প্লেবয়
সেই বছরেই প্রকাশ্যে এল ডিএনএ-র যুগ্ম সর্পিলাকার ওয়াটসন-ক্রিক মডেল। রাজ্যাভিষেক হল ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটারি হলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। টেলিভিশনে প্রথম বারের জন্য প্রদর্শিত হল অস্কারের অনুষ্ঠান। ১৯৫৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের মধ্যে ঘুরতে থাকা পৃথিবী এই বছরটির শেষ লগ্নে এসে খানিক থমকে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ করল আক্ষরিক অর্থেই এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হল ‘প্লেবয়’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা।
একেবারে শুরুতে যে গোটা পৃথিবী ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরেছিল, তা নয়। শিকাগো শহরের এক তরুণ, সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে নিয়ে যে-কাণ্ডটা ঘটালেন, তার প্রাথমিক প্রভাব পড়েছিল আমেরিকা ও মূলত পশ্চিমি দুনিয়ায়। কিন্তু নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের অদম্য আকর্ষণ, আদিম রিপুর অন্তহীন হাতছানি ক্রমে তা ছড়িয়ে দিল আরও দূরে। স্বপ্নময় এক কল্পরাজ্যের নাম হয়ে উঠল ‘প্লেবয়’। আর তার স্রষ্টা হিউ হেফনার (১৯২৬-২০১৭) ঝড়ের গতিতে উঠে এলেন খ্যাতির শীর্ষে। সমাজের যৌনতা-সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের আগল খুলে প্রথাগত সব মূল্যবোধকে ফেলে দিলেন প্রশ্নের মুখে। শুধু স্পর্শযোগ্য বাহ্যিক জগৎ নয়, অবাধ যৌনতার সেই ঢেউ আছড়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী লক্ষ-লক্ষ পুরুষের কামনার বিমূর্ত অন্তর্জগতে। তোলপাড় করে দিতে থাকল তাদের মন, শরীর।
মানুষী চাহিদার বার্তাবাহকটিকেও হেফনার বাছলেন অসামান্য দক্ষতায়। কিন্তু সে মানুষ নয়, ছটফটে একটি খরগোশ! ‘প্লেবয় বানি’। পত্রিকাটির চিহ্নায়ক। শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে খরগোশের অবয়বটি ব্যবহৃত হয়েছে পত্রিকার পাতায়। মহিলাদের সাজপোশাকে তো বটেই, আনুষঙ্গিক নানা কিছুতেও উঠে এসেছে দুষ্টু-মিষ্টি প্রাণীটি। টেলপিস হিসাবেও এর ব্যবহার শুরু ‘প্লেবয়’-এর প্রথম সংখ্যা থেকেই। চার নম্বর পৃষ্ঠার শেষে ছোট্ট একটি মোটিফের মতো এটি বসানো হয়। সেই প্রথম ব্যবহার। কালক্রমে এটিই হয়ে ওঠে লোগো। এই খরগোশের দৌড় আজও অব্যাহত। ‘প্লেবয়’ পত্রিকার শুরুতে আর্ট ডিরেক্টরের ভূমিকায় ছিলেন দক্ষ শিল্পী আর্থার পল (১৯২৫-২০১৮), লোগোটি তাঁর হাতেই তৈরি। বিপণনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম সফল লোগো। মার্কিন মুলুকে খরগোশ প্রাণীটি যৌনতার ইঙ্গিতবাহী হলেও দৃশ্যত লোগোটিতে সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। সিলুয়েটে ধরা মুখাবয়ব, খাড়া দু-টি কান, গলায় বো। সহজ, কিন্তু অব্যর্থ। চোখে পড়লেই মনে-মনে গল্প বোনা শুরু!
