ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঈশ্বরচন্দ্রের দ্বিতীয় ভুবন


    একরাম আলি (August 5, 2023)
     

    ১৮২৮ সাল। বাবার পিছু পিছু সে হাঁটছে। যেতে হবে অনেকদূর। বীরসিংহ গ্রাম থেকে কত দূরের শহর কলকাতায়। আট বছরের শিশুটির ছোট ছোট পা-দুটো পেরিয়ে যাচ্ছে কত-কত গাছ, বনবাদাড়, নাম না-জানা পাখি, খাল, নদী, ছোট-বড় গ্রাম। ঢুকে পড়ছে একটার পর একটা মাইলস্টোনের ভিনদেশি সব সংখ্যার ফাঁদে— ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর…। যাচ্ছে নিরন্নের দেশ থেকে অন্নের খোঁজে।

    অন্ন কি জুটেছিল? হ্যাঁ, জুটেছিল। পরিবর্তে গ্রাম ছেড়ে, পরিজন ছেড়ে, গাত্রবর্ণের মতো প্রকৃতি ছেড়ে, থাকতে হয়েছিল ইট, কাঠ, ভারী-ভারী বইপুস্তক আর পাণ্ডিত্যের ঘন জঙ্গলে। এক ভদ্রবিত্ত সমাজে। সমাজের অন্যতম মাথা হয়ে। সেখানে জীবনের সেরা সময়টায় কী-কী করেছিলেন তিনি, আমরা সবাই জানি। সেসব কর্মই ছিল নতুন ভদ্রবিত্ত সমাজের জন্য— উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজের সংস্কারসাধন করে, শিক্ষার— বিশেষ করে নারীশিক্ষার— প্রসার ঘটিয়ে, নতুন এক সমাজ নির্মাণ।

    যেহেতু ব্রাহ্মণ-পরিবারের সন্তান, গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে ঢুকে পড়তে হয়েছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে। ক্রমে সেই সমাজের উপরতলায়। অর্থাৎ, এক ধরনের ঘেরাটোপে। সেই ঘেরাটোপের ভেতর যে-ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখি, আমাদের সবার মনে আঁকা হয়ে আছে সেই ছবিটি। সে-ছবি বিশাল, বিপুলায়তন হয়ে আমাদের দেখার চোখকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু একবার যদি এই উচ্চবর্গীয় ঘেরাটোপের বাইরে বিপুল বাংলাদেশে আমরা পৌঁছতে পারি, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বাস, যেখানে বিধবাবিবাহের বা নারীশিক্ষার বা বহুবিবাহ বন্ধের দায় ছিল না, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নমঃশূদ্র আর আদিবাসী আর মুসলমান সমাজের মাঝে দেখতে পাব অন্য এক ঈশ্বরচন্দ্রকে।    

    অন্য সেই ঈশ্বরচন্দ্র কেমন? আমরা দেখব মুসলমান সমাজের আলো-অন্ধকারে ঈশ্বরচন্দ্রকে, যে-সমাজটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নানা চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা।

    সত্তরের ডিসেম্বর

    সাল উনিশশো সত্তর। ডিসেম্বর মাস। ‘বিদ্যাসাগর: সার্ধশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ’ নামে একটি প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশ পেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে, গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায়। বছরটা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের সার্ধশতবর্ষ। আর ওই বছরটিতেই বৃহত্তর বাংলার এক ভূখণ্ড ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অসমসাহসী। ওই ডিসেম্বরেরই সাত তারিখ পাকিস্তানের বিখ্যাত সাধারণ নির্বাচন, যে-নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয় নিপীড়ন থেকে উঠতে চাওয়া পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকামী মন। নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব, সঙ্গে তাঁর সহযোগী নেতৃবৃন্দ।

    বিরাট কিছু নয়, ২২২ পৃষ্ঠার বই। কিন্তু সে-সংকলনগ্রন্থটি পূর্ববাংলার তৎকালীন মুক্তির আর বন্ধনের আবর্তে এমনই উদ্দীপনা জুগিয়েছিল মুক্তিকামীদের যে, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাভাষার আর কোনও মুদ্রিত গ্রন্থের প্রকাশকালে তেমনটা ঘটেনি। বইটিকে খান-সেনারা ঠাউরেছিল— ভয়ংকর বিপজ্জনক। তাদের খতম-তালিকায় রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় নামটিই ছিল গোলাম মুরশিদের। প্রথম আর তৃতীয় নামও বইটির সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট দুজনের। সেই বই প্রকাশের চল্লিশ বছর পর পুনঃপ্রকাশের সময়ে সম্পাদক গোলাম মুরশিদ লিখছেন—

