ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ১১


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (March 18, 2023)
     

    নিঠুর দরদি

    সাধারণত তাঁর ছবিতে কিছু চমক থাকে, নিরীক্ষা থাকে, যা লোককে প্রকাণ্ড ঝাঁকুনি দেয়, কিন্তু ‘ভোরটেক্স’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: গ্যাসপার নোয়ে) দেখে একটা মায়া ও ভয়ের আশ্চর্য মিশ্রণ দর্শককে ভর করে। ছবিটা জরা নিয়ে। ছবি উৎসর্গ করা হয়েছে তাদের, ‘যাদের মস্তিষ্ক পচে যাবে হৃদয়ের আগে’। সোজা কথায়, যারা বেঁচে থাকবে মরে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরেও। মাথা তেমন চলবে না, কিন্তু শরীরে শ্বাস চলবে। ছবিতে এক বুড়ো দম্পতিকে দেখানো হয়। বৃদ্ধার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, অধিকাংশ সময়েই কিছু মনে থাকে না, ভাল বুঝতে পারেন না। বৃদ্ধের হার্টের গোলমাল আছে, বছরতিনেক আগে স্ট্রোক হয়েছিল। বৃদ্ধা উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় ঘোরেন, দোকানে ঢুকে পড়েন। বৃদ্ধ একটা বই লেখার চেষ্টা করেন, সিনেমা ও স্বপ্নের সম্পর্ক বিষয়ে। বৃদ্ধা বহু সময় চুপ করে বসে একটা আবছা ঘোরের মধ্যে কাটান, বৃদ্ধ চেষ্টা করেন তাঁর একটা কুড়ি বছর ব্যাপী পরকীয়া সম্পর্ককে জিইয়ে রাখতে। কখনও বৃদ্ধা বসে বসে একটা ওষুধের সঙ্গে আরেকটাকে মেশান, নিজে সাইকায়াট্রিস্ট ছিলেন, নিজেকেই প্রেসক্রিপশন লিখে দেন খুব কড়া ওষুধের, সেই ওষুধ বা তার মিশেল খেয়ে তাঁর সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু কে দেখবে, বৃদ্ধ তো ঘরে বসে লিখছেন। আবার বৃদ্ধের কাশি হয় ভয়ানক, বৃদ্ধা কি পারবেন বিপদ ঘটলে তাঁর যত্ন নিতে? ছবিটা শুরু হয় একটা ছোট দৃশ্য দিয়ে, যেখানে দম্পতি বারান্দায় বসে খাচ্ছেন। তারপর একটা গান হয়, যা আমাদের দ্রুত ফুরিয়ে আসা আয়ু নিয়েই। তারপরেই, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোবার একটা শটে, পর্দার মধ্যিখান দিয়ে একটা সরলরেখা এসে পড়ে, এবং পর্দা দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একপাশে আমরা বৃদ্ধাকে দেখতে থাকি, একপাশে বৃদ্ধকে। তাঁরা একসঙ্গে বেঁচেছেন অনেক বছর, কিন্তু এবার তাঁদের মৃত্যু নিজের নিজের। মৃত্যু ভাগ করে নেওয়া যায় না। দৃশ্যগুলো পর পর দেখালেই হত, কিন্তু পাশাপাশি দুজনকে দেখানোর পণ নিয়ে, পরিচালক তুলেছেন দ্বিগুণ দৃশ্য, অধিকাংশ সময়েই অবশ্য কিছু ঘটছে না বিরাট, কিন্তু দর্শকের আশ্চর্য রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তও ঘনিয়ে ওঠে, যখন বৃদ্ধা ওষুধ মেশাচ্ছেন কিন্তু পাশের ঘরেই বসে বৃদ্ধ তা খেয়াল করছেন না, অথবা বৃদ্ধের কষ্ট করে লেখা পান্ডুলিপির পাতাগুলো, টেবিল গোছাবার চেষ্টা করতে গিয়ে বৃদ্ধা ফড়ফড় করে একের পর এক ছিঁড়ে একটা বাজে কাগজের বাক্সে ভরে, তারপর তা কমোডে উপুড় করে ফ্লাশ করে দিচ্ছেন, এদিকে বৃদ্ধ পুরো সময়টায় স্নানে ব্যস্ত। তারপর বৃদ্ধ অবশ্য কাঁদছেন, বলছেন সংসারটা পাগলাগারদ হয়ে গেল। কিন্তু দম্পতির ছেলে যখন এসে বলছে, এভাবে তো চলতে পারে না, তুমি অসুস্থ মা অসুস্থ, তোমাদের তার চেয়ে একটা হোমে দিয়ে দিই, বৃদ্ধ বলছেন, আমার এত বই কী করে হোমে নিয়ে যাব, এত জিনিস, আমাদের গোটা অতীত, তা ছেড়ে কী করে থাকব। সত্যি, গোটা ফ্ল্যাট জুড়ে অসংখ্য বই, পত্রিকা, কাগজ, পোস্টার ডাঁই, তাতে বোঝা যায়, তাঁদের যৌবন কেটেছে হইহই করে গোদারের ছবি বা ফ্রান্সের ছাত্রবিপ্লব নিয়ে, গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করার আন্দোলনে, শিল্পের ঝাঁঝালো আরক চাখতে চাখতে, আজ সময়ের নিষ্ঠুর চাবুক-নিয়মে, তাঁরা শুধু নিভন্ত শরীরের দাস, একজনের মস্তিষ্ক নষ্ট, অন্যজন রেস-টা দৌড়চ্ছেন, জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন প্রতিভা ও প্রেম, কিন্তু তাঁরও সংগ্রামের পরিণাম কী হবে তা স্পষ্ট। তাঁদের সন্তান তাঁদের প্রতি যত্নবান, কিন্তু তারও শিশুসন্তান আছে, আর বউয়ের সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি। তাছাড়া মাদকাসক্তির সমস্যা। কথাবার্তায় জানা যায়, সেও একসময়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অর্থাৎ, বার্ধক্য যাঁদের আক্রমণ করেছে, চারপাশের বাস্তব প্যাঁচে তাঁরা একা। তাঁদের নিঃসঙ্গ ও অসহায় অবসান তো অবধারিত, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটার নিষ্ঠুর খুঁটিনাটি-সত্য আমাদের বহু ক্ষেত্রে প্রায় রিয়েল টাইম-এ দেখান পরিচালক, তাঁর দৃষ্টি প্রখর, নাছোড়, কোনও প্রলেপ দিতে নারাজ।

    বৃদ্ধ মিটিং-এ যান, সেখানে গিয়ে নিজের বইয়ের কথা বলেন, আবার একফাঁকে ভেঙে পড়েন প্রেমিকার কাছে আর বলেন এখনও মিস করেন তাঁকে। বৃদ্ধা এক সময় বেশ জ্ঞানে আছেন, তখন নিজের ছেলে ও স্বামীকে বলেন, তিনি মরে গেলে খুব ভাল হয়, সকলে নির্ভার হয়। ছবির গোড়ায় মনে হয়েছিল, একটা চৌকোয় শুধু বৃদ্ধকে, অন্যটায় শুধু বৃদ্ধাকে দেখানো হবে। কিন্তু তাঁদের সন্তানকেও মাঝেমাঝে দেখানো হয়। কখনও, যাদের দেখানো হচ্ছে তারা পাশাপাশি বা মুখোমুখি বসে আছে, সামান্য আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গলে দুটো চৌকোতেই প্রায় একই দৃশ্য ফুটে উঠছে, একটাই যেন প্রসারিত শট, শুধু একটু বিকৃতি তার জোড়টায়, মধ্যিখানের রেখাটায় সামান্য প্রতিসরণ যেন ঘটে গেছে। তাই বৃদ্ধ যখন বৃদ্ধার হাত ধরে আছেন, হাত-ধরাটা তেমন করে আর হয়ে ওঠে না। তাঁদের সন্তান যখন বাবাকে জিজ্ঞেস করে, মাকে কোন ডাক্তার দেখানো হচ্ছে, বৃদ্ধ বলেন তাঁর কাছে একটা বড় তালিকা আছে ডাক্তারের, কিন্তু এখনও দেখানো হয়ে ওঠেনি। বারবার আশ্বস্ত করেন, ঠিক সময় এলেই তিনি ঠিক কাজটা করে ফেলবেন। ফলে বোঝা যায়, অক্ষম ও গোঁয়ার, কালের মারে বিপর্যস্ত ও মানতে-নারাজ প্রাণীদের এই ন্যালাখ্যাপা বন্দোবস্তে, কী ঘটতে চলেছে। এক সময় বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হয়, তিনি মাটিতে পড়ে যান, অনেক পরে বৃদ্ধা জেগে উঠে তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে। বৃদ্ধ অ্যাম্বুল্যান্স ডাকতে বলেন, বৃদ্ধা ছেলেকে ফোন করেন। দর্শক ভয় পাচ্ছিল, বৃদ্ধা সেই চৈতন্যেও থাকবেন কি না, কিন্তু সেই সময় উনি কিছুটা স্বাভাবিক। বৃদ্ধ হাসপাতালে মারা যাওয়ার একটু পরেই, একটা চৌকো কিছুক্ষণের জন্য কালো হয়ে যায়। অন্য চৌকোয় আমরা বৃদ্ধাকে দেখতে থাকি। পরে অবশ্য ফের দুই চৌকোয় আসি। ফের কখনও এক-চৌকোতেও ফিরে যাই। বৃদ্ধা কখনও তাঁর স্বামীকে খুঁজতে থাকেন, রাত্রে স্বামীকে ডাকতে ডাকতে সিঁড়ির কাছে চলে যান, পাশের বাড়ির বেল বাজান, প্রতিবেশী ফেরত দিয়ে যায়, বলে ‘আপনার স্বামী চলে গেছে, আর আসবে না।… সকালে ছেলেকে ফোন করবেন।’ এক সময় দেখি, বৃদ্ধা তাঁর সব ওষুধ কমোডে ফেলে দিচ্ছেন, ওই সময়েই (পাশের চৌকোয়) তাঁর ছেলে নিজের বাড়িতে বসে ড্রাগ নিচ্ছে, তার সন্তান দৃশ্যের শেষদিকে সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। এক দৃশ্যে একটি লোক বৃদ্ধাকে বলে, ‘আপনাকে হোম-এ দিয়ে দেওয়া হবে, ছেলে ব্যবস্থা করেছে।’ বৃদ্ধা তারপর গ্যাসের সুইচগুলো ঘুরিযে গ্যাস খুলে দেন এবং ঈশ্বরের প্রার্থনা করতে করতে বিছানায় গিয়ে নিজের মুখে চাদর টেনে দেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টি উপলক্ষে কিছু ছবি দেখানো হয়, তাঁর শৈশবের, যৌবনের। ছবির শেষে তাঁদের ফাঁকা ফ্ল্যাটটা দেখানো হয় অনেকগুলো স্থিরচিত্রে, তারপর দেখানো হয় তা একেবারে  শূন্য হয়ে গেছে, অর্থাৎ আসবাব নেই, বই নেই, কিচ্ছু নেই। মানে, লোকগুলো মুছে গেল, তাদের অভিজ্ঞানগুলোও আর রইল না। যারা বেঁচেছিল ভালবেসেছিল কষ্ট পেয়েছিল, তারা বেমালুম ও সর্বৈব উবে গেল।

    ছবিটা ‘হরর ফিল্ম’ও তো বটেই, কারণ মানুষের সবচেয়ে আতঙ্কের ভাবনা তো তার অস্তিত্ব-লোপ, বা অস্তিত্বের মূল বলতে যে ক্ষমতা-সমষ্টি, তার প্রধানগুলোর বিনষ্টি। তবে মানুষের আদি ভয় আর আদত বেদনা একসঙ্গে মাখার ফলে ছবিটা কিছুটা নরম হয়ে দর্শকের কাছে আসে। পর্দা আচমকা দুই চৌকোয় বিন্যস্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ছবিটা গল্পহীন হওয়া সত্ত্বেও, শেষে কী হবে দর্শক গোড়া থেকেই আন্দাজ করা সত্ত্বেও, দুই চরিত্রের আমূল অসহায়তা ও ত্রাণহীনতা হৃদয়ে এসে লাগে।

    ছবিটা ‘হরর ফিল্ম’ও তো বটেই, কারণ মানুষের সবচেয়ে আতঙ্কের ভাবনা তো তার অস্তিত্ব-লোপ, বা অস্তিত্বের মূল বলতে যে ক্ষমতা-সমষ্টি, তার প্রধানগুলোর বিনষ্টি। তবে মানুষের আদি ভয় আর আদত বেদনা একসঙ্গে মাখার ফলে ছবিটা কিছুটা নরম হয়ে দর্শকের কাছে আসে। পর্দা আচমকা দুই চৌকোয় বিন্যস্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ছবিটা গল্পহীন হওয়া সত্ত্বেও, শেষে কী হবে দর্শক গোড়া থেকেই আন্দাজ করা সত্ত্বেও, দুই চরিত্রের আমূল অসহায়তা ও ত্রাণহীনতা হৃদয়ে এসে লাগে। প্রাণের আকাঙ্ক্ষা আমাদের সর্বাধিক, প্রাণ চলে যাওয়ার প্রকাণ্ড আতঙ্ক মনের পিছনে বেজে চলেছে সর্বক্ষণ, তাই সহ-প্রাণীর অন্ত বিষয়ে সহমর্মিতা এবং তাদের প্রতি প্রীতি জাগ্রত হয় সহজে। প্রায় ডকুমেন্টারির মতো কিচ্ছু-না-ঘটা মুহূর্তের পর মুহূর্তের নথিবদ্ধকরণ ছবিটাকে সত্য-স্টেটাস দেয়। ছবিটা একঘেয়ে হতেই পারত, অথচ মানুষগুলোর অভিনয়ে এবং চরিত্রগুলোর দৈনন্দিনতা বিষয়ে পরিচালকের নিবিড় মনোযোগে, একটা দরদের পরত এসে পড়ে। এমনিতে গ্যাসপার-বাবুর ছবিতে কিছু বাধ্যতামূলক অস্বস্তি পাওনা থাকে, কেউ তা উপভোগ করেন অধিকাংশ ভুরু কুঁচকে রাখেন, কিন্তু এখানে দুটি চৌকো এসে একাকিত্বের খোপে বন্দি ব্যক্তিভাগ্যকে প্রায় আক্ষরিক ভাবে উপস্থিত করার ফলে, বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিকের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। সিনেমার শুরুতে নায়ক নায়িকার ভূমিকায় অভিনেতাদের ও পরিচালকের জন্মসাল দেখানো হয়। যেন, যা-ই করো, বয়স তোমাকে খাবে, তাই শিল্পীর বয়সও দর্শককে জানিয়ে রাখা ভাল। শেষে চরিত্রগুলোর মৃত্যুসাল দেখানো হয়। ছবি জুড়ে বিদিত থাকে, জীবন নামক একটা উৎসব চলেছে বটে, এবং তুমি বেশ মগ্ন, কিন্তু মনে করো শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর, অসংখ্য আলোকিত ঘরের একের পর এক সুইচ এলোপাথাড়ি ভাবে অফ করে দেওয়া হবে, তাই কিসের পোস্টার কিসের বিপ্লব কিসের সৃষ্টিক্ষণ। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার দেহভস্ম যখন একটা কোটরের মধ্যে রাখা হয়, তাঁদের নাতি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এবার কি দাদু আর ঠাম্মা নতুন বাড়িতে একসঙ্গে থাকবে? বাবা বলে, না, বাড়ি শুধু জীবিতদের জন্য। তাই কোনও বাষ্পাকুল রূপকথা না শুনিয়ে, ছবিটা বলে, লিখনপ্রয়াস আর ফোটোগ্রাফ দিয়ে মানুষের এই সমুদ্রের ধারে বালির বাঁধ তৈরির প্রক্রিয়ার কিছু তিক্ত হাসি ও কিছু অশ্রুফোঁটা প্রাপ্য। নির্ধারিত পরাজয়ের এই আখ্যান সত্যের জোরে আমাদের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।   

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook