ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হন্তারক


    অরুণ কর (November 25, 2023)
     

    ১.

    আদিগন্ত ধানক্ষেতের মাঝখানে শেখ সাহেবের মস্ত দিঘিতে এই খর বৈশাখেও টলটলে জল। পাড়ে বেঁটে নারকেল গাছের সারি, কয়েকটাতে প্রায় মাটি ছুঁয়ে কাঁদি ঝুলছে। মাটি ফেলে উঁচু করা উত্তরপাড়ে কোঠাঘরটা নামে আলাঘর হলেও বেশ সাজানো-গোছানো। সামনে একফালি ফাঁকা জমিতে বেল, জুঁই, আরও নানা বাহারি ফুলের গাছ। গোলাপও আছে, তবে রোদের জন্যে ফুলে জৌলুস নেই, ফ্যাকাশে ম্যাড়মেড়ে।  

    বছর দু’য়েক বাদে মজনু এখানে এল। আলাঘরটা দোতলা হওয়া ছাড়া জায়গাটার তেমন পরিবর্তন হয়নি। তবে ওপরতলায় যে একজন মেয়েমানুষ আছে, এখানে পা দিয়েই মজনু তা টের পেয়েছে। মতিমিঞাকে সম্ভবত তার ফাইফরমাশ খাটবার জন্যে রাখা হয়েছে। ওপরের হাঁকডাক শুনে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

    আপাতত মজনুর দেখভালের ভারও মতিমিঞার ওপর, শেখ সাহেবের হুকুম। আবলুশ কালো, লম্বা হিলহিলে শরীর, শাণিত দৃষ্টি; তবে মতিমিঞা মনে হয় কানে খাটো, চেঁচিয়ে কথা না বললে শুনতে পায় না। 

    শেখ সাহেবের দরাজ দিল। তিনি মজনুকে একপ্রকার জামাই আদরে রেখেছেন। খাওয়া-দাওয়ার অকঞ্জুস আয়োজন। মতিমিঞা কখনও দিঘিতে জাল ফেলছে, কখনও বা গ্রাম থেকে দিশি মোরগ এনে জবাই দিচ্ছে, খাতিরের শেষ নেই।

    তবু দিনের পর দিন বদ্ধ ঘরে মুখ বুজে পড়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না মজনুর। অথচ এ ছাড়া উপায়ও নেই।

    আলপথ ধরে কিছুটা এগোলেই কেওটসা যাওয়ার কাঁচা রাস্তার ধার ঘেঁষে কশাড় জঙ্গলের মধ্যে সাবেক আমলের বিরাট কবরস্থান। একপাশে ঝুপসি শেওড়া গাছের নীচে সিমেন্ট বাঁধানো মানিক পিরের থান।

    সারা বছরই দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা মানত করে শেওড়ার ডালে ঢিল বাঁধতে আসে। গাই বিয়োলে পালান-ভাঙা প্রথম দুধটুকু পিরের থানে ঢেলে যায়। তবে সে সবই দিনের বেলা। লুঠপাট আর খুনখারাপির ভয়ে সন্ধের পর এ পথে লোকজন তেমন আসে না।

    আঁধার নামলে মজনু মাঝেমাঝে ওই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে হাঁটাহাঁটি করে, বুক ভরে শ্বাস নেয়। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। একবার জাম পাড়তে গিয়ে গাছের মগডাল থেকে পড়ে গিয়েছিল। নীচে নতুন কবরের ঝুরোমাটি ছিল বলে প্রাণে মরেনি। তবে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। বুবু ওকে ছেড়ে বাড়ি যেতে চাইত না, হাসপাতালের বেডে গুটিসুটি মেরে ওকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকত। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মজনু।

    দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া হলেও সে এখানকার সব খবরই রাখে। সামনেই বিধানসভা ভোট। উনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রুলিং-পার্টির টিকিট যোগাড় করেছেন। জিতলে মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন। মুখে যে যতই সেকুলার কপচাক, মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের অলিখিত কোটা থাকতে বাধ্য। কিছু খরচাপাতি লাগলেও শেখ সাহেব হয়তো পিছপা হবেন না।

    রাজনীতিটা এখন রেসের মতো, বাজিটা ঠিক ঘোড়ায় লাগাতে পারলে এক বাজিতেই কিস্তিমাত।

    মজনু শুনেছে, এখন তাঁর পথের কাঁটা একজনই— বিরোধী পক্ষের প্রার্থী বাসু মালাকার।  শিক্ষিত ছেলে, বছর কয়েক হল মাস্টারিতে ঢুকেছে, সাংঘাতিক ডাকাবুকো। গতবার ঘূর্ণিঝড়ের পর সরকারি ত্রাণ নয়ছয়ের অভিযোগে দলবল জুটিয়ে দিনের পর দিন পঞ্চায়েত অফিসে হুজ্জোতি করেছিল। একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনার অনিয়ম নিয়েও পঞ্চায়েত প্রধান শেখ সাহেবকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। দিন দিন তাঁর জনসমর্থন যেভাবে বাড়ছে, তাতেই হয়তো শেখ সাহেব সিঁদুরে মেঘ দেখছেন।

    অবশ্য এসব রাজনৈতিক কূটকচালিতে মজনুর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ফেলো কড়ি, মাখো তেল— তার সোজা হিসেব।  

    ২.

    সকাল থেকে মতিমিঞার দেখা নেই। মজনু বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে কাজের কথা ভাবছিল। এখানকার ব্যাপারটা মিটলেই কাকদ্বীপ যেতে হবে। সতীশ মাকাল খবর পাঠিয়েছে। চুনোপুঁটি কেস, লাখ চারেকে রফা হয়েছে। সেখান থেকে ইটিন্ডা, ভোট এলেই মজনুর কদর বাড়ে।

    হঠাৎ দরজায় মৃদু টোকা শুনে সে কান খাড়া করল। টোকার ধরনটা আলাদা, মতিমিঞা কিংবা শেখ সাহেব নয়। মজনু সাড়া না দিয়ে কান পেতে রইল।

    মিনিট খানেক পরে আবার টোকা পড়ল। তাতেও সাড়া না পেয়ে কে যেন ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় নেই, দরজা খোলেন।’

    ওপরের সেই মেয়েমানুষটার গলা। তবু অভ্যাসবশে কোমর থেকে যন্ত্রটা হাতে নিয়ে সাবধানে দরজাটা সামান্য ফাঁক করে অবাক হয়ে গেল মজনু। সুজনি-ঢাকা থালা হাতে অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। হলুদ শাড়ি, কালো ব্লাউজ, ফর্সা ছিপছিপে চেহারা। ব্লাউজে চুলের ভেজা দাগ, একটা হালকা সুবাস, হয়তো সে সদ্য গোসল করে এসেছে।

    গভীর কালো চোখ তুলে মৃদু গলায় মেয়েটি বলল, ‘আপনার নাস্তা। মতিচাচার শরীর খারাপ,  শেখ সাহেব তাকে আসতে মানা করেছে।’

    খাবারের থালাটা টুলের ওপর নামিয়ে রেখে বেরোতে গিয়েও সে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    এমন রূপবতী মেয়েমানুষ মজনু কখনও দেখেনি। তবু ক্ষণেকের মুগ্ধতাটুকু গিলে ফেলে পেশাদারি কঠিন গলায় বলল, ‘সরুন, দরজাটা বন্ধ করতে হবে।’

    কথাটা যেন তার কানেই গেল না। ধনুকের মতো ভুরু বাঁকিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে মজনুর দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে সে কী যেন একটু ভাবল। তারপর অন্যদিকে ফিরে বলল, ‘কাজটা কি না করলেই নয়?’

    বিনা ভূমিকায় এমন প্রশ্ন শুনে মজনু অবাক হল। মেয়েটা কতটা জানে, বোঝার জন্যে খুব নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোন কাজ?’

    মুহূর্তে হিংস্র বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠল মেয়েটি। হিসহিসে গলায় বলল, ‘কেন ন্যাকামো করছেন? বুঝতে পারছেন না, আমি কোন কাজের কথা বলছি?’

    মজনু দেখল, অযথা লুকোচুরিতে লাভ হবে না। সে সরাসরি মেয়েটার চোখে চোখ রেখে নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘আপনি যে কাজের কথা বলছেন, সেটাই আমার পেশা। বায়নার টাকা আগাম পেয়ে তবে এসিছি, এখন কাজটা না করলে বেইমানি হবে না?’

    মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক ঝলক বাঁকা হাসি খেলে গেল। বিদ্রুপের গলায় সে বলল, ‘বাহ্‌! আপনারও ইমান? বেশ, বেশ! তা শুনি আপনার ইমানের দাম কত?’

    ‘তা জেনে আপনি কী করবেন?’

    ‘কেনা যায় কি না চেষ্টা করে দেখতাম!’

    কথা তো নয়, যেন চাবুক! তবু মাথা ঠান্ডা রেখে শীতল গলায় মজনু বলল, ‘আমাকে বুঝতে হয়তো আপনার ভুল হয়েছে। আমি ইমানের নিলাম ডাকিনি।’  

    মেয়েটা নিঃশব্দে হাসল। তারপর তির্যক গলায় বলল, ‘ভুল সবারই হয়। এসব পেশার মানুষদের কাছে ইমানের চাইতে টাকার দাম বেশি বলেই তো জানি! আরেকবার ভেবে দেখলে ক্ষতি কী?’

    দিঘিতে কারা যেন চান করতে আসছিল, দূর থেকে তাদের গলা পেয়ে মেয়েটা আর দাঁড়াল না।

    মজনু কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। তারপর চামচ দিয়ে ডিমের পোচটা তুলতেই টলটলে লাল কুসুমটা ছেতরে গিয়ে একটা আঁশটে গন্ধ যেন নাকে লাগল। সে আলগোছে নাস্তাটা সরিয়ে রেখে  চোখ বন্ধ করল।

    ৩.

    একটু বেলার দিকে শেখ সাহেব এসে বললেন, ‘মতিমিঞার জ্বর, শুনেছ বোধহয়। চাদ্দিকি করোনা হচ্চে, ওরে তাই আসতি মানা করিচি। মালিহারে বলচি, আপাতক সে-ই তুমার খাবারদাবার দিয়ে যাবে।’

    মালিহা! এমন নাম মজনু আগে শোনেনি। তার প্রসঙ্গ উঠতে সে একটু অস্বস্তিতে পড়ল। মালিহার মনোভাব শেখ সাহেব নিশ্চয় জানেন না। মজনু যদি সব বলে দেয়, উনি কি বিশ্বাস করবেন?   

    হঠাৎ শেখ সাহেব ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ভাবদেছ, মজনু?’

    মজনু বলল, ‘ভাবছি, কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে পারলে ভাল হত। এভাবে বদ্ধ-ঘরে লুকিয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না। আপনার হুকুম পেলে…’

    শেখ সাহেব ওর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘এট্টু ধৈর্য তো ধত্তি হবেই! বাদুড়ে থানায় নতুন যে বড়োবাবু এয়েচেন, শুনচি তিনি নাকি অত্যন্ত সেয়ানা ঘুঘু। অতএব ভাল করে আটঘাট বেঁধে, মানে বুজদিই তো পাত্তেচো, সামনে ইলেকশান। এখন গায়ে কালি লাগলি আম ছালা দুটোই যাবেনি!’

    শেখ সাহেব আর দাঁড়ালেন না।

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মজনু ঘুমিয়ে পড়েছিল। আচমকা দরজায় টোকা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। জানালার ঘষা কাচ ভেদ করে বিছানায় চড়া রোদ পড়েছে। উঠতে গিয়ে মনে হল, মাথাটা খুব ভার, শরীরটাও যেন ম্যাজম্যাজ করছে।

    ‘কী হল, দরজা খুলুন! থালা হাতে নিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?’

    মালিহার গলা। অতি কষ্টে উঠে দরজা খুলে দেখল, দু’হাতে দুটো থালা এবং মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালিহা দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গোঁজা, প্রসাধনহীন মুখ। ঘামে ভেজা কপালে এক গোছা চুল লেপ্টে অপূর্ব দেখাচ্ছে।

    টুলের ওপর থালা দুটো নামিয়ে রেখে সে খর দৃষ্টিতে মজনুর দিকে চাইল।

    ফুলছাপ কলাই করা থালা, একটাতে শিউলি ফুলের মতো ধবধবে সাদা ভাত, অন্যটাতে ডাল-তরকারির গোটা তিনেক বাটি সাজানো। এমন পরিপাটি করে বেড়ে দেওয়া থালায় মজনু আগে কখনও খায়নি। অথচ একটুও খেতে ইচ্ছে হল না।

    বিরক্ত মালিহা হয়তো কোনও কড়া কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ মজনুর ছলছলে চোখে চোখ পড়তে সে একটু থমকে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর খারাপ?’

    অন্য সময় হলে হয়তো মজনু এই মেয়েলি কৌতূহলের জবাব দিত না। কিন্তু ওর এই জিজ্ঞাসার মধ্যেকার আন্তরিকতার ছোঁয়াটুকু উপেক্ষা করতে পারল না। বলল, ‘না! অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই হয়তো…’

    মালিহা অনুসন্ধিৎসু চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উঁহু, আপনার মুখখানাও যেন থমথমে লাগছে, জ্বরটর আসেনি তো?’

    অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়তে মজনুর মনটা যেন নরম হয়ে এল। কখনও ওর শরীর খারাপ হলে বুবু এভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করত।   

    তীব্র শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল, ‘ছিঃ! মেয়েরা বুঝি শুধু ন্যাকামোই করে? যার ইজ্জত বাঁচাতে খুন করে জেলে গিয়েছিলেন, আপনার সেই বড়বোনও কিন্তু মেয়েই ছিলেন!’   

    মজনুকে চুপ করে থাকতে দেখে মালিহা বলল, ‘লোকে আপনার নাম শুনে যেভাবে ডরায় তাতে আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি ভয়ঙ্কর মানুষ। অথচ আপনাকে দেখে কিন্তু তা মনে হয় না।’

    ‘কী মনে হয়?’

    ‘সাধাসিধে, উদাসী; অনেকটা ছ্যাঁকা খাওয়া প্রেমিকের মতো— দুঃখী-দুঃখী।’

    মালিহার কথা শুনতে শুনতে মজনুর কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল। হঠাৎ সন্দেহ হল, এটা হয়তো ওর কৌশল। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলে হয়তো তাকে দুর্বল করতে চাইছে।  

    মুহূর্তে সে বদলে গেল। অত্যন্ত রুক্ষস্বরে বলল, ‘শুনুন, আমাকে বুঝতে আপনার আবারও ভুল হচ্ছে। এসব মেয়েলি ন্যাকামোতে ভুলবার বান্দা আমি নই! আপনি আসতে পারেন।’

    আচমকা ধমক খেয়ে মালিহা একটু হকচকিয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। তীব্র শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল, ‘ছিঃ! মেয়েরা বুঝি শুধু ন্যাকামোই করে? যার ইজ্জত বাঁচাতে খুন করে জেলে গিয়েছিলেন, আপনার সেই বড়বোনও কিন্তু মেয়েই ছিলেন!’   

    মালিহা দ্রুত পায়ে ওপরে উঠে গেল।

    তার বিদ্রুপ যেন গরম সিসার মতো মজনুর কানে আছড়ে পড়ল। সে নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল।

    তারপর খেতে বসে দেখল, ভীষণ গা গোলাচ্ছে। জোর করে দু-চার গ্রাস মুখে তুলতে হড়হড় করে বমি হয়ে গেল। কোনও রকমে হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম এল না। মনে হল, কান দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।

    কিছুক্ষণ পরে ফের দরজার সামনে যেন পায়ের শব্দ হল। টোকার শব্দে সন্তর্পণে দরজা খুলে দেখল, গম্ভীর মুখে মালিহা দাঁড়িয়ে।

    দুটো ট্যাবলেট হাতে দিয়ে মালিহা বলল, ‘বমির শব্দ পেলাম মনে হল! এই দুটো ট্যাবলেট একসঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়ুন। আপনাকে ভোলাতে এসেছি ভেবে আবার তেজ দেখিয়ে ফেলে দেবেন না যেন!’

    কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপটুকু গায়ে না মেখে মজনু বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’   

    মালিহা ধনুকের মতো ভ্রু বাঁকিয়ে বিদ্রুপাত্মক গলায় বলল, ‘কী?’

    ‘আপনি কে?’

    ‘তা জেনে আপনি কী করবেন?’

    ‘না, এমনি কৌতূহল?’

    ‘বেশি কৌতূহল কিন্তু বিপদ ডেকে আনে। তার চেয়ে আপনি বরং আমার প্রস্তাবটা আরেকবার ভেবে দেখতে পারেন।’

    ‘সে কথা পরে হবে। আপাতত শুধু বলুন, আপনি এখানে এলেন কী করে?’

    মালিহা মজনুর চোখে চোখ রেখে বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘সে-সব মেয়েলি ন্যাকামোর কথা নাই বা শুনলেন! গাঁ-গঞ্জে ক্ষমতাবান পুরুষরা কেমন করে জরু-গরুর দখল নেয়, সেটা তো আপনার না জানার কথা নয়! সকলের তো আপনার মতো ভাই থাকে না!’

    মুহূর্তে মজনুর মাথার মধ্যে যেন রক্ত চলকে উঠল।

    মালিহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কোমর থেকে শাড়ির আঁচলটা নিয়ে আঙুলে জড়াতে জড়াতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, এবার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

    মজনু ভূতে পাওয়া মানুষের মতো অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা?’

    ‘আপনি আমার কথা জানতে চাচ্ছেন কেন? এই এক-দেড় বেলার দেখায় আপনি কি আমার প্রেমে পড়ে গেছেন?’

    মজনুর মনে হল, ওর গালে যেন ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ল। চমকে উঠে ভাবল— সত্যিই তো, তার মতো একজন পেশাদারের তো অন্যের সুখ-দুঃখের খবর নেওয়ার কথা না! তবে কি…’

    মালিহা মজনুর অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ঠাট্টা করলাম। আমি জানি, শেখ সাহেব থাকতে আমার দিকে কারও নজর দেওয়ার সাহস হবে না। তা ছাড়া সবাই জানে, আমি খুব অপয়া।’

    মজনু কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলল। বলল, ‘অপয়া মানে? এ যুগে ওসব কেউ বিশ্বাস করে নাকি?’

    মালিহা ধরা গলায় বলল, ‘কেউ না করলেও আমি করি। যার জন্যে নিজের বাপ খুন হয়ে গেল, অন্য একজনকে বিনা দোষে জেল খাটতে হচ্ছে, তার মতো অপয়া আর কে আছে?’

    মজনুর মনের মধ্যে যেন এক ভয়ঙ্কর তোলপাড় শুরু হল। যে নিষ্ঠুরতার বর্মে এতকাল অন্তরের কোমলতাটুকু আড়াল করে রেখেছিল, মনে হল, তাতে যেন চিড় ধরতে শুরু করেছে।

    অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে সে বলল, ‘আপনি কি আরেকটু খোলসা করে বলবেন? মানে আপনার জন্যে কে জেল খাটছেন, কেন আপনার বাবা খুন হলেন…’

    মালিহা নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘কী হবে ওসব শুনে? বরং বলুন, কত টাকা পেলে আপনি চুপচাপ এখান থেকে চলে যাবেন। আমি পারলে দেব, না পারলে আমাকে অন্য উপায় দেখতে হবে। কিন্তু আমার কারণে নতুন করে কোনও খুনখারাপি হতে দেব না।’

    মজনু আরও ধন্দে পড়ে গেল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না, বাসু মালাকারকে বাঁচাবার জন্যে সে এতটা মরিয়া কেন? তবে কি বাসুর সঙ্গেই মালিহা…

    ৪.

    সন্ধের পর শেখ সাহেব এসে বললেন, ‘মালিহার মুখি শোনলাম, তুমার নাকি শরীল খারাপ?’

    ওষুধ খেয়ে শরীরের অস্বস্তি অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। মজনু বলল, ‘তেমন কিছু না।  অবেলায় ঘুমোনোর জন্যে গা-টা একটু ম্যাজম্যাজ করছিল, এখন ঠিক আছি।’

    শেখ সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ‘যাক, বাঁচা গেল! আমি তো চিন্তায় পড়ে গিসলাম।’

    তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘কালই সে জেলের থেকে বেরোবে। সন্ধের মদ্যি কাজডা সেরে তুমি সরে পড়বা। দেখো, কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।’   

    ভীষণ রকম চমকে গেল মজনু। স্বভাববিরুদ্ধ কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, ‘বাসু মালাকার আবার কবে জেলে গেল?’ 

    শেখ সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘বাসু মালাকারের প্রশ্ন আসচে কনথে? আমি কি তুমারে তার কতা বলিচি?’

    মজনু আমতা-আমতা করে বলল, ‘না, তা বলেননি। কিন্তু এবারের ভোটে সে-ই তো আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ। কয়েক বছর ধরে সে আপনাকে কম জ্বালাতন করছে না, তাই ভাবলাম…’

    ‘কল্লিই বা! বাসুর জন্যি আমি ইলেকশানের আগে এত বড় রিক্স লেব, তুমি ভাবলে কী করে?’

    মজনু জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইল।

    কিছুক্ষণ পরে শেখ সাহেব নিজেই বললেন, ‘শোনো, বাসুর জন্যি আমি থানায় কতা বলে অন্য ব্যবস্থা করে রেকিচি। অল্প জলের মাছের ফড়ফড়ানি বেশি। দু-এক দিনির মদ্যি পুলিশ ধরে ওরে এমুন গাঁজা কেস দেবেনি, ভোটের আগে আর বেরুতি পারবে নাকো। তুমারে ডেকিচি রজ্জাকের জন্যি।’

    একটু আগের অপমান মাথায় রেখে মজনু পাথুরে মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘রজ্জাক? সে আবার কে? তাকে আমি চিনবই বা কেমন করে?’

    শেখ সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একখানা ছবি বের করে ওর হাতে দিলেন। মজনু দেখল, সুন্দর একটা অল্পবয়সি ছেলে, কোঁকড়া চুল, টিকোলো নাক, স্বপ্নালু দৃষ্টি।

    শেখ সাহেব দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে হিসহিসে গলায় বললেন, ‘এই হল গে মালিহার নাগর। ওরে জেলে পেটকে ভেবিলাম, মালিহা হয়তো ওর কথা ভুলে যাবেনি। কিন্তু ওর সোঙ্গে কতা বললি টের পাই, আজও ওর নিশ্বাসে প্রশ্বাসে রজ্জাক। সে বাইরি থাকলি পাখি ঝে কোনও দিন উড়াল দিতি পারে। ওই কাঁটা আমি রাকবো না।’ 

    তারপর পার্স থেকে একটা সিমকার্ড বের করে বললেন, ‘কাল এই সিমডা তোমার মোবাইলে ভরে নেবা, রজ্জাক জেলের থে বেরিয়ে কখন কমনে যাচ্চে, এই লম্বরেই সব খবর পাবা। কাজডা হয়্যি গেলি ওডা খুলে পানিতি ফেলে দে চুপিসাড়ে কেটে পড়বা। ভুলেও আমার সোঙ্গে যোগাযোগ করবা না।’  

    মজনুর মাথায় শেখ সাহেবের একটা কথাও ঢুকছিল না। জীবনের প্রথম খুনের কথাটা মাথায় পাক খাচ্ছিল। তার সবচেয়ে কাছের মানুষ বুবু, সে-ও এমনি একজনকে ভালবাসত। পাটক্ষেতের ধারে তাকে একলা পেয়ে দিনে দুপুরেই এক খবিশ… বুবুকে বাঁচাতে না পারার আফশোস মজনুর আজও যায়নি।   

    হঠাৎ শেখ সাহেব মজনুর চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠলেন,  ‘কী হয়েছে তোমার? ওকী, আমার দিকি ওর’ম করে এগিয়ে আসছ কেন, মজনু?’

    ৫.

    মালিহা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছিল। সে জানে, নীচের লোকটার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হলেই শেখ সাহেব ওপরে আসবেন। উনি শৌখিন মানুষ, সাজগোজ না দেখলে চটে যান, চড়চাপড় লাগাতেও দ্বিধা করেন না। অথচ ওই আধবুড়ো লোকটার জন্যে সাজতে হচ্ছে, এ কথাটা মনে হলেই মালিহার কেমন যেন বমি পেয়ে যায়।

    অন্যমনস্কভাবে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে হঠাৎ নীচে ভারী কিছু পড়ার শব্দে মালিহা চমকে উঠল। কান পেতে মনে হল, নীচে যেন ভয়ঙ্কর কোনও দাপাদাপি হচ্ছে।  

    সে একছুটে নীচে নেমে এল। আলো-আঁধারিতে মনে হল, কে যেন জবাই করা খাসির মতো চিত হয়ে মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুড়ছে, তার দু-ফাঁক হওয়া গলার নলি থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারায় মেঝেটা ভিজে উঠছে। আরও কাছে গিয়ে দেখল, মানুষটা স্বয়ং শেখ সাহেব!

    প্রচণ্ড আতঙ্কে মালিহার পায়ের নীচের পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। গলার কাছে উঠে আসা বমিটাকে প্রাণপণে আটকে একলাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। আপনা থেকেই গলা দিয়ে জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল।

    চরাচর ভেসে যাওয়া ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় মালিহা দেখল, কিশোরীর সিঁথির মতো সরু আলপথ ধরে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে… দিগন্তে বিলীয়মান সেই জ্যোৎস্নামাখা অলীক ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর দু’চোখ জুড়ে আঁধার নেমে এল।   

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook