রিলেট’ শব্দটি আমরা বাংলায় খুব ব্যবহার করে থাকি। আমাদের জীবনের বেশ খানিকটা জুড়ে আছে কোনও কিছুর সাথে রিলেট করতে পারা, না-পারার প্রশ্ন। যেমন, গান। এক এক ধরনের মানুষের এক এক রকম গান পছন্দ হবে বা প্রাসঙ্গিক মনে হবে, এটাই গ্রাহ্য। তবে এই রকমফেরের কারণটা ঠিক কী, সে নিয়ে বহুদিন তর্কবিতর্ক চললেও, কোনও পরিষ্কার উত্তর মেলেনি। মেলার কথাও না। একজন ডাক্তারি করেন বলে তাঁর নজরুলের গান পছন্দ, আর তাঁর বন্ধু কাঠের ব্যবসায়ী বলে এলভিস প্রেসলি ভালবাসেন, রুচির বিশ্লেষণ এমন গাণিতিক সূত্র ধরে হয় না! অতএব কে কোন গানের সঙ্গে কেন ‘রিলেট’ করে থাকেন, তার হিসেব করার আগে মেপে নেওয়া ভাল, আমরা ঠিক প্রশ্নগুলো করছি কি না। তিনটি এমন প্রশ্ন প্রায়ই করা হয়ে থাকে— গান কি তার সমসাময়িক পৃথিবীর কথা বলতে পারছে? গান কি যথাযথ ভাষ্যে নিজেকে বোঝাতে পারছে? গানের সঙ্গে রিলেট করা যাবে কি না, সে বিষয়ে শ্রোতার বিচারবুদ্ধিই কি শেষ কথা বলছে? প্রথম দু’টি প্রশ্ন যথাক্রমে কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) এবং ফর্মের (ভাষ্য), তৃতীয়টি প্রাসঙ্গিকতার উৎস নিয়ে।
প্রথম প্রশ্নটিই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। প্রাসঙ্গিকতার বিচারে আমরা সচরাচর গানকে তার সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে মেপে থাকি। কবীর সুমন যখন বলছেন ষাটের দশকে তিনি তাঁর টালমাটাল সময়ের উপযোগী বাংলা গান খুঁজে পাচ্ছেন না, অথবা মোৎজার্ট যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ইতালিয়ান ভাষার গা-জোয়ারির প্রতিবাদে জার্মানে ‘সেরালিও’ সৃষ্টি করে হৈচৈ ফেলে দিচ্ছেন, সেসব ক্ষেত্রে তাঁরা গানের প্রাসঙ্গিকতার বিচার করছেন যুগের প্রয়োজনের নিরিখে। যে-গানে মানুষ তাঁর চারপাশের পৃথিবীর কথা শুনবেন, খুঁজে পাবেন তাঁর যুগের প্রতিবাদী কন্ঠ, স্বাভাবিক ভাবেই সে গানের সঙ্গে তাঁর রিলেট করবার কথা। কিন্তু শুধু এই মাপকাঠিতে গানের প্রাসঙ্গিকতার হিসেব মিলছে কি? ইতিহাস বহুবারই দেখেছে, প্রসঙ্গ পালটে গেলেও বহু গানের জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং বেড়েছে। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ ‘বেলা চাও’ গানটি। এ গান অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতালিয়ান কৃষক আন্দোলনের গান, ১৯৪৩ সালে সেটি ফ্যাসিবাদবিরোধী স্লোগানও হয়ে ওঠে। কিন্তু এমন একটি গান বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা পেল রাজনৈতিক গান হিসেবে নয়, সমকালীন একটি স্প্যানিশ টিভি সিরিয়ালে কিছু ‘রবিন হুড’ গোত্রীয় চরিত্রের বাহাদুরির উচ্চারণ হিসেবে। অর্থাৎ ‘প্রভাতে উঠে দেখি/ দ্বারে ভিনদেশী বর্গী’-র মতো বিষয়বস্তুকে অনায়াসেই তার মূল রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা গেল, এবং তা সত্ত্বেও বহু মানুষ সেই গানের সঙ্গে ঠিকই রিলেট করতে পারলেন। কাজেই, সমসাময়িক পৃথিবীর নিরিখে গানের প্রাসঙ্গিকতা অনেকটা হলেও পুরোপুরি মাপা চলে না। গেলে ‘কালজয়ী’ কথাটি গানের ক্ষেত্রে এত ঘন ঘন ব্যবহৃত হত না।
তবে কি প্রাসঙ্গিকতার রহস্য লুকিয়ে আছে গানের বিষয়বস্তুতে নয়, ভাষ্যে? বাংলার লোকায়ত গানের দিকপালেরা এই রহস্যের সন্ধান জানতেন। সংস্কৃতে শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের ‘এলিট’ ধার্মিক তত্ত্বকে দৈনন্দিন গ্রাম্য জীবনের ভাষ্যে প্রকাশ করে তা এক ধাক্কায় হাজার হাজার মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক করার বিপ্লব এনেছিলেন লালন ফকির, কুবির গোঁসাই, লালশশী, অথবা যাদুবিন্দু। একই ভাবে, সহজেই মনে রাখা যায় এমন কিছু কথ্য শব্দবন্ধের সাহায্যে গান বাঁধার ওস্তাদ ছিলেন বব ডিলান। তাঁর আশেপাশের আর পাঁচজন শিল্পীও সেই সময়ে একই বিষয়ে গান লিখেছেন বটে, তবে ডিলানের গানকে তাঁদের চেয়ে শতগুণ জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছে ‘সহজে রিলেট করা যায়’ এমন ভাষ্য, এমন গঠন। এভাবে দেখতে গেলে গানের প্রাসঙ্গিকতার পিছনে বিষয়বস্তুর চেয়ে ভাষ্যের গুরুত্বটাই বেশি চোখে পড়ে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভাষ্যকে একমাত্র মাপকাঠি বলা কঠিন। কোন ভাষ্য উপযুক্ত অথবা শ্রোতার কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হবে, এর সোজা-সাপটা হিসেব খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। একবিংশ শতাব্দীর শহুরে বাঙালি শ্রোতাদের যে বিরাট এবং ক্রমবর্ধমান অংশ লোকসঙ্গীত নিয়ে মেতে উঠেছেন, তাঁদের দৈনন্দিন ভাষ্যের সঙ্গে লোকায়ত সঙ্গীতের ভাষার কোনও লেনাদেনা নেই। অথচ আদ্যোপান্ত শহুরে তরুণ-তরুণীও দিব্যি রিলেট করছেন, প্রেমালাপ করছেন ‘সোনার গৌর’, ‘চ্যাপটা গুড়ের ভিয়েন’, অথবা রাধাতত্ত্বের মূর্ছনায়। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন শ্রোতারাও মুখের ভাষায় ‘তব’, ‘মম’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন না, অথচ তাঁর জনপ্রিয়তম গানগুলিতে এমন ভাষার ছড়াছড়ি। মানুষ রিলেট করবেন কি না, তাঁর পিছনে ভাষ্যের একটি ভূমিকা রয়েছে ঠিকই, তবে এটাও স্বীকার করা দরকার যে, গানের ভাষ্য মাঝেমধ্যেই তার নিজের একটি কৃত্রিম প্রাসঙ্গিকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। শহুরে বাঙালি যুবক যখন তার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে ‘রাধার নামে বিভোর হয়ে’ মগ্ন থাকার গান গাইছেন, তিনি ওই বাক্যের সন্ধ্যাভাষ্যে অন্তর্নিহিত দেহতত্ত্বের বার্তাটিকে ডিসপ্লেস করে দিচ্ছেন। সেই ডিসপ্লেসমেন্ট সৎ হতে পারে, তার মধ্যে মূল গানকে অপমান করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য না থাকাই স্বাভাবিক, তবে দিনের শেষে ওই ভাষ্যের প্রাসঙ্গিকতাটি কৃত্রিম।
এই কৃত্রিমতার প্রসঙ্গেই আসি শেষ প্রশ্নে— শ্রোতা গানের সঙ্গে রিলেট করবেন কি না, সেটা কি সম্পূর্ণ ভাবেই তাঁর একার সিদ্ধান্ত? টি এস এলিয়ট লিখছেন, ‘কোনও শিল্পীই সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে, একা একা তাঁর শিল্পের অর্থ বা সাংস্কৃতিক মূল্য ঠিক করতে পারেন না।’ আমাদের আলোচনায় এর উল্টো দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ— কোনও শ্রোতার বিচারবোধও নিজে নিজে গানের প্রাসঙ্গিকতা ঠিক করতে পারে না। বিষয়বস্তু বা ভাষ্যের নিরিখে গানের প্রাসঙ্গিকতার বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা প্রথমেই ধরে নিই, শ্রোতা একটি গান গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কি না, সেই চাহিদার উপর তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে। তাঁর এই বিচারবুদ্ধিকে স্বাধীন ধরে নিয়ে আমরা সমালোচনা শুরু করি। বস্তুত তা নয়। আমরা জানি, নব্য উদার কনজিউমারিজমের পৃথিবীতে, বাজার নিজেই নিজের পণ্যদ্রব্যের চাহিদার সৃষ্টি করে। এ পৃথিবীর ক্রেতা-নাগরিকেরা সেই চাহিদার আত্মীকরণ করে নিয়ে তারই বাঁধা পথে বিকিকিনির খেলায় যোগ দেন। যে বাজারে গানের পণ্যীকরণ বহুদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে (এবং উত্তর-ইন্টারনেট যুগে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে), সেখানে এই কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াটি লুকিয়ে ফেলা হয় প্রাসঙ্গিকতা বা ‘লোকে খাচ্ছে’-র মোড়কে। লোকে তো আজকাল অমুক গান বেশ খাচ্ছে, এই উক্তি সহজেই আমাদের সামনে তুলে ধরে একটি স্বাধীন পৃথিবীর ছবি। সে-পৃথিবীতে আমরা কোন গান খাব, বা খাব না, নিজেরাই তার বিচার করে থাকি। আর পাঁচটা পণ্যের মতো এ ক্ষেত্রেও যে গোপন কথাটি গোপনেই থাকে, তা হল, আমাদের এই গানের খিদে সৃষ্টি করার পিছনে বিজ্ঞাপনি বাজার বা প্রযোজকের কূটনীতির বিপুল প্রক্রিয়া। একটু আগে লোকসঙ্গীতের যে শহুরে সাফল্যের কথা লিখলাম, তার পিছনে উৎসাহী শ্রোতাদের আখড়ায় আখড়ায় গিয়ে গান খুঁজে আনার ভূমিকা খুবই কম। বরং তাকে সুকৌশলে চালিত করছে ‘বাউল-ফকির-খমক-একতারা’ ব্র্যান্ডকে নাগরিক ক্রেতার কাছে লোভনীয় করে তোলার অর্থনীতি। গানকে পণ্য বানাবার এই (কাণ্ড)কারখানা লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে নিপুণ অস্ত্রই হল ‘রিলেট’ করার এহেন রূপকথা। এতে একদিকে বাজার চুপিচুপি খেলার মাঠটুকু বেঁধে দিতে পারে, অন্যদিকে সমালোচকদের সহজেই ‘এটা শ্রোতার গণতান্ত্রিক অধিকার, আপনি বাধা দিতে পারেন না’ বলে দাবড়ে দেওয়া যায়।
কোন গানের সঙ্গে কে রিলেট করবেন এবং কেন, এ তর্ক বহুদিন চলবে। কিন্তু আধুনিক যুগে এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের স্বীকার করা আশু প্রয়োজন, যে গান এখন পণ্য হিসেবেই সামাজিক জীবনে ঘোরাফেরা করে। কথাটা মানতে খারাপ লাগতে পারে, তবে এই সত্যটি আমাদের হিসেবের অন্তর্ভুক্ত না করতে পারলে ‘রিলেট করা’ এবং ‘রিলেট করিয়ে দেওয়া’র এই ভয়ানক জট আমরা ছাড়াতে শুরু করতে পারব না।