… ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বুদ্ধিমান, প্রতিভাবানও বলতে পারো। না না এটা অহংকার নয়, তথ্য। তথ্য নিয়ে আর যাই হোক, অহংকার করা চলে না। না হলে এরকম একটা আইসোলেশনের প্ল্যান কোনও মানুষের পক্ষে করা সম্ভব?
স্তব্ধতার শব্দ। জেনরা বলেন, সেটা শোনার চেষ্টা করো, এ সুযোগ জীবনে পাবে না। এই দুর্গসুদ্ধু দ্বীপটা কেনার পর অনেকটা সময় গেছিল সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে, কারণ প্রিভেসিতে ইনট্রুড করাটা আমার একদম পছন্দ নয়। মজার কথা কী জানো, দ্বীপটা সিকিওর করতে যত সময় লেগেছিল তার তিরিশ গুণ সময় লাগল দুর্গটাকে সাউন্ডপ্রুফ করতে। এই যে এত লোক চলাফেরা করছে, তাদের কারো কোনও শব্দ পাচ্ছ? পাবে না। এটা এদের রপ্ত করতে হয়েছে। এখানে শব্দ বলতে তোমার এলোমেলো শ্বাস, হাত-পায়ের নাড়াচাড়া। আমার গলা কিন্তু শুধু তোমার কান অব্দি যাচ্ছে।
‘মানুষ’— এই প্রজাতিটার কথা ভাবলে শুধুই অনুকম্পা হয়, নিজেকে এর অন্তর্ভুক্ত ভেবে লজ্জা করে। এত বোকা কেউ হয় কী করে? চিরকাল তুমি শুনে আসবে ফিল্ম হল ডিরেক্টর্স মিডিয়াম, আর একটা কম্পোজিট আর্ট ফর্ম। যারা এটা বলে, সব গাধা, গাধা। আমার এই লম্বা কেরিয়ারে শুধু একটা হিট, বাকি হয় সুপার হিট, না হলে সুপার-ডুপার। কেন জানো? কারণ চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে প্রথমে তোমাকে পাবলিক পাল্স বুঝতে হবে, দেখতে হবে সেন্টিমেন্ট-এর স্রোতে গপ্পোটা স্মুথলি সেল করছে কি না। লাইট, মেক-আপ, ক্যামেরা রপ্ত করেছি। ঠিক যেরকম নিজেকে অতুলনীয়া রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় অনুশীলন করেছি বাৎস্যায়ন আর দামোদর গুপ্তর কলাকৌশলের। এটা অলওয়েজ ফুলপ্রুফ, বুচ ক্যাসেডি অ্যান্ড দ্য সান্ডেন্স কিডের কয়েন টস, দু’দিকেই এক ছবি।
কাজেই প্রোডিউসার, ব্যয়কারদের শাড়ির খুঁটে বেঁধে রাখতাম। যদি এই বঁড়শিতে কেউ না গাঁথে, তখন এদের বাবারা আছে, মন্ত্রী-সেপাই। তাই চিরকাল যা চেয়েছি, তাই হয়েছে। কথায় বলে না, কুইন্স ডিজায়ার ইজ কুইন্স অর্ডার। অভিনয়? আমার কথা বাদ দাও, আগেই বললাম আমি ট্যালেন্টেড। বাকিদের দেখিয়ে দিয়েছি, না হলে বদল।
তা বলে ডিরেক্টর কি থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে। আমার ইন্সট্রাকশনগুলো পৌঁছে দেবে কে? আসল কথা হল সেন্টিমেন্টের ব্যালেন্স। সেটা যদি ঠিক থাকে, তখন এসব খুচরো ব্যাপার নিয়ে পাবলিক মাথা ঘামায় না। ধরো রবিবাবুব মতো যুগান্তকারী প্রতিভা, কিন্তু ওঁর লেখা থেকে কি কোনও ন্যাশনাল আইকন উঠে এসছে? না। অথচ শরৎবাবুর লেখা থেকে তিন-তিনজন— দেবদাস, শ্রীকান্ত, সব্যসাচী। এমন উদাহরণ পৃথিবীতেই আর আছে কি না সন্দেহ। সেই শরৎবাবু রবীন্দ্রনাথের ঢঙে সংলাপ সাজালেন ‘শেষ প্রশ্ন’-এ। কী হল? টোটাল গোঁত্তা।
২
তুমি তো ঔপন্যাসিক কাম ফোটোগ্রাফার। মানে শুধু বঙ্কিম নয়, সঙ্গে ব্রেঁসো! মানুষ নিয়ে কী ভেবেছ? আমি তো মানুষের ইতিহাস স্ক্যান করে দেখেছি। প্রস্তরযুগটা তবু মানা যায়। বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি নেই, সাহিত্যের বুকনি নেই, আছে শুধু হাঁটা। খিদে পেলে শিকার, ক্লান্ত হলে শুয়ে পড়া, এভাবেই এক সময়ে আকাশ দেখতে দেখতে মরে যাওয়া। তারপর থেকে শুধুই ডিটোরিয়েশন। আর এখন? সামনে নল পেছনে নল, তোমাকে ভদ্রভাবে মরতে অবধি দেবে না। দিজ পিপিল শুড বি হ্যাঙ্গড টিল ডেথ, ইভেন আফটার ডেথ।
এসব নিয়ে ভেবেছ, লিখেছ? তা না লোন টাইগ্রেস, ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড— আমায় নিয়ে এসব হিজিবিজি, বস্তাপচা জিনিস লিখেছ। আর মেল করে করে আমায় তো বটেই এমনকী আমাদের সিস্টেমগুলোকে পর্যন্ত বোর করে দিয়েছ।
তোমার মতো লাখো মেল রোজ আসে, বিশেষ দেখি না। তবে যেটুকু চোখে পড়ে, তাতে ব্যাকুলতার আড়ালে হিংস্র অভিযোগ থাকে। মনে হয় নিজের মতো থাকাটা যেন অন্যায়। আমার বডি আমি আড়ালে রাখব না সামনে, সেটা তো সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।
অথচ দেখো, এতদিন হয়ে গেল উঁকিঝুঁকির বিরাম নেই। প্লেন থেকে সি-প্লেন, জাহাজ বা লঞ্চ থেকে টেলি দিয়ে ছবি। না, মানুষ পাবে কোথায়, কেউ তো বেরোয় না! দ্বীপ আর দুর্গর ছবিই সই। বছর তিনেক আগের সেই ঘটনাটা ভাবো। যে-চপারটা আমাদের সাপ্লাই নামায় তার পাইলটকে ঘুষ দিয়ে একটা পাপারাৎজি উঠে ছবি তুলছিল। সর্বাঙ্গ কালো আলখাল্লায় ঢাকা কিছু লোক বস্তাগুলো নিচে নিয়ে যাচ্ছে। একে অন্যকে আড়াল করে আছে, যাতে ছাদের ফাঁক দিয়ে ভিতরের কিচ্ছু না দেখা যায়। লোকটা উত্তেজিত হয়ে আরও নিচে ঝুলে তুলতে গিয়ে একটা ইনভিজিবল তারে টাচ, ব্যাস ফিনিশ!
নেহাত শহরে আমার অফিসের লোকজন, লইয়াররা অসম্ভব এফিশিয়েন্ট। নাহলে আর কিছু করতে পারুক না পারুক, নির্ঘাত এমন একটা বখেরা খাড়া করত যাতে আমাকে বেরোতে হত। হয়তো কোর্টে, হয়তো পুলিশ স্টেশন বা ওরকমই কোথাও। হল? হল না। হবেও না, সম্ভব নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা মানেই তো হার। আমাকে কে হারাবে? কী করে? কারণ মানুষ আজ যা ভাবে, আমি বহুকাল আগে তা ভেবে রেখেছি। এদের চিন্তার ম্যাপ আমার পকেটে।
যখন আসার অনুমতি দিলাম, কী ভেবেছিলে, নির্ঘাত কোনও বায়োগ্রাফি লেখাব, সঙ্গে অ্যালবাম? কী হল? ঢোকামাত্র শুধু ক্যামেরার ব্যাগ নয়, সমস্ত কিছু— মায় জামাকাপড় অবধি জমা দিতে হল। এখানে আমি ছাড়া সবার এক ড্রেস, ফতুয়া, খাটো পাজামা, স্নিকার। তুমি প্রথম নও, আসার পারমিশন আগেও কাউকে কাউকে দিয়েছি। তবে কখনওই random নয়, খোঁজখবর নিয়ে। এখন ইনফর্মেশন যার, দুনিয়া তার।
এরপর আমার কন্ডিশনগুলো। যেগুলো তোমাকেও মানতে হয়েছে। প্রথমত, এখানে আসছ সে-কথা কাউকে জানানো যাবে না। দ্বিতীয়ত, লইয়ারের তৈরি করা পেপারে সাইন করতে হবে। যাতে লেখা থাকবে, একজন স্বেচ্ছায় আসছে, কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না তার কোনও ঠিক নেই। কেন থাকবে? ভেতরের খবর বাইরে যাক এটা আমি একেবারেই চাই না।
কথায় কথায় অনেকটা সময় চলে গেছে। বুঝতে পারছ না কর্মীদের চোখে ফুটে উঠছে উত্তেজনা, ঠোঁটে হাসির আলগা ঝিলিক। কারণ খেলা হবে, সময় সমাগত। এতক্ষণ ছিলে নরম আলোয়, এবার দেখবে ফিল্মি লাইটিং। চড়া আলোর সঙ্গে পাগল করা ড্রাম। না না আজ ড্রাম নয়, আজ তোমার পছন্দের বোনি এম বা Backstreet Boys! কারণ আজ তুমিই নায়ক। অবশ্য আমাদের দুজনের প্রিয় কাম সেপ্টেম্বর হলেই বা ক্ষতি কী?
ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। খেলা বলতে ২০/২৫ মিনিটের নাটক। আমার কুশীলবদের সঙ্গে রোজই বাইরের কেউ না কেউ না কেউ পারফর্ম করে, আজ তুমি করবে। জানি তুমি কখনও অ্যাক্টিং করোনি, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। সবাই অ্যাক্টর। মুখের ২৪টা মাস্ল এধার-ওধার করে নানা কিছু এক্সপ্রেস করে বা করে না। সঙ্গে চোখ-কণ্ঠা-হাত-পা। শুধু মানুষ নয়, আমি জন্তুদের দিয়েও কাজ করিয়েছি। অবাক হবার কিছু নেই। আমরাও তো বহু জেসচার ওদের থেকে নিয়েছি। আমার ফার্স্ট হলিউড মুভি ‘বিটার মুন’ ভাবো, মরা বাচ্চা কোলে নিয়ে ওই ভয়ংকর চিৎকার, বুক চাপড়ানি— সে তো গরিলাদের নকল, ‘অ্যান আগলি ওম্যান’-এ হায়নার হাসি বা ‘লোন টাইগ্রেস’-এ বাজপাখির ছোঁ। আর আমি একা নাকি? ব্রাণ্ডো কী করেছিলেন ‘আ স্ট্রিটকার নেম্ড ডিজায়ার’-এ? চলো চলো, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অন্ধকার বলে বুঝতে পারছ না, ওরা বসে পড়েছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে খেলার। সারা দিনের খাটনির পর এটুকু রিল্যাক্স-সেশন তো দরকার, তাই না? অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে মেক্স জ্যাক আ ডাল বয়। এখনই আলো জ্বলবে, মিউজিকও শুরু হল বলে।
৩
তোমাকে চমকে দিতে চাই না বলে আগেই বলে রাখি, জায়গাটা কিন্তু প্রসেনিয়াম নয়, অ্যাম্ফিথিয়েটার— বা ঠিক তাও নয়, অনেকটা ফিল্মের সেটের মতো। এখানে বড়সড় পুকুর আছে। দুটো টিলা, একটা ঝর্না। দু’দিকে অল্প জঙ্গল। এই নাটকে কোনও স্ক্রিপ্ট নেই। ওনলি অ্যাকশন অ্যান্ড রিঅ্যাকশন। চিন্তা নেই, না পারলে ওরাই করিয়ে নেবে।
এবার আলাপের পালা। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ডানপাশে মরা কাঠের মতো যে শুয়ে আছে, ওর নাম মদনগোপাল। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। আসল সময়ে ইয়াসিন বা ব্যাঙ্কসের চেয়েও ক্ষিপ্র, তায় তোমায় মুখে তুলে জলে ডুবিয়ে দাঁতে গেঁথে তুলে নেবে ওপরে। দর্শকদের হাততালি কে না চায় বলো?
টিলার ওপর যার কাঁটা-কাঁটা ল্যাজটা দেখা যাচ্ছে, ও কনকলতা। ওর স্টাইল হল, প্রথমে ল্যাজের বাড়ি তারপর কামড়। জলের মধ্যে দিয়ে যে তিনজোড়া মার্বেল তোমার জন্য ছুটছে ওরা মদালসা, অম্বালিকা, দেবসেনা। এদের ধরনটা বড্ড প্রিমিটিভ। ছিঁড়ে-কামড়ে শেষ করে দেয়। ওপারে প্রচেতা, বিনায়ক, আরও জনা তিন/চার আছে। চুপচাপ দেখছে। পরে খেলার মতো কিছু বাঁচলে মাঠে নামবে ।
এতক্ষণ যাদের বোবা মনে হচ্ছিল সেই স্পেকটেটারদের গর্জন শুনছ? আঃ, কী অসাধারণ হচ্ছে তোমার অ্যাক্টিং। আক্ষেপ শুধু এই যে, তোমার দেখা হল না। লোয়ার পার্টটা ছিঁড়ছে, গন্ধ পাচ্ছি রক্তের। আর্তনাদ ম্লান করে দিচ্ছে বোনি এম-কে। ছোট সাপ জিভে হালকা ছোবল দিলে যেমন একটার পর একটা বিষের ছোট-বড় বল ফাটে মাথায়, ঠিক সেইরকম। রক্তের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে নামছে তৃপ্তি। এত ছেঁড়াখোঁড়ার পরও তোমার মাথাটা কিন্তু আনটাচ্ড। সোনালি চুলে লাল ছোপ। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে বাইরে। অসাধারণ, অনন্যসাধারণ। ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঢুকে অ্যালিস বলেছিল না একেবারে সেইরকম, wonderfulest।
আমার গেটম্যান কী বলে জানো? ম্যাডাম, বাঁচলে এভাবেই, না হলে নয় ।