ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • জেম্মা


    পম্পা বিশ্বাস (August 20, 2023)
     

    এই ঘরটা থেকে আমি বেরোতে চাইছিলাম বরাবরের মতো। ফর এভার। কিন্তু যাওয়ার জায়গা সীমিত। পকেটও ফাঁকা। পলেস্তরা-খসা এই বেখাপ্পা দেওয়ালগুলো, দুই-এক খোপ ছোট-ছোট নোংরা জানলা, কালচে সিমেন্টরঙা অন্ধকার অন্ধকার মেঝে…। সব কিছু থেকে ঝোঁক ওঠে বিবমিষার। সঙ্গে আছে পরীক্ষা দিয়ে-দিয়ে বসে থাকা এবং চাকরি না পাওয়া! চাকরি কেনার পয়সা থাকলে তো কথাই ছিল না। কীভাবেই বা সেটা থাকবে… চুরির কারণে চাকরি-খোয়ানো বাপের ছেলের? আমার জন্মের আগেই সেইসব কাণ্ড ঘটে গেছে। আর এখন এবারের ডব্লু.বি.সি.এস. দিয়ে ফ্যা-ফ্যা করছি। এই নিয়ে দু’বার হল। এদিকে, এই জঘন্য ঘরটা আমাকে পেটের মধ্যে নিয়ে বসে আছে। তবে এখন আমি বেরোব। বেরোতেই হবে। এবং… অগত্যা… ফাঁকা পকেটেই। বেরোলে কিছু আমদানিও হতে পারে। কিন্তু যাব কীভাবে? উপায় একটাই। সেটা হল হাঁটা। হাঁটতে হবে। তা ছাড়া, চেনা ডাকটাও যেন শুনতে পাচ্ছি বাতাসে। ক্ষুধিত পাষাণের প্রতিটা প্রস্তরখণ্ড আমায় ডাকছে। টুপি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার আগে-আগে। কাজেই…।

    … সেখানে গিয়ে পাব, পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে সাজানো তার খাতা। চূর্ণ-বিচূর্ণ কবিতায় ভরা। ঝরাপাতা আর হেমন্তের দীর্ঘশ্বাস। বিষাদ এবং অনেক অনেক ঋণাত্মক অনুভূতি। সারা জীবন ধরে বিন্দু-বিন্দু এইসব কবিতার সঞ্চয়। ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত! কবিতারা আর্ত। কথা বলে। কাঁদে।

    এই তো আমার ধমনীতে কম্পন।
    এসো, তোমার মস্তক আঘ্রাণ করি।
    ভেঙে-ভেঙে টুকরো-টুকরো আয়নার কাচে
    বৃদ্ধ মুখাবয়ব ছিন্ন-ভিন্ন আমার—
    খসে-খসে যায়
    শুকনো পাতারা অফুরন্ত।
    আয়, তোকে আলিঙ্গন করি।

    হয়তো মুক্তির তীব্র আগ্রহ ছিল। তাই এই রোদ, এই উন্মাদ গরম সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। অবিশ্রান্ত হন্টনে প্ররোচিত হয়ে পড়ি। হাঁটি আর হাঁটি। হাঁটতেই থাকি। এক-কামরার ওই সস্তা অথচ পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাটের দরজা আমার জন্য সর্বদা খোলা। সাদা লেসের ভারহীন হালকা পর্দা জানলায় হাহাকার করে ওড়ে। অ-কুলীন দেওয়ালের চুনকাম-খসা কদর্যতাকে আবডালে পাঠায় স্বপ্নপ্রতীম ওই পর্দাগুলো। আর আছে কবিতার অস্পষ্ট উচ্চারণ।…সামান্য কথা। একটু স্পর্শ।

    ‘রোদে তুই আগুনের মতো লাল হয়ে গেছিস।’

    ‘হ্যাঁ, জেম্মা।’

    ‘আয়, বোস।’

    সোফার অভাবে বালিশ-বুকে বিছানায় আধশোয়া আমি। প্রকৃতপক্ষে, মাইলের পর মাইল হেঁটে ধরাশায়ী।

    ‘জল…’

    ‘এই নে, নুন-চিনির লেবুজল। আরাম হবে। করে রেখেছি। যদি তুই আসিস। ভাবছিলাম, আসবি।’

    পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম, ‘আমি তো ফোন করিনি!’

