দিদিমণি
১.
হঠাৎই সুগন্ধার ফোন পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। প্রথমে ভাবলাম যে মাস খানেক আগে আমার স্বামীর চলে যাওয়ার খবরটা দেরিতে হলেও, হয়তো তা পেয়েই বোধহয় ফোন করছে। ‘দাদা কেমন আছেন’— জিজ্ঞাসা করাতে বুঝলাম যে সে এসব কিছুই জানে না। কোন এক সূত্রে আমেরিকাবাসী ওর এক পরিচিতের কাছে আমার পরের বোন উমার নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করায়, উমাই ওকে আমার নম্বর দিয়েছে। আজ প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে সুগন্ধার গলা শুনলাম। শেষ যে কবে কথা হয়েছে আজ আর তা চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না। কিন্তু মনটা যেন কেমন ছলছল করে উঠল। সেই সুগন্ধা! আমার প্রথম ছাত্রী; আর এখন আমার বয়স প্রায় ছিয়াশি। আমার মেয়ে ভিডিয়ো কল করে কথা বলাল বলে পরিণত বয়সের ওকে দেখেও বড় আনন্দ হল। এ জীবন ছেড়ে যাবার আগে হঠাৎ করেই যেন দেখা হয়ে গেল, পূর্ব জন্মের রাশি-রাশি গল্পের সঙ্গে। যখন আমি আর সুগন্ধা দু’জনেই জুড়ে যাচ্ছি নির্দিষ্ট একটা অভিযানে।
একটা সাজানো প্লটে, গল্পের মতোই হুড়হুড় করে মনে পড়তে লাগল সেই অভিযানের স্মৃতি। কলকাতা থেকে চলেছি ব্যারাকপুরের কিছুটা আগে একটা অচেনা নামের পাড়ায়, আমার সেই প্রথম পাওয়া চাকরিতে যোগ দিতে। এখানেই এক পরিবার নাকি নিজেদের উদ্যোগে একটি ইস্কুল করেছেন। এ রকম যে হয় তা আমার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। কোনও ইন্টারভিউ ছাড়াই নার্সারি ইস্কুলে সরকারি চাকরি হয়ে গেল। ১৯৬২। আমার বয়স বাইশ। চেহারা বরাবরই লাবণ্যহীন এবং সাজগোজের বালাই নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একজন পরিশ্রমী মেয়ের চেহারা। মাড় দেওয়া খড়খড়ে একটা ছাপা শাড়ি পরে, একবেণী আমি ভেসে পড়লাম চাকরিতে যোগ দিতে। শেয়ালদা ও বেলেঘাটা অঞ্চলের এপারে বা ওপারে সবই আমার অচেনা। আগের রাতে বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘ব্যারাকপুর লোকালে করে চলে যাও, ঠিকানা দেখিয়ে রেলযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেই সঠিক জেনে যাবে।’ রেল স্টেশনের নাম পড়তে পড়তে নেমে পড়লাম সোদপুর— এই নামের এক স্টেশনে।
ঠিকানা তো একটা ছিলই। রেল লাইনের দু’দিকেই বসতি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে রেললাইন পার হয়ে পশ্চিমমুখো, মানে গঙ্গাপাড়ের দিকে যেতে হবে। সাইকেল রিকশা নিয়ে খোঁজ করতেই বোঝা গেল যে ওই নামে কোন ইস্কুলই কেউ চেনে না। তবে সে পাড়ায় একটা বাড়ি সবাই চেনে গৃহস্বামীর নামে— ‘রণেনদার বাড়ি’ এবং যাঁর স্ত্রী ওই অঞ্চলের এক ইস্কুলের বড় দিদিমণি। সেই একটা নাম ভরসা করেই চলতে চলতে এসে থামলাম, তিনতলা একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটা কর্নার প্লটে হওয়ায় উত্তর এবং পশ্চিম— দু’দিকের রাস্তার ওপরেই সেই বাড়ির বাইরের দেওয়াল। দোতলার দেওয়ালে