‘So No One Told You, Life Was Gonna Be This Way’
– Song by The Rembrandts
একটি লোক মনের দুঃখে ডাক্তারের কাছে এসেছে। বড় অবসাদে ভুগছে, কিচ্ছু ভাল লাগছে না। খালি মনে হচ্ছে পৃথিবীতে কেউ তার আসল কষ্ট, আসল যন্ত্রণাগুলোর কথা জানতে চায় না। ‘ডাক্তারবাবু, আপনি বলুন, কী করে একটু মনের শান্তি ফিরে পাব? একটু খুশি থাকব?’
ডাক্তার বললেন, ‘এক কাজ করুন। আপনি পালিয়াচ্চির নাম শুনেছেন? বিখ্যাত কমেডিয়ান, যেমন তাঁর রসবোধ, তেমন তাঁর বুদ্ধি। নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করে, হাসিয়ে হাসিয়ে তিনি মানুষের পেটে খিল ধরিয়ে দেন। আপনি পালিয়াচ্চির অনুষ্ঠান দেখতে যান, দেখবেন আপনার মন ভাল হয়ে যাবেই।’
এই কথা শুনে লোকটি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অসহায় শিশুর মতো কেঁদে ফেলে বলল, ‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমিই তো পালিয়াচ্চি!’ ম্যাথিউ পেরির চলে যাওয়ার খবরটা পেয়ে পালিয়াচ্চির গল্পটাই আজ মনে পড়ছে।
১৯৯৪-২০০৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার এনবিসি (NBC) চ্যানেলে দশ সিজনের জন্য ধারাবাহিক ভাবে চলে ‘ফ্রেন্ডস’ নামে একটি কমেডি সিরিজ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই সিরিজের চেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ খুব কমই তৈরি হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি দর্শক সিরিজটি দেখেছেন, এবং— শেষ এপিসোডের উনিশ বছর পরে আজও দেখে চলেছেন! পাশাপাশি, বিশ্বের পপুলার কালচার-এর উপরেও বিপুল প্রভাব ফেলেছে এই সিরিজ ও সিরিজের ছ’জন মুখ্য চরিত্র। যাদের মধ্যে চ্যান্ডলার বিং নামে এক আমেরিকান তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ম্যাথিউ পেরি।
চ্যান্ডলারের চরিত্রটি বড়ই চমৎকার। এক দিকে সে দশটা-পাঁচটার কলমপেষা চাকরি করে, অন্যদিকে তার কল্পনাশক্তি এবং রসবোধ তুখোড়, তাই সে চায় একঘেয়ে আপিসের কাজ ছেড়ে বিজ্ঞাপনের চাকরি করতে। তার বাবা ও মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় তার ছোটবেলাতেই— তখন থেকেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লে, ঘাবড়ে না গিয়ে সে ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে রসিকতার সাহায্য নেয়, নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করে, যদিও সেই ঠাট্টার পিছনে লুকিয়ে থাকে একজন সত্যিকারের সংবেদনশীল মানুষ। একটি উদাহরণ দিই। চতুর্থ সিজনে ক্যাথি বলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে চ্যান্ডলার, কিন্তু ক্যাথি সে-সময়ে প্রেম করছে চ্যান্ডলারের প্রিয় বন্ধু জোয়ির সঙ্গে। অতএব, এই প্রেমে চ্যান্ডলার বিশেষ এগোতে সাহস পায় না। ফলে ক্যাথি যখন তার সঙ্গে একটু ফ্লার্ট করে তাকে বলে, ‘বাহ্, তোমার চুলগুলো দিব্যি তো!’ চ্যান্ডলার পাল্টা ফ্লার্ট না করে স্রেফ ঠাট্টার সুযোগ নেয়; ‘ধন্যবাদ, ওগুলো আমি নিজের বাগানে নিজেই গজিয়েছি!’ অথচ এই ঠাট্টার আড়ালে আছে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং সহানুভূতিশীল মানুষ, যে জোয়ির প্রতি বন্ধুর দায়বদ্ধতা এবং ক্যাথির প্রতি ভালবাসাকে, নিজের হাজার দুঃখ সত্ত্বেও সামলে এগিয়ে চলে এবং পরবর্তীকালে ক্যাথির সঙ্গে প্রেম করলেও, জোয়ির রাগ-অভিমান-হিংসে সব কিছুকেই মেনে নিয়ে, প্রিয় বন্ধুকেও বিচ্ছিন্ন হতে দেয় না।
চ্যান্ডলারের গল্প এর থেকে বেশি বললে, যে বন্ধুরা এখনও ‘ফ্রেন্ডস’ দেখেননি, তারা আমার বিরুদ্ধে স্পয়লার দেওয়ার অভিযোগ আনতে পারেন। তাই আর গল্প বাড়াব না। তবে এটুকুই বলব, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে একটা ধারণা ছিল যে আমেরিকান কমেডির হিরোরা একটু চালাক-চতুর গোছের হয়— তারা বুদ্ধি ও চালাকির জোরে বার বার নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও, অবশেষে অন্যদেরই বোকা বানিয়ে দিনের শেষে জীবনযুদ্ধে জিতে যায়। জন বেলুশি থেকে জেরি সাইনফেল্ড, সবাই এই ধারারই কমিক হিরো। চ্যান্ডলারের চরিত্রে কিন্তু পেরি এই স্টিরিওটাইপটি ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর কমিক হিরো অনেকটা বেশি ব্রিটিশ ধারার; এই হিরো রসিকতা বা ঠাট্টার ব্যবহার করে সব কিছু জিততে পারে না, বরং বার বার হেরে যাওয়াটাকেই হালকাভাবে নিয়ে এগিয়ে চলার রসদ সংগ্রহ করে। চ্যান্ডলারের মন্ত্র বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেই মন্ত্র আসলে রবীন্দ্রনাথের— ‘মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’
এই মন্ত্র কিন্তু ম্যাথিউ পেরির নিজের জীবনেও আমরা দেখতে পাই। ১৯৯৭ সালে একটি দুর্ঘটনার পরে শারীরিক যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে পেরিকে ভিকোডিন নামে একটি পেইনকিলার বা যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ খেতে হয়। আমেরিকার ওষুধের বাজারে আফিমজাত পেইনকিলার যত্রতত্র বিক্রি করার, এবং ফার্মাসিউটিকাল সংস্থানগুলোর বিপুল অর্থ ও লাভের তাগিদে ডাক্তারদের নিয়মিত সে সব ওষুধ সরবরাহ করার এক ভয়ানক সমস্যা রয়েছে বহু দিনই, যাকে আজ opioid crisis বলা হয়। এই ভিকোডিন খেতে খেতে এর নেশায় আসক্ত হন পেরি, এবং এর পরে প্রায় দশ বছর শুধু মাদক নয়, মদের নেশার সঙ্গেও তিনি লড়াই করেছেন। বহু বছর পরে একটি সাক্ষাৎকারে পেরি জানান, তাঁর মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, নিয়মিত নেশা করার ফলে ‘ফ্রেন্ডস’-এর তিনটি সিজনের শুটিং-এর সমস্ত স্মৃতিই তাঁর মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এই নেশার ফলে, এবং মাদকজাত শারীরিক অসুস্থতার ফলে, ‘ফ্রেন্ডস’ শেষ হওয়ার পরে পেরি আর সেভাবে ফিল্মের দুনিয়ায় সাফল্য লাভ করতে পারেননি, যতটা পেরেছেন তাঁর সহ-অভিনেতা জেনিফার অ্যানিস্টন, লিজা কুড্রো, বা ডেভিড শুইমার।
তবে এই জীবন-সংগ্রাম কিন্তু ম্যাথিউ পেরিকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। কী করে দেবে? তিনি যে স্বয়ং চ্যান্ডলার বিং। বার বার এই নেশার সঙ্গে লড়েছেন পেরি, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বা আড্ডায় নেশার প্রসঙ্গ উঠলে তাকে অস্বস্তিকর বিষয় ভেবে এড়িয়ে যাবার বদলে তিনি খোলাখুলি ঠাট্টা করেছেন নিজের নেশা নিয়ে, বলেছেন— ‘আমরা যদি নেশার মতো একটা জটিল বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে কথা না বলতে পারি, একটু হাসি-তামাশা না করতে পারি, তাহলে এই সমস্যাকে আমরা জুজু ভেবে খাটের নীচেই লুকিয়ে রাখব, কোনও দিন আর এর সুরাহা মিলবে না।’ ফলে পেরি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন আমেরিকার মাদক এবং নেশাবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে— National Association of Drug Court Professionals (NADCP) সংস্থার তরফে ২০১১ সালে একাধিকবার আমেরিকার কেন্দ্রীয় কংগ্রেসে জোরালো দাবি তুলেছেন তরুণ-তরুণীদের অবাধে আফিমজাত ওষুধ বেচার বিরুদ্ধে, মাদকের বিষয়ে আলাদা ড্রাগ কোর্ট তৈরি করার দাবিতে। ক্যালিফর্নিয়ায় ম্যালিবু শহরে নিজের বিলাসবহুল বাড়িটিকে তিনি ‘পেরি হাউজ’ নামে একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন এই সময়েই। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই, আর কেউ যেন তাঁর নিজের মতো মাদকের নেশায় কষ্ট না পায়।
ম্যাথিউ পেরি চলে গেলেন, মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে। আজ খালি মনে পড়ছে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পেরির স্বীকারোক্তি— ‘আমি জানি বেশির ভাগ মানুষ আমাকে মনে রাখবে চ্যান্ডলার হিসেবে। তাতে আমার আপত্তি নেই; এত মানুষকে এত বছর ধরে যে আমার এই একটি চরিত্র আনন্দ দিতে পেরেছে, তা খুবই ভাল কথা। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করে, আমাকে মানুষ মনে রাখুন এমন একটা লোক হিসেবে, যে বিপদে-আপদে আর একটা লোকের পাশে থাকতে চেয়েছিল। কেউ যখন আমাকে এসে বলেছেন— ম্যাথিউ, আমি মদের নেশা বা মাদকের নেশা ছাড়তে চাই, আমি বিনা দ্বিধায় তাঁকে সাহায্য করেছি যেটুকু পারি। আমার মতে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এটাই। আমি খুব চাই, আমি মরে গেলে লোকে আগে এটা মনে রাখুক। কিন্তু আমি জানি, লোকে আগে ‘ফ্রেন্ডস’-কেই স্মরণ করবে।’
আজীবন ‘ফ্রেন্ডস’-এর একজন পাগল ভক্ত হিসেবে এই লেখাটা শেষ করতে ইচ্ছে করছিল ‘বিদায় চ্যান্ডলার বিং’ লিখেই। কিন্তু কৈশোরের ভালবাসার মানুষটার এই ইচ্ছের সামনে মাথা নত করে বলতে চাই, বিদায় ম্যাথিউ ল্যাংফর্ড পেরি। নিজের সমস্যার সঙ্গে সারা জীবন লড়াই করেও আপনি আর দশটা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। Could you be more of a hero?