ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আয়নাতে মুখ দেখব না?


    সারস্বত সেন (August 19, 2023)
     

    হলিউডে চিত্রনাট্যকার ও ভয়েস-অ্যাক্টররা কাজকর্ম শিকেয় তুলে গত কয়েক মাস ধরে ধর্মঘটে। তাঁদের সেই লড়াইয়ে কাঁধ মেলাচ্ছেন রুপোলি দুনিয়ার তাবড় তারকারাও। সেখানকার বিখ্যাত স্টুডিয়োগুলোর সঙ্গে শিল্পী-কলাকুশলীদের অনেকদিন ধরেই মন কষাকষি চলছিল, হকের পাওনা আদায় করা নিয়ে। সেই আলোচনার লিস্টে সাম্প্রতিক সংযোজন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)! হলিউডের জগৎজোড়া খ্যাতিই তো সিনেমায় হালফিলের কাটিং-এজ টেকনোলজি ব্যবহার করে অবাস্তবকে বাস্তবভোগ্য করে তোলার জন্য। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে, যাদের কাজ দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘এ শুধু হলিউডেই সম্ভব’, চ্যাট জিপিটি-র রমরমা বাজারে সেই ইন্ডাস্ট্রিতে হঠাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে এত প্রতিবাদ কেন?

    ইন্ডিয়ানা জোন্‌স সিরিজের নতুন সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন তাঁদের হয়তো মনে আছে ছবিতে একটা সময় ৮০-র দশকের ইন্ডিয়ানা জোন্‌সকে দেখানো হয়। নামভূমিকায় থাকা হ্যারিসন ফোর্ডের বয়স এখন ৮০। অথচ সিনেমাতে কিছু সময় জুড়ে আমরা দেখতে পাই তরুণ হ্যারিসন ফোর্ড-কে। অভিনেতার ‘ডি-এজিং’— মানে বয়স কমিয়ে তৈরি করা হয়েছে তাঁরই এক ডিজিটাল ক্লোন— প্রায় নিখুঁত এক প্রতিবিম্ব যা শুধু প্রথাগত সি.জি.আই. এবং ভি.এফ.এক্স.-এ সিদ্ধ করা অসম্ভব। সম্ভব করেছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স— ওই দু’য়ের সঙ্গে মেলবন্ধনে।

    শোনা যাচ্ছে কাজ চলছে মৃত সেলিব্রিটিদের নিয়েও। কীরকম? ১৯৫৫-তে প্রয়াত হলিউডের অন্যতম কালচারাল আইকন জেমস ডিন-কে খুব শীঘ্রই দর্শকরা ফিরে পাবেন রুপোলি পর্দায়। ‘ডি-এজিং’ পদ্ধতিতে তৈরি করা তাঁর ডিজিটাল ক্লোনকে দেখে ফিরে যাওয়া যাবে ৫০-এর দশকে। এতটুকু পড়ে তো মনে হতেই পারে, ‘এ অতি উত্তম কথা’। কোনও পুরনো সিনেমার এইচডি রেস্টোরেশন নয়: সম্পূর্ণ নতুন চিত্রনাট্যে, নতুন সিনেমায় যদি এবারের পুজোয় ফিরে পাই জিন্‌স টি-শার্ট পরা মহানায়ককে? দর্শক থেকে পরিচালক আহ্লাদে আটখানা হলেও, পর্দায় তাঁর পুনরাবির্ভাব সবার পছন্দ নাও হতে পারে।

    কিংবদন্তির সঙ্গে স্ক্রিন-শেয়ার করা স্বল্পসময়ে স্বপ্নের মতো হতে পারে কিন্তু তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে দেরি হবে না যখন প্রায় সব সিনেমায় অবধারিতভাবেই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন বাঙালির ম্যাটিনি-আইডল। এখনকার উঠতি অভিনেতা, এমনকী প্রতিষ্ঠিত তারকারাও পড়ে যেতে পারেন চিন্তায়— রুজি রোজগারের চিন্তা। এ-বঙ্গভূমে সেই দিন আসতে হয়তো অনেকটা সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু প্রযুক্তির দিক থেকে হাজার মাইল এগিয়ে থাকা আমেরিকায় শিল্পী ও কলাকুশলীদের কাছে সেটা এখনকার অস্তিত্ব সংকট। তাঁদের ভয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে-গতিতে ধাবমান তাতে আগামী দিনে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই চলে যাবেন প্রাক্তনীদের লিস্টে।