    ছাপা হয়ে যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের জন্যে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয় ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি। সমস্ত জাতীয় দৈনিকে এই পুস্তক প্রকাশিত হতে যাচ্ছে— এ খবর প্রকাশিত হয় একেবারে প্রথম পৃষ্ঠায়। প্রকাশনা উৎসবের পরের দিন আবার— গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে বলে প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ বের হয় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে। একটা বই নিয়ে এতো হৈ চৈ হতে দেখে রয়টারও এর খবর করে। আকাশবাণী দিল্লি থেকেও এ সংবাদ প্রচার করা হয়।

    সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষ-সমৃদ্ধ এক ভূখণ্ডে এমন উচ্ছ্বাসের কারণ কি শুধুই উষ্ণ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বইটির প্রকাশ? মৃত্যুর দেড়শো বছর পর ভিন্ন আবহে নতুন এক বিদ্যাসাগর কি আবির্ভূত হলেন না, যাঁর সূতিকাগৃহ বাঙালি মুসলমানের— হোক-না ওপারের— শ্রমে আর মেধায় বিনির্মিত?

    কেন এমন হল? যে-বিদ্যাসাগরের প্রতি বাংলার মুসলমানের এক বৃহৎ অংশের অভিযোগ যে, তাঁদের জন্য তিনি কিছুই করেননি— না সমাজ-সংস্কারে, না শিক্ষাক্ষেত্রে; উপরন্তু বাংলাভাষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সংস্কৃতের পাষাণখণ্ড ঢুকিয়ে উদার আর মুক্ত ভাষাটাকেই করেছেন হিন্দুদের ভাষা, যে-মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে তাঁর মতো বিরাট মাপের মানুষের এমন নিঃস্পৃহ থাকাটা অস্বাভাবিক রকমের একদেশদর্শিতা বলেই মনে করেছেন সমাজটির বড় অংশ, গত শতকের পঁচিশ/তিরিশ বছরের পরিসীমায় একান্ত পারিবারিক চিত্র থেকে বৃহৎ সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিবেশে সেই সমাজটিতেই তাঁর এহেন উজ্জ্বল উপস্থিতি সম্ভব হল কী করে?

    গোলাম মুরশিদ-সম্পাদিত সংকলনগ্রন্থটির লেখক-সংখ্যা বারো। আহমদ শরীফ দিয়ে শুরু এবং আলী আনোয়ারকে দিয়ে শেষ যে-সূচিপত্র, তাতে দেখতে পাচ্ছি, জন্মসূত্রে আটজন মুসলমান-বংশোদ্ভুত লেখকের নাম। বাকি চারজন হিন্দু-বংশোদ্ভুত। কিন্তু ওই ভূমিকা পড়েই অনুমান করতে পারছি— সংকলনগ্রন্থটি নির্মাণের পশ্চাৎভূমিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মেধা, মনন, সমর্থন আর সাহায্য সম্পৃক্ত ছিল অধুনা বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের। অর্থাৎ বারোজন লেখকেরই শুধু নয়, আমরা হয়তো-বা পাচ্ছি বিরাট এক জনসমষ্টির বিদ্যাসাগর-ভাবনার গ্রন্থিত রূপ। পাচ্ছি বিশেষ কোনও ব্যক্তিকে নয়, সম্মিলিত একদল চিন্তককে— যাঁরা বীরসিংহ গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মণসন্তানকে খুঁটিয়ে দেখতে চাইছিলেন, যিনি মানুষের সমস্যা অশিক্ষা দুঃখ-কষ্ট দেখতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সেসব দূর করতে।

    হোক ওপার বাংলার, তবু সেই প্রথম আমরা বিদ্যাসাগর-বিষয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তার সম্মিলিত একটা চিত্র পেলাম। বলতে হবে— সম্মিলিত হলেও সংকলনগ্রন্থের রচনাগুলিতে বিদ্যাসাগর-বিষয়ে ব্যক্তির চিন্তাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবু, এতগুলি ব্যক্তির পৃথক-পৃথক চিন্তা একটি মাত্র সংকলনগ্রন্থে যেভাবে সমাজ-সময়-ক্ষেত্র একত্রীভূত করেছে, তেমনটি ইতিপূর্বে হয়নি। এর আগে যা পেয়েছি, সেসবেরও গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু সেগুলি ছিল ব্যক্তির চিন্তা। সে-চিন্তায় সমাজটির বড়ো অংশের সায় ছিল কি না, স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এই যে নিজের সমাজক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত একদল চিন্তকের বিদ্যাসাগরকে দেখা শুরু হল, কেমন ছিল তার আগের পর্যায়গুলো?

    পলাশি থেকে কলকাতা

    মোটা দাগে ছবিটা যদি আঁকি, দেখতে পাব— অষ্টাদশ শতকের শেষ তিরিশ বছর থেকে দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক চিত্রে বড় পার্থক্য দেখা দিতে শুরু করেছে। প্রথমে আমরা দেখব অর্থনৈতিক পার্থক্য।

    তুর্কিরা আসার পর ভারতের মতো বাংলাতেও জমিদারদের প্রাচীন তালিকাটিতে ক্রমসংযোজন হয়েছিল। উচ্চপদাধিকারী মুসলমান রাজকর্মচারীদের অনেকে ক্রমে জমিদার হয়ে ওঠেন। এর শুরু সেই ত্রয়োদশ শতকে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর, আরও নির্দিষ্ট করে বললে— ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর, বাংলায় এই স্রোতটি একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই।

    ফল কী হল? চোখে পড়ল অনেক পরে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর, হঠাৎ ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে— এখন তো কোম্পানির শাসন নেই; ভারতীয় মুসলমানরা এখনও কেন মহারানির বিরোধিতা করছে? ভাইসরয় লর্ড মেয়ো বিষয়টি খতিয়ে দেখার ভার দেন ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারকে। অনেক খেটে ১৮৭১ সালে হান্টার লিখলেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ নামে একটি সন্দর্ভ। বই আকারে বেরোলে সেটি বিখ্যাত হয়ে যায়। ডেপুটি কালেক্টর পদে বীরভূমে থাকার অভিজ্ঞতা-সূত্রে কাছ থেকে দেখেছেন অতি সাধারণ স্তরে নেমে আসা সেখানকার মুসলমান রাজ-পরিবারকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল নেওয়ার আগে যে-পরিবারের বাৎসরিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। সেই বই থেকে হান্টারের একটি বাক্য এখানে রইল—

    A hundred and seventy years ago it was almost impossible for a well-born Musalman in Bengal to become poor; at present it is almost impossible for him to continue rich.’ (p. 158)

    মোট কথা— পলাশির যুদ্ধের মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে বাংলার মুসলমানদের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়। ১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেই প্রথম বড় ধাক্কা খায় নবাবি সেনাবাহিনী। ক্ষমতা যাওয়ার প্রাক্‌-মুহূর্তে নবাবের সেনা-সদস্য ছিল পঞ্চাশ হাজার। ক্রমে নবাবি সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়। একইভাবে রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসে এবং মুসলমান কর্মীসংখ্যা ভয়ংকরভাবে কমে যায়।

    বাঙালি মুসলমানের ভাষা

    সব মিলিয়ে এই অবনমন এমনই গড়গড়িয়ে হয় যে, উনিশ শতকের মাঝপর্বে এসে তিনটে ভুল তথ্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়— জাতি হিসেবে মুসলমানরা জন্ম-গরিব। তারা শিক্ষায় অনাগ্রহী। সেই সঙ্গে আরেকটা নতুন তথ্যও প্রচার পেতে শুরু করে— বঙ্গদেশীয় মুসলমানরা মূলত উর্দুভাষী। এখানে একটা কথা: উনিশ শতকের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য বাংলার মুসলমানকে স্পষ্ট তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আশরাফ, আজলফ বা আতরাফ এবং আরজল। আমরা জানি— বহির্ভারত থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা আশরাফ। মুলত সৈয়দ, কুরেশি, সেখ, তুর্কি, মোগল, পাঠান ইত্যাদি।

    পরিবারগুলো বাংলায় এল। স্থায়ী বাসিন্দাও হল। কিন্তু থেকে গেল এক ধরনের দড়কচা-মার্কা বাঙালি হয়ে। দেশজ নিম্নবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের থেকে অভিজাত-দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বেছে নিল উর্দুকে। যেহেতু আশরাফ শ্রেণিই ছিল শাসক অথবা সমাজপ্রধান বা আজকের ভাষায় ‘প্রভাবশালী’, তাই যখন উনিশ শতকে সামাজিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার মনে করলেন কেউ-কেউ যে, বাঙালি মুসলমানের শিক্ষার ভাষা কী হবে, আশরাফ শ্রেণি থেকে চটজলদি উত্তর এল— উর্দু। তাঁরা ভুলে গেলেন বা অস্বীকার করলেন— বাংলার মুসলমান শুরুর থেকে, অর্থাৎ হিন্দুরা যখন বাংলাকে ব্রাত্য করে সংস্কৃত চর্চা করছে, বাংলাকেই বেছে নিয়েছে তাদের একান্ত ভাষা হিসেবে।

    সমাজে ইংরেজি-বিমুখতা ছিল। কিন্তু শিক্ষা-বিমুখতা ছিল না। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডাম রিপোর্ট জানাচ্ছে, বাংলা ও বিহারে এক লক্ষেরও বেশি স্কুল বর্তমান। ১৮০২ সালে বর্ধমান জেলার ম্যাজিস্ট্রেট জানাচ্ছেন— তাঁর জেলায় এমন কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রাম নেই, যেখানে স্কুল নেই। পলাশির যুদ্ধের ৪৫ বছরের মধ্যে ইংরেজ-কর্তৃক এমন অবস্থা তৈরি হওয়া ছিল অসম্ভব। বিশেষ করে ১৮১৩ সালের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিক্ষাখাতে কোনও ব্যয়বরাদ্দই করেনি।

    পলাশির পর ইংরেজি থেকে সরে আসতে চেয়েছে ‘পরাজিত’ মুসলমানরা। অনেকটা সরে আসার পরও, মূলত আশরাফ শ্রেণির অংশগ্রহণে, উচ্চশিক্ষিত মুসলমানের দলটি কম ভারী ছিল না। বিদ্যাসাগরের সমসময়ের ছবি যদি দেখি, গোটা বাংলাজুড়ে আশরাফ শ্রেণির শিক্ষিত মানুষজনের বিচরণ দেখতে পাই। শিক্ষার জন্য, এবং সামাজিক কাজকর্মের জন্যও, উনিশ শতকে বহু মুসলমান পুরুষকে— এমনকী এক নারীকেও— ব্রিটিশ সরকার নবাব, খানবাহাদুর, নাইটহুড উপাধি দিয়েছেন।

    নবাব আবদুল লতিফ

    তথাকথিত এই উর্দুভাষীদের কেউ-কেউ নিছক জমিদারই ছিলেন না— সমাজভাবনায়, শিক্ষার প্রসারে এবং সাহিত্যচর্চায় এঁদের কাজের আর মেধার স্ফূরণের স্বাক্ষর আমরা দেখতে পাই। এঁদেরই বা এঁদের সমগোত্রীয়দের আমরা দেখি উনিশ শতকের মাঝপর্বের বাংলায়। যেমন মেদিনীপুরের সোহ্‌রাওয়ার্দি পরিবার। যেমন ফরিদপুরের আবদুল লতিফের পরিবার। যেমন বর্ধমানের জাহেদি পরিবার ছাড়াও জেলার আরও দু-একটি পরিবার।

    নবাব আবদুল লতিফ

    যে-সময়ে আমরা ঢুকে পড়েছি, সেই সময়ে বাংলার নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের দু-একজনকে আমরা দেখব। প্রথমে দেখব নবাব আবদুল লতিফকে। অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে ১৮২৮ সালে জন্ম। হিসেবে বিদ্যাসাগরের চেয়ে আট বছরের ছোটো।

    ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন লতিফই প্রথম নীলচাষিদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বলতেই হবে, স্বধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি শুরুর থেকেই ছিল তাঁর মমত্ববোধ। ভাবনা ছিল— পাশ্চাত্য শিক্ষার দিকে, আর সেই সূত্রে সমাজের মূল স্রোতের দিকে, বাংলার মুসলমানদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। কেননা, শত বছরের ঘটনাপ্রবাহে ব্রিটিশ এবং হিন্দু প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের প্রতি যে-সন্দেহ পুরু হয়েছে তাঁর সমাজে, যে-দূরত্ব তৈরি হয়েছে দুই সম্প্রদায়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তাঁর সমাজ এবং অর্থনৈতিকভাবে আর মননে হয়েছে দরিদ্র, সেই অন্ধকার থেকে বের করতে হলে চাই শিক্ষা শুধু নয়— ইংরেজি শিক্ষা, পাশ্চাত্য শিক্ষা। কিছুটা সফলও তিনি হন। কেউ-কেউ বলেন, বাংলার মুসলিম জাগরণের তিনি পথিকৃৎ। কিন্তু, তাঁর চেষ্টা যে পূর্ণতা পায়নি, তার একাধিক কারণের একটি— বিদেশাগত উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবারগুলোর মতো লতিফও ছিলেন উর্দুভাষী এবং বাংলার মুসলমানের মাতৃভাষারূপে উর্দু প্রর্বতনের প্রধান দাবিদার।

    তাঁরা সমসাময়িক— তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আবদুল লতিফের মতবিনিময়ের কিছু প্রমাণ আমরা পাই। দুজনেই নানা সমিতিতে এবং সংস্থায় যুক্ত থেকে স্বদেশীয়দের উন্নতিসাধনে চেষ্টা করে গেছেন। যেমন ১৮৫১ সালে সাহিত্য এবং বিজ্ঞান বিষয়ে ইয়োরোপীয় আর এ-দেশীয়দের মধ্যে জ্ঞানচর্চায় সংযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে বেথুন সোসাইটি গঠিত হলে বিদ্যাসাগর ছিলেন কার্যকরী সমিতির প্রথম সভাপতি। ওই সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল লতিফও। এছাড়া শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের ‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ’ (পৃ. ১৩৮-১৩৯) গ্রন্থে জানা যায়, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী আবদুল লতিফ বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহায়তা করেছিলেন।

