কয়েকটি কবিতা
১
কত চিঠির উত্তর আসেনি,
কত ফোন বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে,
দেশ ছেড়ে যাবার আগে আগে মনে পড়তে থাকে এসব।
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি
ট্রাফিক গার্ড খুলেছে ছাতা, কিশোরী তুলে নিচ্ছে ফুলের পসরা।
ভিতরে, বিমানবন্দরে তখন অপেক্ষা।
পরের উড়ান তোমাকে নিয়ে চলে যাবে দূরে কোথাও।
আশঙ্কা থেকে, দুঃখ থেকে দূরত্ব তবু তৈরি হবে না।
তুমি দরদাম করো নতুন জুতো ও হুইস্কি কিছু
আলোয় সাজানো এই শীতল বিপণি যত
তোমাকে ভুলিয়ে দিতে চায় ব্যথার আরাম। বিদায়কালে বিমানবন্দরের চেয়ে বড় বন্ধু আর হয় না।
২
তরিবত বোঝে না এই মন। আলগোছ জানে কেবল।
পুরনো আলনায় ভুলে যাওয়া শাড়ির মতোই সে থাকতে চেয়েছিল
থেকে যেতে চেয়েছিল ঝুলনের পর্বতমালার মতো
নিদেনপক্ষে মুদিখানার ফর্দে আঁকাবাঁকা হাতের লেখা যেমন
তেমন সে থেকে যেতে চেয়েছিল কোথাও।
এই গুছিয়ে রাখা তার স্বভাবে নেই।
এই ভাঁজ করে তুলে রাখা, পাট করে রাখা জীবন
তাকে স্বস্তি দেয় না।
সে নেমে আসে নদীর চরে, পাটকলের ধারটায়
যেখানে হরেন মণ্ডল খুন হয়েছিল
আর দীপা চুমু খেয়েছিল বরুণকে
সেখানে সে বাতাস সেজে ঘুরে বেড়ায়, কাঁদে, খেলা করে।
তুমি বাড়ি ফেরার পথে, সাজানো মানুষ, তাকে মন বলে চিনতে পারো না আর
৩
বানিয়ে লেখা কবিতার মতো তোমার হাত।
ভারি মোলায়েম, অথচ স্পর্শ নেই কোনও।
মাঝে কতশত যুদ্ধ হয়ে গেল দেশে
কত মানুষ চাষ করতে বেরিয়ে আর ঘরে ফিরল না
গাছে গাছে হারিয়ে গেল কত মেয়ের ঝাঁক
কত নেকড়ে ডেকে উঠল টিলার উপরে
সেসবের কোনও চিহ্ন তোমার হাতে নেই।
আছে কেবল বিয়ের নিমন্ত্রণ, সন্ধেবেলা মৃদু আড্ডা
আর থিয়েটারের বিজলি আলো।
আমি, বোকা লোক, তোমার হাত ধরতে এসে কেবল একা হয়ে যাই
৪
খেলা কখনও উঁচু থেকে দেখতে নেই।
তাতে দৌড় বোঝা যায় না, গতি বোঝা যায় না
ঘামে ঘামে ঘষে যাওয়া শরীরের ছোঁয়া বোঝা যায় না
ট্যাকল-এর মুহূর্তে সারাজীবনের লড়াই ঝলসে ওঠা দুটো পা
দেখা যায় না ওই অত উঁচু থেকে।
দেখা যায় না গোল বাঁচানোর মুহূর্তে কিপারের মরণঝাঁপে
কতখানি জেদ লুকিয়ে থাকে।
কেবল আলো, কেবল শব্দ, কেবল হুল্লোড় আর কেবল হতাশা দিয়ে
খেলা বোঝা যায় না।
তোমাদের প্রেম, খেলা যত, আমি উঁচু থেকে দেখেছি। সম্পর্ক বুঝিনি তাই, হাওয়ায় টিকিট উড়ে গেছে।
৫
মাননীয় ভালবাসা, তোমাকে বসাই এনে পোর্টিকোর নীচে।
এখানে বাতাস বেশি, ছায়া সুনিপুণ।
মাঝেমধ্যে মালির যাতায়াত তোমাকে দেবে গাছগাছালির খবর
কখনও পরিচারিকা মেয়েটি দ্রুত পায়ে ছুটে গেলে বুঝবে
বাড়িতে কেলেঙ্কারি হয়েছে।
ছোট ছেলে বিদেশে
তার চিঠিও এ-পথ দিয়েই আসে।
সে-দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, ইতিহাস ও মুদ্রা
তুমি সেসবেরও ছোঁয়া পেতে পারো চাইলে।
কেবল উড়িয়ে ধুলো মোটরকার এসে দাঁড়ালে
উঠে যেতে হবে তোমাকেও।
৬
অন্ধের লেখা গীতিকবিতা এ-দেশের বাতাসে ঘোরে।
ঘুরে বেড়ায় শিকারি বিষয়ক নানা প্রবাদ, জলের তোড়ে।
নদীর সঙ্গে বাজেট নিয়ে কথা বলে নুড়িপাথরেরা
আসন্ন বিপ্লব নিয়ে চিন্তিত গাছেদের দল।
তারই মাঝে তুমি এলে বেমানান লাগে
ওই রোদচশমা, ওই রুটম্যাপ, ওই ব্যাকপ্যাক সভ্যতা
জীবনের সব বোধ ভাঁজ করে পকেটে পুরে নেবার
ওই ঔদ্ধত্য এরা শেখেনি।
এই ট্যুরিস্ট-মন, এই জিপিএস-চোখ খুলে রেখে
যদি পারো, জলে নামো। হাত রাখো গাছের গায়ে।
বেঁচে ওঠো একবার। নিজের চেহারা দ্যাখো আয়নায়।
ভালবাসো।