের সঙ্গে শাফিকাও নিশ্চয় তা লক্ষ করেছে। প্রেসের ভিড় থেকে সরে এসে, অপরিচিত আমার পাশে এসে দাঁড়ায় শাফিকা। তার দিকে তাকিয়ে, আমিও উদাসীন ভাবেই হাসি। প্রত্যুত্তরে, শাফিকাও তার হাসি বিনিময় করে। কেউ কোনও কথা বলি না। আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে, শুধুমাত্র দর্শক হিসেবে তার সঙ্গে কথা বলা যায় কি না! তার সঙ্গে তো কথা বলছে, হয় সংগ্রাহক নয় সাংবাদিক। কেনা-বেচার এক চরম সংগঠন তাকে ঘিরে। শাফিকা হয়তো ভাবছে, গুছিয়ে কথা বলতে সে পারে না বলেই তো, কথা বলাবলি করে তার স্বামী। তার জন্যই তো এখন তার ক্যানভাস শুধু এই গ্যালারিতেই আসে; আর তার সব ছবি এরা-ই কিনে নেয়, থোক টাকায়। আঁকার আগেই বুকিং হয়ে যায়। ছবিটা শেষ হলে, শাফিকা শুধু তার নামটা সই করে ইংরেজিতে; সাল-তারিখ সমেত। ইচ্ছে করলেও সে আর জানতে পারে না, ওই ছবিগুলো কার কাছে গেল বা কেমন লাগল তার কাজ! তেমন লেখাপড়া জানা নেই বলে, কাগজের রিভিউতে শুধু সে তার নিজের আর ছবির যে ফোটো ছাপা হয় সেগুলোই দেখে। ফলে কিছুদিন পর আবার সে মগ্ন হয়ে যায়, নতুন ছবির ক্যানভাসে।
একরাশ অস্বস্তি নিয়েই জানতে চাইলাম, ‘এই যে এত রঙের সবুজ এনেছেন, এগুলোর মধ্যে কোন শেডটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?’
শাফিকা অপতিভ হয়ে বলল, ‘নাম তো জানি না; যেমন দেখি সেটাই মনের মধ্যে গুঁজে যায়। তারপর মিল-মিলন্তি করতে করতে ছবি হয়।’
বললাম, ‘ভারী সুন্দর আপনার এই মিল-মিলন্তির ভাবনা।’
শাফিকা বলল, ‘আমার ঘর থেকে একটু দূরে, ঠিক এরকম একটা জলা আছে— বাদার ধারে, কেউ সেখানে যায় না। একদিন হঠাৎই চোখে পড়ল। একটা উঁচু ধাপিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম। ওই একবারই যা দেখা! থম মেরে গিয়েছিলাম। সন্ধেবেলা ঘরে না দেখে, মিঞা খুঁজতে বেরিয়ে দেখতে পায় আমাকে। ওখানে আর যেতে বারণ করে দিয়েছে।
‘কেন! হারিয়ে গিয়েছিলেন?’
শাফিকা বলল, ‘উপায় নেই। হারিয়ে আর যাব কোথায়? সংসারের টানও তো কম নয়!’
‘আমি কিন্তু এই জলার ধারটায় বসে বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতে পারি!’
শাফিকা বলল, ‘আসুন না একবার— আমাদের গ্রামে। চারিদিকে শুধু সবজে আর সবজে।’
‘সবজে’! খট করে কানে লাগল। আবার মনে পড়ল বাবার গলাটা। হলুদ-সবুজ এমন বলতেন না। বলতেন হলদে, সবজে…। শাফিকাও এমন বলে, সবজে! মনে পড়ল, একটা লম্বা কাগজে তুলির পোচ দিয়ে দিয়ে শেখাতেন নানা রঙের শেড— Poker Green, Khaki Green, Harlequin, Kelly Green… মনে-মনে বিড়বিড় করতে করতেই ঝপ করে ভেসে উঠল বাবার সেই প্রিয় ‘সবজে’, Hooker’s Green নামটা। বলতেন, পুকুরের সবুজ জলের মধ্যে কোলাব্যাং যখন সাঁতার কাটে, ঠিক যে সবুজ রঙটা তার চামড়ায় তখন ভেসে ওঠে, সেই উজ্জ্বল গাঢ় সবুজটাই Hooker। চোখের ওপর ভাসতে লাগল art album-এর পাতা উলটে-উলটে বাবার দেখানো সেই ‘Hooker’-এর ব্যবহার। ভ্যান গখের নামটাই মনে আসছে। সঙ্গে সেই সবজে পাতার বাহার।
বাড়ি ফিরেই নেট সার্চ করতে বসে দেখি, শত শত সবুজ রঙের যে ফর্দ, তাতে নতুন সব নাম; সবই মূলত দেওয়াল বা জামাকাপড়ের রং চেনাতে। নাছোড়বান্দা হয়ে খুঁজতে খুঁজতে, পেয়ে গেলাম Katy Kelleher নামে এক রং, গবেষকের লেখা সেই অনবদ্য আর্টিকেল: Hooker’s Green: The Color of Apple Trees and Envy (The Paris Review: October 3, 2018) যেখানে কেটি লিখছেন,
‘Hooker’s green isn’t pretty. It’s better than pretty; it’s dense and moody, a bit wild, a bit languorous… Hooker’s green feels strange and singular… It’s a haunting color, heartbreakingly familiar and deceptively pleasant. It’s a poison color and a sweet color… complex color, an almost smoky green… Hooker’s Green is beloved by many artists, who swear by the verdant hue for all their leaf-painting needs.’