সাইনবোর্ডে ভারী সুন্দর করে বাংলায় লেখা ইস্কুলের নাম— ‘নবজীবন শিক্ষায়তন’। গাঢ় সবুজ রঙের ওপর কালো দিয়ে লেখা এমন সাইনবোর্ড আগে কোথাও দেখিনি। সাইনবোর্ড পড়ে বুঝলাম যে ঠিকানা সঠিক। মনে মনে ভাবলাম— কিন্তু ইস্কুল কই! পশ্চিম দিকে ঘুরেই রিকশাটা দাঁড়াতে বুঝলাম— এই হল সদর দরজা। ক্রিম রঙের দেওয়ালে বাড়িটার যদিও কোনও পরিচিতিই লেখা নেই। দু-পাল্লার কাঠের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ নয়; আলগা ভেজানো। দু’পাশের রোয়াকের মাঝখানে তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে, রিকশা ভাড়া মিটিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে রিকশাওয়ালা বলল, ‘আপনি দাঁড়ান। আমি ডেকে দিচ্ছি।’ নীচের ঘরগুলোর সবক’টা জানলা বন্ধ দেখে বুঝলাম যে ওখানে কেউ থাকে না।
কিছুক্ষণ পর সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে অনুমান হল যে রিকশাওয়ালা নেমে আসছে। নীচে নেমে সে আমাকে বলল, ‘দোতলায় বসার ঘরে চলুন, বাবু আসছেন।’ আমার আগে-আগে উঠে, ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েই সে চলে গেল। লাল সিমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ-হাতি একটা ঘর। সাদা দেওয়াল আর সাদা মার্বেলের মেঝে দেওয়া সেই ঘরে চারটি বড় বড় জানলা; দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়ালে একজোড়া করে কাঠের খড়খড়ি দেওয়া পাল্লায় লম্বা লম্বা শিক। কিন্তু কোনও জানলাতেই পর্দা নেই। দেওয়াল জুড়ে ফ্রেমে বাঁধানো হাতে আঁকা বেশ কিছু ছবি। আসবাব বলতে একটা জলচৌকি আর খান কয়েক বেতের মোড়া। চৌকির চারটে পা এবং কাঠের ফ্রেমটাও আলপনা দিয়ে আঁকা; তোশকের ওপর তাঁতে বোনা যে চাদর, তার ওপরে আবার একটা শীতলপাটি বিছানো। সঙ্কোচে আড়ষ্ট হয়ে মোড়ার ওপর বসতে না বসতেই, দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন এক দীর্ঘদেহী মানুষ। বছর পঞ্চাশের বেশি হবে বলে মনে হয় না। ঘাড়ের কাছ অবধি যত্ন করে কাটা এক মাথা কালো চুল। গায়ের রং তামাটে। বড় বড় চোখের তাকানোটা দেখে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। খুব স্বচ্ছন্দ ভাবে হেঁটে এসে চৌকিতে বসলেন তিনি। নিয়োগপত্রটা ব্যাগ থেকে বার করে তাঁর হাতে দেওয়ার আগেই, আমার দিকে তাকিয়ে খুব আন্তরিক স্বরে জানতে চাইলেন, ‘তুমিই ক্ষমা! বেলেঘাটা থেকে প্রতিদিন এত দূরে যাতায়াত। ধকল সইবে তো!’
বললাম, ‘ইস্কুলটা কোথায়? এখান থেকে কত দূর! কোন দিকে?’
বললেন, ‘আপাতত এই বাড়িরই একতলায়। একটা ঘরে অফিস, অন্য ঘরটায় ক্লাস।’
বললাম, ‘স্টুডেন্ট ক’জন? আরও টিচার আছেন?’
বললেন, ‘স্টুডেন্ট একজন। অন্য যে দুজন টিচার তাঁরাও একে-একে যোগ দেবেন।’
কী করব বুঝতে পারছি না; বুঝতে পারছি না যে ‘মাফ করবেন’ বলে পালিয়ে যাব কি না! এমন সময়ে জানতে চাইলেন, ‘ছবি এঁকে পড়াতে পারো কি? মানে পেনসিল-বই-খাতা সব সরিয়ে রেখে!’
বললাম, ‘গল্প বলে বলে? খেলতে খেলতে!’
বললেন, ‘বাচ্ছা যাতে তার নিজের গল্প নিজে বলতে পারে; নিজের পছন্দে ছবি আঁকতে পারে!’
বললাম, ‘চেষ্টা করব। এ ভাবে তো ভাবিনি কখনও।’
হঠাৎই কথা থামিয়ে বললেন, ‘তাহলে কাল থেকে শুরু করে দাও। আমার স্ত্রীও থাকবেন। উনিই সব বুঝিয়ে দেবেন।’
আমার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের দরজা দিয়ে ওদিকটায় চলে গেলেন। ঘর থেকে আমিও যে বেরিয়ে আসছি, সে দিকে আর তাকালেনই না। অনুমান হল যে ওই দিকে আরও ঘর আছে। মুখোমুখি আর একটা খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা-কালো চক মেলানো ঢাকা বারান্দাটা। আর দেখলাম ডানহাতি তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে আরও একটা খোলা দরজা। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম, কাচের পাল্লা দেওয়া বইঠাসা দুটো পেল্লায় আলমারি ল্যান্ডিংয়ে রাখা দেখে। ভাবলাম এগুলো তো ওই বসবার ঘরটায় অনায়াসে ধরে যেত! এ ভাবনাও মনে এল যে, এ বাড়িতে কি চোর ঢোকার ভয়ও নেই। একতলা থেকে তিনতলা, পুরো বাড়িটাই হাট করে খোলা এবং অসম্ভব নির্জন। বিচিত্র এক অনুভূতিও মনে এল কারণ মানুষটার ওই দাপুটে রাশভারী চেহারার সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গিটা যেন মিল খাচ্ছে না কিছুতেই— এই রকম বড় বাড়ি, নায়কোচিত চেহারা অথচ এত সহজ! মানুষটা কি সত্যিই এত সরল? তসর রঙের সিল্কের লুঙ্গির ওপর সাদা পাঞ্জাবি পরা মানুষটাকেই কি কথা দিয়ে এলাম— কাল থেকেই শুরু করে দেব বলে!
২.
আজ আর রিকশা লাগল না। একেবারেই চলে এলাম। পাড়াটার নাম গাবতলা। স্টেশন থেকে হেঁটে এলেও সময়ের একটু আগেই এসে গেছি। একতলার ঘর দুটোর জানলা এবং দরজা আজ সব খোলা। ঘর লাগোয়া ঢাকা বারান্দা দিয়ে বেরলেই ভেতর উঠোন এবং কুয়োতলা। এই বাড়িটার আরও দুই দিক কুয়োতলার পুব আর দক্ষিণ দিক ঘিরে। তবে বাকি তিন দিকে তিনতলা নেই, খোলা ছাদ। সত্যিকারের লোকজন সমেত উঠোন দেওয়া এত বড় বাড়িতে আমি এই প্রথম ঢুকলাম। ভেতরে এসে দেখলাম একটা বড় টেবিলের অন্য দিকের চেয়ারে বসে আছেন একজন মহিলা। খুব মিষ্টি করে বসতে বললে, সামনের চেয়ারটিতে বসলাম। পরিচয় দিতে বুঝলাম যে, ইনি-ই এ বাড়ির বউ এবং এঁরই উদ্যোগে এই ইস্কুলটি তিনজন শিক্ষিকা-সহ সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। বয়সে আমার থেকে কিছু বড় বলেই মনে হল, তবে বছর পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না।
মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর ব্যবহারে, এবং রূপে তো বটেই। পাখির মতো হালকা শরীর, গায়ের রং ধপধপে। কোনও সাজগোজ নেই। ধোয়া রঙের তাঁতের শাড়িতেও কী জৌলুস! কপালে শুধু ছোট্ট একটা সিঁদুরের ফোঁটা; কান গলা সব খালি, বাঁ হাতে লোহার ‘নোয়া’ আর ডান হাতে সরু সরু দু’গাছা খাঁটি সোনার চুড়ি। তবে মাথার চুলটা মেমসাহেবদের মতো রোল করে, ঘাড়ের কাছে আঁটা। টেবিলে রাখা যে অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারটি তুলে নিয়ে নাম সই করতে এগিয়ে দিলেন, সেটির মলাটটিও হাতে আঁকা। ‘নবজীবন শিক্ষায়তন’-এর লোগোটিও, বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে দেখা সেই শ্যাওলা-সবুজ রঙেরই। মুগ্ধ এবং অবাক দুই-ই হলাম— লোগো এবং রেজিস্টার দুটো দেখেই। ঘরে ঢোকার সময়েই চোখে পড়েছিল, রাস্তা থেকে দেখা বাড়ির বাইরের দেওয়ালে লাগানো সেই সাইনবোর্ডেরই আর একটা এ ঘরের দেওয়ালেও টাঙানো। ওঁকে বউদি না বলে ‘দিদি’ সম্বোধন করলাম। পাশের ঘরে নিয়ে যেতে বুঝলাম যে ওটাই ক্লাসরুম। সদ্য রং করা হয়েছে; তবে সে ঘর একেবারে ফাঁকা। কিছুক্ষণ পর গুড়গুড়ে দুটি মেয়ে এসে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
ওদের মধ্যে বড়জনকে দেখিয়ে ‘দিদি’ বললেন, ‘এই তোমার প্রথম ছাত্রী; আর তুমি ওর দ্বিতীয় দিদিমণি। কারণ এর আগে একজনকে দিয়ে ইস্কুলটা শুরু হলেও, তখন অনুমোদন আসেনি। ওঁকে সকলেই ‘পিসিমা’ বলত। সরকারি অনুমোদনে ওদের পাঠানো টিচারই নিতে হবে বলেই, তোমাকে পাওয়া গেল। পিসিমাও আর কাজ করতে চাইলেন না। ফলে সব কিছু নতুন করেই শুরু করা। আমার মেয়ের মানিয়ে নিতে একটু হয়তো সময় লাগবে।’
ছোট্ট মেয়েটিকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও! আজ থেকে এই দিদিমণির কাছে পড়বে।’
অন্য মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে দিদি তো চলে গেলেন, আর আমি পড়লাম অকূল পাথারে। এত সুনসান হয়ে গেল চারিদিক যে, কুয়োপাড় থেকে স্নানের শব্দ, রাস্তার ফেরিওয়ালার হাঁক— সব যেন এসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে লাগল আমার সেই নতুন চাকরির ক্লাসরুমে। জানলা দিয়ে দেখলাম যে মেয়েটির মা, মানে আমার সদ্য আলাপ হওয়া সেই ‘দিদি’ একটা লেডিস সাইকেল টেনে একতলার রকের সেই তিনটে সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নেমেই, প্যাডেল করতে করতে হুট করে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের কোনে ভাঁজ করে রাখা কতগুলো আসনের থেকে একটা বার করে, পেতে বসে মেয়েটিকে কাছে ডাকতেই সে আমার কোলে এসে বসল।
আদর করে জানতে চাইলাম, ‘নাম কী তোমার?’
মাথা নিচু করে সে বলল যে তার ভাল নাম সুগন্ধা, কিন্তু তাকে সবাই ডাকে ঝিনি বলে।
বললাম, ‘বোনের নাম?’
বলল, ‘বিনি। বাবার-মায়ের নাম ‘দিদা’।’
বললাম, ‘কী পড়তে ভাল লাগে?’
বলল, ‘বই পড়তে ভাল লাগে না। ছবি আঁকি, রং করতে ভাল লাগে।’
বুঝলাম যে এ বাড়িতে তারা এই পাঁচজনেই থাকে। সে না হয় হল, কিন্তু পড়াবটা কী? হঠাৎই ওই একতলা ঘরের জানলার কাছে আওয়াজ পেয়ে দেখি ‘দাদা’; মানে কালকেই আলাপ হওয়া সেই মানুষটি, উঁচু একটা সাইকেল থেকে নামছেন। কোল থেকে উঠে ‘বাবা’ বলে লাফিয়ে, এক দৌড়ে ঝিনি সেদিকটায় ছুটে গেলে, খেয়াল করলাম দুটো জানলার মধ্যে একই রকম দেখতে ওটা আসলে একটা দরজা। সেটা ঠেলেই ঘরে ঢুকে এলেন দাদা। আমিও সম্ভ্রমে উঠে দাড়ালাম।
সপ্রতিভ ভাবেই বললেন, ‘ব্ল্যাকবোর্ড, নিচু-ডেস্ক, টুল সব অর্ডার হয়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যেই এসে যাবে…’
বললাম, ‘কিন্তু আজ কী ভাবে ক্লাস নেব?’
