কত্তামশাই একেবারে গোঁ ধরে বসেছিলেন, মেয়ে শুনে। ওই ‘ছোটলোকের বেটি’কে কিছুতেই তাঁর বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে দেবেন না! পুলিশওয়ালি বলেই কি বেজাত-কুজাতের মেয়েমানুষ জুতো গটগটিয়ে অন্দরে ঢুকে পড়বে? তদন্তের নামে এটা-সেটা ছোঁয়াছুঁয়ি করবে? বাপ-পিতেমোর আমল হলে হারামজাদিকে নাঙ্গা করে চাবকানো যেত। এখন এই সংবিধানের রাজত্বে জমিদার-জমাদার সবারই একটা করে ভোট! তাই হাত নিশপিশ করলেও একটু সামলে রাখতে হয়। অবশ্য চোখ যে একদম রাঙানো যায় না, তেমন নয়। উঁচু বংশের গরিমা আর রাজনীতির ‘কানেকশন’— লাগাম আর চাবুক, দুটোই মুঠোয় থাকলে ক্ষমতার ঘোড়া এখনও আগের মতোই ছোটানো যায়। এই যে মাড়োয়ারি এক ঠাকুরের মেয়ে যখন এক মুসলিম ছোঁড়ার সঙ্গে নিজের মর্জিতে ভাগলবা হল, আবার হিন্দু ব্রিগেডের হাতে আশিক-সুদ্ধ ধরা পড়ে ঘরে ফেরত এল, তখন কী হয়েছিল? এই পুলিশওয়ালি অঞ্জলি ভট্টি খুব তো ওর স্টেশন অফিসারদের সঙ্গে গিয়েছিল ঠাকুরদের মেয়ের বয়ান নিতে, কিন্তু পেল ঢুকতে? মেয়ের বাবা তো অফিসারদের মুখের ওপরেই সাফ বলে দিয়েছিল, নীচু জাতের কাউকে অন্দরমহলে ঢুকে ঠাকুরবাড়ির মান-ইজ্জত নিলাম করতে দেওয়া যাবে না। স্টেশন অফিসারকেও তো মুখ চুন করে, সুড়সুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তব্বে? আছে বাবা, কেতাবে তো কত কথাই লেখা থাকে! তাই বলে জাত-ধর্ম-সমাজ-সংস্কার সব জলাঞ্জলি দিতে হবে না কি?
অঞ্জলির মা-ও তো মেয়েকে পইপই করে সেই কথাটাই বোঝাতে চান। বড় সরকারি অফিসার বাবা লাই দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথা খেয়ে গেছেন। ‘মেয়েমানুষ’-এর বদলে মেয়েকে এক ‘খাঁটি মানুষ’ করতে চেয়েছেন। আর তাতেই তো মেয়ের মাথায় এসব ভূত চেপেছে। পুজো-পাঠ, ঘরের কাজে মন নেই। পুলিশের চাকরি করে যেন দেশোদ্ধোর করবেন। আরে, নামের ল্যাজে যতই ভট্টি লাগিয়ে ভটভটি চেপে ঘোরো না কেন, এক মুঠো শহর মানোয়ারের সব বাচ্চা-কাচ্চাও জানে তোমার জাত কী! এখনও স্বজাতির ভেতর দুটো-চারটে পাত্র যদি বা জুটছে, এমন ধিঙ্গিপনা করে বেড়ালে, এরপর তা-ও জুটবে না। কনে দেখানোর দিনে কোথায় মেয়েপক্ষ ভয়ে সিঁটিয়ে একশেষ হয়ে থাকবে, মেয়েকে সাজিয়েগুজিয়ে বরপক্ষের কড়া মাপজোকের সামনে বসাবে, তা নয়— এ-মেয়ে পুলিশের উর্দি পরে কফি-শপে এলেন হবু-বরের ইন্টারভিউ নিতে। ইন্টারভিউ তো নয়, যেন থানা লক-আপে আসামীর পুছতাছ। কী করা হয়, নিজের ব্যবসা না বাপের— আরে! তোর এই সব খবরে কী দরকার? বিধবা মা এরপরে আর মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে? তার দিকটা একবার ভেবে দেখবি না?
অ্যামাজন প্রাইম-এর ওয়েব-সিরিজ ‘দহাড়’-এর প্রোটাগোনিস্ট অঞ্জলি ভট্টি অন্তত প্রথম সিন-এ কোনও আপোশের লাইনে হাঁটেনি। বরং সিরিজের একদম শেষ দৃশ্যে আমরা তাকে রেজিস্ট্রেশন অফিসে দেখি। নামের পেছনে চিপকানো রাজপুত মহিমা ছিটকানো ‘ভট্টি’ পদবিটা ছেঁটে সেই জায়গায় সে তাদের সাত পুরুষের ‘মেঘওয়াল’ পদবিটাই আবার ফেরত আনতে চায়। সেই ‘মেঘওয়াল’, যে-শব্দটা তার নিম্নবর্গীয় আত্মপরিচয়, তা নিয়ে আর কোনো আড়াল-লজ্জা-সংকোচ-অস্বস্তির ধার ধারে না। এমন উলটপুরাণ হয় না কি? ‘ভট্টি’ থেকে সাধ করে ‘মেঘওয়াল’-এ নেমে আসতে চায়? রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানিবাবুটিও বাপের জন্মে এমন বায়না শোনেননি। তাঁর হকচকিয়ে যাওয়া মুখ আর স্বগতোক্তি দিয়েই ‘দহাড়’-এর ওই সিনটা শেষ হয়ে যায়। একই সঙ্গে পুরুষবাদ আর মনুবাদের ডবল-ইঞ্জিনের বিরুদ্ধে অঞ্জলির লড়াইটা যে পরের সিনেও জারি থাকবে, সেটাও মোটামুটি বোঝা যায়।
তবে এই কেরানিবাবুটির মতো একটু ধাঁধা বা চমক আমাদেরও যে লাগে না তা নয়। বলিউডে আমরা এতদিন যে সব সুপার-কপদের দেখেছি, তারা সবাই পুরুষ, একাই ‘দাবাং’— সময় বুঝেই বেরিয়ে আসে তাদের সিংহের সাহস। এবং কম-বেশি সবাই যাকে বলে উচ্চঘর— পান্ডে, সিংহম, সূর্যবংশী! অঞ্জলি যখন তার মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে অফিস যাতায়াত করত, মহল্লার নিষ্কর্মা ছেলেরা তাকে ঠেক থেকে আওয়াজ দিত— ‘লেডি সিংহম।’ অঞ্জলিও পাল্টা খিস্তি করে ভূত ভাগিয়ে দিত। কিন্তু সে মোক্ষম জানত যে ‘লেডি সিংহম’ বা চুলবুল ‘দাবাং’ পান্ডেদের নারী-সংস্করণ হওয়া সম্ভব নয়। ওই পেশির উল্লাস, ওই মাচো-পনা, আইন-আদালত-সাংবাদিককে ওইভাবে উর্দির পকেটে বা সানগ্লাসের মতো কলারের পেছনে ঝুলিয়ে শরীরী মস্তানি বা স্টাইল-স্টেটমেন্ট মেয়ে-পুলিশদের মানায় না। নীচু জাতের লেডি সাব-ইন্সপেক্টর অঞ্জলি ‘ভট্টি’ মেঘওয়াল তাই প্রাইম সাসপেক্ট-এর পৈতৃক হাভেলিতে খানা-তল্লাশি চালানোর সময় দেশের সংবিধানেই ভরসা রাখে। নারাজ কত্তামশাইয়ের ফিউডাল-ফোঁসের মুখে সে ডক্টর আম্বেদকরের মন্ত্র ঝাড়তেই বৃদ্ধ পেট্রিয়ার্ক চুপসে এইটুকু হয়ে যান। তাঁকে পাশ কাটিয়েই অঞ্জলি তার বাহিনী নিয়ে গটগটিয়ে ঢুকে যায়।
এ তো একেবারে হাতের মোবাইল হাঁটুতে রেখে ফটাফট তালি দেওয়ার মতো দৃশ্য, ডায়ালগ! আমাদের লিবারল, গণতান্ত্রিক, শহুরে বিবেকের ইচ্ছে-পূরণের হেব্বি আয়োজন। তবে অঞ্জলি ভালই জানে, সংবিধান দেখিয়ে মাঝেমধ্যে সরকারি কাজ উদ্ধার হলেও, সমাজ বা পাবলিকের মন বা চিন্তার ধরন অন্য চিজ! সেখানে অঞ্জলি উর্দিতে দুই তারা লাগানো কোনও পুলিশ অফিসার নয়, সে একজন নারী এবং দলিত। জেলার এস.পি সাহেবের কাছে সে আসলে একটি ‘আইটেম’। পুলিশ অফিসার হিসেবে তার দক্ষতার চেয়েও মেয়ে হিসেবে তার রূপ-যৌবন-যৌন আবেদনেই সাহেবের মনোযোগ বেশি।
