সে ছিল আমার দিদির বান্ধবী। মানে ঠিক বান্ধবী নয়, একসঙ্গে কলেজে পড়ত। মিশকালো গায়ের রং, পাটের ফেঁসোর মতো রুক্ষ-বাদামি চুল, লিকলিকে হাত-পা, সব মিলিয়ে অপুষ্টির চলমান বিজ্ঞাপন। অত্যধিক রোগা হওয়ার জন্যে চোখগুলো বড়-বড় দেখাত। মালো ঘরের মেয়ে। সুন্দরবনের কাছাকাছি কোনও এক গাঁয়ে ছিল ওদের বাড়ি। হাসনাবাদ থেকে ভুটভুটিতে একবেলার পথ পেরিয়ে ঘাটে নেমে নাকি আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হত। মাঝে দু-দু’টো খাল, বাঁশের সাঁকো, পায়ের নীচে একখানা বাঁশ এবং ধরার জন্যে বুকের কাছাকাছি আরেকখানা, একবার ফসকালেই—
বলতে বলতে সে এমন করে হাসত, যেন ফস্কে যাওয়াটা খুব মজার ব্যাপার।
একটা মাত্র সিন্থেটিক শাড়ি, বহু ব্যবহারে সেটা পাকানো দড়ির মতো গুটিয়ে থাকত। সঙ্গে সস্তা রংচটা ছিটের ব্লাউজ, হাড়-জিরজিরে শরীরে সেটা পাশবালিশের ওয়ারের মতো খলবল করত।
দিদির সঙ্গে প্রায়ই সে কলেজ থেকে আমাদের বাড়িতে এসে উঠত। বিশেষ করে পরীক্ষার আগে নিয়ম করে কয়েকদিন থেকেও যেত।
আমাদের বাড়িতে এলেই সে আমার মায়ের হাতের কাজ টেনে নিয়ে করতে বসে যেত। বাধা দিলেও শুনত না। একগাল হেসে বলত, ‘তোমরা কি আমার পর, মাসি?’
আমাদের সকলকে সে এমন আন্তরিক গলায় ডাকত যে, বাইরের কেউ এলে বুঝতেই পারত না, ও আমাদের কেউ নয়।
কাজ করতে-করতে মায়ের সঙ্গে ওর বাড়ির গল্প ফেঁদে বসত। ওর বাবা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে একবার কত বড় কুমিরের খপ্পরে পড়েছিলেন, বন্যার সময়ে গ্রামে নদীর জল ঢুকে পড়লে ওরা কীভাবে ঘরের চালের উপর বসে দিন কাটিয়েছিল, বাঘ এসে নদীর পাড় থেকে কীভাবে ওদের কালি গাইটার বাছুর ধরে নিয়ে গিয়েছিল, এইসব হাবিজাবি। শুনতে-শুনতে আমাদের প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
গ্রামে ওর আরও কয়েকটা ভাইবোন ছিল। তাদের কথাও বলত। তারা কেউ নাকি প্রাইমারির পরে আর স্কুলে যায়নি। বলত, ‘যাবে কীর’ম করে, হাই ইস্কুলি যেতি হলি যে সেই দু’খানা খাল পেরুতি হয়!’
তবে অল্প বয়স থেকেই তারা নাকি স্বাবলম্বী, কেউ নদীতে মাছ ধরে, কেউ যায় মউলিদের সঙ্গে বাদাবনে মধু সংগ্রহ করতে। এসব কথা বলতে ও বিন্দুমাত্র লজ্জা পেত না। তবে বলার সময়ে ওর চোখের কোণগুলো চিক চিক করে উঠত।
আমাকে বলত, ‘ভাই, একবার যাবি আমাদের গাঁয়ে? দেখবি, চাদ্দিকি জল আর জল, মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপির মতো আমাদের গেরাম। নদীতি সারা বছর মাছ কিলবিল করে। গুলে, ট্যাংরা, শটিমাছ, কই, চেঙ্গো, চিংড়ি, কত খাতি পারিস দ্যাকপো। বাবারে বলিচি, ওখেনে আমার এট্টা ভাই আছ, একদম রাজপুত্তুরের মতো দেকতি। একবার তোরে নে যাব।’
বাইরে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করলেও আমাদের সঙ্গে সে নিঃসঙ্কোচে আবাদের ভাষায় কথা বলত, যেন আমরা ওর পরিবারেরই মানুষ।
আমি ওর কথার জবাব দিতাম না। সত্যি কথা বলতে কী, ওকে দেখলেই আমার খুব রাগ হত। কিংবা ঘৃণা। ওরকম একটা হাঘরে কুৎসিত মেয়ে দিনের পর দিন আমাদের বাড়িতে এসে পড়ে থাকছে, আমাকে ‘ভাই’ বলে ডাকছে, এটা আমার একেবারে সহ্য হত না।
ও আমার এই উপেক্ষাটুকু গায়ে মাখত না। আমাকে দেখতে পেলে ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ত। নিজের খেয়ালে খলবল করে কত কথা যে বলে যেত! বলত, ‘জানিস ভাই, আমাদের গাঁয়ের শেষে লদীটা পেরুলিই বাদাবন। সেখেন থে রাতবিরেতে দক্ষিণ রায়ের গজ্জন শুনা যায়। মাঝে মাঝে দক্ষিণরায় নদী সাঁতরে গেরামের মদ্যিও চলে আসে, গরু-ছাগল নে যায়। তবে মানষির কোনও ক্ষেতি করে না। করবে কী করে? গাঁয়ে ঢুকবার মুখি মা ওলাবিবির থান যে! দক্ষিণরায় কক্ষণো ওলাবিবিরে অমান্যি করে না। ভাই, যাবি একবার? আমার বাবার লৌকোয় করে বাদাবন ঘুরে আসপি!’
তারপর মা’কে বলত, ‘মাসি, তুমি একবার বলো না, ভাইরে আমার সঙ্গে যেতি। মঞ্জুলারে তো তুমি ছাড়বা না, ভাই একবার যাক আমার সঙ্গে। আমার বাবা-মা খুব খুশি হবে।’
ওর কথা শুনে আমরা সবাই হাসাহাসি করতাম। অথচ ও নির্বিকারভাবে একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে যেত, আমাদের উপেক্ষা কিংবা হাসিঠাট্টা যেন বুঝতে পারত না।
আমার মনে হত, পুরোটাই ওর ভান, সাময়িক আশ্রয় এবং দু’মুঠো খাওয়ার লোভে গায়ে পড়ে কুটুম্বিতা।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাসস্ট্যান্ডে ওর সঙ্গে দেখা। হয়তো বাস ধরার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে এক ছুটে এসে আমার হাত ধরল। তারপর খলবল করে বলতে লাগল, ‘যাক, তোর সঙ্গে দেখা হল তা’লি। আমি তো ভাবদিলাম, আজ বুঝি ভাইয়ির সঙ্গে দেখা হল না।’
পড়ন্ত বিকেলে তার চোখেমুখে উপচে পড়া খুশির আলো, অথচ আমি ভেতরে-ভেতরে চরম ঘৃণা আর লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। বন্ধুরাও সঙ্গে ছিল। তার সেই সহজ আন্তরিক উচ্ছ্বাসে ওদের মুখ টিপে হাসতে দেখে আমি যেন মরমে মরে যেতে লাগলাম।
কোনওরকমে হাত ছাড়িয়ে চলে এলাম বটে, কিন্তু তীব্র রাগে আমার শরীর রি-রি করে জ্বলতে লাগল। বন্ধুদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কেমন দিদি?’
অবজ্ঞার গলায় বললাম, ‘দিদি-ফিদি নয়, আমাদের বাড়িতে এক সময়ে কাজ করত।’
কথাটা তার কানে গেছে কি না বোঝার জন্যে পেছন ফিরে দেখি, সে সতৃষ্ণ ব্যথাতুর চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
কিন্তু তার পরেও ওর ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন দেখিনি। একই রকম সহজ, অকপট এবং আন্তরিক।
তবে এরপর পথেঘাটে ওকে দেখতে পেলেই আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
আমার দিদিও যে ওকে খুব একটা পছন্দ করত, তা নয়। আমাদেরও সে-সময়ে নুন আনতে পান্তা ফুরনো অবস্থা। কিন্তু আমার মা ওকে খুব ভালোবাসত। বলত, ‘সুন্দরবনের ওরকম প্রত্যন্ত গ্রামের নিরক্ষর পরিবারের মেয়ে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় কলেজ পর্যন্ত এসেছে, এটা কি কম কৃতিত্বের কথা? সামর্থ্য থাকলে ওকে আমাদের বাড়িতেই রেখে দিতাম।’
ওর নাম ছিল হিজলা। মানে জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে বলত, ‘সুন্দরবনে গাছ আছে না, হিজল! গরমের সময় হালকা গোলাপি থোকা-থোকা ফুলে ভরে যায়। রাতে ফুটে সকালেই ঝরে যায়, কিন্তু তার মিষ্টি গন্ধে পশুপাখি পর্যন্ত মাতাল হয়ে ছুটে আসে। সেই হিজল থেকে আমি হিজলা।’
পদবি মল্লবর্মণ, কিন্তু নাম বলবার সময়ে সে বরাবরই নিজেকে ‘মালো’ বলে উল্লেখ করত। আমার দিদি হেসে বলত, ‘মল্লবর্মণ বললেও তোর স্টাইপেন্ডের টাকাটা মার যাবে না, হিজলা!’
ও বিষণ্ণ হেসে বলত, ‘প্রথম-প্রথম তাই বলতাম। কিন্তু মল্লবর্মণ শুনলিই লোকে বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে, অ, তার মানে মালো? আমি যেন চুরি-ডাকাতি করে লুকোবার চেষ্টা করছি! মাথায় থাক আমার মল্লবর্মণ! এই ‘মালো’ই আমার ভালো!’
সবার কথা বললেও নিজের কথা খুব একটা বলতে চাইত না হিজলা। প্রাইমারির পর ওর বাবা-মা চাননি যে ও হাইস্কুলে ভর্তি হোক। ওদের গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেক দূরের স্কুল, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, জলকাদা ভেঙে, বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে সেই স্কুলে যাতায়াতও সহজ ছিল না। তবু ওই ছোট্ট বয়েসে কেমন করে যে ওর মধ্যে পড়াশুনো করার অদম্য জেদ চেপেছিল, নিজেও সে-কথা গুছিয়ে বলতে পারত না।
আমার দিদি জিজ্ঞেস করত, ‘অত দূরের স্কুল, একলা যেতে ভয় করত না তোর?’
হিজলা হাসতে-হাসতে বলত, ‘ও মা, ভয় করবে কেন? আমার যা চেহারা, তাতে মেয়ে বলে ভয় পাওয়ার তো কোনও কারণ নেই! শুধু নদী পেরিয়ে আসা বাঘের জন্যি চিন্তা? কিন্তু ওই যে বললাম, চেহারাই আমার রক্ষেকবচ! আমারে দেখে কোন মড়াখেকো বাঘের লোভ হবে, তুই বল!’
বলেই সে হো হো করে হেসে উঠত।
আমার মা বলত, ‘কান পেতে শুনে দেখিস, হাসি না, ওটা আসলে ওর কান্না। একটু সহানুভূতি পেলে দুঃখী মানুষরা ওভাবেই কাঁদে!’
হায়ার সেকেন্ডারির পর ওর বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে খুব চেষ্টা হয়েছিল। মালোদের মেয়ে, বেশি লেখাপড়া শিখলে পাত্র পাওয়া যাবে না, এই ভয়ে ওর পড়াও বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু হিজলাকে কেউ থামাতে পারেনি। ইচ্ছে ছিল বসিরহাট কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু কাছাকাছি আশ্রয় পাওয়ার মতো কেউ না থাকায় জঙ্গলপুরে কোনও এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছিল। অতএব হাবড়া কলেজ।
তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সঙ্গে বাসন মাজা, জল তোলা, ঘর মোছা, গেরস্থালির সব কাজই করতে হত ওকে। সামান্য এবং অনিয়মিত স্টাইপেন্ড, তাই খরচ চালাবার জন্যে দু’একটা টিউশনি ছাড়া উপায় ছিল না। এত কিছু সামলে পড়াশুনো যে সে কখন করত, স্বয়ং ঈশ্বরও জানতেন কি না সন্দেহ।
মাঝে মাঝে ওর কথা পুরোটা বিশ্বাস হত না। সন্দেহ হত, অন্যের সহানুভুতি আদায়ের জন্যে ও হয়তো ওর কষ্টের বারোমাস্যা অতিরঞ্জিত করে বলে।
কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হঠাৎ খবর এল, হিজলার বড়ভাইকে বাঘে নিয়ে গেছে। তখন সে আমাদের বাড়িতে এসে আস্তানা গেড়েছে। ওর ভাই মউলিদের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়েছিল মধু ভাঙতে। সঙ্গীরা তাকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দক্ষিণরায়ের সঙ্গে পেরে ওঠে, সাধ্য কার!
খবরটা শুনে হিজলার সে কী আছাড়িবিছাড়ি কান্না! আমরা ভাবলাম, এমন ভয়ানক খবরের পরে হিজলা হয়তো পরীক্ষাটাই দেবে না।
আমার মা ওর হাতে যাতায়াত ভাড়া দিয়ে বলল, ‘তুই বরং বাড়ি যা। এ-সময়ে একবার তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা উচিত।’
হিজলা কিন্তু গেল না। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘মাসি, বাড়ি গিয়ে কী হবে? ভাইটারে তো আর ফিরে পাব না। পরীক্ষা দিয়ে একেবারে যাব।’
এমন মর্মন্তুদ খবর শোনার পরেও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে ওর অনড় মনোভাব দেখে আমার মা হয়তো একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। আড়ালে বলেছিল, ‘এমন পাষাণ মেয়ে আমি বাপের জন্মে দেখিনি!’
সেবার পরীক্ষা শেষ করে তবে গ্রামে ফিরেছিল হিজলা। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
রেজাল্ট বেরোবার পর সেই সুদূর বাদাবন থেকে একটা চটের থলিতে কয়েকটা বড় কাঁকড়া আর একগাদা ক্যাওড়া ফল নিয়ে এসেছিল দেখা করতে। টেনেটুনে কোনওরকমে পাশ, তাতেই সে মহাখুশি।
নিজেই বঁটি টেনে নিয়ে বসে গেল সেই কাঁকড়া কাটতে। বলল, ‘জানো মাসি, আমাদের গ্রামে আমিই প্রথম গ্রাজুয়েট!’
মা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সে না হয় হল, কিন্তু এবার কী করবি!’
সে বলল, ‘কী আর করব? চাকরিবাকরির চেষ্টা করব! অনার্স থাকলে মাস্টার ডিগ্রিটা করার চেষ্টা করতাম। সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড হত, বলো, মাসি? আপাতত যতদিন চাকরি না পাই, নদীতি চিংড়ির মীন ধরব। আমাদের মালো পাড়ার মেয়ে-বউরা তো ওই করেই বেঁচে আছে! এখানে থাকলি টিউশ্যানি কত্তি পাত্তাম। কিন্তু আমাদের ওদিকি বাচ্চাদের পড়ানোর তো তেমন চল নেই। সবই চাষাভুষো গরিবগুর্বো মানুষ। যে দু’একজন ইস্কুলে যায়, তাদের প্রাইভেট মাস্টার রাখার সামর্থ্য কোথায়!’
অনেক কষ্টে জমানো পয়সায় স্টুডিওতে গিয়ে টুপি আর গাউন পরে ছবি তুলে সেই যে হিজলা গ্রামে ফিরে গিয়েছিল, তারপর আর কখনও সে আমাদের বাড়িতে আসেনি।
আমরাও তার খোঁজ রাখিনি। এক সময়ে ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা।
বেশ কিছু বছর পরে কনিষ্ঠ কেরানির চাকরি পেলাম কলকাতায়। কিছুদিন গ্রাম থেকে যাতায়াত করে বুঝলাম, ওভাবে চাকরি এবং শরীর, দুটো এক সঙ্গে রক্ষা করা যাবে না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে মফস্সল শহরের উপান্তে একখণ্ড জমি কিনব বলে বায়না দিয়েছিলাম। তার জন্যে আক্ষরিক অর্থেই ঘটিবাটি সব বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু রেজিস্ট্রি করাতে গিয়ে পড়লাম ফ্যাসাদে। সরকার নাকি মৌজা ধরে ধরে সব জমির দাম নির্ধারণ করে তালিকা তৈরি করেছে। জমির প্রকৃত মূল্য যা-ই হোক না কেন, স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হবে সরকার নির্ধারিত দামের উপর।
করণিক ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে আঁক কষে মোটা টাকার অতিরিক্ত স্ট্যাম্প ডিউটির নিদান দিয়ে অন্য ফাইল দেখতে লাগলেন।
দেখলাম, বাড়তি অতগুলো টাকা জোগাড় করা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব।
অফিসার ভদ্রলোক সব শুনে বললেন, ‘আপনি এখন প্রভিশনাল রেজিস্ট্রি করিয়ে নিন, পরে যখন বাকি স্ট্যাম্প ডিউটি জমা দেবেন, তখন দলিল পাবেন।’
অগত্যা তাই-ই করতে হল।
এর পরেই পড়লাম সেই আসল গাড্ডায়। প্রায় বছরখানেক বাদে অবশিষ্ট স্ট্যাম্পের টাকা জোগাড় করে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে রসিদ দেখালাম। করণিক ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘এটার একটা জেরক্স রেখে যান, ফাইলটা খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতদিন লাগবে?’
ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে মেপে নিয়ে খিঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘আমি কি জ্যোতিষী না কি, আগাম বলে দেব? মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যাবেন!’
বাধ্য হয়ে অফিস কামাই করে মাঝে মাঝে খবর নিতে যাই, কিন্তু ফাইল আর পাওয়া যায় না। জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে একবার আমাকে জরিপ করেন, তারপর মাছি তাড়াবার মুদ্রায় রাস্তা দেখান।
অফিসারের সঙ্গে দেখা করলাম, কিন্তু তাতেও কাজ হল না। তিনি সরকারি সিস্টেম সম্পর্কে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে দীর্ঘতর অপেক্ষার পরামর্শ দিলেন।
অবশেষে মরিয়া হয়ে গেলাম ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে। আমার সমস্যার কথা সংক্ষেপে লিখে সাহেবের কাছে স্লিপ পাঠালাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে আর্দালি স্লিপ হাতে বেরিয়ে জানালেন, ‘সাহেব এডিএম ম্যাডামকে রেফার করেছেন, আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করুন।’
তিনি নিজেই আমাকে নির্দিষ্ট চেম্বারের বাইরে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
মিনিট পাঁচেকও কাটেনি, হঠাৎ একজন ভদ্রমহিলা চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন। অপেক্ষারত দর্শনার্থীরা শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন। হকচকিয়ে আমিও উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছি, এমন সময়ে তিনি সটান আমার সামনে এসে হাত ধরে বললেন, ‘ভাই, তুই? মাসিমা কেমন আছে? মঞ্জুলার খবর কী?’
সেই একই রকম খলবল করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আমি বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের সেই হিজলা মল্লবর্মণ! তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে অকৃত্রিম খুশির আলো, ঠিক পুরনো দিনের মতো।
নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘দিদি!’
জীবনে প্রথমবার!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র