    ‘তবু মনে হল।’

    ব্লাশ করল জেম্মা। অদ্ভুত সলজ্জ ভাব পঁয়ষট্টির ওই প্রাচীন মুখে। বলিরেখার তলায় তলায় তৃষ্ণা।

    ‘খাতাটা আনো।’

    ‘পরে। আগে এটা নে।’

    উঠে বসি, ‘কী এটা?’

    ‘পায়েস। বৃদ্ধা সুজাতা তরুণ বুদ্ধকে পরমান্ন নিবেদন করছে। হুঁঃ হুঁঃ হুঁঃ।’

    শুকনো, খিন্ন হাসির মতো আওয়াজ হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার। তাকাই না। খেতে থাকি।

    ‘বাহ্‌! বেশ ভাল হয়েছে।’

    পর্দারা ওড়াউড়ি করছে। দেখতে-দেখতে বিড়বিড় করি, ‘কবিতা আনলে না?’

    ওর দিকে না তাকিয়েও আমি জানি, অতি সাধারণ, অ-সুশ্রী গাল-ভাঙা মুখটায় আলো ফুটে উঠেছে।

    ‘তোর ভাললাগা আমায় বাঁচিয়ে রাখে।’

    ‘তুমি এমনিই বাঁচবে, জেম্মা।’

    ‘তোর মায়ের কোল থেকে প্রথম যখন তোকে কোলে নিয়েছিলাম, তখন কি জানতাম, হাড়ে-মাসে-মজ্জায়-দাড়িগোঁফে এক অনিন্দ্য যুবক হয়ে ফিরে এসে আমারই জীবনে তুই এতখানি হয়ে থাকবি? সেই শিশুর সঙ্গে তোর কোনও সম্পর্ক নেই। যেন তুই নতুন এক স্বয়ম্ভু।’

    হাসলাম, ‘আচ্ছা, আচ্ছা! দেখি খাতাটা।’

    স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ভাসতে-ভাসতে জেম্মা খাতা এনে দিল। চাতকের মতো বসে রইল সামনের চেয়ারে।

    ধূসর হেমন্ত দিয়ে গেল
    এক রক্ত-গোলাপ
    এক আগুনে পলাশ—
    আর চোখের সামনে দিয়ে
    ঝড় তুলে উড়ে গেল
    ঝরাপাতার দল।
    এই উত্তাপ, এই উত্তাপ, এই উষ্ণতা
    … আমার মনমণ্ডলে সে।

    দ্বিপ্রাহরিক আরও-আরও সুখাদ্য পেটে পুরে, ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। খুব গভীর হতে চলেছিল হয়তো দিবানিদ্রাটি। হঠাৎ অস্পষ্ট ভাবে জাগরণ আসে। চেতন-অচেতনের মধ্যে স্পর্শ অনুভব করি কপালে। চুলের ভিতর বিলি কাটছে কয়েকটি আঙুল। যদি এতে কোনও গোপনচারিতা থেকে থাকে! নড়লে-চড়লে যদি কেউ লজ্জায় পড়ে! তাই কাষ্ঠবৎ আমার শরীর। ক্রমে ঘুম, না-ঘুম মিলেমিশে যেতে থাকে।

    চুলের অরণ্যে আঙুল চালাতে-চালাতে বহুযুগ আগের একটি ক্ষণ মনে পড়ে অঙ্গুলিসঞ্চালিকার। হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে তেইশের এক প্রেম-তরুণীকে দাঁড় করিয়ে রেখে সটকে পড়েছে জলজ্যান্ত প্রেমিকটি। আর, অধীর আগ্রহে, অকথ্য বিশ্বাসে ভর করে সেই তরুণী সময় গোনে। গুনেই চলে। কেউ আসে না। পরে জানা গেছে, সে সটান দেশ-গাঁয়ে ফিরে গিয়ে এক ফাইভ-পাস রূপসীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।

    ‘আর কখনও ওই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছে?’

    ‘হ্যাঁ, এই সরকারি হাউজিংয়েই সে থাকে। পথে হঠাৎ একদিন দেখা, পালিয়ে যাওয়ার আঠাশ বছর বাদে। সে তখন কোনও এক বেসরকারি সংস্থার চাকরি-ছুট মানুষ। ফ্ল্যাটটায় ওর কোনও সম্পন্ন আত্মীয় ওকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। ফ্ল্যাট ওর নয়।’

    ‘কী বলল?’

    ‘ও বাবা! ক্ষমা-টমা চেয়ে একশা। পরের দিনই দেখা করতে এল। আমি উদ্‌গ্রীব ছিলাম।’

    ‘তারপর?’

    ‘কিন্তু সে এসেছিল, তার বউ-এর জন্য কোনও চাকরির সুযোগ হয় কি না দেখতে। রাজনীতির যোগাযোগে যদি আমি কোনও সুরাহা করে দিতে পারি। সে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে, লাল শাসকপক্ষের সেজ-শরিকের একদা জনৈক নেত্রী ছিলাম। কাজেই, সে বলেছিল, ‘একটু দেখো না। বড় দরকার চাকরিটার। সংসার চলছে না গো।’ আমি সেদিন কেঁদেছিলাম।’

    শৃগাল-সম্মুখে ভেঙে ভেঙে যায়
    ক্রিস্টাল ফুলদানি
    ভাঙা খানখান টুকরোগুলো
    এক এক ঢোক পানি
    হয়তো-বা।
    কিন্তু এখন অপেয় তা।

    হাওড়া স্টেশনের ঘটনার কয়েক বছর পরে জেঠু এসেছিল জীবনে। জেঠুর সঙ্গে কী হয়েছিল তা খানিক-খানিক জানা। শরীরের যোগসূত্র হারিয়ে গেছিল বহুদিনই। জেঠু বাঁধা পড়েছিল এক বেশ্যা-শরীরের সঙ্গে।

    ‘না রে। কোনও ভুল তো সে করেনি। যাতে তার শান্তি, যাতে তার আনন্দ, সে তো সেই পথেই গেছে। মহিলা-পড়ুয়া, মহিলা-লিখিয়েদের কাছে এলে বহু পুরুষেরই দম বন্ধ হয়ে আসে। সবাই তুই নোস। তবে এটাও কথা নয়। হয়তো আমার মধ্যে সহজতার অভাব আছে। হয়তো আমার সঙ্গে কথা চালানো যায় না। হয়তো আমার মন এবং শরীর তার কাছে কাম্য ছিল না। ঠিকই করেছে সে, আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে। তার প্রতি ভালবাসা আমারও তো মরে গিয়েছিল। তবে? আমি কেন হিপোক্রিটের মতো তাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম?’

    এসো নতুন পথে হাঁটি
    এসো নতুন পাতা হয়ে জাগি
    এসো ভেজা চোখ
    মুছে ফেলি চটপট
    এসো নতুন রৌরবে জমাই পাড়ি।