হো হো করে হেসে উঠে মেয়েকে বললেন, ‘ঝিনি, স্টুডিয়ো ঘরে গিয়ে রঙিন চকের বাক্সটা নিয়ে এসো তো। ইজেলের দিকে জানলার ওপর আছে, জোরে দৌড়োবে না কিন্তু!’
নানা রঙের এক বাক্স চক নিয়ে ঝিনি এসে দাঁড়াতেই, তার থেকে নীল আর সবুজ এই দু’রঙের চক বার করলেন দাদা; নিচু হয়ে বসে নীল চকটা দিয়ে মেঝে জুড়ে, বেশ বড়সড় একটা মাছ আঁকলেন।
আঁকা শেষ করে বললেন, ‘নাও, মাছের আঁশগুলো আর চোখটা এই সবুজ চক ঘষে ভরিয়ে দাও।’
আমি ইতস্তত করলেও ঝিনি কিন্তু শান্ত হয়ে রং ভরতে লাগল। তাকে দেখে আমিও হাত লাগালাম; আমার কাছে এ একেবারে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এমন একখানা ফাঁকা ঘরও তো এই প্রথম দেখলাম, যেখানে লুটিয়ে বসে ছবি আঁকা যায়!
নিজের হাতের একটা চেটোর ওপর আর একটা চেটো ঘষে চক ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘এত বড় মেঝে থাকতে ব্ল্যাকবোর্ড লাগে!’
সম্মতির হাসি হাসতেই বললেন, ‘বুঝলে তো ক্ষমা, আসল বইপত্র হল মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা ওই আঁকিবুঁকিগুলোই; একটু সুযোগ দিলেই ওগুলোই বেরিয়ে এসে ছবি হয়ে যায়।’
বললাম, ‘কিন্তু এভাবে কি অক্ষর পরিচয় হবে?’
আবার নিচু হয়ে বসে ওই ছবিটার পাশে বাংলায় লিখলেন— মাছ; আর ইংরেজিতে— fish।
লেখা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অক্ষর আবিষ্কারের অনেক-অনেক আগে, মানুষ তো ছবিই এঁকেছে— গুহাচিত্র।’
দাদা আর দাঁড়ালেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে সাইকেলটা টেনে মূল দরজার দিকে হেঁটে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলেন। মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘চাবিটা রইল; পড়ানো হয়ে গেলে ঘরটা বন্ধ করে ঝিনির হাতে দিয়ে চলে যেও।’
আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে, ঝিনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পড়া হয়ে গেলেই ওপরে চলে যেও; চকের বাক্সটা এ ঘরেই থাক।’
আমি আবার অবাক হলাম; ক্লাস শেষ হওয়া এবং দরজা বন্ধ করার অভিনব ব্যবস্থা দেখে।
৩.
এত বছর পর ফোন করে ঝিনি মানে সুগন্ধা কত কিছুই না জানতে চাইছিল।
জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ইন্টারভিউ কে নিয়েছিল ক্ষমাদি?’
হাসতে হাসতে বললাম, ‘কেউ না। সরকারি নিয়োগপত্র নিয়ে সোজা চলে এলাম।’
জানতে চাইল, ‘অত দূরে, ওই রকম একটা প্রাইভেট বাড়িকে ইস্কুল বলে ধরে নিতে ইন্সপেকশন কী ভাবে হল!’
বললাম, ‘ওসব কিছুই হয়নি। দিদির যোগাযোগের সূত্রে কিছুই লাগেনি।’
আবার বলল, ‘মাইনে আসত কী ভাবে?’
বললাম, ‘দিদির নামে যে মানি-অর্ডার আসত, সেখান থেকেই দিদি আমাদের দিয়ে দিতেন। স্কেল তো আমি জানতামই। অসুবিধে হত না।’
ঝিনি ফোন রেখে দেবার পরেও, অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। আমার কোলে বসে অক্ষর চিনতে শেখা সেই ছোট্ট ঝিনিও আজ কত বড় হয়ে গেল! ডুব দিলাম স্মৃতির পাতায়। মনে আছে প্রথমদিন বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বললেও, পরদিন কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছিল আমার নতুন চাকরির অভিজ্ঞতা বলে শেষ করতে। গাবতলা নামে মফস্বলের এক পাড়ায়, অমন একটা বাড়ি, গোনাগুনতি মানুষ, কোনও কাজের লোক নেই, এবং সমস্ত ক’টা দরজাই হাট করে খোলা। অবাক লেগেছিল নতুন শোনা সব শব্দ এবং ভাবনাও— যেমন স্টুডিয়ো, ইজেল এবং ছবি-এঁকে অক্ষর পরিচয়। বুঝেছিলাম একেবারেই ভিন্ন ধরনের দুটি মানুষ এই ‘দাদা’ এবং ‘দিদি’; কিন্তু দুজনেই আসলে স্বপ্নবিলাসী, আপাতত তাঁরা মেতেছেন এই ইস্কুলটা নিয়ে।
~ আমি ক্ষমা। রিফিউজি পরিবারের মেয়ে, দেশ ভাগের সময় কলকাতায় আসি। বাবা ওকালতি করতেন ঢাকায়। আট ভাইবোনের মধ্যে আমাদের বড়দিদি তার ছোটবেলাতেই মারা যাওয়ার পর আমিই হয়ে যাই সকলের বড়। অভাব আর উদ্বেগে মায়ের পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজের পড়াশোনাটা বড় বেশি মার খায়। কোনও রকমে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিয়ে, নাইট কলেজে পড়ে এবং মন্তেসরি ট্রেনিংয়ের একটা সার্টিফিকেট পেয়েই যা হোক কিছু কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। ততদিনে ভাড়াটে অবস্থা থেকে বেরিয়ে, বাবা একটা ঘর কেনেন। সরকারি অনুদানে পটারি রোডের কাছে টালির চাল দেওয়া। সে ঘরেই গাঁতাগাঁতি করে আমরাই জনা দশেক মানুষ এবং দেখ না দেখ, থেকে থেকেই আরও আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়া। এই চাকরিটা আমার যে কী দরকার ছিল তা শুধু আমিই জানি। আর মজার কথাও এই যে, ওই অদ্ভুত বাড়িটায় ঢুকে যে-আমি ভেবেছিলাম যে, কোনও দিন আর ওইমুখো হব না, সেই আমি-ই কিনা ওখানেই কাটিয়ে দিলাম টানা চল্লিশ বছর। ওখান থেকে অবসর নিয়ে আজও যে পেনশন পাই, সেখানেও লেখা আছে সেদিনের সেই ‘নবজীবন শিক্ষায়তন’। ফলে এই ‘দাদা’ এবং ‘দিদি’-র সংসারের অনেক কিছুতেই ক্রমে জড়িয়ে যেতে থাকি আমি। খুব কাছ থেকে দেখতে থাকি একটা ইস্কুলের গড়ে ওঠা এবং একজন চিত্রীর জীবন ও ভাঙন।
ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল যে, বাড়ির ঠিকানার ওপর রণেনদা তাঁর নামের পরে পদবি লিখেও, তার পাশে কমা দিয়ে লিখতেন ‘চিত্রকর’। এই মানুষগুলি, সেই বাড়ি, ওই পাড়ার নাম সব কিছু লোপাট হয়ে গেলেও, আমার আর ঝিনির মনে সবটুকুই যেন ধরা আছে গভীর এক দীঘির মতো। যেখানে ডুবে-ডুবে আমরা দুজনেই খুঁজে চলেছি আসবাবহীন একটা লাল মেঝেতে, নীল খড়ি দিয়ে আঁকা সেই মাছটাকেই, যার আঁশগুলো শ্যাওলা-সবুজ! অনেক পরে, ‘দাদা’-র কথাতেই জেনেছিলাম যে, অচেনা ওই শ্যাওলা-সবুজ রংটার নাম— Hooker’s Green।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র