    ওবাইদুল্লাহ আলওবাইদি

    এমনই আর-একজন— ওবাইদুল্লাহ আল-ওবাইদি সোহ্‌রাওয়ার্দি (১৮৩২-১৮৮৫)। বয়সে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বারো বছরের ছোট। উপমহাদেশের বহু কৃতী এবং বিখ্যাত মানুষের জন্মদাতা মেদিনীপুরের যে-সোহ্‌রাওয়ার্দি পরিবার, সেই পরিবারের সন্তান। পরিবারটি ছিল উর্দুভাষী। সবার শিক্ষা শুরুই হয়েছে আরবি, ফারসি, উর্দুভাষায়। সঙ্গে ইংরেজি।

    ওবাইদুল্লাহ আল-ওবাইদি আলিয়া মাদ্রাসার কৃতী ছাত্র। উর্দু, আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা বহু বই রয়েছে তাঁর। অনুবাদও করেছেন এইসব ভাষা থেকে। তাঁরই করা ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে রামমোহন রায়ের ‘তুহফাতুল মুওয়াহেদিন’-এর। ওবাইদির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সরাসরি বা পরোক্ষ যোগাযোগের তেমন সূত্র পাওয়া যায় না। এমনকী, রামমোহন-অনুবাদের পরও না।

    আমার বর্ণ আমার পরিচয়

    বিদ্যাসাগরের অক্ষয়কীর্তি ‘বর্ণপরিচয়’। মুসলমান সমাজের সব চেয়ে বেশি অভিযোগও ‘বর্ণপরিচয়’-এর উপর। তাদের অভিযোগ: লেখক বিদ্যাসাগরের মতো মহাপ্রাণ মানুষ হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সমাজের বড় অংশটির— অর্থাৎ মুসলমান শিশুর— জন্য বর্ণপরিচয়ে কোনও স্থান রাখেননি। নানা ভাবে বাংলার মুসলমান সমাজের মনোবেদনা, অভিযোগ, প্রকাশিত হয়েছে এবং সংস্করণের পর সংস্করণ ‘বর্ণপরিচয়’ ছাপাও হয়েছে সেই সব অভিযোগ আর মনোবেদনাকে অগ্রাহ্য করেই। একটা সময়ে হতাশা থেকে তাঁরা নিজেরাই লিখতে শুরু করেন বাংলা প্রাইমার। উনিশ শতকেই মীর মোশাররফ হোসেন-সহ অন্তত পনেরোজন লেখক মুসলমান শিশুদের জন্য রচনা করেছিলেন বাংলা অক্ষর-পরিচয়ের বই। কিন্তু সেসবের একটাও টেকেনি।

    এদিকে ১৮৭১-’৭২ সালের শিক্ষা বিভাগের একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারি, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার অগ্রগতিতে একশো বছরেরও কম সময়ে কতখানি তারতম্য ঘটে গেছে।

    হিন্দু: স্কুলের ছাত্র— ১৪৯,৭১৭; আর্টস কলেজের ছাত্র— ১,১৯৯; মোট ১৫০,৯১৬ জন।

    মুসলমান: স্কুলের ছাত্র— ২৮,০৯৬; আর্টস কলেজের ছাত্র— ৫২; মোট ২৮,১৪৮ জন।

    এই রিপোর্টটি বিদ্যাসাগরের চোখে পড়েনি, এমনটা আন্দাজ করা শক্ত। রিপোর্টের ১৬ বছর আগে ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারে এসেছে। তৎকালীন মুসলমান সমাজের বহু অভিমান-অভিযোগের কথাও আমরা জেনেছি। বইদুটির কিছু পরিমার্জনও হয়েছে। কিন্তু সে-পরিমার্জন মুসলমান সমাজের অভিমান-অভিযোগের অনুকূলে নয়।

    ওবাইদুল্লাহ আল-ওবাইদি

    বাংলাভাষাকে সংস্কৃতায়িত করা, প্রচলিত ভাষা থেকে নির্দয়ভাবে আরবি ফারসি তুর্কি পোর্তুগিজ শব্দ ছেঁটে ফেলা, এবং সংস্কৃতকে বাংলার জননীর আসনে প্রতিষ্ঠা দেওয়া এই সময়ের ঘটনা। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বা ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য যদি বিদ্যাসাগরের যে-কোনও রচনার পাশে রেখে পড়ি, আমরা বুঝতে পারব।

    ‘বর্ণপরিচয়’-সহ ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে যেসব গুরুতর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, সেসবই কি ব্যক্তি-বিদ্যাসাগরের নিজস্ব ভাবনা? না কি নবজাগরণের নামে হিন্দু জাগরণের যে-স্রোত বইতে শুরু করেছিল তৎকালে, তার প্রবল সামাজিক চাপ ছিল বিদ্যাসাগরের ওপর? 

    আমরা প্রায় দুশো বছর ধরে জানি— এই মানুষটির ঘাড়ের ওপর অনেকগুলো মাথা ছিল। কিন্তু সংখ্যাটা এত বেশি ছিল কি-যে সার্বিক বিরুদ্ধ পরিবেশে, ‘বর্ণপরিচয়’-এ, তিনি মুসলমান শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনব্যাপী কাজকর্মে এ-ধরনের সীমাবদ্ধতার দিকগুলো বহু আলোচিত। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর: সার্ধশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ’-এ আলী আনোয়ার ‘বিদ্যাসাগর ও ব্যক্তির সীমানা’ প্রবন্ধে লিখেছেন—

    বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় যতটা পুঁজিবাদী সভ্যতার প্রশ্রয়ে বিকাশোন্মুখ বাঙালী সমাজের প্রধান সামগ্রিক প্রবণতাগুলিকে রূপ দিচ্ছিল ততটুকুই তিনি সাফল্যে ভাস্বর, যতটুকু তাঁর ব্যক্তি-আকাঙ্ক্ষার ফলাফল সামাজিক সম্পর্কের দোলাচলে যার সমর্থন ছিল না ততটুকু তিনি ব্যর্থ— ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের সীমাবদ্ধতা।

    এই কারণেই বিধবাবিবাহ প্রচলনে সাফল্য পেলেও, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁকে মেনে নিতে হয়েছে পরাজয়। এবং, ‘বর্ণপরিচয়’-এর ‘পবিত্র পৃষ্ঠা’গুলিকে তিনি হিন্দু-মুসলমান শিশুদের মিলিত বিচরণভূমি করতে পারেননি।

    বিদ্যাসাগরের মুসলমান জগৎ

    কলকাতা ছিল বিদ্যাসাগরের কর্মক্ষেত্র। ছিলেন বিশেষ এক ঘেরাটোপে। সেখান থেকে প্রথম বলবার মতো বেরোলেন ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। সে-সময়ে সরকারি কাজে ২১ মে থেকে ১৮ জুন তাঁকে ঘুরতে হয় হুগলি নদিয়া বর্ধমান মেদিনীপুর জেলার কিছু জায়গায়। উদ্দেশ্য: সরকারি স্কুল স্থাপন।

    যেমন বর্ধমান শহর। ওই ১৮৫৪ থেকেই স্বাস্থোদ্ধারে তাঁর বর্ধমান যাতায়াত শুরু। এরপর ১৮৫৫ সালে, ১৮৫৬ সালে, ১৮৫৯ সালে এবং ১৮৬০ সালে তাঁর বর্ধমান আগমনের এবং বসবাসের কথা জানতে পারি। এরপরেও গিয়েছেন বর্ধমান। যেমন, ১৮৬৮-তে টানা চার মাস তিনি সেখানে কাটান। সেবার তাঁর বাসস্থানের পাশেই ছিল গরিব মুসলমানদের পল্লি। অল্পদিনে সেই গরিব পল্লিটি তাঁর পোষ্যবর্গে পরিণত হয়। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থের (১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ) ৪৯৬ পৃষ্ঠায় লিখছেন—

    ঐ পল্লীর ছোট ছোট বালক বালিকা তাঁহার বিশেষ স্নেহের পাত্র হইয়া উঠিল। তাহাদিগকে প্রতিদিন খাবার কিনিয়া দেন, তাহাদের স্নেহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া তাহাদের পিতা মাতা প্রভৃতিরও নানা অভাব মোচন করিতে প্রবৃত্ত হন।

    ১৮৬৯ সালে কালান্তক ম্যালেরিয়ায় বর্ধমানে যখন অসংখ্য লোক আক্রান্ত হয়, ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ মিত্রকে নিয়ে বিদ্যাসাগর তখন হতদরিদ্র পল্লিগুলোতে ওষুধ আর পথ্য নিয়ে হাজির। ডাক্তার মিত্রের বয়ান-অনুযায়ী চণ্ডীচরণ ওই গ্রন্থেরই ৪৯৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন—

    কৃশ ও রুগ্‌ণ মুসলমান শিশুসন্তান তাঁহার পবিত্র ক্রোড়ে স্থান পাইয়াছে, কেহ বা আত্মচেষ্টায় তাঁহার ক্রোড়ে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু তাহাতে তাঁহার উপবীত বা উপবীত পরিশোভিত দেহ অপবিত্র হয় নাই।

    দেখা যাচ্ছে, তাঁর উপবীত বেপরোয়া রকমের সহনশীল।

    আর-একটি ঘটনা। বিদ্যাসাগর তখন ষাটোর্ধ্ব। তাঁর ‘বোধোদয়’ গ্রন্থটির বয়স প্রথম প্রকাশের ভূমিকার তারিখ-অনুযায়ী তিরিশ অতিক্রান্ত (২০এ চৈত্র। ১৯০৭ সংবৎ।)। কুমিল্লার ‘রুপ্সা’ (রূপসা) থেকে একটি চিঠি তিনি পান। পত্রলেখকের নাম মহম্মদ রেয়াজ উদ্দীন্ আহম্মদ। বোধোদয়ের কিছু তথ্যসংক্রান্ত অসংলগ্নতা দেখিয়ে পত্রটি লেখেন তিনি। বিদ্যাসাগর সেই চিঠি পেয়ে পরের একোনবিংশতিতম সংস্করণে সংশোধন করেন। সেই সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন: ‘ইহাতে আমি সাতিশয় উপকৃত ও সবিশেষ অনুগ্রহিত হইয়াছি।’ এ-বিষয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর অমূল্য একটি সাক্ষাতের বিবরণ আমরা পাই রেয়াজ উদ্দীনেরই স্মৃতিকথায়, যেটি তিনি লেখেন ১৯২৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি লিখছেন:

    আমি ১২৮৫ কিংবা ৮৬ সালে, পণ্ডিতপ্রবর দয়ার সাগর মহানুভব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্কলিত “বোধোদয়” নামক পুস্তকখানির কয়েকটি ভুল প্রদর্শন করিয়া তাঁহাকে একখানি পত্র লিখি। তখন আমার বয়ঃক্রম ১৬/১৭ বৎসরের অধিক নহে। ছেলেমানুষী খামখেয়ালের বশবর্তী হইয়া সেই পত্রখানি লেখা হয়; ৭/৮ দিন পরেই পণ্ডিতপ্রবর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বহস্তলিখিত একখানি পত্র আমি প্রাপ্ত হই। পত্রখানিতে ঐ কয়টি ভুল স্বীকার করিয়া, আমাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। সঙ্গে সঙ্গেই বোধোদয় পুস্তকে একটি বিজ্ঞাপন ছাপিয়া ভুল স্বীকার এবং আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ঐ বিজ্ঞাপনখানি বোধোদয় পুস্তকে তাঁহার জীবিতকাল পর্যন্ত বরাবর ছাপা হইয়াছিল।…

    কলিকাতায় পঁহুছার মাস দুই পরে একদা মহানুভব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাক্ষাৎ করিতে গমন করিলাম। সেদিনের কথা স্মরণ করিতে আজও আমার হৃদয়ে আনন্দের একটা প্রবল উচ্ছ্বাস অনুভূত হয়। মনে আছে, শৈশবে— ১২৭৫ বা ৭৬ সালে ওয়ালেদ মাজেদ মরহুম মগফুরের নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রণীত “বর্ণপরিচয়” পুস্তকখানি পাঠ করিয়া ছিলাম। প্রায় ২০ বৎসর পরে আজ সেই পুস্তকের বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থকার মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গমন করিলাম। আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিতে পাইলাম, দুইটি হৃষ্টপুষ্ট স্থুলাঙ্গ বালক বাহিরে (বিস্তৃত আঙ্গিনায়) খেলা করিতেছেন; পরে জানিতে পারিলাম, ইহারা তাঁহারই দুইটি দৌহিত্ররত্ন— প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও তদীয় কনিষ্ঠ সহোদর। একতলে বৈঠকখানায় গিয়া দেখিলাম, একজন ধুতিচাদর পরিহিত সুদর্শন হিন্দু যুবক তথায় বসিয়া আছেন। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ইনি একজন নবাগত হিন্দু ব্যারিস্টার। ভৃত্য একখানি শ্লেট ও পেন্সিল আনিয়া দিলে, উভয়ে তাহাতে নাম লিখিয়া দিলাম। ভৃত্য শ্লেটখানি লইয়া উপরে চলিয়া গেল। ২/৩ মিনিট পরে আসিয়া সে আমাকে উপরে যাইতে ইঙ্গিত করিল। তদনুসারে আমি তাহার সঙ্গে দ্বিতলে আরোহণ করিলাম। প্রথমে একটি বৃহৎ কামরায় আমাকে লইয়া উপস্থিত করিল। দেখিলাম, অতি সুন্দর সোনালী বাইন্ডিং করা কেতাব সমূহে পরিপূর্ণ ১০/১২টি গ্লাসকেশ আলমারি ঐ কামরায় রহিয়াছে। একটি ভৃত্য পরিষ্কার রুমাল দিয়া এক একখানি পুস্তক মুছিয়া আলমারীর যথাস্থানে রাখিতেছে; একখানি প্রকাণ্ড টেবিলের চারিদিকে ১০/১২ খানি চেয়ার। টেবিলের উপর একখানি পিতল নির্মিত ক্ষুদ্র হ্যান্ডেল দেখিলাম একখানি লেফাফাযুক্ত পত্র। পত্রখানির শিরোনামা দেখিয়া চিনিতে পারিলাম, আমার লিখিত সেই পত্রিখানি— যাহা ৪/৫ বৎসর পূর্বে আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লিখিয়াছিলাম। আমার পত্রখানি এরূপ যত্নপূর্বক রাখিতে দেখিয়া আমি নিতান্তই বিস্ময়াপন্ন হইলাম। সেখানে ২/৩ মিনিট বসিবার পর ভৃত্য আমাকে আর একটি প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল। দেখিলাম, সেই প্রকোষ্ঠেও ঐরূপ সুন্দর গ্রন্থরাজি পরিপূর্ণ আলমারীগুলি শ্রেণীবদ্ধরূপে দণ্ডায়মান আছে; একখানি বৃহৎ তেবিলের পার্শ্বে সৌম্যমূর্তি এক প্রবীণ পুরুষ চেয়ারে বসিয়া আছেন, কিন্তু চেয়ারে তিনি পৃষ্ঠ সংলগ্ন করেন নাই। আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য-সহকারে পার্শ্ববর্তী ১ খানি চেয়ারে উপবেশন করিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমি ‘সেলাম’ করিয়া বসিলাম। তিনি বলিলেন, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি এককন বয়স্ক পুরুষ; এখন দেখিতেছি তরুণ যুবক মাত্র। তোমার কথা আমার বেশ স্মরণ আছে।… নিজের সম্বন্ধে বলিলেন, পূর্ব্বে আমি লাটসাহেব ও বড় বড় সাহেবসুবাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিতাম, ইদানীং আমি আর তাঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি না…। অবশেষে বলিলেন, মাঝে মাঝে আসিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবে। এইবার আমি ভক্তিভাবে সালাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলাম। ভৃত্যটিও আমার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়া নিম্নে নামিয়া আসিল; সে আমাকে বলিল, বিদ্যাসাগর মহাশয় এত অধিক সময় পর্যন্ত কাহারও সঙ্গে বসিয়া আলাপ করেন না;  পাঁচ-দশ মিনিটকাল আলাপ করিয়াই বিদায় দেন। আশ্চর্য্যের বিষয়, আপনার সঙ্গে বহুক্ষণ পর্যন্ত খুব আগ্রহের সঙ্গে আলাপ করিলেন।…

    আর দুটি প্রসঙ্গ

    এক. অখিলউদ্দিন (নামের এমন বানানই লিখেছেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) নামে এক অন্ধ আর খঞ্জ ফকিরের গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন বিদ্যাসাগর।

    দুই. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন—

    ‘… আলোপ্যাথি ডাক্তার ও আয়ুর্ব্বেদীয় চিকিৎসক মহাশয়েরা বলিলেন অহিফেনের মাত্রা এত অধিক পরিমাণে থাকিলে, আমাদের চিকিৎসায় উপকার দর্শিবে না, এই কথায় ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে কলিকাতার অন্তর্গত কলুটোলা হইতে সেক আব্দুললেতীব হকিমকে আফিং পরিত্যাগ করাইবার জন্য আনাইলেন। ১৮ই আষাঢ় হইতে উক্ত হকিমের চিকিৎসা আরম্ভ হইল।’

    শেষ কথা

    দেখা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই সীমাবদ্ধ থেকেছে হিন্দুসমাজে। বলা উচিত— হিন্দু উচ্চবর্ণ সমাজে। কিন্তু, তাঁর জীবনচর্যায় বাধাহীনভাবে ঢুকে পড়েছে ‘অচ্ছুৎ’ সমাজের মানুষজন— নমঃশূদ্র (দুর্ভিক্ষের সময়ে বীরসিংহ গ্রামে, ১৮৬৬ সালে), মুসলমান (মূলত বর্ধমানে, ১৮৫৪ সালের পর থেকে) আর সাঁওতাল (কর্মাটাঁড়ে, ১৮৭১ সাল থেকে আমৃত্যু)।

    আমার বিশ্বাস— ১৮৫৪ সাল থেকে তিনি কলকাতার স্বক্ষেত্র ছেড়ে মাঝে মাঝেই-যে বাইরে যেতে চাইতেন, সে-ওই তিন সম্প্রদায়ের কাছাকাছি পৌঁছোবেন বলেই হয়তো-বা। হয়তো পেতে চাইতেন তাদের দারিদ্রের, বঞ্চনার নৈকট্য— যে-বঞ্চনা আর দারিদ্র সরকারকে চিঠি লিখে বা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে, বিতর্ক করে বা একক চেষ্টায় দূর করা ছিল অসম্ভব।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook