কথাগুলো আমাকে প্রথমে বাবা বলেছিল, ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না। কারোর সাথে ভালভাবে কথাই বলতে পারিস না।’ বাবাকে কোনও উত্তর দিইনি। কেন দেব? এই মুহূর্তে বাবার সৌজন্যে তার হোটেলেই চার বেলা খাওয়া এক্কেবারে ফ্রি। শুধু খাওয়া কেন, হাগা, জামাকাপড়, প্রতিদিনের বিড়ি, এমনকী সপ্তাহের শেষে একটু-আধটু দু’পাত্তর খরচের সৌজন্যে বাবা। অবশ্য এই খরচটা মায়ের মাধ্যমেই পেয়ে থাকি। মা এই দু’পাত্তরের ব্যাপারটা জানে। বাবা জিজ্ঞেস করলে খুব সুন্দর করে আমাকে সাইড করে দিয়ে বলে, ‘ও একটু বন্ধুদের সাথে ফিস্ট করতে গেছে।’
‘প্রতি সপ্তাহে ফিস্টের কী আছে? আর এত খরচের টাকা কে দিচ্ছে?’
মা’কে এই সময়ে চুপ করে থাকতে হয়। একবার মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, ‘ওদের কোন এক বন্ধু চাকরি পেয়েছে, ও সবাইকে খাওয়াচ্ছে।’ আর যায় কোথায়, তার পরের দিন পর্যন্ত বলতে লাগল, ‘দেখলে তো তোমার ছেলের বন্ধুগুলো সব এক-এক করে চাকরি পাচ্ছে, আর তোমারটি? অবশ্য পাবেই বা কীভাবে! যে-ছেলে ভাল করে লোকের সাথে কথা বলতে পারে না, সে কখনও চাকরি পায়?’
কথাগুলো আমারও কানে আসে, প্রেস্টিজেও লাগে। আমি, যার কিনা মাধ্যমিক থেকে সব পরীক্ষায় ভাল নম্বর, তাকে বলে কিনা কথা বলতে পারে না! বাবার সাথে একদিন খুব করে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয়। আমার এক বন্ধু তো বিয়েবাড়িতে নিজের বাবার সাথেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে গেছিল। ওই ঝারি-মারা কেস। চার-চারটে চোখ অথচ পয়েন্ট একটাই। ব্যাস, আর যায় কোথায়! আমি অবশ্য সেরকম নয়। বাবাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমন কথা কেন বলছ? আমি তো দিব্যি কথা বলি।’
‘নিশ্চয়, কথা তো বললি! আমার সেই বন্ধু, একটা বড় ফার্মের অফিসার, খুব ছোট ও সাধারণ একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, তুমি সায়েন্স নিয়ে পড়ে এই ফার্মে চাকরি করবে, আমি কমার্স নিয়ে পড়ে চাকরি করছি। দুজনের কী পার্থক্য?’
‘কই আমি তো ভালো উত্তরই দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, আপনি গ্রহ আমি উপগ্রহ। কোম্পানি হল সূর্য। আলো ও তাপ দিয়ে বাষ্প করলেই কেল্লাফতে। শুষে নেওয়া সব প্রাণের বিনিময়ে আপনার জীবন।’
‘এটা অডিট ফার্ম, তোর সাহিত্যের টিউশন নয়।’
আমি বলতে পারিনি আপনার এই ফার্মে কত হাজার-হাজার টাকার ঘাপলিং-সান্টিং হয়। লাখ লাখ কামাচ্ছেন আর যারা কাজ করছে তাদের নামমাত্র কয়েক হাজার পেমেন্ট। খুব শান্ত থেকে বলেছিলাম, ‘দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্যও নেই।’
তারপর আমি এক্কেবারে অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলাম। সাহিত্যে ফার্ম মানে শব্দ, বাক্য আর এই অডিট ফার্ম মানে টাকাপয়সার হিসেব। দুটোই তো হিসাব গো বাবা। হিসাব করতে না জানলে কীভাবে ছন্দ শিখবে, ছন্দ না শিখলে কীভাবে অডিট করবে?
পরের দিন বাবার মুখে শুনেছিলাম ওই বন্ধু নাকি বাবাকে বলেছে, ‘তোমার ছেলে তো সায়েন্সের ছাত্র, তাহলে কী করে এইসব ছাইয়ের ছন্দ-অলঙ্কার শিখল? এই সব থেকে সামলে থেকো, নাহলে জীবনটা এক্কেবারে কয়লা হয়ে যাবে। সায়েন্সের ছেলে, এই অডিট ফার্মে ভালো না লাগলে অন্য কোথাও ভাল কোনও জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করো।’
বাবা আমাকে কিছু বলেনি। উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি ছিলাম। ‘তাহলে মা ভাত রাঁধছে বলে রুটি রাঁধতে পারবে না, না কি ডিম রাঁধলে, মাংস রাঁধবে না?’ সব জায়গায় এরকম স্পেশালিস্ট থাকলে তো মুশকিল। কোনদিন শুনব লেখাতে স্পেশালিস্ট কেউ হয়ে গেছেন। ‘ইনি, ছন্দের কবিতা লেখেন, ইনি অ-ছন্দের কবিতা লেখেন, ইনি গোল গল্প লেখেন, ইনি চৌকা গল্প লেখেন। আচ্ছা প্রেমের জন্য এমন কেউ স্পেশালিস্ট থাকতে পারেন না? যেমন ইনি বেঁটে স্পেশালিস্ট, ইনি লম্বা স্পেশালিস্ট। ইনি মেয়ের মেয়ে নয়, মেয়ের মা স্পেশালিস্ট।’
‘তোর প্রেম হবে না। সারাটা জীবন ওই ঢ্যাঁড়স হয়েই থাকবি।’
কথাগুলো তানিয়া একদিন মুখের সামনেই বলে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আর আমি ক্যাবলাকান্তের মতো কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন, আমি কি ছেলে নয়!’ খিস্তি দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘তোকে একটা মেয়ে প্রোপোজ করল, আর তুই কী করলি? মুখের সামনে বলে দিলি, ‘তোর মা তো ডাইভোর্সি, এখন শুনছি আরো কারোর সাথে নাকি কীসব সম্পর্ক আছে।’ আরে বাবা যেটা সবাই জানে, এটা মুখের সামনে বলতে হয়?’
আমি তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। ওর কথা পরে মনেও পড়ছিল। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি, ভুলটা কী বলেছিলাম? তবে বুঝতে পারছিলাম, আমার চারদিকে একটা দেওয়াল তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির থেকে বেরোনো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। এইসবের জন্যেই ফিস্টের কথা শুনলেই মা নিজের থেকেই টাকা দেয়। নেহাত সবার থেকে বেশি টাকা দিই, তাই ওরা আমাকে দলে নেয়। না হলে কবে পশ্চাৎ দেশে স-পাদুকা পদাঘাত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত। এমনিতে সাতজনের মধ্যে তিনজন কোনও কথাই বলে না। এমনকী আমি কথা বলতে গেলেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অন্য সবাই আমাকে বারণ করে বলে, ‘কী দরকার বল তো, তুই এক্ষুনি কি সব বলে দিবি!’ আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, কিন্তু সাধারণ কথাগুলোই কেমন যেন হয়ে যায়। লোকজন আমাকে ভুল বোঝে, রেগে যায়। ঘরে-বাইরে আমার চারদিকে একটা দেওয়াল উঠে গেছে। তার ভিতরে আমি একা, এক্কেবারে একা।
২.
চারদিকের দেওয়ালটা দিন-দিন লম্বা হচ্ছে, অনেক-অনেক লম্বা। তার ভিতরে আমি অবশ্য ছোট হয়ে যাচ্ছি। বন্ধুরা এখন নিজেরাই আমার থেকে সরে গেছে। দেখতে পেলেই বলে, ‘তুই বাবা দূরে থাক, এক্ষুনি কাকে কী বলে দিবি।’ আমার অবশ্য সেরকম দুঃখ নেই। এখন সারাদিন ঘরের ভিতরেই থাকি। বিকালটাতে একটু বেরিয়ে সামনে একটা পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। বন্ধু বলতে পুকুরের জলে ভেসে থাকা আমার আমিটা। জিজ্ঞেস করি, ‘ভালো আছ?’ ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দেয়, ‘আমি ভালো, কিন্তু তুমি তো ভালো নেই।’
ভালো থাকা তো একটা চরম আপাত শব্দ। একটা বিরোধিতাও বলতে পারো। মানে এক-একটা পরিস্থিতির বিচারে-মুহূর্তের মধ্যে ভালো থাকাটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ধরো তুমি চাকরি পেলে একরকমের ভালো লাগা থাকে। কিন্ত যে-মুহূর্তে তোমার কোনো বন্ধু তোমার থেকে ভালো চাকরি পেয়ে গেল, ব্যাস, তোমার ভালো লাগা শেষ। মন্দ লাগা শুরু। তবে এত সব কথা বলিনি। ভয় লাগে। এও যদি আমাকে বাচাল বলে দেয়? শুধু বললাম, ‘তুমি কীভাবে জানলে?’ উত্তর দেয় না। একটা মুখোশ আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘পরে ফেলো।’
আমি পরতেই একটা অদ্ভুত শক্তি পাই। নিজেকে জলের মতো মনে হয়। সামনে দাঁড়ানো বা বসে থাকা প্রতিটা মানুষ এক-একটা আধার, একটা জায়গা হয়ে ওঠে। আমাকে ধরে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই সব হিসাব এক্কেবারে সমীকরণের ছাঁচে পড়ে যায়। বাবার বন্ধু থেকে বাবা, আমার বন্ধুরা থেকে তানিয়া, সবাই কীরকম অদ্ভুত ভাবে খুশি হয়ে ওঠে। এমনকী সেই মেয়েটার প্রোপোজে আমি রাজি। বিয়ে করি বা না করি, আমার অন্য বন্ধুদের মতো সাথে নিয়ে ঘোরা তো যাবে! আড়ালে কে কী বলছে জানা নেই, তবে সামনে এখন সবাই বলছে, ‘তোর মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন এসেছে। এখন যা কথা বলছিস ওতেই তো সবাই তোর দাস হয়ে যাবে।’
মায়ের মুখে শুনছি বাবা নিজেও আমার অনেক সুনাম করছে। আমিও মাসের পাওয়া মাইনের প্রায় পুরোটাই বাবার হাতে তুলে দিচ্ছি। এখন ফিস্টে আমাকে সব থেকে কম টাকা দিতে হয়। বন্ধুরা আমার কথা শুনতে চাইছে, আমাকে গ্লাসের জন্যেও কোনও টাকা দিতে হয় না। যদিও আমি সেই অডিট ফার্মটাতে চাকরি করছি। আসলে এই মুখোশটা আমাকে অনেক অলিগলি কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিয়েছে। তবে বাড়িতে এসে মুখোশটা খুললেই সারাটা শরীরে দগদগে ঘা দেখতে পাই। তখনই যন্ত্রণা হয়, কাঁদি। মা এসে হাত বুলিয়ে দিলেও শরীর ঠিক হয় না। সারাটা রাত না ঘুমিয়ে কাটে। অথচ সবাই খুব খুশি। দিন আস্তে-আস্তে রাতের ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে যায়। ঢোকা বা বেরোনোর এই ঢেঁকিটাতে আমাকেও উঠতে বা নামতে হয়। কিন্তু আমি নিজে কি সত্যিই খুশি? উত্তর পাই না। কারণ উত্তরগুলোও এখন মুখোশের ভিতর ঢুকতে বা বেরোতে শিখে গেছে। আমার সাথে প্রতিদিন, প্রতিসন্ধ্যা লুকোচুরি খেলে।