কেটির ওই লেখা পড়বার আগে পর্যন্ত, আমার বাবার দেখাদেখি আমিও শেওলা ঘেঁষা ওই উজ্জ্বল সবুজের নাম বলতাম Hooker। ওই রঙের নাম আসলে Hooker নয়; Hooker’s Green। আঠারো শতকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া, উইলিয়ম হুকার নামে এই বৃটিশ আঁকিয়ের নাম নিশ্চয় বাবা জানতেন; জানতেন যে ইনিই ওই রঙটির আবিষ্কারক। সম্ভবত এ জন্যই hooker বলেই উল্লেখ করতেন। কিন্তু কেটির লেখা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সিন্থেটিক রং তৈরি হওয়ার অনেক আগেই বোটানিকাল আর্টিস্ট উইলিয়ম হুকার, পাতাঝরা গাছের গুঁড়ির গা থেকে নিঃসৃত আঠার (gamboge) থেকে হলুদ রং তৈরি করে, Prussian Blue-র সঙ্গে তা মিশিয়ে তৈরি করেন, এই অন্যরকম সবুজ। সেজন্যই এই রঙের নামটিও ওই সাহেবের পদবি অনুসারে। পড়তে পড়তে আমার তখন মনে পড়েছিল বাবার দেখানো সেই ম্যাজিক— ‘হলদের সঙ্গে নীল মেশালেই, দেখ তা কেমন সবজে হয়ে যায়!’
আর্টিস্ট উইলিয়ম হুকার অন্যান্য চিত্রীদের মতো ঠিক যে ছবি আঁকতেন এমন নয়। তিনি ছিলেন লন্ডনের Royal Horticultural Society-র একজন বেতনভুক্ত আঁকিয়ে; তাঁর কাজ ছিল ফল, ফুল এবং পাতা, এসবের রিয়ালিস্টিক ছবি এঁকে যাওয়া। প্রকৃতি-প্রেমিক এই সাহেব খুঁজে বেড়াতেন সঠিক রঙের নমুনা; যাতে ফুল, ফল বা পাতাগুলি একেবারে নিখুঁত রঙে ফুটে ওঠে। আর এখানেই আমারও অবাক হওয়ার শুরু। কারণ এসবের কোনও কিছুই না জেনে, শাফিকাও ওই রং-ই ব্যবহার করেছে তার দেখা জলাভূমির সবুজ ফুটিয়ে তুলতে! না জানে সে রঙের ইতিহাস, না সে পেয়েছে কোনও ইশকুল কলেজের পাঠ; নিবিড় ব্যবহারে এনেছে যে ‘সবজে’ রং, তার নামও সে জানে না। অথচ প্রকৃতির সংরাগে একটা জলা-ডোবার চারপাশের সবুজ নিজের মনে ফোটাতে গিয়ে অনায়াসে সে পেয়ে গেছে William Hooker (1779–1832) এর উত্তরাধিকার! আর আমি; একজন চিত্রী বাবার মেয়ে হয়েও বেমালুম ভুলেই গেছিলাম যে এই ‘সবজে’ রঙের নামই সেই Hooker’s Green! আমি শুধু নামটাই জেনেছি; আর শাফিকা ওই রং সরাসরি প্রয়োগ করেছে তার কাজে। মাথার ভেতর তাই কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে— শাফিকা…। জলা-জঙ্গলের শাফিকা; বন-বাদাড়ের শাফিকা।
সবুজ নাকি ঈর্ষার রং! তবে কি আমার ঈর্ষার কারণ হল, শেষে এই শাফিকা!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র