সুধাংশুদা বলেছিলেন, ‘আরেকটা নাও! সবে তো সাড়ে আটটা! কোথায় থাকো, কোথায়?’
প্রদ্যোত বলেছিল। শুনে সুধাংশুদা বলেছিলেন, ‘তবে? বেশি দূরেও তো নয় যে রাত হয়ে গেলে বাড়ি ফেরার গাড়ি পাবে না! এই যে আমাদের মিহির…’— আশেপাশে চার-পাঁচটা টেবিলজুড়ে সাঙ্গোপাঙ্গরা যে যার মতো মাল খেয়ে যাচ্ছিল পছন্দমতো চাট-সহযোগে, তাদেরই কোনও একজনকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ও থাকে সেই সীতাগাছি, ট্রেন থেকে নেমে ভ্যানরিকশা করে বাড়ি যেতে হয়— দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে! খাবে না কেন? আর কারও পয়সায় তো নয়, নিজের পয়সায়, নিজের রোজগারের পয়সায় খাচ্ছে, খেয়ে যাচ্ছে! তুমিও খাও!’
‘না, মানে, আসলে…’
‘বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘বাবা, মা’
‘বউ নেই? সে কী! ফুটে গ্যাছে?’
‘বিয়েটা আসলে করা হয়নি!’
‘বিয়ে করোনি? সে কী! কেন? চাকরি তো বেশ কিছুদিন করছ! আমাদের গোয়ালে ঢোকার আগেও তো চাকরি করেছ, তবে? প্রেম করছ না কি? প্রেম করলে অনেকেই বিয়ের আগে ব্রহ্মচর্য পালন করে!’
‘না, না, সেসবও নয়!’
‘তবে বিয়ে হচ্ছে না কেন? বাঙালির ছেলে! তুমি কি প্রফুল্ল?’
‘প্রফুল্ল আমার বাবার এক মামা! আপনি চেনেন?’
‘আরে গেল যা! বাংলা বোঝে না! তুমি কি সম?’
‘সম— কী?’
‘ধ্যাত্তেরিকা! হোমো বোঝো, হোমো? তুমি কি হোমো?’
কান লাল হয়ে গিয়েছিল প্রদ্যোতের।
‘না, না, লজ্জা পাবার কিছু নেই, এখন এসব লুকোচাপার ব্যাপার নয়! বুক ফুলিয়ে গলা উঁচিয়ে বলবে!’
মাথা নীচু করে প্রদ্যোত ঘাড় নেড়ে না বলতে বলেছিলেন, ‘তাও না! তাহলে তো বিয়ে না-করার কোনও কারণ দেখছি না! এই জগদীশবাবু! আপনার কোন শালি না শালির মেয়ে— কার জন্যে পাত্র খুঁজছেন বলেছিলেন না?’
একটা কোণের টেবিলে একলা বসে একজন রাম খেয়ে যাচ্ছিলেন, একগাল খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, চোখে মোটা নীলচে লেন্সের ভারী চশমা, কথাটা নিশ্চয়ই তার উদ্দেশে বলা। ভদ্রলোক দ্রুত মুখ নেড়ে কী সব বলতে শুরু করতেই সুধাংশুদা বলেছিলেন, ‘কী বলছেন? শুনতে পাচ্ছি না!’
‘না পেলেই ভাল!’ গলা তুলেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘শুনলে ভাল্লাগবে না! খিস্তি দিচ্ছি!’
‘সে খিস্তিই হোক আর যাই হোক, যেসব কথা জোর গলায় বলতে পারেন না, সেসব কথা বলতে যান কেন! যাক গে! গোপাল, এখানে মাল দাও। এনাকে আর আমাকে। আর তুমি শোনো, প্রদ্যোতবাবু, বাবা-মা যদি বিয়ে দিতে রাজি না হয়…’
‘কার বাবা-মা?’
‘সে তোমারই হোক বা যাকে বিয়ে করবে তারই হোক, সবার বাবা-মাকে রাজি করাবার দায়িত্ব আমার!’
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বাবা দরজা খুলে দিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে সরে গিয়েছিলেন। দেরি হবার কারণ জেনে মা বলেছিলেন, ‘নতুন আপিসে ঢুকতে-না-ঢুকতেই এত কাজ! এর জন্যে কি মাইনে বেশি দেবে?’ তারপর বারদুয়েক নাক টেনে বলেছিলেন, ‘কীরকম যেন একটা টোকো, মোদো-মোদো গন্ধ বেরোচ্ছে না?’
‘আপিসে সব পালিশের কাজ হচ্ছে, তার মধ্যে বসে কাজ!’
‘জামাকাপড় সব কাচতে ফেলে দিয়ে, তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এসো, মাঝরাত্তির পর্যন্ত আর এই নেতুড় নিয়ে বসে থাকতে পারব না! আবার তো সেই ভোর থেকে উঠে কাঁধে জোয়াল যুতে লেগে পড়তে হবে!’
দু-তিনদিন গিয়ে চতুর্থ দিন প্রদ্যোত আর মালের আড্ডায় গেল না। ছুটির পর নেশাড়ুদের হাত এড়িয়ে আপিসের ভেতরেই এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে, শৌচালয়ে বহুক্ষণ কাটিয়ে, ছুটি হবার বেশ কিছুক্ষণ বাদে বেরোবার জন্যে মেন গেটে পৌঁছে দেখেছিল ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে! বৃষ্টি থামবার জন্যে অপেক্ষা করা উচিত না ভিজে-ভিজেই সামনের বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া উচিত সেই নিয়ে যখন ভাবনা-চিন্তা করছে, তখনই পেছন থেকে এসে কেউ তার কাঁধে থাবড়া মেরেছিল। স্বয়ং সুধাংশুদা!
‘তোমারও দেরি হয়ে গেল! ছিলে কোথায়? ডিপার্টমেন্টে দেখলাম না তো?’
‘আ-আমি আজ যাব না সুধাংশুদা।’
‘আজ যা ওয়েদার না, দারুণ জমবে!’
‘না না, আজ আমি যাব না!’
‘কেন? কী হয়েছে? এই গাড়ি এসে গেছে। চলো, ওঠো, যেতে-যেতে শুনব!’
‘আসলে আমার টাকার খুব দরকার সুধাংশুদা।’ গাড়িতে বলেছিল প্রদ্যোত।
‘আরে! সে আর কার নয়? আমারও টাকার খুব দরকার, নইলে এই ছাতার চাকরি করে কেউ? ওটা কোনও কথা নয়।’
‘না, মানে আমরা খুব গরিব না হলেও, বড়লোকও নই।’
‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার! বুঝেছি!’
‘মানে, বলতে পারেন আমি ফ্যামিলির সোল না হলেও, মেজর আর্নিং মেম্বার। বাবা আছেন, খুব সামান্য পেনশন পান, অসুস্থ। দুই বোন আছে, ছোট-ছোট, এখনও পড়ছে— একজন কলেজে, ছোটটা এখনও স্কুলে।’
‘সে ঠিক আছে, সময়ে ঠিক বড় হয়ে যাবে। তাতে মাল না খাবার কী, সেটা তো বুঝলাম না?’
‘না, মানে মাল খেয়ে টাকা নষ্ট করা আমার একদম উচিত না!’
‘নষ্ট বলছ কেন? আমাদের ঠেকটা কিন্তু খুব ভাল। ওই দামে যে মাল দেয়, জেনুইন মাল, কোনও ভেজাল নেই, কোত্থাও পাবে না, আমি বলছি! আর পাতি রাম খাও তো তুমি? বেশি-ও খাও না! সে আর ক’টাকা গো?’
‘সেই ক’টাকাও আমার নষ্ট করা উচিত নয় স্যার।’
‘ও! তুমি তাহলে যাবে না? কোথায় যেতে চাও বলো?’
‘বাড়ি যাব।’
‘সে তো যাবেই! সেখানে যেতে গেলে কোন স্টেশন যাবে, হাওড়া না শেয়ালদা? এই, গাড়ি থামাও! বাঁয়ে রোকো। শুধু-শুধু তোমায় এতদূর টেনে নিয়ে এলাম গো! স্টেশনে পৌঁছে দিতে বলব?’
‘না, না তার দরকার হবে না। আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন, আমি চলে যাব।’
সেদিন বাড়ি ফিরতে অন্য দিনের মতো দেরি হয়নি, তুলনায় একটু তাড়াতাড়িই হয়েছিল বরং। মা দরজা খুলে হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘ওরা এসেছিলেন, মিস্টার আর মিসেস অধিকারী! বেশ খানিকক্ষণ আগেই চলে গেলেন! তোর ফিরতে দেরি হবে কি হবে না জানতুম না তো, তাই আর আটকাইনি! হাত-মুখ ধো, চা করে দিই, চায়ের সঙ্গে কিছু খাবি?’
মিস্টার আর মিসেস অধিকারীটা যে কে, বুঝতে পারছিল না প্রদ্যোত। চা দিতে-দিতে বড় বোন রুমকি বলেছিল, ঋতুপর্ণার বাবা-মা। ‘ওরা খুব বড়লোক, না রে? যেমন সব সাজপোশাক, তেমনি পারফিউম! মস্ত বড় একটা গাড়ি করে এসেছিল।’
বাবা এসে কাছে বসে বলেছিলেন, ‘এসইউভি! ড্রাইভার ছিল।’
এরা কারা, ঋতুপর্ণাটাই বা কে— কিছুই বুঝতে পারছিল না প্রদ্যোত। নীরবে চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিল। এক বাটি চিঁড়েভাজা নিয়ে এসে মা বলেছিলেন, ‘শনিবার তোদের আপিস বন্ধ থাকে শুনে বলে গেছেন, সামনের শনিবার সকালে তোকে ওদের বাড়ি যেতে।’
ওদের বাড়িটা কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল প্রদ্যোত, এমন সময়ে তার বাবা একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে মোটা করে গোবিন্দ অধিকারীর নাম, তার নীচে তাঁর আপিস আর বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, ই-মেল, ওয়েবসাইট ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের যোগাযোগের হদিস বিস্তারিতভাবে ছাপানো ছিল। প্রদ্যোতের বাবা এক নাগাড়ে অধিকারীদের কোথায়-কোথায় কীসের দোকান আছে, কাদের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ আর এজেন্সি আছে, কোথায় খানদুয়েক ছোটখাটো কারখানা আছে, সাবেক বসতবাড়ি ছাড়া কোথায়-কোথায় আরও বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে— এইসব ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে কিছুই বুঝতে পারছিল না প্রদ্যোত। তারপর যখন শুনেছিল, ঋতুপর্ণা নামের মেয়েটির কাছে থাকা প্রদ্যোতের একটা ক্লাসনোটের খাতা থেকে ওরা এ-বাড়ির ঠিকানা পেয়ে এসেছিলেন, তখন আন্দাজ করতে পেরেছিল এ তাহলে মহিম স্যারের কোচিং ক্লাসের জুনিয়র ব্যাচের সেই মেয়েটি— যার বয়-কাট চুল, কানে ঝোলা দুল, গলায় ঢ্যাবলা-ঢ্যাবলা পুঁথির মালা, হাঁটু-ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট আর বুকের বোতামখোলা শার্ট পরে যে কোচিং ক্লাসে আসত! সাধারণত ওদের ক্লাস শেষ হবার পর প্রদ্যোতদের ক্লাস শুরু হত।
কিন্তু প্রদ্যোত বা সেই ঋতুপর্ণা নামের মেয়েটি কেউই একে অপরকে দেখে কখনওই কোনও ভাবে আপ্লুত হয়নি! তাই এই এতদিন বাদে তাদের বাড়ি যাবার কী কারণ থাকতে পারে সেটা প্রদ্যোত বুঝতে পারছিল না। বলে ফেলেছিল, ‘ওদের বাড়ি গিয়ে আমি কী করব!’
‘কথাবার্তা বলবে!’ মা বলেছিলেন, ‘ওরা তোমার সঙ্গে ওদের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি আছেন।’ বাবা বলেছিলেন, ‘তোমার কাজকর্মের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে না! চাইলে এখনকার চাকরিও তুমি ছেড়ে দিতে পারো। বুঝলে তো! ওদের যে-কোনও একটা কোম্পানিতে উঁচু পোস্টে ওরা তোমায় ফিট করে দেবেন, ইচ্ছেমতো আপিস যাবে-আসবে, মোটা মাইনে, বাড়ি-গাড়ি, সোশ্যাল স্টেটাস সবই পাবে!’
সেই শনিবার প্রদ্যোত মা-বাবার তাগাদায় ভোর-ভোর উঠে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সকাল এগারোটা বাজার আগেই অধিকারী ম্যানসনে পৌঁছে গিয়েছিল। দেওয়ালে বাঁধা ভোঁতা পেন্সিল দিয়ে ভিজিটর্স স্লিপে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর— যেখানে যা লেখার সব লিখে পাহারাদারের হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘মিস ঋতুপর্ণাজিকো সাথ ভেট করনা হ্যায়, সমঝা না?’
খানিক বাদেই হাউসকোট পরা এক থলথলে মহিলা হাঁসফাঁস করতে-করতে এসে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলেছিলেন, ‘ইজ দিস প্রদ্যোত? ওহ্! হাউ স্যুইট! গোভিন্ডা ইজ স্টিল ইন বেড, আয়্যাম গোডাভরি! ঋতু’জ মাদার।’
প্রদ্যোত কোনওরকমে বলেছিল, ‘ঋতুপর্ণা?’
‘ওহ্! শিওর, অফ কোর্স! হোয়াই নট! জাস্ট কলিং হার…’ বলে লাল রঙের একটা টেলিফোনের দু-তিনটে বোতাম দ্রুত টিপেছিলেন। বার তিনেক বোতাম টিপেও বোধহয় সাড়া পাননি, বলেছিলেন, ‘নটি গার্ল! শি ইজ সো শাই! রেসপন্ড করছে না। তুমি কাইন্ডলি আর একটু বোসো প্লিজ। আমি ওপরে গিয়ে দেখছি ও কী করছে।’ বলে, থলথল করতে-করতে চলে গিয়েছিলেন।
আরও অনেক পরে উর্দিপরা এক পরিচারক এসে প্রদ্যোতকে ওপরে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসিয়েছিল। বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত ঘরটির জানলা-দরজা সব বন্ধ ছিল, নিশ্চয়ই এসি চলছিল বলে। একটু পরেই দরজা ঠেলে স্লিপিং স্যুটের মতো সুতির ঢোলা পাজামা আর শার্ট পরা একটি রোগা মেয়ে ঘরে ঢুকেছিল। তার বয়কাট চুল কিন্তু কানে ঝোলা দুল বা গলায় মালা ছিল না। ফোলা-ফোলা লাল চোখ। ও কি কাঁদছিল!
‘হাই প্যাডি! হোয়াটস্ আপ?’
‘তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
‘বলো।’
‘এখানে বলব?’
‘নইলে কোথায় বলবে? ছাদে তো যাওয়া যাবে না, বারান্দাতেও না। বাইরে যাবার সব দরজা তো তালাবন্ধ, সেসব তালার চাবি নাকি আবার হারিয়ে গেছে! এত তালা তো তুমি ভাঙতে পারবে না। যা বলার এখানেই বলতে হবে, বলো।’
তার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে প্রদ্যোত ঝুঁকে পড়ে নীচু গলায় জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও? কেন ঋতুপর্ণা?’
‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই? শিট! কে বলেছে?’
‘যেই বলুক, আমি তোমার কাছ থেকে সরাসরি জানতে চাই।’
‘কী? আমি তোমায় বিয়ে করব কি না? হোয়াট আ জোক! কী করে করব? আমি যে ট্রান্সম্যান! বুঝতে পারছ? আমি ছেলে হয়ে যাচ্ছি! তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাইবে?’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র