আবার মান্ডোসা থানার ওই কনস্টেবল ভদ্রলোকটিকে বা আপনি ভুলবেন কী করে? নিষ্ঠাবান হিন্দু, উচ্চবর্ণ জন্মের গর্বে গর্বিত ওই লোকটি। হারিয়ে যাওয়া বোনের জন্য মিসিং ডায়েরি লেখাতে আসা দলিত যুবকটিকে অফিসঘরের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয় না। আবার অঞ্জলি যখন থানায় ঢোকা-বেরোনোর সময়ে সেই অফিসারদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, প্রত্যেক বারেই দেখা যায়, কনস্টেবলমশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে এক গোছা ধূপ জ্বালিয়ে দরজার বাইরে ধোঁয়া দেয়। ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার। ‘চণ্ডালিনীর ঝি’ নিখোঁজের কেসটা পুলিশি কায়দায় চেপে দেওয়া গেলেও, উর্দিধারী দলিত-কন্যার থানায় আসা-যাওয়া সাংবিধানিক ভাবে আটকানো যাচ্ছে না! তাই অচ্ছুৎকন্যার নোংরা-দূষিত ছোঁয়ায়, সরকারি ভবন যতটা অশুচি হল, সনাতনী ধূপের পবিত্র ধোঁয়ায় তার কিছুটা অন্তত যদি শুদ্ধ হয়!
সুতরাং সংবিধান অঞ্জলিদের সব অপমান ঢেকে দিতে পারে না। তবু ভাল, অঞ্জলির পুলিশের চাকরিটা ‘রিজার্ভ কোটা’য় কি না, সে-প্রশ্নটা কাউকে তুলতে দেখা যায়নি। বলিউডের অমিতবিক্রম, সর্বশক্তিমান সুপার-কপদের কথা বাদ দিন। আমরা গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ওয়েব-সিরিজে, বাস্তবের মাটিতে পা রাখা, নানা রকম মানবিক ইমোশনাল সমস্যায় জেরবার, অনেকটাই রক্তমাংসের ‘ফ্যামিলিম্যান’ যেসব পুলিশ-চরিত্রদের দেখেছি, তাদের কারোরই এই ধরনের পরিচয়ের সংকট ছিল না। রিমা কাটগি-জোয়া আখতারদের ‘দহাড়’ সেখানে ওয়েব-সিরিজের পরিসরটা আরও কিছুদূর বাড়িয়ে দিল। আর এটাও বেশ আশ্চর্যের, ‘দহাড়’-এ অঞ্জলি ‘ভট্টি’ মেঘওয়ালি যখন তার নিজের লড়াইটা লড়ছে, তখনই প্রাইম-এর প্রতিযোগী ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স-এ মুক্তি পেল ‘কাঠাল : আ জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’। মরুভূমি-ঘেঁষা পশ্চিম রাজস্থান থেকে ‘কাঠাল’-এ লোকেশন সরে আসছে উত্তরপ্রদেশে। মওরা নামের, মধ্যপ্রদেশ সীমান্ত থেকে অল্প দূরে ছোট গঞ্জ শহরটায় একটাই থানা। আর সেই থানার থানেদার মহিমা বাসোর। মহিমা তার ‘বাসোর’ পদবিটা নিয়ে একটুও হীনম্মন্যতায় ভোগে না। বরং যে সংবিধানের সমতার নীতি তাকে লেডি কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদে উঠে আসতে সাহায্য করেছে, তাকে সম্মান করে। অবশ্য অঞ্জলির জাতি-পরিচয়টা যেমন মান্ডোয়ার শহরসুদ্ধ লোকের জানা ছিল, মহিমার পরিস্থিতিটা ঠিক তেমনটা ছিল না। সে তার কোয়াটার্সে একাই থাকে। হয়তো তার পরিবার অন্য কোথাও থাকে। সেখানে ‘বাসোর’ পদবিধারী তপশিলী জাতিভুক্তদের হয়তো সামাজিক সংস্কারমাফিক অনেক বেশি কুণ্ঠিত-সংকুচিত থাকতে হয়। কিন্তু এই শহরে মহিমা শুধুই ‘ইন্সপেক্টর ম্যাডাম’। তার পরেও উঁচু বর্ণের কেউ যখন সাবেকি অভ্যাসে বলে ফেলে, নীচু জাতের লোকগুলো সব চোর-ছ্যাঁচড়, মহিমা তখন তার উর্দিতে লাগানো নেমপ্লেটটা দেখায়। সেখানে ‘বাসোর’ পদবিটা জ্বলজ্বল করছে। ওই এক মুহূর্তেই মহিমা যেন তার নিজের সামাজিক আইডেন্টিটিকে গোটা দলিত সমাজের অপমানের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
এই প্রসঙ্গেই আরেকটা ছবির কথা বলা যায়। এই ছবিটাও এখন নেটফ্লিক্স-এ দেখা যাচ্ছে। ‘ভিড়’ নামে এই ছবিটি অতিমারী, লকডাউন ও পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপর্যয়ের ক্যানভাসে আসলে একজন দলিত পুলিশ অফিসারের গল্পই বলছে। এই অফিসারটি উঁচু বর্ণের হাতে হেনস্থা হওয়া তার গরিব আত্মীয়টিকে বড়জোর বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করে আনতে পারে। কিন্তু হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তার প্রেমিকা বামুনের মেয়ে। বিছানায় তাকে আদর করার সময়েও তার মনে হয়— এই রে, ছুঁয়ে দিলাম! সঙ্গমের তুঙ্গ-মুহূর্তে সে ছিটকে সরে আসে। নিজের এই প্রান্তিক, অন্ত্যজ পরিচয়ের ঘোষণাটা উর্দিতে ঝুলিয়েই, সে কোথাও রাজ্যের সীমান্তে আটকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া অসহায়-মরিয়া দশাটা বুঝতে চায়। সে, ইন্সপেক্টর সুরজ সিং ‘টিকাস’ তাই কখনও সিংহম বা চুলবুল পান্ডে হতে পারবে না। পারার দরকারও নেই। তবু তো সুপার-কপদের ব্রহ্মাণ্ডে টিকাস-বাসোর-মেঘওয়ালিরা তাদের আলাদা আকাশ খুঁজে নিচ্ছে।
মহিমার প্রেমিক তার থানারই কনস্টেবল এবং (খুব সম্ভবত) ব্রাহ্মণ। ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় উতরাতে পারেনি বলে তার প্রোমোশন আটকে আছে। বিছানায় যাই হোক, চাকরির জায়গায় বউ ওপরে থাকবে, সেজন্যে তাদের বিয়েতে ছেলেটির বাড়ি থেকে প্রবল আপত্তি। ওদিকে ‘দহাড়’-এ অঞ্জলিরও এক গোপন প্রেমিক আছে। রাতদুপুরে তার বাড়ির দেওয়াল বেয়ে অঞ্জলি অভিসারে যায়। জুলিয়েটের ব্যালকনিতে রোমিওর বদলে, এখানে রোমিওর ছাদে জুলিয়েট। বদমেজাজি, খিস্তিবাজ, ঘোর সিনিক অঞ্জলি আদরকালেও বেশ আগ্রাসী থাকে। তুলতুলে হয়ে গলে যায় না। তবে শরীরের আকর্ষণ বাদ দিলে, এই সম্পর্কটা থেকে অঞ্জলির খুব কিছু প্রত্যাশা আছে বলে মনে হয়নি। বরং দর্শকদের দেখিয়ে-দেখিয়ে সে গর্ভনিরোধক বড়ি খায়। আর এই ওষুধ খেতে-খেতেই, হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের যে-কেসটার তদন্ত সে করছিল, তার সমাধানের নতুন একটা ক্লু মিলে যায়। ‘কাঠাল’-এ মহিমার প্রেমে অবশ্য এতটা অ্যাডাল্ট আমিষগন্ধ নেই, প্রেমিককে সে খানিকটা অপত্যস্নেহে ‘মানুষ’ করে। কাজে ভুল করলে তেড়ে বকা লাগায়। আবার সোনা-বাবু বলে আদর করে মান ভাঙায়। ওদিকে মধ্যপ্রদেশের এক পুলিশ অফিসার যখন এঁটুলির মতো গায়ে পড়ে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে, তখন তাকে মুখের ওপর কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারে। থানার লেডি কনস্টেবলটি স্বামী-সংসারের জন্য ডিউটিতে ফাঁকি দিলে, মহিমা বিরক্ত হয়।
আসলে অঞ্জলি বা মহিমার পেশাদারিত্বে কোনও খামতি নেই। নারী ও ‘পিছড়ে বর্গ’ হিসেবে বাড়তি কাঁদুনি গাওয়া বা ভিক্টিম কার্ড খেলার প্রবণতাও নেই। আবার ‘মর্দানি’-১ ও ২-এ রানি মুখার্জি অভিনীত সিনিয়র পুলিশ ইন্সপেক্টর শিবানী শিবাজী রায়, পুরুষের দুনিয়ায় ‘নারীশক্তির জয়’ প্রতিষ্ঠা করতে যে অকারণ নাটকীয়তা-স্টান্টবাজি আমদানি করেন, অঞ্জলি-মহিমাদের সেটারও দরকার পড়ে না। ‘মর্দানি’-তে ‘দাবাং’-এর চুলবুল পান্ডেকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি থাকলেও, নির্দয়া নারী-পাচারকারী বা সেডিস্ট সিরিয়াল-কিলার ভিলেনকে শায়েস্তা করার জন্য শিবানী আদতে পুরুষ-নায়কদের কায়দায় অ্যাকশন আর ‘মর্দাঙ্গি’-ই দেখান। মহিমা-অঞ্জলিও কিন্তু মেয়ে পাচার কিংবা সিরিয়াল-কিলারের কেসই নাড়াঘাঁটা করে। কিন্তু সেজন্য তাদের নারী-জাগরণের ডাক দিতে হয় না। ভিভিআইপি ক্ষমতাবানদের চটি-চাটা প্রশাসন কিংবা লাভ জিহাদের ধুয়ো তোলা মতলবি রাজনীতির মোকাবিলা করেই তারা নিজেদের বিশ্বাসের জায়গায় ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে। মহিমা যে-মেয়েটিকে উদ্ধার করে, সে-ও তার মতোই দলিত। অঞ্জলি যে সিরিয়াল-কিলারটিকে পাকড়াও করে, নীচু বর্ণের মেয়েরাই ছিল তার মূল টার্গেট। সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তিক, অসহায় এই মেয়েদের নিয়ে ঘরসংসার-নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সে ফাঁসাত, ভোগ করত— তারপর খুন করত। এই কেসটাকে অঞ্জলি কিন্তু পুলিশ অফিসারের যে-কোনও অ্যাসাইনমেন্ট, বড়জোর একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখেছিল— শিবানী রায়ের মতো কোনও ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা হিসেবে নয়। ‘দহাড়’ বা ‘কাঠাল’-এর অঞ্জলি বা মহিমা কোনও আগমার্কা ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ বা সমাজ-সংস্কারক নয়। ‘ভিড়’-এর সুজয় সিং টিকাস-ও নয়। কিন্তু এরা সবাই মিলে একটা অন্য রকম ‘পুলিশের গপ্পো’ (যাকে ‘কপ-স্টোরি’ বললে একটু ছকে পড়ে যেতে হবে!) বলছে। সেখানে লিঙ্গবৈষম্য, জাতের নামে বজ্জাতি, নানা রকম পরিচিতির রাজনীতি-প্রসঙ্গ কোনও জোরজবস্তি ছাড়াই ন্যারেটিভে ঢুকে পড়েছে। আর সেজন্যই ‘দহাড়’-এর সিজন-টু বা মহিমা বাসোরের পরের কোনও তদন্তের জন্য আমাদের আগ্রহটা এমএলএ সাহেবের কাঁঠাল বা এঁচোড়ের মতোই তাজা রইল!