    মনে-মনে ভাবছিলাম, যে-লোকটা দেশ-গাঁয়ে ফিরে গিয়ে বিয়ে করেছিল, সে-লোকটাকে পরবর্তীতে মিট করার জন্য তুমি ‘উদ্‌গ্রীব’ ছিলে। তোমার কথাতেই জেনেছি। তোমার উদ্‌গ্রীব হওয়ার বহিঃপ্রকাশ কেমন তা আমি অনুমান করতে পারি। যেমন, তোমার গোছহীন পাতলা লম্বা চুল তুমি অন্তত পনেরো মিনিট ধরে আঁচড়েছিলে মাথা থেকে শেষ-পর্যন্ত। তৈলচিক্কণ গোছাটি ধরে টেনে একটা পরিচ্ছন্ন এলো-খোঁপা করেছিলে। মুখে মেখেছিলে ফেসপাউডার। তারপর সেটা নরম কোনও ন্যাকড়া দিয়ে মিনিট তিনেক ধরে ঘষে-ঘষে উঠিয়ে ফেলেছিলে। তোমার এই সাজগোজের পদ্ধতি ছোটবেলায় নজর করতাম। তোমার স্কুলে বেরোনোর সময়ে। এরপর পরিপাটি করে একটি অরগেন্ডি শাড়ি পরিধান। অন্তত মিনিট দশেক তোমার লাগত শাড়ি পরে, কুচি ও আঁচল পাট-পাট করে সেফটিপিন আটকাতে। তারপর প্রতি মুহূর্তে টেনেটুনে ঠিকঠাক করতে আঁচলটা। আর বার বার মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে নিতে বুকের আঁচল যথাস্থানে আছে, না কি স্খলিত। তুমি সদা দ্বিধান্বিত থাকতে… এখনও ঠিক তাই-ই আছ। একবার বুকের আঁচল টানটান করে আঁট করে নিতে, পরমুহূর্তে খানিক ছাড় দিয়ে সেটা একটু আলগা করতে। কতটা লুজ হবে সেটা নিয়েও নিজের সঙ্গে দরকষাকষি চলত। এই টাইট তো এই লুজ! খানিকটা স্খলন চাইতে কি? তোমার কবি-মনে এত আঁটিসাঁটি পোষায় না, তাই না? কিন্তু হয়তো তুমি চাইতে আঁচলের পাড় তোমার ডান স্তনবৃন্তের চূড়া দিয়ে ত্রিভুজ অঙ্কন করে স্থিত থাকুক। বগলের দিকে ঢুকে গিয়ে ত্রিভুজের তীক্ষ্ণতা না হারায়। তাই এত টানাটানি হয়তো। এখনও তোমার মধ্যে সেই অভ্যাসের প্রকাশ দেখতে পাই।… ওই লোকটার জন্য উদ্‌গ্রীব অপেক্ষার কালে বুঝি ওইসব ক্রিয়াকলাপে ব্যাপৃত ছিলে? আর লোকটা এসেই তোমার সমস্ত সাগ্রহ প্রতীক্ষায় জল ঢেলে নিজের বউয়ের জন্য করেছিল চাকরির উমেদারি।… যা হোক একখানা চাকরি। অফিসের বেয়ারা কিংবা ইস্কুলের বাচ্চা-সামলানো মাসি। যত তুচ্ছ-ই হোক, কিছু তো পয়সা আসবে। বড্ড দায়ে পড়ে আসতে হয়েছে যে!

    আমার জরার শরীর
    দেখো না দেখো না দেখো না
    শুধু থেকো আমার পাশে
    আমার কোলে থাকুক তোমার মাথা
    ঘন কুন্তলে ছয়লাপ।
    … তোমাকে সর্বদা অনুভব করি।

    কেন যে আমার এত স্মৃতিশক্তি! কেন যে একবার চোখ বোলালেই কবিতারা মাথায় গেঁথে গিয়ে অনুরণন তোলে! উঃ! মাঝে মাঝে কষ্ট পাই। ঘুমে-জাগরণে সবসময়ে ওদের আনাগোনা চলে।… এবার কিন্তু ছোট-ছোট ঢেউয়ের ধাক্কা লাগছে শরীরে। দোলন জাগছে।

    ঘরে গিয়ে আরেক ভ্যাগাবন্ড-মক্কেলের সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম-চোরটি চোখ ফিরিয়ে নেবে। এবং ঘরের সবচেয়ে দূরবর্তী ও চরম অন্ধকার কোণটিতে হারিয়ে থাকবে। চোর হিসাবে ধরা পড়ে চাকরি খোয়ানোর পরেও ব্যাটা আমার জন্ম দিয়েছিল— বিনা দ্বিধায়!

    ‘ওঠ রে। অনেক ঘুমোলি।’

    ‘হুঁ।’

    হাই ওঠে বড়-বড়।

    ‘চা খা। আয়, টেবিলে আয়।’

    নড়বড়ে প্লাস্টিকের টেবিল। সাদা লেসের আবরণে ঢাকা। দূর থেকে দেখতে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু ওটায় কাপ-প্লেট রেখে চা খাওয়া দুষ্কর। বড্ড নড়ে টেবিলটা। চেয়ারগুলোতেও সচেতন হয়ে বসতে হয়।

    ‘নাহ্‌। বিছানাতেই দাও।’

    মুগ্ধ অনুনয়ের হাসি ওর (জেম্মার) মুখে।

    ‘ভারি কুঁড়ে রে তুই। শুধু বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকতে ভালবাসিস। আলসে নাম্বার ওয়ান।’