‘…like Coca-Cola or Mickey Mouse, the magazine’s ubiquitous bunny logo became an international symbol of American life’— যথার্থ বলেছেন ইতিহাসের অধ্যাপক ও লেখক স্টিভেন ওয়াটস, তাঁর ‘Mr. Playboy: Hugh Hefner and the American Dream’ বইয়ে। গত শতকের পাঁচের দশকে সচ্ছল মার্কিন জনজীবনে বস্তুত উপভোগের নতুনতর দিশা যোগ করেছিলেন হেফনার। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা না করে, কোনোরকম ঢাকঢাক-গুড়গুড় না রেখে মার্কিন পুরুষদের জন্য একটি বিনোদনধর্মী বুদ্ধিদীপ্ত পত্রিকা চালু করাই হয়তো তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু এর সামগ্রিক অভিঘাত হয়ে উঠেছিল আরও বিস্তৃত ও গভীর। ১৯৫৩-র ডিসেম্বরে, প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় অংশে একেবারে স্পষ্ট ভাষায় খোলসা করে বলা হয় যে, ‘প্লেবয়’ পত্রিকা শুধুই আঠারো থেকে আশি বছরের পুরুষদের জন্য। শুনতে আপত্তিকর লাগলেও, দ্বিধাহীন স্বরে ঘোষণা করা হয়—
‘We want to make clear from the very start, we aren’t a “family magazine.” If you’re somebody’s sister, wife or mother-in-law and picked us up by mistake, please pass us along to the man in your life and get back to your Ladies Home Companion.’
প্রথম সংখ্যা থেকে প্রচ্ছদে বড়ো হাতের হরফে লেখাও থাকত, ‘ENTERTAINMENT FOR MEN’। শুধু টার্গেট অডিয়েন্স নির্দিষ্ট করে দেওয়াই নয়, বিষয়গত ক্ষেত্রেও সুরটি বাঁধা হয়েছিল অনন্য ভঙ্গিতে—
‘We like our apartment. We enjoy mixing up cocktails and an hors d’oeuvre or two, putting a little mood music on the phonograph, and inviting in a female acquaintance for a quiet discussion on Picasso, Nietzsche, jazz, sex. ’
যদিও, ধারদেনা করে শুরু করার পরও হেফনার পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না এই মাসিক পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রথম সংখ্যায় সন-তারিখ কিছু উল্লেখ করা হয়নি। দাম ছিল ৫০ সেন্ট। প্রচ্ছদে মেরিলিন মনরো। ভিতরে, সেন্টারফোল্ড হিসাবে তাঁরই সম্পূর্ণ নগ্ন রঙিন চিত্র। আগামী দিনের ছবিটা আঁচ করতে ‘প্লেবয়’ কর্তৃপক্ষের আর খুব বেশি সময় লাগেনি।
পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য যেহেতু পুরুষ পাঠক, স্বাভাবিক কারণে ‘প্লেবয়’-এর প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল মহিলা মডেলদের আবেদনময় চিত্রাদি। প্রতি সংখ্যার সেন্টারফোল্ডে রতিক্রীড়াসঙ্গী বা ‘প্লেবয় প্লেমেট’-এর পাতাজোড়া ছবি তো থাকতই, বাকি অংশেও এর কমতি ছিল না। সময়ের সঙ্গে এসবের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে, প্রচ্ছদে ও ভিতরে ব্যবহৃত ফোটোগ্রাফের প্রকৃতি হয়ে পড়ে আরও খোলামেলা— প্রযুক্তির কল্যাণে আরও ঝকঝকে। সবাই যে মুখ বুজে গোটাটা মেনে নিয়েছিলেন এমন নয়; শুরু থেকেই তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় হেফনারকে। ‘পিউরিট্যানিক’ নীতিবোধের ধ্বজাধারীরা তো ছিলেনই, সংগত প্রতিবাদে মুখর হন পশ্চিমি নারীবাদীরাও। ‘প্লেবয়’ ভোগ্যপণ্য হিসাবে নারীকে দেখায়, এই অভিযোগ তীব্রতর হয়ে ওঠে। মহিলাদের নগ্ন ছবি প্রকাশ কিংবা বিবাহ, পরিবার বা ধর্মের মতো বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ করার প্রবণতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাংবাদিক, রাজনীতিক থেকে আমজনতা— পত্রপত্রিকায় লেখা চিঠিতে হেফনারের কর্মকাণ্ডকে ‘পাশবিক’ বলে চিহ্নিত করতেও তাঁদের বাধে না। স্টিভেন ওয়াটস-এর মতে, ‘they viewed him as a dark prophet of American debauchery and decline’। আবার এর উলটো দিকে, ভোগবাদের প্রতি ‘প্লেবয়’-এর সমর্থন, যৌনতার প্রশ্নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শরীর ও মনের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাদি প্রতিযুক্তিও দেখা যেতে থাকে। সে-সময়ে হিউ হেফনারকে কেউ ‘পিম্প’ বলে বিদ্ধ করেন, কেউ-বা তুলে ধরেন ‘রেবেল’ হিসাবে। আর এই টানা-পোড়েনের জেরে আরও চড়তে থাকে হেফনারের খ্যাতির পারদ। বাড়তে থাকে পত্রিকার কাটতি। বৃদ্ধি পেতে থাকে মুনাফা।
পত্রিকার পাশাপাশি ‘প্লেবয়’ ব্র্যান্ডটির ইমেজকে নানাভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন হেফনার। আজও যেমন ওই খরগোশের মুখাবয়বটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বিবিধ পণ্যে ব্যবহৃত চেনা প্রতীক। এ-ধরনের প্রয়াসের সুবিধা হল, একটি পণ্য অপরটির বিপণনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা করে। পত্রিকা প্রকাশের সাত বছরের মধ্যে সেই পথে হাঁটতে শুরু করেন হেফনার। ১৯৬০ সালে শিকাগোতে চালু করেন ‘প্লেবয় ক্লাব’। লস এঞ্জেলস, আটলান্টা, বোস্টন ইত্যাদি শহরেও একে-একে চালু হতে থাকে একই ধরনের নাইট ক্লাব ও রিসর্ট। এসব জায়গায় পরিচারিকা হিসাবে থাকতেন ‘প্লেবয় বানি’-রা। কখনো তাঁদের ফোটো পত্রিকায় ছাপাও হত। ‘প্লেবয় ক্লাব’-এর প্রভাব এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যে, আমাদের মতো তুলনামূলক রক্ষণশীল দেশেও সে-সময়ে ফলাও করে ছাপা হয়েছে তার বিবরণ। ১৯৬৭ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় সুধানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘বিশ্ব বেষ্টন’ ধারাবাহিকের ষষ্ঠ কিস্তিতে এ-প্রসঙ্গে যা লিখছেন, তা থেকেই ক্লাবের আবহ ও তৎকালীন মার্কিন মুলুকের ছবি বেশ বুঝতে পারা যায়—
‘এখানে স্তনোচ্ছলতা ও নগ্নতার মাত্রা অত্যধিক। আরও বেশী বাড়াবাড়ি চলেছে Toplessরা মোকদ্দমায় জিতে। Topless হয়ে বেরুনো আইন সিদ্ধ কিনা। এই মোকদ্দমায় কারুর ব্যক্তিগত জীবনে তার রুচিমত চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত করা তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কি না? এই সব বিষয়ে আদালত রায় দিয়েছেন যারা যেমন খুশী তারা তেমন চলতে পারেন। ব্যক্তিস্বাধীনতায় ‘প্রদেশের আইন’ হাত দিতে পারেনা। এরকম নাইট ক্লাবে রায়ের প্রয়োজনীয় অংশের নকল ও অনাবৃত অঙ্গ শোভা প্রকাশ করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গবাক্ষে টাঙ্গানো রয়েছে।…
…সভ্য বা সভ্যদের বন্ধুবান্ধব ছাড়া ওখানে প্রবেশ নিষেধ। ক্লাবের দরজার চাবি প্রত্যেক সভ্যের কাছে থাকে। ক্লাবের বার্ষিক চাঁদা একশো ডলার। এরা PLAY BOY নামে রঙিন সচিত্র মাসিক পত্রিকা বের করে। বহুলোক কেনে শুনেছি।
… প্রায় মুক্তস্তনী বিবসনা সুন্দরী সেবিকা এসে ডনের নাম লিখে নিল। ঐ নাম আজ ক্লাবের বোর্ডে উঠবে কোন্ কোন্ সভ্য আজ হাজির আছেন জানাতে। এখানের সেবিকারা সত্যি কিশোরী, যুবতী ও সুন্দরী। অনেকেই অতি ভদ্রঘরের।…এদের বিশেষ খরগোসের মত সাজ। মাথায় তাদের খরগোসের মত কান বাঁধা ও পাছায় পাউডারের পাফের মত সাদা থোবনা। বুকের খানিকটা আবৃত ক’রে রংমেলানো কাঁচুলি। ঘাড়ের উপরে এসে মিষ্টি গলায় কী পানীয় দিতে হ’বে তারই অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে।’
ছয়ের দশকের শেষ ও সাতের দশকের শুরুতে ‘প্লেবয়’-এর বিক্রি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছোয়। ১৯৭১-’৭২ সালের পর থেকে ফের কিছুটা পড়তে থাকে গ্রাফ। যদিও বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এর পরেও ‘প্লেবয়’-এ জায়গা পান। শুধু মডেল বা অভিনেত্রী নন, খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী, ক্রীড়াবিদ অনেকেই আছেন সেই তালিকায়। যেমন, ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি চাঞ্চল্য ফেলে দেয় ম্যাডোনা-র ফোটোসিরিজ থাকার কারণে। অর্থের প্রয়োজনে কয়েক বছর আগে এই নগ্ন ছবিগুলি তুলতে সম্মত হয়েছিলেন ম্যাডোনা। সেগুলিই সাড়ম্বরে প্রকাশ্যে আসে ওই সংখ্যায়।
একইভাবে বলা যায় মাইকেল জ্যাকসনের দিদি লা টয়য়া জ্যাকসন-এর কথা। ‘প্লেবয়’ পত্রিকার দু-টি সংখ্যায় প্রধান আকর্ষণ ছিলেন এই শিল্পী। ১৯৮৯ মার্চ এবং ১৯৯১ নভেম্বর। এরকম অনেকেই একাধিক বার অবতীর্ণ হয়েছেন ‘প্লেবয়’-এর পিচ্ছিল পাতায়। সবচেয়ে বেশি অভিনেত্রী-মডেল পামেলা অ্যান্ডারসন। ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে প্রথম তাঁর ‘নুড’ ছাপা হয় ‘প্লেবয়’-এ। ২০১৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় চতুর্দশ বারের জন্য তিনি জায়গা করে নেন মলাটে।
আবার পুরুষ-চরিত্রও কখনো কভারে ঠাঁই করে নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। যেমন, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখনও অবশ্য তিনি ধনকুবের মাত্র। মার্চ ১৯৯০ সংখ্যাটি সেই দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। ক্রীড়াক্ষেত্রের উজ্জ্বল মহিলারাও আলোকিত করেছেন ‘প্লেবয়’-এর প্রচ্ছদপট। আমান্ডা বিয়ার্ড-এর মতো অলিম্পিক্সে সাত বার পদকজয়ী সাঁতারু ছিলেন জুলাই ২০০৭ সংখ্যার মুখ। তাঁর পরিচিতিটিও ছিল লক্ষণীয়— ‘World’s Sexiest Athlete’!
প্রথম ভারতীয় হিসাবে ২০১২ সালে ‘প্লেবয়’-এর জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান (?) শার্লিন চোপড়া। তা নিয়ে এ-দেশের মিডিয়ায় কিছু প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। তবে, জন্মগতভাবে ভারতীয় না হলেও, আরেক বলিউডি অভিনেত্রী ঢের আগেই এই ‘কৃতিত্ব’ অর্জন করেছেন। কেটি মিরজা। সাতের দশকের শুরুতে তিনি ‘প্লেবয় বানি’ হন। এর পর পরই চলে আসেন ভারতে। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘অমৃত’ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে—
‘কেটি মিরজা নামে একটি পার্শী মেয়ে বম্বেতে দারুণ হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে। এসেছে সদ্য লন্ডন থেকে। এতদিন মডেলিং করেছে। প্লে-বয় পত্রিকায় ওর ন্যুড ছবি ছাপা হয়েছে। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে প্লে-বয় সারা পৃথিবী থেকে জোগাড় করা সুন্দরী মেয়েদের ন্যুড ছবি ছেপে ব্যবসা চালায়। কেটি ওদেরই কালেকশন। ওখানে কাজ শেষ করে সে ভারতে এসেছে সিনেমায় নামবে, এই অভিপ্রায়ে। হিন্দি জানে, তাই সে সোজা বম্বেতে এসে উঠেছে। এসেই বম্বের রমরমে কয়েকটা সিনেমা পত্রিকায় বুক খোলা, উরু দেখানো প্রায় ন্যুড ছবি ছাপিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।’
শেষমেশ অবশ্য ‘কিসসা কুর্সি কা’, ‘কসমে ওয়াদে’ ইত্যাদি হাতে-গোনা বলিউডি ছবি আর কিছু দ্বিতীয় স্তরের পাঞ্জাবি সিনেমায় অভিনয়ের বাইরে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি কেটি।
শুধুই এই ধরনের ‘পিন-আপ’ মডেলদের ফোটোগ্রাফ নয়, যৌনগন্ধী শানিত কার্টুনেও ‘প্লেবয়’ ছিল ব্যতিক্রমী। কখনো নির্ভেজাল ‘আমিষ’ মজার জোগান দিয়ে গিয়েছে, কখনো দমকা হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছে সামাজিক নীতিবোধের বজ্র আঁটুনি। আবার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার কিংবা বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা ফিকশনও ছিল এর নিয়মিত উপাদান। ক্যাসিয়াস ক্লে, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, বব ডিলান, স্ট্যানলি কুব্রিক, মার্লন ব্র্যান্ডো, স্টিফেন হকিং, বিল গেটস, মাইকেল মুর-এর মতো বিবিধ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে ‘প্লেবয়’।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই পত্রিকার লেআউট বা অঙ্গসজ্জার মান। সেই ১৯৫৩ সালে যে-উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন আর্থার পল, সময়ের সঙ্গে তা আর খুব-একটা নিম্নমুখী হয়নি। ‘প্লেবয়’-এর কনটেন্ট নিয়ে কারও আপত্তি থাকার একাধিক সংগত কারণ রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই ‘আপত্তিকর’ কনটেন্টের বিন্যাসটিকে অস্বীকার করা মুশকিল। যেমন উচ্চমানের ফোটোগ্রাফ, তেমনই গ্রাফিকের উপস্থিতি। টেক্সট বা ছবির সঙ্গে স্পেসের সুসমঞ্জস অবস্থান, পাশাপাশি জোড়া-পাতা বা ‘ডাবল স্প্রেড’-এর ব্যবহার মুগ্ধ করার মতো। কালেক্টরস এডিশন কিংবা যেসব বিশেষ সংস্করণ মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, দৃশ্যগত দিক থেকে ভাবনার অভিনবত্ব ও প্রয়োগ সেখানেও তাক লাগায়। নমুনা হিসাবে জানুয়ারি ২০১৪-র নিতম্ব বিষয়ক সংখ্যাটির কথাই ধরা যেতে পারে। ওই সংখ্যারও যেটি নিতম্ব অংশ, অর্থাৎ কিনা পিছনের মলাট, তার দুটি পৃষ্ঠে পুরো পাতা জুড়ে ছবির নির্বাচন ও ব্যবহারের প্রশংসা না করে উপায় নেই!
