ভয়ের খিচুড়ি
একটা লোকের ভীতি নিয়ে ছবি। নামও সহজ, Beau is afraid (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: আরি অ্যাস্টার, ২০২৩)। এই বু একজন মধ্যবয়স্ক মার্কিন পুরুষ, যে সর্বক্ষণ গুটিয়ে থাকে এবং সব দেখেশুনে তার হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে যায়। তার চারপাশটাও ভয়ানক, বাড়ির সামনের রাস্তায় সর্বক্ষণ মারামারি চলেছে, কেউ কারও চোখ উপড়ে নিচ্ছে, কেউ ছিনতাই করছে। তার ফ্ল্যাটবাড়ির ও লিফটের দেওয়ালভর্তি অশ্লীল গ্রাফিত্তি, সে চুপচাপ শুয়ে আছে অথচ কেউ তার দরজার তলা গিয়ে একটা করে চিরকুট গলিয়ে দিচ্ছে, যাতে লেখা, তোমার বাড়ির গানবাজনার ভল্যুম কমাও, আমরা ঘুমোতে পারছি না। ক্রমশ এই চিরকুটের সুর হুমকিতে বদলে যাচ্ছে। তার চাবি চুরি যাচ্ছে, সুটকেস চুরি যাচ্ছে, তার বাড়ি খোলা পেয়ে ঢুকে আসছে ভিখিরি ভবঘুরে সারা-গায়ে-ট্যাটুভর্তি-গুন্ডা এবং বাড়ির দফারফা করে ছাড়ছে। সে টিভি খুললেই দেখতে পাচ্ছে এক নগ্ন হত্যাকারী ছুরি নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যাকে পারছে আক্রমণ করছে। এ হচ্ছে সবে শুরু। এরপর বু-কে গাড়ি ধাক্কা দেবে, নগ্ন হত্যাকারী ছুরি মারবে, বু-কে মারতে ধাওয়া করবে প্রাক্তন সৈন্য যে এখন উন্মাদ, এবং এক সময় বু বুঝতে পারবে তার গোটা জীবনটাই হয়তো টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মতো পূর্বনির্ধারিত ও অনবরত লক্ষিত।
সোজা কথা, একটা লোক যত কিছুকে ভয় পেতে পারে, তার সবটাই উজাড় করে ঢেলে দেওয়া হয়েছে নায়কের ঘাড়ে। ছবিটা একটু পরেই বাস্তব পেরিয়ে চলতে থাকে স্বপ্নযুক্তিতে; মানে, ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে যুক্তির সীমা অমান্য করে একটা স্বপ্নের মতো, যেখানে যখন খুশি যা খুশি ঘটতে পারে, অবশ্য ভূতপ্রেত আসে না বা ভিনগ্রহীরা লেসার-রশ্মি চালায় না, কিন্তু জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে একটা দলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় যারা বিভিন্ন অরণ্যে নাটক করে বেড়ায় এবং সেই নাটক দেখতে দেখতে আচমকা বু নিজেকে নায়ক ভাবতে শুরু করে এবং অ্যানিমেশনে বু-র আরেকটা জীবন দেখানো শুরু হয়। গল্পসর্বস্ব হলিউডে একটা ছবি করা হচ্ছে যা কোনও কিচ্ছুর তোয়াক্কা না করে শুধু নায়কের আড়ষ্ট কুঁকড়ে যাওয়া, ত্রস্ত মনটাকেই যেন বাস্তবে এনে ছুড়ে ফেলছে এবং প্লটের ঘনবদ্ধতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্রমশ উদ্ভট থেকে উদ্ভটতর হয়ে চলেছে— এ সাধুবাদযোগ্য প্রচেষ্টা, কিন্তু ঝামেলা আছে।
প্রথম ঝামেলা, স্বপ্নযুক্তির ছবিতে যা খুশি ঢোকানো যায়, এবং সেজন্যই অতীব সতর্ক থাকতে হয়, যা খুশি ঢুকিয়ে দিলে চলে না। যদি কেউ রক্ষণশীল ভাবে একটা গল্প বোনে, কাজের একটা ফর্মুলা তার সামনে থাকে। কিন্তু যদি কেউ নিয়মের বাইরে যেতে চায়, তাকে নিজস্ব জাদু নিজে নির্মাণ করতে হয়, এবং তা খুব কঠিন। সে যদি ভাবে, এই তো স্বপ্নের মতো সব গণিত পেরিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম, এবার নিরন্তর প্রলাপ বকে যাও আর চোখ ঠেরে বলো, ‘হুঁহুঁ, গভীর অর্থ আছে’, তাহলেই কাজ সমাধা, তবে সে শেষ অবধি একটা অর্থহীন ও নিরর্থক ছবি বানিয়ে ফ্যালে, আর ফাঁকিবাজির দ্বারা মহান সিনেমা হওয়া তো অসম্ভব। যদি একটা চরিত্র হুট করে এসে আরেকটা চরিত্রকে বলে এবার তুমি দেওয়ালে রং করার রং ঢকঢক করে খাও, এবং সে-কথা ওই চরিত্র না শুনলে নিজে ঢকঢক করে রং খেয়ে মরে যায়, তখন দর্শকের মনে ‘যাক্কলা!’ ছাড়া কোনও অভিব্যক্তি উৎপন্ন হয় না। পর পর আশ্চর্য কাণ্ড ঘটলে ভাল লাগে, রূপকথার বদলে একটা উল্টো-রূপকথা, একটা দুঃস্বপ্ন বয়ন করে যাওয়ার প্রোজেক্ট খারাপ না, কিন্তু ব্যাপারস্যাপার সারাক্ষণ প্রক্ষিপ্ত আর গা-জোয়ারি ভাবে প্রবিষ্ট মনে হলে, আর সবচেয়ে বড় কথা: ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনও আকর্ষণ খুঁজে না পেলে, সিনেমা কোনও ভাবেই দাগ কাটে না।
দ্বিতীয় ঝামেলা হল, একটা মানুষের পরিস্থিতি খারাপ করে তুলব, উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু তা বলে মাকড়সার ভয় থেকে জল চলে যাওয়ার ভয়, ছুরি খাওয়ার ভয় থেকে ফ্লাইট মিস করার ভয়, কিচ্ছুটি বাদ দেব না— আজি এ ছবিতে গোটা তালিকা টিক মারিব হে বালক-বালিকা— এ ভাল শিল্পসিদ্ধান্ত নয়। গোড়ায় তবু মনে হচ্ছিল, আজকের পৃথিবীর সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা হচ্ছে, সেখানে এক সরলসোজা লোকের সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত না-হওয়াই বরং শক্ত, কিন্তু একটু পরেই ছবি নায়কের নিতান্ত ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে মোড় নেওযায় আর সমাজ-সমালোচনার দৃষ্টিকোণটা থাকে না। বু একসময় জেগে ওঠে এক দয়ালু ও ইতিবাচক হাবভাবের দম্পতির ঘরে, এদের গাড়িতেই তার ধাক্কা লেগেছিল, স্বামীটি বু-কে অপারেশন করে সারিয়ে তুলেছে, স্ত্রীটি সেবা করেছে, এখন নিজেদের মেয়ের ঘরে বু-কে রেখেছে। সোফায় শুতে হচ্ছে বলে মেয়েটি বু-র প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বিষ্ট। একইসঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকে তাদের ছেলের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়া একটি লোক, সে এখন পাগল, কিন্তু যুদ্ধে খুব বীরত্ব দেখিয়েছে। দম্পতির ছেলে যুদ্ধে মারা গেছে। দুর্ঘটনার পর জ্ঞান ফিরতেই বু-র মনে পড়ে, সে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল ফোনে, মা’র মাথায় একটা ঝাড়লণ্ঠন পড়ে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সে যাবে কী করে, বু-র তো ক্রেডিট কার্ডে একটাও পয়সা নেই, মানিব্যাগও শূন্য! এই দম্পতি তাকে নিয়ে গেলে ভাল, কিন্তু এরা একবার বলে এত অসুস্থ অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, পরের দিন বলে অন্য একটা অপারেশন এসে গেছে বলে আজকের যাওয়া ক্যানসেল। ক্রমাগত দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়, গুরুত্বপূর্ণ কাজে পৌঁছতে না পারার ভয়— আমাদের প্রায় সব দুঃস্বপ্নের মূল। শুধু এই নিয়েই একটা দুরন্ত ছবি হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে আবার এসে পড়ে দম্পতির কন্যার রাগ, তার উন্মাদ যুদ্ধবাজটিকে ফুসলে তোলার চেষ্টা, মেয়েটি ও তার বান্ধবী মিলে জোর করে বু-কে ড্রাগ খাইয়ে দেওয়া, যুদ্ধবাজটির হিংস্র চোখে বু-র দিকে তাকানো, এবং ধাঁ করে মেয়েটির বু-কে এসে বলা যে বু-কে যে পরীক্ষা করা হয়েছিল তাতে সে উতরোতে পারেনি। কী পরীক্ষা, কোন জিনিসটা সে পেরে উঠছে না, কোনখানে সে বিশাল ভুল করে ফেলল— বু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অর্থাৎ কাফকাও ঢুকে পড়লেন। এক তীব্র অপরাধবোধ, কর্তৃপক্ষের কাছে তিরস্কৃত হওয়ার ভয়, এবং কী দোষ করেছি তা-ও কিছুতেই বুঝতে না পারা: এই নিয়েও দুর্ধর্ষ ছবি হয়, কিন্তু এটা এল অন্যতম উপাদান হয়ে, অজস্র উপাদানের ভিড়ে।
এবং অবশ্যই, বু-র মা। তিনি সারাজীবন তাঁর দাপটে এবং ঝাপটে বু-কে এমন দমন করেছেন যে বু তাঁর উল্লেখমাত্রে জড়সড় হয়ে যায়। বু-র বাবা নেই, মা বলেছেন, বিয়ের রাত্রে প্রথম যৌনতা করেই বাবা মারা যান। বাবার বাবা, এবং সেই বাবার বাবাও এইভাবেই মারা গেছিলেন, এই বংশে কোনও পুরুষ যৌনতা করলেই সে মারা যাবে। মানে যৌনতার পাপবোধও ছবিতে এল। এখানে অবশ্য শেষ নয়, এও জানা যাবে যে বাবাকে মা সারাজীবন একটা গুদামে বন্দি করে রেখেছেন। তবে সেই বাবা হয়তো একজন মানুষ, কিংবা একজন অতিকায় শিশ্ন। তবে কি তিনি পুরুষের যৌন কামনার প্রতীক? যাকে বন্দি করে পুত্রকে অযৌন করে তোলার প্রয়াস করেছিলেন নিষ্ঠুরা মা? কে জানে। কেনই বা অ্যানিমেশন নাটকে দেখা যায় বু এক নারীকে বিবাহ করে তিন পুত্রের জন্ম দিল ও এক ভয়াল বন্যায় সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারাজীবন তাদের সন্ধান করতে লাগল? এ কি তার ফ্যান্টাসি এবং সেখানেও ঢুকে পড়েছে দুর্দশার ভয়? অস্পষ্ট। বু-র মূল ভয় কি মা’র চোখে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হওয়া? মা’কে খুশি না করতে পারার ভয় থেকেই তার যাবতীয় ভয় উৎসারিত? মা এক সাংঘাতিক সফল ব্যবসায়ী, বু এক অকর্মণ্য লোক, যে কোনও টাকা আয় করে না, মা’র টাকাতেই তার চলে। এও জানা যায়, বু মনস্তত্ত্ববিদের কাছে গিয়ে মা সম্পর্কে যা যা বলে, তাও রেকর্ড করে মা’র কাছে জমা দিয়ে দেয় সেই চিকিৎসক। যে মেয়েকে বু সারাজীবন ভালবেসে এসেছে, সে মা’র কাছেই চাকরি করে, কিন্তু কখনও বু তা জানতে পারেনি, তার সঙ্গে দেখাও হয়নি। তবে কি বু’র গোটা জীবনটা মা পরিচালনা করেন, কার সঙ্গে তার দেখা হবে বা হবে না, কী ঘটবে বা ঘটবে না, সমস্ত মা’র চক্রান্ত ও পরিকল্পনা? তার মানে কি বু একটা ‘ট্রুম্যান শো’-তে বন্দি, যেখানে সে ছাড়া সবাই অভিনয় করছে? (‘দ্য ট্রুম্যান শো’ ১৯৯৮-এর ছবি, চিত্রনাট্য: অ্যান্ড্রু নিকোল, পরিচালনা: পিটার ওয়্যার। সেখানে নায়ক আবিষ্কার করে, তার গোটা জীবনটা সাজানো ও টেলিভিশনে টানা প্রচারিত)। এ কি আসলে ভাগ্যের হাতে পুতুলনাচ নাচার ভয়? ভয়ঙ্করী জননী বা ঈশ্বরের হাতে অত্যাচারিত হওয়ার ভয়? শেষ দৃশ্যে বু’র বিচার হয়, সেখানে মা’র উকিল তার দৈনন্দিন জীবন থেকে ঘটনা তুলে তুলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে থাকে, বু’র উকিল প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে উঁচু থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। ফের কাফকা। বিচার, শাস্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ না থাকা।
এই পরিচালক এর আগে সমালোচকের প্রশস্তিধন্য দুটো পূর্ণদৈর্ঘ্যের হরর-ছবি বানিয়েছেন, এই ছবিটাও একটা অন্য ধাঁচের হরর-ফিল্ম, কিন্তু সেই ধাঁচটা জগাখিচুড়ি টাইপ হয়ে গিয়ে, দর্শক কোনও স্বাদই ঠিকঠাক পায় না। যখন চিত্রনাট্যে সামান্য তীব্র ভাবনা ভর করেছে মনে হয়, তখনই অন্য সাহিত্য বা চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে। হোয়াকিন ফিনিক্স প্রধান চরিত্রে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, স্বরটাকে অবধি ফ্যাঁসা ও উদ্ভট করে নিয়েছেন, কিন্তু তাতে তো ছবিটা উতরে দেওয়া যায় না। ভরসা একটাই, এক সময় ছবি শেষ হয়, দর্শকের অনেকক্ষণ থেকে যে সাংঘাতিক ভয় করছিল: এই ছবি শেষ না-হওয়ার ভয়— তার অবসান ঘটিয়ে।