    একজন কুঁড়ে মানুষের প্রতি এত প্রশ্রয় কেন, ভাবি মনে মনে।

    বিদায় দিয়েছি ঝরাপাতা
    বিদায় দিয়েছি দীর্ঘশ্বাস
    নিঃসঙ্গতা ছিন্ন করেছ তুমি।
    বড় সুখের সময় আজ
    অতি কাছাকাছি নিগূঢ় মন্থন—
    রোমাঞ্চিত শোনিত;
    হৃদয় উচাটন— 
    অন্ধকার জলস্রোতে
    আলোর প্রদীপ ভেসে আসে
    এ-ভাঙা ঘাটে।

    চায়ের সঙ্গে বড় এক টুকরো ঘরে বানানো কেক।

    ‘প্রেসার-কুকারে বানালাম তোর জন্য।’

    ‘খাইয়ে-খাইয়ে মোটা করে দেবে দেখছি।’

    ‘না রে, না। এত সুন্দর ছিপছিপে চেহারা তোর। অত সহজে মোটা হবি না। খুব সুন্দরী একটি মেয়ে আসবে তোর জীবনে। দেখিস, মিলিয়ে নিস আমার কথা।’

    আমি এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ
    অন্ধকার জানলায় একা।
    তোমরা দুজনে থেকো মুখোমুখি,
    রোমন্থন কোরো সুখের সাগর।

    হেসে বললাম, ‘মেয়ে না হয়ে ছেলেও তো জুটতে পারে।’

    ‘কী যে বলিস না! ছিঃ!’

    ‘কেন ছিঃ? প্রেম কি সম-লিঙ্গে হতে পারে না? ভালবাসাতে কি ছেলে-মেয়ে, নবীন-প্রবীণ আছে না কি? তোমার মনে হয়? তুমি বিশ্বাস করো?’

    ‘কী জানি রে! হয়তো আছে কিংবা নেই। আমি কনফিউজড।’

    স্থির জলের মতো চোখ তোমার
    এত নবীন কিন্তু এতই গভীর—
    এত তারুণ্য কিন্তু এত প্রাজ্ঞতা।
    দয়া করে আমায় যেও না ছেড়ে—
    তোমার অনুপস্থিত কালেও আমি
    অনুভব করি তোমার শরীর।

    আমার প্রবল নৈকট্যে এগিয়ে আসে জেম্মা। রোগা, শুকনো, শিরাজর্জর হাত ঢুকে যায় আমার শার্টের পকেটে।

    ‘মা-বাবার জন্য আমার হয়ে কিছু নিয়ে যাস, কেমন?’

    স্থির চোখে তাকাই, ‘থাক না। রোজই তো তুমি এসব করছ। মা-বাবারও অভ্যাস খরাপ হয়ে যাচ্ছে। ওরা যদি এখানে আনাগোনা শুরু করে, মাথায় উঠবে তোমার কবিতা লেখা।’

    ‘ওহ্‌! হাসাস না। খুব দুষ্টু তো তুই!… আবার কবে আসবি? আমি রোজ অপেক্ষা করব। আরও কবিতা লিখে রাখব।’

    ‘বনি দিদিকে বলো, তোমার একটা বই ছাপিয়ে দিতে। সৌদিতে বসে শুধু সোনা কিনলেই হবে? মায়ের কাব্যপ্রতিভার জন্য কিছু তো করতে পারে!’

    ‘কাউকে কিছু বলতে পারি না রে। কেউ ছাপাবে না আমার বই। এখনও অবধি একমাত্র পাঠক তুই। তুই না থাকলে কবিতাগুলো আমায় গিলে খেতে আসত। আমার কালু তো আর কবিতা বোঝে না!’

    রোডেশিয়ান কালু-কুকুরকে জেম্মা রোজ খেতে দেয়। অনেক স্নেহবাক্যও বলে। ও প্রায়ই চারতলায় উঠে এসে দরজার বাইরে বসে থাকে। আমার সঙ্গে দেখা হলে ভাঙা লেজটা সামান্য নাড়ে।

    ‘থাক গে, ছাড়ো। আমিই তোমার বই ছাপব। একটা চাকরি শুধু পেতে দাও।’

    ‘পাবি রে, পাবি। এবারই ডব্লু.বি.সি.এস-টা তোর লেগে যাবে, দেখবি। তখন তো তুই দূরে কোথাও পোস্টিং পেলে আর আসতেই পারবি না আমার কাছে। বড্ড একা হয়ে যাব রে।’

    আমার হাতে জেম্মার শুকনো-কাঠি হাতটা।

    … দয়া করে কিছু সময় দাও
    আমাকে তোমার।
    একবার ফিরে এসো।
    বোসো আমার সঙ্গে একই
    পাথরখণ্ডে—
    তারপর তুমি চলে যেও
    পূর্ণ জ্যোৎস্নায় আমায় একা ফেলে রেখে।

    রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, জেম্মা তো জানে, এই টাকা থেকে একটা পয়সাও কাউকে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু জেম্মা প্রত্যেকবার…

    অবশ্য এই অনুদান খুবই দরকার ছিল আমার। এবার বাসে চড়তে পারব।

    ছোট্ট চারাটি
    সজীব বৃক্ষ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় একদিন।
    সতেজ লতাটি তখন শুকিয়ে কঙ্কাল—
    তার শরীর নেই,
    মন আছে শুধু।
    তবুও ওরা বন্ধু হয়ে যায়।

    একটা অদ্ভুত অস্বস্তি জাগে। কী যেন, কী এক অবান্তর ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে যেতে হচ্ছে। কবিতাগুলো কানাগলির অভেদ্য দেওয়ালে মাথা কুটে মরে। অসহ্য একঘেয়েমিতে মাঝে মাঝে মনে বিদ্রোহ জাগে। এটা চলতে পারে না। অথচ এটা চলছেই।

    দূর থেকে হাতছানি আসে।
    তোমার চোখ দ্যাখে নতুন আলো,
    আগুনের ফুলকি উড়িয়ে
    নদীর ধারে মেঠো শ্মশানে
    চিতা জ্বলে ওঠে।
    সব চঞ্চলতার পরিশেষ—

    নাহ্‌! ব্যাপারটা বিরক্তিকর। নিজের ষোলো থেকে আঠেরো আনার দখল নিজে বুঝে নিতে পারা যাচ্ছে না। ছায়ার পাশে প্রচ্ছায়াও যথেষ্ট আগ্রাসী। এদিকে আমার ক্লান্ত পা-দুটো এখন চলন্ত বাসে জাঁকিয়ে আরাম করে নিচ্ছে। যেন এতে আমার জন্মগত দাবি।…শুকনো লতার কি এত ক্ষমতা আছে সতেজ বৃক্ষকে পেঁচিয়ে ধরার? লতার আগ্রাসনে কত গাছ মরে যায় কিংবা নিজের আকার-অস্তিত্ব হারিয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তবে সেগুলো নিশ্চয় সতেজ লতার কাজ। শুকনো লতার সে-শক্তি নেই। ছুঁয়ে থাকা আর পেঁচিয়ে ধরা এক নয়।

    বাস থেকে নামতেই হন্টনরত মায়ের সঙ্গে দেখা। মা ফিরছে।

    ‘কোথাও পড়াতে যাস না কি বাপি? কোনও টিউটোরিয়ালে? বাড়িতেও তো পড়াতে পারিস!’

    ‘নাহ্‌। পড়াতে একেবারে ভাল লাগে না।’

    ‘ভাল লাগে না বললে হবে, বাবা? আমাদের সেবিকা কেন্দ্রটা বন্ধ হবার মুখে। মালিক আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। বলছে, আমার ভুল ম্যানেজারিতে মেয়েরা সব অন্য অন্য আয়া সেন্টারে চলে যাচ্ছে। আমার চাকরিটা গেল বলে! আসলে, আমাকে ছাড়িয়ে দিলে আমার মাইনেটা বাঁচবে।’

    ‘আমি চাকরি পেয়ে যাব, মা। ভাল চাকরিই হবে হয়তো।’

    ‘কিন্তু মাঝখানের সময়টাতে কী হবে?’

    আকুল প্রশ্ন। না শোনার ভান করলাম। মনে-মনে চিৎকার করে উঠলাম এই বলে যে, এরকম চাকরি তুমি আর একটা জুটিয়ে নেবে। নইলে আর-দুটো বেকার প্রাণী খাবে কী? ‘সেবিকা কেন্দ্র’, এই অসহ্য শব্দবন্ধটা শুনলেই আমার বমি-বমি পায়। অথচ জঘন্য এই সেবিকা কেন্দ্রই আমায় ডাল-ভাত-আলুসিদ্ধ-ডিমসিদ্ধ খাইয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে মায়ের থেকে দূরত্বটা অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে হয়। ঘরে গিয়ে আরেক ভ্যাগাবন্ড-মক্কেলের সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম-চোরটি চোখ ফিরিয়ে নেবে। এবং ঘরের সবচেয়ে দূরবর্তী ও চরম অন্ধকার কোণটিতে হারিয়ে থাকবে। চোর হিসাবে ধরা পড়ে চাকরি খোয়ানোর পরেও ব্যাটা আমার জন্ম দিয়েছিল— বিনা দ্বিধায়!

    ওহ্‌, আর পারা যাচ্ছে না। তাহলে কি চাকরি না পেয়ে আমায় আত্মহত্যা করতে হবে? না না, এখনও আমার চাকরির পরীক্ষায় বসার বয়স চলে যায়নি। এখনই আমি মরব না। মরতে পারি না।

    ‘খেতে আয়, বাপি।’

    মা খেতে ডাকছে। 

    ‘আজ আর কিছু খাব না, মা। বন্ধুর বাড়িতে অনেক খেয়েছি।’

    মনে-মনে বিড়বিড় করি— কবিতা সহযোগে প্রচুর ইনটেক হয়েছে আজ। এখন মলিন ভ্যাপসা-গন্ধী বিছানায় অ-কাব্যিক নিদ্রা বাকি। ব্যাস, তাহলেই চব্বিশটা ঘণ্টা শেষ হতে পারে।

    অঝোর বৃষ্টি নিয়ে সেই দিনটা এল, যে-দিনটায় আমি সত্যিই চরম সংকটাপন্ন। বেশ কিছুদিন ধরে শুধুই আলুসিদ্ধ-ভাত চলছে। সেবিকা আয়া কেন্দ্রে মায়ের মাইনে অর্ধেক হয়ে গেছে। শিগ্‌গিরিই চাকরি চলে যাবে। সেখানকার হতভাগ্য ম্যানেজার গরিব মা-আমার আর কতই বা মেনু জোটাবে! এখন বেরোতে হবে। সামনে সাঁতরে পার হওয়ার জন্য রয়েছে দুস্তর পারাবার। ভাঙা হিজিবিজি ছাতায় আত্মগোপন করে লাগাও হাঁটা। রেডি স্টেডি গো-ও-ও-ও।

    বৃষ্টি ধারায় আনন্দস্নান হোক
    বিষাদবর্ষা যায় যদি যাক থেমে
    নয়ানবারি আর না যেন ঝরে

    এসো, একত্র বসত করি ঘরে ওর অল্প কয়েকটা ছন্দের কবিতার মধ্যে এটা একটা। নিজেকে গালাগালি দিতে ইচ্ছে করে। স্মৃতিশক্তি নিপাত যাক। কী লাভ আছে অক্ষরে সাজানো এইসব শব্দবন্ধ এবং বাক্যলহরী মাথার মধ্যে গজগজ করিয়ে? তাও নিজে যদি কিছু বানানো যেত। গুণ বলতে শুধু মনে রাখার ক্ষমতা। আর এটাই হয়তো আমাকে চাকরি-প্রতিযোগিতার বৈতরণি পার করাবে। দেরি হলেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।

    ছাতার ভিতর জল টোপাচ্ছে। পায়ের পাতায় নোংরা প্রবাহ। ড্রেন উপচিয়ে গেছে। পর্দা-ওড়া কবিতা-কক্ষে ঢোকার আগে বাথরুমে পা ধুয়ে নিতে হবে। আজকে গিয়েই চা চাই। নইলে মুড নষ্ট হয়ে যাবে।

    একটাই পেয়ালা ফেনায়িত
    বিষ বিষ বিষ উথলে আছে
    আমার অধর-ওষ্ঠে এই পেয়ালা
    তুলে ধরবে তুমি…
    হ্যাঁ, তুমি তুমি তুমি—

    মাথা ঝাঁকিয়ে মনে-মনে নিজেই নিজের চুল টেনে ধরলাম। বাস্তবে সেটা করা গেল না। কারণ এক হাতে হিজিবিজি ছাতাটা, অন্য হাতে প্যান্ট তুলে ধরেছি।