বিবিধ গুরুতর বিতর্ক মাথাচাড়া দেওয়া কিংবা যথেচ্ছ মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য— এসব তো ছিলই; কিন্তু সার্বিকভাবে যৌনতাকে উদ্যাপনের এক বার্তাও দিতে চেয়েছিল ‘প্লেবয়’। এমনকী তাদের শেয়ারের সার্টিফিকেটও একদা অলংকৃত হয়েছিল শায়িত নগ্নিকার দৃশ্যে! এখনও সেসব বিস্তর দামে বেচা-কেনা চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর বাইরে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ এমনকী এশিয়ার কোনো-কোনো দেশেও সেখানকার আইন অনুসারে প্রকাশিত হত ‘প্লেবয়’-এর পৃথক সংস্করণ। ভারতে অবশ্য প্রকাশ্যে এর স্বাদগ্রহণ সাধারণত সম্ভব ছিল না। খুব সীমিত মানুষজনই এর নাগাল পেত। শুনেছি ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের মতো কলকাতার বাছাই কিছু ঠেকে উচ্চদামে বিক্রি হত এই পত্রিকা। কখনো মিলত পুরোনো বইয়ের কারবারিদের কাছেও, গোপনে। এই যে লুকিয়ে-চুরিয়ে কেনা, নিষিদ্ধ বস্তুর আস্বাদন, তার খানিক আভাস মিলতে পারে সমরেশ মজুমদারের ‘অগ্নিরথ’ উপন্যাসে—
‘আপনাকে প্লেবয় ম্যাগাজিন আনিয়ে রাখতে অ্যাডভান্স করেছিলাম।’ একটি ছিপছিপে স্মার্ট অনেকটা ড্যানির মতো দেখতে নেপালি ছেলে সামনে দাঁড়াল।
‘ইয়েস। এনেছি। আজই এসেছে। আরও কুড়িটা টাকা লাগবে ভাই। কালোবাজারে দাম বেশি।’ আড়াল থেকে সন্তর্পণে একটা প্যাকেট বের করে দাসবাবু ছেলেটির হাতে দিতেই সে কুড়িটা টাকা পেমেন্ট করল।
ডাক্তার কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি সায়ন, এবার কাঁধে হাত পড়তেই সে একটু চমকে গেল। ডাক্তার বললেন, ‘চলো, ফেরা যাক।’ গাড়ির দিকে হাঁটার সময় সায়ন জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, প্লেবয় পত্রিকা কালোবাজারে বিক্রি হয় কেন?’
…ডাক্তার আঙ্কলকে আজ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘শখের জিনিস না পেলে মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। তখন বেশি দাম দিয়ে পেতে চায়। এই ধরো যারা খুব সিগারেট খায় তারা যদি শোনে বাজারের কোনও দোকানে সিগারেট নেই, তখন তাদের কী অবস্থা হবে। যেখানে পাবে সেখান থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে ছুটবে। প্লেবয় ম্যাগাজিনকে অনেকেই পছন্দ করেন না, যাঁরা করেন তাঁরা বেশি দাম দিয়ে কিনতে চান হাতের কাছে না পেলে।’
মানুষের আদিম রিপুর এই তাড়নাই ছিল ‘প্লেবয়’ পত্রিকার সবথেকে বড়ো পুঁজি। ইন্টারনেটের বিস্তার প্রাপ্তবয়স্কের উপভোগ্য যৌন উপাদান অত্যন্ত সহজলভ্য করে দেওয়ায় সেই পুঁজিতেও টান পড়ে। ২০১৬-’১৭ নাগাদ পূর্ণাঙ্গ নগ্ন ছবির প্রকাশ সাময়িক স্থগিত করেও বিশেষ লাভের মুখ দেখা যায়নি। কোভিড শুরুর ধাক্কায় শেষমেশ মুদ্রিত পত্রিকাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় শেষ সংখ্যা। পাঠকের জন্য যে ভার্চুয়াল সুখের কল্পরাজ্য একদা নির্মিত হয়েছিল, সময়ের হাত ধরে তার ঠিকানাও এখন পুরোদস্তুর ভার্চুয়াল।
ছবি সৌজন্যে : লেখক