    ভয়টা হয়তো অমূলক নয়। সিনেমা ছেড়ে একটু অন্য পেশার দিকে তাকান, প্রায় সর্বত্রই এক চিত্র। টিভিতে খবর পড়া থেকে শুরু করে রেডিয়োতে সঞ্চালনা, এমনকী পুলিশ ও আদালতের কাজকর্মেও সাহায্য করছে সে। খরগোশের মতোই গুটি গুটি পায়ে কিন্তু দৃঢ়প্রত্যয়ে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। আমেরিকার অথর্স গিল্ড, প্রায় ৮০০০ লেখকদের একটা সম্মিলিত পিটিশন দায়ের করেছে যাতে স্বাক্ষর আছে মার্গারেট অ্যাটউড, ভিয়েট থান ন্যুভেন-এর মতো স্বনামধন্য লেখকদের। অভিযোগ কাদের বিরুদ্ধে? মূলত চ্যাট জিপিটি, গুগল বার্ড-এর মতো ‘লার্জ-ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ বাজারজাত করে তুলছে যারা, সেই কোম্পানিগুলোই তাঁদের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।

    এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে এআই নিয়ে আমাদের ভয়ের কারণ। এ ভয় শুধু জীবিকা হারানোর বা অজানা ভবিষ্যতের নয়; এটা আমাদের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ভয়। মহামারি এসে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে সাজানো-গোছানো জীবন হঠাৎ পাল্টাতে সময় লাগে না।

    চ্যাট জিপিটি বা বার্ড কঠিন বিষয় জলবৎ তরলম করে দিচ্ছে— এতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট সার্চ করে নেটজনতা যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সেগুলো পলকে চোখের সামনে হাজির করছে, কোডিং থেকে শুরু করে কবিতাও সে লিখছে— এই বহুমুখী প্রতিভা তো রাতারাতি আসেনি। এর জন্য তাকে আত্মস্থ করতে হয়েছে অগুন্‌তি তথ্য (যেটা সে এখনও প্রতি মুহূর্তে করেই চলেছে), তারপর প্যাটার্ন রিকগনিশনের মাধ্যমে তার ব্রহ্মাণ্ডসমান তথ্যভাণ্ডার থেকেই করছে আমার-আপনার চাহিদা পূরণ। আর তার এই বিপুল তথ্যভাণ্ডারের চাবিকাঠি হল আন্তর্জাল ও আদি অকৃত্রিম বই। এই যে এত-এত ছাপানো অক্ষর এআই মডেলগুলোর ট্রেনিংয়ের কাজে ব্যবহার হল, সেটার জন্য না নেওয়া হয়েছে সেইসব বইয়ের লেখকদের অনুমতি, না দেওয়া হয়েছে কোনও আর্থিক ক্ষতিপূরণ। তাই কপিরাইট আইন মেনে লেখকেরা এখন সেটাই দাবি করছেন। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তখন আদালতই ভরসা।

    তবে লেখকেরা মনমরা হতে পারেন জেনে যে, এর আগে প্রায় একই ধরনের মামলায় অথর্স গিল্ড হেরে গেছিল গুগল-এর কাছে। গুগলের এই বিপুল ভাণ্ডারও যে একই পদ্ধতিতে গড়া, তা সত্ত্বেও আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত গুগলের যুক্তিকেই মান্যতা দিয়েছিল। আদতে যুক্তির শিকড়ে ছিল সামান্য দুটো শব্দ: পাবলিক ইন্টারেস্ট!— এই বিশাল কর্মকাণ্ড তো শুধুই জনসাধারণের সুবিধার্থে যাতে মাউসের ক্লিকে হয় তাঁদের মুশকিল আসান। আর এই জনস্বার্থকেই এখন শিখণ্ডী খাড়া করছেন আজকের এআই প্রবক্তারা। 

    অটোমোবাইল ব্যবসা থেকে আইন-আদালত হোক কি সামরিক বিভাগ— বড় ক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার না হয় বাদই দিলাম; একটু তলিয়ে দেখলেই নজরে পড়বে আমাদের রোজকার জীবনেও কিন্তু একটু একটু করে ছড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্মার্টফোনের স্পিচ থেকে টেক্সট, অনলাইন শপিং সাজেশন থেকে অ্যালেক্সা বা সিরি-র মতো ভার্চুয়াল অ্যাসিসট্যান্ট, সবই তো কমবেশি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ। তবে এগুলোর দৌড় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীর কমান্ড/প্রম্পট্‌ এবং অতীত-ব্যবহারের ইতিহাসের উপর নির্ভরশীল। বরং ১৯৫০-এ অ্যালান ট্যুরিং তাঁর ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ পেপারে যে-প্রশ্ন তুলেছিলেন সেটাই আজ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— ‘ক্যান মেশিন্‌স থিংক?’

    ২০২৩-এ দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো লুকিয়ে চ্যাট জিপিটির জনক স্যাম অল্টম্যানের সদর্প ঘোষণায়— যেখানে তিনি দাবি করেছেন শুধু এআই নয়, বরং তাঁদের অর্জুনের চোখ এজিআই— আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স। এআই যদি হয় আমাদের প্রতিবিম্ব, তাহলে এজিআই হবে মানুষের থেকেও উন্নততর এক অস্তিত্ব— স্বয়ংক্রিয় ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে এআই নিয়ে আমাদের ভয়ের কারণ। এ-ভয় শুধু জীবিকা হারানোর বা অজানা ভবিষ্যতের নয়; এটা আমাদের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ভয়। মহামারি এসে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে, সাজানো-গোছানো জীবন হঠাৎ পাল্টাতে সময় লাগে না। বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা বেকারত্ব ও জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে আসছে ধরিত্রীর প্রাকৃতিক সম্পদ। এজিআই যেদিন হয়ে উঠবে রোজকার প্রতিযোগী, সেদিন হয়তো নিজেদের সাজানো-গোছানো সংসারে নিজেরাই চলে যাব ব্রাত্যজনের দলে।

    স্যাম অল্টম্যান

    এত আশা-আশঙ্কার মধ্যে ভেসে উঠছে নীতির প্রশ্নও। ভবিষ্যতের তুখোড় এআই-এর উপর যদি আর নিয়ন্ত্রণ না থাকে তার সৃষ্টিকর্তার? তখন তো তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা, ভুল তথ্য দেওয়া, পক্ষপাত, নারীনিগ্রহ থেকে বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দ্বেষ— এরকম অনেক সাইবার ক্রাইম-এর অভিযোগ উঠবে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে। এত বিপদবাণী শুনতে শুনতে একটাই খটকা জাগে মনে— সবই তাহলে অন্যের দোষ, থুড়ি টেকনোলজির দোষ? যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, নারীর অবমূল্যায়ন— এসব তো আমাদেরই আবিষ্কার— এই পলিটিকাল ও মিডিয়া কারেক্টনেস-এর যুগেও যা সযত্নে লালিত-পালিত। অপরের প্রতি আমাদের মনে ঘৃণার পরিমাপটা বোঝার জন্য ইতিহাসের পাতা উল্টোতে হবে না, তার জন্য রোজকার সংবাদ আর সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টস সেকশনই যথেষ্ট। আমরা কতটা বর্বর, মণিপুর আবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল। যেটুকু সভ্যতার বড়াই করি, তাও সম্ভব হয়েছে শাস্তির ভয়ে, ভক্তিতে নয়। অতএব ভবিষ্যতের এআই যদি তৈরি হয় আমাদেরই মনের বিষ মিশিয়ে, তখন আয়নাতে মুখ দেখব না বললেও, সত্যিটা থেকে কিন্তু সেদিন মুখ ফেরানো যাবে না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook