তিনজন দুইকোণ
কয়েকজন পরিচালক সত্যের লক্ষ্যে দূরপাল্লার ভল্ল ছোড়েন, কিছু পরিচালক খুঁটিনাটির মধ্যে সত্যের টুকরো ছড়াতে ছড়াতে যান। হং সাং সু দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক, প্রায় সব ছবিতেই তাঁর প্রতিটি দৃশ্য একটি শটে তোলা, ক্যামেরা অধিকাংশ সময় নড়ে না, আর নড়লে তা নিতান্ত একটা লোককে অনুসরণ করার জন্য, বা দৃশ্যের শুরুতে একটা জায়গা ধরে, তারপর প্যান করে প্রকৃত মনোযোগের জায়গায় আসার জন্য। স্টাইল খুব স্পষ্ট এবং সাহসী, দুটো লোক কথা বললে কোনও ক্লোজ-আপ, ওভার-দ্য-শোলডার’এর ছক মানার প্রশ্ন নেই— স্রেফ প্রোফাইলে দুজনকে দেখিয়ে যাওয়া একটানা— কোনও কাট নেই, কোনও তাড়া নেই। গোটা ছবিতেই কাট থাকে খুব কম, একবার পরিচালক বলেছিলেন তাঁর সিনেমার সম্পাদনায় সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে— একদিন। ছবিজুড়ে নিতান্ত সাধারণ মানুষ নিতান্ত বাস্তবোচিত ব্যবহার করে চলে, কখনও কখনও অনেকটা মদ খেয়ে মাতলামি করে, কখনও রেগে ওঠে, কিন্তু প্রধানত শুধু কথা বলে যায় পরস্পরের সঙ্গে। ছেলেরা প্রায়ই যৌনতা চায়, কখনও পায়, কখনও না পেয়ে অন্যত্র রাগ আর ক্ষোভ দেখায়। কথোপকথন, মদ খাওয়া ও যৌনতা চাওয়া— এই পরিধির মধ্যে এই পরিচালকের ছবি ঘোরে আর বারেবারে আমাদের অতি-চেনা জায়গায় আঙুল রাখে। ‘ওম্যান ইজ দ্য ফিউচার অফ ম্যান’ (২০০৪) ছবিতে আমরা দেখি দুই বন্ধুকে, একজন আমেরিকার ফিল্ম-স্কুলে পড়তে গেছিল, একজন এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, তারা বেশ কিছুদিন পর দেখা করছে, এবং এদিক-ওদিক কথা বলার পর, এক বন্ধুর প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে দুই বন্ধুই দেখা করতে যায়। যে বন্ধুটি ফিল্মমেকার হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়, তার প্রেমিকা ছিল মেয়েটি, এয়ারপোর্টে এক সময় বহু কেঁদে বিদায় জানিয়েছিল ছেলেটিকে, ছেলেটি তারপর আর যোগাযোগ রাখেনি। তখন অন্য বন্ধুটি (এখন যে শিক্ষক) মেয়েটির সঙ্গে প্রেমসম্পর্ক— বা বলা ভাল যৌনসম্পর্ক— স্থাপন করে, সেটাও বহুদিন মুলতুবি, ছেলেটি এখন বিবাহিত ও সন্তানের বাবা। তবে ফিল্মমেকার জানেই না, শিক্ষকও মেয়েটিকে পেয়েছে। শিক্ষক ছেলেটি এখন নানা বাহানা করে, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করবে না, শেষে রাজি হয়। যখন ফিল্মমেকারটি মেয়েটির কাজের জায়গায় (একটি Bar) খোঁজখবর করে বেরিয়ে এসে বলে ‘অপেক্ষা করতে বলেছে’, তখন সে হাবেভাবে বোঝায়, শিক্ষকটি চলে গেলেও আপত্তি নেই। কিন্তু শিক্ষক এবার যেতে চায় না, দুজনেই অপেক্ষা করে, মদের দোকানে অনেকটা মদ খায়। মেয়েটি তাদের বাড়ি নিয়ে যায়, সেখানে কিছুক্ষণ পর তার এক প্রতিবেশিনীও আসে। এখানেও মদ চলতে থাকে, ফিল্মমেকার বেশ মাতাল হয়ে পড়ে এবং মেয়েটির কাছে হাঁটু গেড়ে বসে, কখনও পায়ে ধরে, ক্ষমাপ্রার্থনা করতে থাকে, কারণ সে ওভাবে তাকে ছেড়ে গেছিল। বলে, এই জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আমাকে পুড়িয়ে দাও। মেয়েটি বলে, তুমি জানো আমি তোমার জন্য কীভাবে প্রতীক্ষা করেছিলাম, জানো তুমি? প্রতিবেশিনী এসব দেখেশুনে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। শিক্ষক সোফায় শুয়ে পড়ে। ফিল্মমেকার প্রাক্তন প্রেমিকার হাত ধরে একটা ঘরে নিয়ে যায়। ভোরের দিকে মেয়েটি ঘরের বাইরে আসে, শিক্ষক সোফায় জেগে বসে। শিক্ষক তার কাছে যৌনতা চায়। মেয়েটি তাকে আরেকটা ঘরে নিয়ে যায়। সকালে তারা তিনজন বেড়াতে যায়, কিন্তু শিক্ষকের সঙ্গে রাস্তায় একদল ছাত্রছাত্রীর দেখা হয়ে যেতে সে ওদের সঙ্গেই থেকে যায়। ফিরে এসে তাকে আর না দেখতে পেয়ে মেয়েটি বলতে থাকে, এ বাবা, আমরা দেরি করেছি বলে বোধহয় রাগ করে চলে গেছে। প্রাক্তন প্রেমিক বলে, তুমি দেরি করলে ওর রাগ করার কি বিশেষ কোনও কারণ আছে? মেয়েটি বলে, এরকম নীচভাবে কথা বলছ কেন? ছেলেটি, ‘ও, আমি তাহলে নীচ?’ বলে মেয়েটিকে ফেলে চলে যায়। মেয়েটি চেঁচিয়ে বলে, ‘এত সহজ, না?’ ছেলেটি ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘সহজ নয়। আমি কাল সারা রাত জেগে ছিলাম। একটুও ঘুমোইনি।’ মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে। মোটামুটি এই হল গল্প, যদিও এর আগে-পরে কিছুটা আছে।
মানে, এই ছবিতে মূলত আছে প্রেমের ও যৌনতার সন্ধানে দুটি চরিত্র, যারা একই মেয়ের কাছে কিছুদিন সেগুলি যাচ্ঞা করে। মেয়েটিকে তারা দু’বার কামনা করে, পায় ও ত্যাগ করে। মেয়েটির কেমন লাগছে বা লাগতে পারে, তা নিয়ে তারা খুব ভাবিত নয়। শিক্ষক যখন মেয়েটিকে প্রথম চুমু খায়, তখন বারবার স্কার্টের নীচে হাত ঢোকাতে চেষ্টা করে। মেয়েটি বারণ করতে থাকে, শোনে না। শেষে মেয়েটি ছিটকে গিয়ে বলে, তোমাকে আমি বারণ করছি না? বলছি না, এরকম কোরো না? যদি তুমি আমাকে শুধু জড়িয়ে ধরে থাকতে, হয়তো আমি সবই করতে দিতাম। আসলে তোমরা সকলেই পশু, আগের শয়তানটাও শুধু যৌনতা চাইত, তুমিও তা-ই চাও। ছবির গোড়াতেই শিক্ষক নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই ফিল্মমেকারকে বলে, বাড়িতে একটু অসুবিধে আছে রে, চ আমরা কোনও ক্যাফেতে গিয়ে বসি। ক্যাফেতে সে আচমকা রেগে উঠে বলে, যখন আমরা তোর সঙ্গে আমেরিকায় দেখা করতে গেছিলাম, তুই আমার বউকে কেন মার্কিন স্টাইলে জড়িয়ে ধরলি? ফের যদি কোনওদিন বউয়ের গায়ে হাত রেখেছিস তো দেখাব মজা। এদিকে বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে গিয়ে প্রাণপণ চুম্বনে জড়িয়ে পড়তে তার কোনও অপরাধবোধ হয়নি। আবার সে নিজেকে মুক্তমনা বলেও দাবি করে, কারণ বউকে বাথরুমে লুকিয়ে সিগারেট খেতে দেখেও সে বারণ করেনি। তবে বউ ধরা পড়ে গেছে ভেবে সে খুব হাসে। এক সময়ে সে গুচ্ছ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বসে, মদ খেতে খেতে, এক ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করে, শেষ কবে যৌনতা করেছ, কার সঙ্গে, এবং কেমন লেগেছে। একজন ছাত্র যখন বলে, স্যার, আপনি একটু বেশি অশ্লীল কথাবার্তা বলছেন, তখন সে খুব রেগে বলে, তোরা কিছু পড়িসনি, কিছু জানিস না, যা পড়েছিস সব মৃত লেখকের হাবিজাবি লেখা, সত্যিকারের শিক্ষিত হোসনি। ফিল্মমেকার এতদিন পর ফিরে এসে প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে গিয়ে একটু আবেগোচ্ছল ক্ষমা চেয়েই তার শরীরসঙ্গে সম্মতি দিব্যি মেনে নেয়, কিন্তু বন্ধুর প্রতিও তার প্রণয়প্রশ্রয় কোনওভাবেই ক্ষমা করতে পারে না। ছবির গোড়ার দিকে একটা ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, ফিল্মমেকারকে তার এই প্রেমিকা এসে জানায়, তার এক ছেলেবন্ধু তাকে একটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। ফিল্মমেকার তখন মেয়েটিকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে নগ্ন করে সাবান মাখাতে থাকে, বারবার সাবান ঘষতে থাকে তার যোনিতে, মেয়েটি ‘ঠিক আছে, যথেষ্ট হয়েছে’ বললেও থামে না। তারপর সঙ্গমের সময় প্রতি ঝোঁকে ফিল্মমেকার বলতে থাকে, ‘তোমায় আমি শুদ্ধ করছি, বুঝতে পারছ? তোমায় আমি শুদ্ধ করছি।’ প্রেমিকা ধর্ষিতা হয়েছে বলে সান্ত্বনা দেওয়া বা তার সঙ্গে কাঁদা ততটা জরুরি মনে হয় না, যতটা জরুরি হয়ে ওঠে তাকে পরিষ্কার করে নেওয়া। এরপর সে প্রেমিকাকে না জানিয়েই দিব্যি আমেরিকা চলে যাচ্ছিল, কিন্তু শিক্ষক গিয়ে, দুজনেরই বন্ধু হওয়ার দরুণ, এয়ারপোর্টে তাদের মিলন করিয়ে দেয়। তাতে ফিল্মমেকার টসকায় না, কিন্তু এতদিনে ফিরে তার মনে বোধহয় নতুন অনুরাগ জেগেছে। বা শিক্ষক ও ফিল্মমেকার দুজনেই মেয়েটির মধ্যে দিয়ে আবার তাদের অতীত দিন ফিরে পেতে চাইছে। আসলে তারাও জানে না, জীবনের ভাল-না-লাগার অন্তত মুহূর্তগুলো নিয়ে করবেটা কী। ক্যাফেতে গিয়ে, যখন ফিল্মমেকার একা আছে, সে তরুণী ওয়েট্রেস-কে বলে, ‘আপনি আমার সিনেমায় অভিনয় করবেন? আমি একজন ফিল্ম ডিরেক্টর। আপনার মুখটা খুব ইন্টারেস্টিং।’ আর যখন শিক্ষক একা আছে, সে তরুণী ওয়েট্রেস-কে বলে, ‘আপনি আমার মডেল হবেন? আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ন্যুড হতে হবে কিন্তু।’
ছবিজুড়ে ছেলেরা যেমন প্রায় যে-কোনও অজুহাতে যৌনতা চায়, আর কিছু না হোক মুখমৈথুন চায়, মেয়েরাও সহজেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েদের কাছে ব্যাপারটা একেবারে জীবন-মরণ হয়ে দাঁড়ায় না। বরং তাদের অবাক লাগে যখন কেউ খেয়াল করে তার একটা দাঁত একটু ভেঙে গেছে। বা তারা দেখনদারি-রত পুরুষকে সকৌতুকে বলে, মেয়েরা চারপাশে থাকলে আপনি একটু আত্মম্ভরী হয়ে পড়েন, না? ছবির প্রধান ছেলেদুটি যখন মাঝবয়সে এসে ঠিক করতে পারছে না কোনদিকে যাবে, একজন ফিল্ম পড়তে গেছিল কিন্তু আজও একটাও ফিল্ম করতে পারেনি, অন্যজন ইউনিভার্সিটিতে একটা ভাল পোস্টের স্বপ্ন দ্যাখে কিন্তু পাবে কি না জানে না, তারা প্রায় যে-কোনও অসন্তুষ্টির সমাধান হিসেবে যৌনতা চায়। আবার বলতেও ছাড়ে না, এই দক্ষিণ কোরিয়ার কোনও কালচার নেই, এরা সারাক্ষণ সেক্স চাইছে। এই যে ক্লাবরুমগুলো হয়েছে, আদ্ধেক স্কুলছাত্রী ছেলেবন্ধু নিয়ে ঢুকে পড়ছে। ছবির নায়িকাও মাঝবয়সে এসে তার ছবি আঁকার শখ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু সে নিজের পোষা কুকুরটাকে নিয়ে খুব খুশি। ছবির শেষদিকে শিক্ষককে এক ছাত্রী এসে বলে, স্যার, আপনার সঙ্গে একটু মদ খেতে চাই, কিন্তু শুধু আজকের জন্যে। শিক্ষক যখন তাকে বলে, একটা হোটেলে চলো, সে রাজি হয়। কিন্তু তার এক ছেলেবন্ধু পিছন-পিছন এসে, হোটেলে ওদের বন্ধ দরজায় দুমদুম করে মেরে চলে যায়। পরে ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে যখন মেয়েটি ও শিক্ষক দাঁড়িয়ে, শিক্ষক বারবার বলতে থাকে, তুমি একটু গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বোলো, ও যদি রটিয়ে দেয়! মেয়েটি শান্তভাবে বলে, আরে, ও সবাইকে বলে বেড়াবে কেন, আমাকে তো আগে বলবে। ছবিতে ছেলেদের মধ্যে একটা টানা হানটান ও মেয়েদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত স্থিতি দেখা যায়। হয়তো সেজন্যেই নাম হয়েছে, মেয়েরাই মানবের ( না কি পুরুষের) ভবিষ্যৎ। যখন শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধুর প্রেমিকার প্রথম সঙ্গম হয়, মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আমি কি গোঙাতে পারি? শিক্ষক রাজি হয়, তার গোঙানি যে খুব উত্তেজক তা-ও বলে, কিন্তু তার একটু পরেই শিক্ষক ফুরিয়ে যায়। মেয়েটি তাকে বলে, তোমার কি এইরকমই হয়? একটু পরে উঠে বসে শিক্ষক বলে, তোমার পায়ে বড্ড লোম। মেয়েটি যখন বলে, অনেকদিন কামানো হয়নি, ছেলেটি হতবাক, মেয়েদের পা এমনিতেই নির্লোম হয় না? আবার কামাতে হয় না কি? এই শিশু-পুরুষদের পরিচালক সযত্নে অনাবৃত করেন। ছবির যৌন দৃশ্যগুলোয় মেয়েটি নগ্ন থাকলেও, সমগ্র ছবিজুড়ে নগ্নতা বেশি ছেলেদুটিরই।