    ভগ্নদূত এই সরকারি ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে যথেষ্টই জল জমে রয়েছে। নির্দিষ্ট জানলায় উড়ছে সাদা লেসের পর্দা। যেন আহ্বান। কাজেই এই নোংরা জমা-জল পেরতেই হবে। বৃষ্টিও পড়ছে ঝিরঝিরিয়ে। প্রকৃতির কান্না থামেনি এখনও। ডুবিয়ে দিলাম পা, শ্যাওলা শ্যাওলা ফেনা ফেনা জলে। এবার চারতলা আবধি ওঠো রে!… সিঁড়ির ভ্যাপসা গন্ধে প্রাণ যায়। কোনওমতে সিঁড়ি টপকাতে-টপকাতে উপরে ওঠা। যাক চারতলায় পৌঁছনো গেল অবশেষে। কিন্তু এ কী! দরজাটা তো খোলা। যদিও পর্দায় ঢাকা। এমন ভঙ্গিতে পাল্লাদুটো খোলা অবস্থায় স্থির হয়ে রয়েছে যেন কারোর হালকা ধাক্কায় ভেজানো পাল্লা খুলে গেছে। পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে অবাক হলাম। কালু-কুকুর ঘরের মেঝেতে টেবিলের কাছে বসে। সামনে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে জেম্মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমায় দেখে কালুর চোখ মুখ আলো আলো হয়ে উঠল। ল্যাজটাও সামান্য নাড়ল। এই প্রথম ওকে আমি ঘরের মধ্যে দেখলাম। জেম্মাই বলেছে, ও কোনওদিন ঘরে ঢোকে না। দরজার বাইরে বসে থাকে। সে যাই হোক, একটু হাসিই পেল। মনে হল, এই বৃষ্টিতে আজ ও-ব্যাটা কবিতাকামী হয়ে উঠেছে হয়তো।

    ‘জেম্মা’।

    উত্তর নেই। বেশ গভীর ঘুম মনে হচ্ছে।

    কাছে গিয়ে আবার ডাকলাম জেম্মাকে। কালু-কুকুরও উঠে দাঁড়িয়েছে। একেবারে জেম্মার কাছে ওর মাথা।

    কিন্তু জেম্মার ঘুম ভাঙল না।

    হঠাৎই দেখতে পেলাম সাদা লেসের টেবিলক্লথের উপর খানিকটা কালচে লাল রং জেম্মার নাক আর ঠোঁটের কাছে।

    প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম।

    ‘জেম্মা!’

    ফিসফিস আওয়াজ বেরোল আমার গলা দিয়ে। হাত রাখলাম শিরা বের করা বিশীর্ণ শুকনো লতার উপর।… বরফের মতো ঠান্ডা।

    পায়ের তলা থেকে অবিরত মাটি খসে যাচ্ছিল। পালিয়ে যেতে হবে আমাকে। পকেটে মাত্র দু-চার টাকা আছে। প্রতিবেশীদের ডাকা বা কোনও কিছুর জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তা ছাড়া কোনও সন্দেহ আমাকে ঘিরে তৈরি হোক সেটাও আমি চাই না। প্রাণ হাতে করে পালানোর মতো আমি ছিটকে দরজার কাছে পৌঁছচ্ছিলাম। কালু-কুকুরও দৌড়ে এল পিছু-পিছু। একটা নিদারুণ ব্যস্ততা ছিল ওর দেহভঙ্গিতে। ও জানে, একা-একা এই কঠিন পরিস্থিতি ও কিছুতেই সামলাতে পারবে না। চারটে পা দিয়ে দৌড়োনো ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করা যায় না।

    কালু-কুকুর চাইছিল, আমি যেন থাকি। যেন যে-কোনও ভাবে ফিরিয়ে আনি ওর অন্নদাতাকে। কিন্তু অপারক-আমি দ্রুত নিঃশব্দে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলাম। আশ্চর্য যে, সিঁড়ির ধাপ কিছুতেই ফুরোচ্ছিল না। অনিঃশেষ। শুনতে পেলাম কালু-কুকুর কেঁদে উঠল এবং কাঁদতেই থাকল টেনে টেনে।  

    মাথার মধ্যে স্মৃতি বলছিল — 
    ওরা সবাই হয়তো ভুলে গেছে,
    শুধু তোমার গেহে আমার চিরাগ জ্বালা।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী


     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook