গোটা ব্যাপারটায় শ্যামের যে খুব দোষ ছিল, বলা যাবে না। আবার একেবারেই যে ছিল না, সেটাও বলতে পারবেন না! কাণ্ডটা যে ‘আন-সিভিক’, সে তো থ্রি-ফোরের বাচ্চাও বলবে! শেষ সুখটানটা দিয়ে, পোড়া সিগারেটের টুকরোটা কায়দা করে এক টোকায় ছুড়ে ফেলার মধ্যে যে একটা হিরো-হিরো ভাব আসে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। নিজেকে খানিকটা ‘তিন ভুবনের পারে’ বা ‘আকাশকুসুম’-এর সৌমিত্র চ্যাটার্জির মতো লাগে। শ্যামেরও সেরকমটাই লেগেছিল কি না বলতে পারব না। ‘বসন্তবিলাপ’ গল্পে বিমল কর অবশ্য লিখেছিলেন, স্টেশন থেকে বেরনোর সময়ে শ্যাম একটু আনমনা ছিল। তার চোখ একটু দূরের রিকশা-স্ট্যান্ডে খালি রিকশা খুঁজছিল। আঙুলের টোকাটাও ঠিকঠাক হয়নি। পাশে বা দূরে না গিয়ে মুখপোড়া আগুনমুখো টুকরোটা পড়বি তো পড় এক্কেবারে অনুরাধা সিংহ বা সিংহী মানে শ্রীমতি সিংহবাহিনীর শাড়ির কুচিতে। উইকেটে স্টে হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান যেমন অফ স্টাম্পের বাইরের বলে হঠাৎ খোঁচা দিয়ে, স্লিপ বা গ্যালিতে, এমনকী উইকেট-কিপারের হাতে জমা পড়ে বেকুব বনে যায়— এও অনেকটা সেই রকম।
তবে ক্রিকেট ম্যাচে আউট হলে আম্পায়ার শুধু আঙুল তোলে— কলার তো আর ধরে না! কিন্তু বিমল করের গল্পে সিংহবাহিনী সিধে এসে পেছন থেকে বেদম জোরে শ্যামের শার্ট খামচে ধরেছিল। আর তারপরে স্টেশন রোড, রিকশা-স্ট্যান্ড ভর্তি পাবলিকের সামনে যাচ্ছেতাই করে অপমান করেছিল। কী বলেনি সেদিন রাধা শ্যামকে! ইডিয়ট, অসভ্য, জন্তু! বখাটে, নচ্ছাড়, হতচ্ছাড়া! তাছাড়াও অভদ্র, বাঁদর বলেছে। কান টেনে ছিঁড়ে দেবে বলেছে। এমনকী কান টানার ভঙ্গিও করেছে। সব মিলিয়ে বেইজ্জতের একশেষ! তাও তো বিমল করের বর্ণনায় ভিড় জমে যাওয়ার কথা থাকলেও লোকজনের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা নেই। একই গল্প থেকে, একই নামের যে-সিনেমাটা দীনেন গুপ্ত বানালেন, সেখানে তো এই দৃশ্যটা দেখতে-দেখতে দুনিয়াসুদ্ধ পুরুষমানুষের গায়ের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে-ফুটতে একেবারে মাথায় চড়ে যাবে! সিনেমায় সিংহীর থাবা শ্যামসুন্দরের শার্ট টেনে না ধরলেও, পিঠে টোকা মেরেছিল। গল্পের মতো ‘বখাটে, বাঁদর’ এসব না বললেও সিনেমার অনুরাধা শ্যামকে ‘ইডিয়ট’ বলেছিল। ‘চ্যাংড়া’ বলেছিল। চোখ-মুখ ঘুরিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। আর সঙ্গিনীকে নিয়ে রিকশায় উঠে ‘সিন’ ছেড়ে যাওয়ার আগে, অন্তরের বাসনাটা বাইরে হাটের মধ্যে বোমার মতো ফাটিয়ে দিয়ে যায়— ‘ইচ্ছে করে কানটা ধরে লাগাই একটা…!’
বলতে-বলতে রিকশা থেকে রাধার ছুড়ে দেওয়া উড়ন্ত চাঁটিটা যেন শ্যামের গায়ে হাওয়া দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেই সঙ্গে চারপাশের হাওয়াটাও গরম করে দিয়ে যায়। একটু আগেও পাবলিকের যে-ভিড়টা তামাশা দেখছিল আর ‘কী দাদা, সিগারেট ফেলার আর জায়গা পেলেন না! একেবারে মেয়েছেলের কোঁচায়?’ গোছের ফুট কাটছিল, চোখ টিপছিল— তারাই কেমন তেড়িয়া হয়ে আস্তিন-ফাস্তিন গুটিয়ে প্রায় গণধোলাইয়ের বন্দোবস্তে লেগে পড়ে। শ্যামের এটা-ওটা কেটে মাদুলি করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো কথাবার্তাও ভেসে আসতে থাকে।
শ্যাম পাড়ার কোনও বখাটে-বেকার-রকবাজ ছোকরা নয়। মেয়ে দেখলেই হিড়িক মারার স্বভাব তার নয়। না দেখেশুনে সিগারেট ছুড়ে ফেলার জন্যে সে অনুরাধাকে সরি বলেছে। কিন্তু মেয়েটা তারপরেও অ্যায়সা সিন-ক্রিয়েট করে গেল যে, পাবলিক এখন তাকে এই-মারে-কি-সেই-মারে! বিমল করের গল্পে লজ্জায়-অপমানে তো শ্যামের চোখ ফেটে প্রায় জল আসি-আসি করছিল। সিনেমায় তো তার হেনস্থা আরও বেশি! চোখে জল না এনেও সে চোয়াল ঝুলিয়ে, মুখখানা হাঁড়ির মতো গোমড়া করে, তার আশা-ভরসার শেষ স্টেশন লালু বা ললিতাদের বাড়ির আড্ডাখানায় এসে বডি ফেলে দেয়। আর এখান থেকেই ছবিটা মফস্সল শহরের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, শ্যামসুন্দরের নারায়ণী সেনা বনাম অনুরাধার সিংহীবাহিনী থুড়ি প্রমীলা ব্রিগেডের কমেডি-মহাভারত হয়ে ওঠে— হাফ সেঞ্চুরি পার করেও যে-ছবির এক ঝলক দেখলেই বাঙালি টুকুস করে চিপকে যান। এবং মেয়ে-পুরুষে ভাগাভাগি হয়ে, যে যার মতো কমেডির সবটুকু রস এমনকী টাগরা-আলজিভ থেকেও চেটেপুটে লুটে নেন।
বিমল করের মূল গল্পের চাল, ঠমক-চমক— তার গতরভরে সিনেমা একেবারে উপচেই পড়ে। পরিচালক মশাইয়ের কাজ শুধু ব্যাপারটাকে একটু বুঝেশুনে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া। আর দীনেন গুপ্ত এই কাজটা যে বেশ যত্ন করে, মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকের একেবারে মনের মতন করে পারেন, প্রথম ছবি ‘নতুন পাতা’তেই সেই লিটমাস টেস্টে তিনি উতরে গেছেন। একটা পাড়াগেঁয়ের ডানপিটে, বয়ঃসন্ধির গেছো মেয়ে কেমন একটু-একটু করে লক্ষ্মীমন্ত, ঘরের বউ হয়ে ওঠে— সে-গল্পটা ভারি নরম, মিষ্টি করে বলতে পেরেছিলেন তিনি। তরুণ মজুমদারের ‘কাল্ট’ হয়ে যাওয়া ‘বালিকাবধূ’র প্রায় ঘাড়ে-ঘাড়েই অনেকটা কাছাকাছি বিষয়ের একটা সিনেমা বানিয়ে, দর্শকদের সেটা ভাল লাগিয়ে দেওয়া কিন্তু খুব সোজা কাজ ছিল না। ‘নতুন পাতা’তেই প্রমাণিত হয়ে গেছিল, দীনেন গুপ্ত ছবিটা করতে জানেন। সেটাও হয়তো এই কারণেই যে, সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে দীনেন গুপ্তের কাজ শুরু হয়েছিল একজন এভারেস্ট-সমান প্রতিভাবান অথচ শিশুর মতো খেয়ালি, অগোছালো এক পরিচালকের সঙ্গে— যাঁর নাম ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিকের কাজ দেখতে-দেখতেই পরিচালকের ‘ডু’জ’ আর ‘ডু নট্স’গুলো দীনেন মোটামুটি বুঝে ফেলেছিলেন। ঋত্বিকের শুটিং-পর্ব গোছাতে-গোছাতেই তিনি এটাও মগজে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন, ‘ইনফ্যান্ট টেরিবল’ হওয়াটা সবাইকে মানায় না। তাঁকে তো নয়ই!
দীনেন গুপ্ত তাই বরাবর নিজের ক্ষমতার মাপেই ছবি করেছেন। বাড়তি কেরদানি কখনও দেখাতে যাননি। দর্শকের গোঁসা হয়, এমন ঝুঁকি নেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রাস্তায় জীবনে হাঁটেননি। আবার ‘সেফ’ খেলতে গিয়ে শুধুই ঝড়তি-পড়তি, বাজারচলতি মাল বেচতে বসে যাননি। দর্শক কতটা নেবেন, কতটুকু ছুড়ে ফেলে দেবেন, সেইসব হিসেব-নিকেশ করতে-করতেই একটু ‘হট্কে’ কিছু দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কখনও উতরেছেন, কখনও পারেননি। ‘বসন্তবিলাপ’-এ একশো ভাগ পেরেছেন। মূল গল্প থেকে শেখর চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যে-চিত্রনাট্যটা দাঁড় করিয়েছেন, সেটাই তো ‘ম্যাচ উইনার’। বিমল করের গল্পের চলনে টুকটাক সিনেমার ফর্মুলা থাকলেও বাংলা ভাষার একজন বড় গল্পকারের শক্ত কব্জির মোচড় আর ঝকঝকে মেধার ঝলকটাও তো ছিল! আর গল্পের প্রায় শুরু থেকে শেষ অবধি ছড়ানো ছিল একটা হালকা, চাপা যৌনগন্ধ। শ্যামের আঙুলের অন্যমনস্ক ভুল টোকায় সিগারেটটা ছিটকে অনুরাধার শাড়ির ভেতর ‘ছুঁচোবাজির মতো ঢুকে যাওয়া’ থেকেই সেই ইশারাগুলো আসতে থাকে। গল্প যখন একেবারে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছে, তখনও হস্টেলেরই একটি মেয়ে আলো রায় সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘আলোর সুইচটা হাতের কাছেই। কিন্তু সিধুর কেরামতি করার সাহস হল না।’
কেরামতি বা সাহস খুব একটা দেখাতে যাননি শেখর চট্টোপাধ্যায়ও। গল্পের নরম যৌনতাকে আরও ফিনফিনে, প্রায় অদৃশ্য করে, খুব সাবধানে, আলগোছে, সেক্স-কমেডির যাবতীয় সম্ভাবনাকে তিনি এবং পরিচালকমশাই হাসি-থইথই ‘রম-কম’-এর দিকে গড়িয়ে দিয়েছেন। তাই সেখানে সিধু-বেশী চিন্ময় রায়, আলোর ‘সুইচ-টুইচ’ না খুঁজে, পুকুরপাড়ে আলোর হাত ধরে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকেন। পায়ে পা জড়িয়ে একটু খুনসুটি করেন। স্মার্ট প্রেমিকের মতো কপাল দিয়ে আলোর গালে আদুরে টোকা দেন। আর তারপরেই চিন্ময়ের সেই কাল্ট সংলাপ— ‘আমাকে উত্তমকুমার বলো!’ চিন্ময়ের সেই আকুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রেমিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা— আর আলো-রূপী শিবানী বসুর কিছুটা দায়, বেশিটা অবিশ্বাস, আর বাদবাকি পুরোটাই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া, অস্বস্তিভরা মুখে কোনওমতে আউড়ে যাওয়া ‘উত্তমকুমার’— বাংলা সিনেমায় কমেডি-রোম্যান্সের একটা চিরকালের দৃশ্য হয়ে আছে। এরপরেই অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স— পুকুরপাড়ে আচমকা সিধুর কাকিমা হিসেবে গীতা দে-র আবির্ভাব— আর এতক্ষণের বেপরোয়া প্রেমিক সিধুর পুকুরে ঝাঁপ। সিচুয়েশনাল কমেডির চেনা ভাষায় একটু আগের ‘চ্যাপলিনেস্ক’ মজার সলিল সমাধি!
গল্প থেকে সিনেমায় ‘বসন্তবিলাপ’ এভাবেই নানান ধরা-ছাড়ার মধ্যে দিয়ে বক্স-অফিস বা দর্শক-সন্তুষ্টির দিকে এগিয়েছে। যেমন গল্পে আছে, আলো-অনুরাধাদের মেয়ে-হস্টেল যে-বাড়িটায়, সেটার এমনিতে কোনও নাম ছিল না। ‘বসন্তবিলাপ’ নামটা শ্যামদের, মানে শ্যামেরই দেওয়া। যে-বাড়িতে অতগুলো বিয়ে না-হওয়া (বা না-করা) কুমারী মেয়ের বসত, অন্তত মদনদেবের আপাতভাবে নো এন্ট্রি, সে-বাড়িতে বসন্তের ফোঁপানি বা বিলাপ ছাড়া আর কীই-বা হতে পারে! এই নামকরণে অবশ্যই শ্যামের ছুপারুস্তম রসের ভাঁড়ার আর টুকটাক শখের কবিত্বের ছাপ আছে। সিনেমায় সেখানে বাড়ির গায়ে ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলের একটা বড়সড় সাইনবোর্ড ঝোলানোই আছে। তাতে গোটা-গোটা করে লেখাও আছে, ‘বসন্তবিলাপ’। এখন, বাড়ির নাম বাড়িওয়ালাই দিক না শখের কবি শ্যামচন্দরই দিক তাতে কিছু এসে যাচ্ছে না। কারণ দুটো ন্যারেটিভেরই শিরদাঁড়ায় চেপে দাঁড়িয়ে আছে একটাই সত্যি। সেটা হল, মফস্সলি পাড়ার অন্দরে বয়স্কা কুমারী মেয়েদের একটা ‘স্বাধীন’ ভূখণ্ড— একটা প্রবল প্রতাপ ছড়ানো প্রমীলা-রাজ। যেখানে বেশ কয়েকটা মেয়ে, যারা কেউই ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাওয়ার মতো কচি খুকিটি নয়— পাড়ার ছেলে-বুড়ো কাউকেই বিশেষ পাত্তা না দিয়ে, নেচে-গেয়ে-হেসে-খেলে হই-হুল্লোড় করে বেশ আছে।
এই মেয়েরা সব্বাই রোজগেরে। সরকারি আপিসে, ইস্কুলে, হাসপাতালে চাকরি করে। শ্যামদের বন্ধু গুপ্ত-র বাঙাল ভাষায় কাম-কাজ করে! এদের মাথার ওপর অভিভাবক নেই, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ষোলআনা গুমর আছে। এবং দেমাকি-সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে ষাট দশকের শেষ, সত্তরের গোড়ার বাঙালি মধ্যবিত্ত যুবকদের হ্যাংলামো, আদেখলাপনা, অপার কৌতূহল এবং আর একটু বয়স্কাদের বাড়তি ছুঁকছুকানিও আছে। অকুতোভয় এই একপাল মেয়েযোদ্ধা সাইনবোর্ড-ঝোলানো বারান্দা থেকেই বুড়োদের আড্ডা, চ্যাংড়াদের ক্লাব-সহ সব কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ওই বারান্দা যেন বাঙ্কার। ওখানে দাঁড়িয়েই বসন্তবিলাপ-এর মেয়েরা শ্যামদের মিতালি সংঘের ‘বাণী বন্দনা’র ব্যানারের দড়ি কেটে দেয়। দোলের দিনে দলের ছেলেদের মাথায় রঙের বালতি উপুড় করে ঢেলে দেয়। আর স্টেশনের সামনে ছোড়া সিগারেট আর পোড়া শাড়ি দিয়ে আমাদের আলোচনার যে-কুরুক্ষেত্র শুরু হয়েছিল, চিত্রনাট্যের হিসেবমতো সেটা ছিল যুদ্ধের তিন নম্বর রাউন্ড।
ভরা স্টেশন রোড চত্বরে শ্যামের যাবতীয় প্রেস্টিজের বেলুনে পিন ফুটিয়ে, তাকে চুপসিয়ে, আমসি বানিয়ে, নিজেদের দুর্গ বসন্তবিলাপ-এ ফিরে অনুরাধা অ্যান্ড কোং রীতিমতো যুদ্ধজয়ের সেলিব্রেশনে মাতে। শ্যাম আর তার বন্ধুরা যখন গাল ফুলিয়ে, ঘুষি পাকিয়ে, ‘রিভেঞ্জ! রিভেঞ্জ!’ করে দাপাচ্ছে, আর বদলা নেওয়ার নানা রকম উদ্ভট, ছেলেমানুষি এমনকী কখনও-কখনও বেশ ভায়োলেন্ট গোছের উপায় বাতলাচ্ছে আর বাতিল করছে— তখনই বসন্তবিলাপ-এ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, অনুরাধার লিপে চলছে আরতি মুখোপাধ্যায়ের সেই সুপারহিট গান— ‘এক চড়েতেই ঠান্ডা/ ধেড়ে খোকাদের পাণ্ডা!’ এই গানের প্রত্যেকটা লাইনে আর অনুরাধা হিসেবে অপর্ণা সেনের প্রতিটা বডি ল্যাঙ্গোয়েজে যে-বার্তাটা ধেয়ে যায়, তাতে শুধু শ্যাম আর তার মিতালি সংঘের বন্ধুরা নয়, গোটা বাঙালি পুরুষসমাজের গা চিড়বিড়িয়ে ওঠার কথা! এবং সেই চিড়বিড়ানিটাই এই সিনেমার ইউ.এস.পি!
সুতরাং কে জিতছে, কে হারছে, এমন একটা লড়াই-লড়াই ভাবখানা, ছবির অন্তত তিনের দুই ভাগজুড়ে জারি রাখতে পেরেছে। তাই মেয়েরা ছেলেদের সরস্বতী পুজোর ব্যানারের দড়ি কেটে দিলে, ছেলের দলকেও পুজোর সন্ধ্যায় মাইক্রোফোনের সামনে আবৃত্তির নাম করে গাঁকগাঁক করে আবোলতাবোল চেঁচিয়ে মেয়েদের গানের জলসা ভেস্তে দিতে হয়। পাবলিক প্লেসে শ্যামের অমন ভয়ানক অপমানের পরে তাদের পালটা অ্যাকশনও হেব্বি কড়া হয়। মেয়েদের নাম ধরে-ধরে ছড়া কেটে গোটা পাড়ার দেওয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। তবু মেয়ে-হোস্টেল বনাম পাড়ার ছেলেদের এই লাগ-লাগ-লাগ লাগাতার লড়াইয়ের ভাঁজে-ভাঁজেও কোন অদৃশ্য পুষ্পধনু থেকে কামশর ছিটকে এসে বিঁধতেই থাকে! থাকেই! বিমল করের গল্পে বসন্তবিলাপ বোর্ডিং হাউসে বেশ একটা জোরদার তথা জোটদার, রীতিমতো নারীবাদী ঐক্য ছিল। অনুরাধা সিংহীর নেতৃত্বে সে এক চরমপন্থী পুরুষবিরোধী রেজিমেন্টেশন। কিন্তু সিনেমায় বসন্তবিলাপ-এর নারীদুর্গ অত দুর্ভেদ্য ছিল না!
শ্যামকে বাদ দিয়ে দলের বাকিদের বসন্তবিলাপ-বিরোধী জেহাদে অনেক ফাঁক আর ফাঁকি তো ছিলই! লালু, সিধু, এমনকী বাঙাল গুপ্ত অবধি যে যার পছন্দের মেয়েদের জন্য ইঁট পেতে, লাইন লাগিয়ে বা শ্যামের ভাষায় ছিপ ফেলে বসেই ছিল! কিন্তু কথা হচ্ছে, বসন্তবিলাপ-এর তরফেও প্রশ্রয়টা কমবেশি ছিল। আলো, নবনীতার পাশাপাশি বোর্ডিং হাউসের সবচেয়ে সিনিয়র মেয়ে-ইস্কুলের ভূগোল দিদিমণি পার্বতী অবধি কাঠ বেকার গুপ্তর সঙ্গে এক রিকশায় চড়ে বসে— এমনকী আঁচলের আড়াল সরিয়ে, ব্লাউসের মাঝখানে গোঁজা কলমটা বের করে, নিজের শরীরের মানচিত্রেরও বোধহয় একটু আভাস দিয়ে রাখে। মোদ্দা কথা, গানের লিরিকে অনুরাধা যতই বিপ্লবী ডাক দিক— ‘শোন রে মেয়ে, বলছি তোদের/ করিস না কেউ ভয়টা ওদের’ বলে তড়পাক, আর অভয় দিক— বসন্তবিলাপ-এ যে বসন্তের রং ধরতে শুরু করেছে, সেটা রাধা নিজেও বুঝতে পারছিল।
আর অনুরাধার ওই সংযম ও শৃঙ্খলার কঠিন দুর্গে ছোট-বড় ফুটো আর ফাটল ছিল বলেই তো ছবিতে আমরা ষাট-সত্তরের মফস্সল বাংলার ওই ভীতু-ভীতু, লাজুক কিন্তু মিষ্টি-মজার প্রেমের ক-টা ঝলক দেখলাম! সেই দুই বিনুনি-হালকা কাজল-ছোট টিপের চাকুরে মেয়ের সঙ্গে কাকা-দাদার হোটেলে থাকা, হাতখরচের টাকায় ফুটানি মারা রেজিস্টার্ড বেকার ছোকরার রোমান্স করতে চাওয়ার বেপরোয়া দুঃসাহস তো সেই সময়টাকেই মানাত! একইসঙ্গে ‘বসন্তবিলাপ’ কোথাও গিয়ে পঞ্চাশ-ষাট দশকের উত্তম-সুচিত্রার রোমান্সগাথার একটা কাউন্টার-ন্যারেটিভও তৈরি করে ফেলে। উত্তম-সুচিত্রাকে পর্দায় দেখে যেমন বয়সই লাগুক, ছবির টেক্সটে তাঁরা প্রায় সবসময়েই কলেজপড়ুয়া তরুণ-তরুণী। ‘বসন্তবিলাপ’-এ ‘কাম-কাজ’ করা মেয়েদের সবারই বয়স কিন্তু তিরিশের আশেপাশে! পার্বতীর মতো কারুর আবার আরও বেশি! তারা কেউই বয়েস লুকিয়ে কচি খুকি সাজার চেষ্টা করে না। আবার মনের বসন্তকে শুধু-শুধু হাঁপিয়ে মরে যেতেও দেয় না। দোলের দিনে হস্টেলের ঘরে স্বাধীন মেয়েদের নিজেদের একান্ত বসন্তোৎসব, একে-অন্যকে আবির মাখিয়ে মিষ্টিমুখ করানোর মতো এমন আধুনিক দৃশ্য এই ছবিটার আগে বাংলা সিনেমায় কখনও দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না।
আর এই মেয়েদের সঙ্গে সমানে ঝগড়া করে চলেছে যে-ছেলের দল, তারাও কেউ বয়ঃসন্ধির খোকা নয়! শ্যাম ব্যাঙ্কের অফিসার। লালুকে কখনও কাজে যেতে দেখা না গেলেও, ছবিতে তার দাদার কথায় জানা যায়, তারও নাকি একটা অফিস আছে! সিধু আর গুপ্ত সেখানে মুক্ত পুরুষ— অফিস-টফিসের বালাই নেই, সে তো আগেই বলেছি। মেঘে-মেঘে বেলা কারোরই কম হল না! তাদের কাণ্ডকারখানা, হাবভাব একটুও রোম্যান্টিক প্রেমিকদের মতো নয়। তবু তারা প্রেমে পড়ে— আর উত্তম-সুচিত্রা ব্র্যান্ডের রোমান্সকে পেটো ঝেড়ে উড়িয়ে দিয়ে, সে-প্রেম লেগেও যায়। মহুয়া সিনেমাহলের ইভনিং শো-এর দুটো টিকিট হাতে নবনীতার জন্য লালুর অপেক্ষা বা সিনেমার নায়কের মতো গলাটা বেশ রোম্যান্টিক করে আলোর জন্য সিধুর ‘আলো, আমার আলো’ গেয়ে শোনানো, অথবা পার্বতীর সঙ্গে প্রায় গেরিলা কায়দায় গুপ্তের এদিক-ওদিক রিকশা সফরে সেসব প্রেম জল-মাটি-সারও পায়। বসন্তের এই এতোল-বেতোল দখিনা পবনে মফস্সলি নারী-পুরুষের ছদ্ম-লড়াই ঝড়ে উড়ে যায়-যায় দশা, শুধু ইগোর খুঁটিতে তখনও বাঁধা শ্যাম আর রাধা। বোঝাই যাচ্ছিল, এমন মিথিক্যাল প্রেমের ট্যাগ ঝোলানো নামের বাহার যাদের, ক্লাইম্যাক্সে তাদের ‘সঙ্গম’ ‘হোগা… হোগা… হোগা!’ শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর অপেক্ষা একটা ধামাকার।
সেই ধামাকার জন্যেই দোলের দিনে ভরদুপুরে বসন্তবিলাপ-এর ছাদে আলোর খোঁজে আসা সিধুর ওপর অনুরাধার সিংহবাহিনীর ভরপুর হামলা হয়ে যায়। আর মেয়েদের সেই ‘ভায়োলেন্ট অ্যাকশন’-এর জবাবে, লালুর দাদার উকিলি বুদ্ধিতে শ্যামেরা ‘সফ্ট’ দান চালে। খবরের কাগজে ‘পাত্র চাই’ কলামে গোটা মেয়ে-মেসবাড়ির নামেই বিজ্ঞাপন ছেপে দেয়। বিয়ে না-হওয়া (বা না-করা) মেয়েদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত, সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটা নিয়ে এটা চিরকেলে পুরুষসমাজের একটা বদ রসিকতা ভেবে আপনার পলিটিক্যালি সাফসুতরো বিবেক যখন চোঁয়া ঢেকুর তুলছে, তখনই বোঝা যায়, এটা আসলে ফাঁদের মধ্যে আরেকটা ফাঁদ— চক্রান্তের মধ্যে চক্রান্ত। বসন্তবিলাপ আর মিতালি সংঘের চার হাত, থুড়ি চার-চারে ষোল হাত এক করে দেওয়ার জন্য লালুর দাদা-বৌদির মাস্টার প্ল্যান!
‘বসন্তবিলাপ’ ছবিটাও তো এরকমই একটা ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর নিপুণ, হিসেবি রূপায়ণ। ছকের মধ্যে থেকেই ছক ভাঙার চেষ্টা। তার একটা বড় কারণ অবশ্য দীনেন গুপ্ত-র কলাকুশলী টিম। দীনেন তাঁর ব্যক্তিগত প্রযোজনার প্রথম ছবিতেও টিম-ঋত্বিকের ওপরেই নির্ভর করেছিলেন। শিল্প নির্দেশনায় সূর্য চট্টোপাধ্যায় ছেলেদের আড্ডাঘরের মতোই সমান যত্নে মেয়ে-হস্টেলের অন্দরটাও সাজিয়েছেন। দীনেন গুপ্ত বাঙালি মনন মাথায় রেখে বিমল করের সব রেফারেন্স যে মেনেছেন, এমনও নয়। সম্পাদনায় রমেশ যোশীও মেদিনীপুরের লোকেশন আর ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর অন্তর্দৃশ্যকে ভারি মোলায়েম করে মিলিয়েছেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সুধীন দাশগুপ্ত সুর নিয়ে এতরকমের খেলাধুলো করেছেন, তা ছবির প্রত্যেকটা গানকে শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, গানগুলোকে চিত্রনাট্যের হাত-পা-মগজ-হৃদয় বানিয়ে তুলেছিল। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিরিকও সেখানে গানগুলোতে আরও বেশি নাটক এনেছে। অনুরাধা-ব্রিগেড আর শ্যামের পল্টনের একে-অন্যকে টেক্কা দেওয়ার ন্যারেটিভ যেন এই গানের সিকোয়েন্সগুলোয় ফেটে পড়ে।
এই ছবিতে নিজের-নিজের বাড়ির আদর-প্রশ্রয়ের নিশ্চিন্তপনায় থাকা এই ছেলেরা যে জীবনের ময়দানে বসন্তবিলাপ-এর লড়াকু মেয়েদের চেয়ে সব ব্যাপারেই অনেকটাই পিছিয়ে, শ্যামেরা সেটা জানত। শ্যামের অভিনয়ে সেই দ্বিধা, সেই আত্মবিশ্বাসের অভাবটা সৌমিত্র নিয়ে আসেন। পাশাপাশি রবি ঘোষ, চিন্ময় এবং অনুপকুমার— এই তিনজনই কমেডি অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত নাম। তিনজনেরই অভিনয়ের ধরন আলাদা। তাই তিনজনকেই যার-যার নিজস্ব খেলবার মাঠটুকু ছেড়ে দিয়েই সৌমিত্রর ‘শ্যাম’ তার এলাকা খুঁজে নেয়। আর এভাবেই চলন-বলন, চাকরি-বাকরি, লেখাপড়ায় শ্যামের সঙ্গে বাকিদের একটা ক্লাসের তফাত থাকলেও, সব মিলিয়ে সত্তর দশকের মফস্সল বাংলার যৌবন আর বন্ধুত্বের একটা নকশা ঠিক বোনা হয়ে যায়।
বসন্তবিলাপ-এর মেয়ে-হস্টেলে আবার এই নক্সাটা আবার অন্যরকম। সেখানে অনুরাধার ভূমিকায় সুচিত্রা-উত্তর টালিগঞ্জের এক নম্বর নায়িকা অপর্ণা সেন তাঁর সবটুকু গ্ল্যামার, কটাক্ষের সেই অব্যর্থ পঞ্চশর, ঠোঁটের সেই বিখ্যাত পাউটিং এবং কণ্ঠের সেই মাদকতাসুদ্ধুই গোটা ছবিজুড়ে স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন। এ-ছবিতে তিনি একইসঙ্গে ‘কাছে এসো’ আর ‘তফাত যাও’-এর নোটিশ টাঙিয়ে রেখেছেন। শ্যামের দলবলকে তিনি যখন-তখন দাবড়ে এমনকী থাবড়েও দিতে পারেন। বোর্ডিং-এর মেয়ের দল ভয়ে-ভক্তিতে তাঁকে লিডার মানে। তবে ছবিতে অপর্ণার পর্দাজোড়া থইথই জ্যোৎস্নার মতো উপস্থিতি সত্ত্বেও কিন্তু ‘পার্বতী’ কাজল গুপ্তর পড়ন্ত যৌবনের গোধূলি-আলো মুছে যায় না। ‘নবনীতা’ হিসেবে প্রায় নবাগতা সুমিতা মুখোপাধ্যায়ের ঘোর ঘরোয়া, বাঙালিনী, ঢলঢল-কাঁচা অঙ্গের লাবণি ঠিক পড়ে ফেলা যায়। এখানেই ছবিটার জিত। চিত্রনাট্যের অন্দরমহল থেকেই তৈরি হয়ে যাওয়া এই আশ্চর্য টিমওয়ার্কই ‘বসন্তবিলাপ’-এর সাফল্যের গোপন রহস্য। সেজন্যই এখানে একেবারে শেষ দৃশ্য ছাড়া সৌমিত্র-অপর্ণার চেনা-পুরনো পর্দা-রসায়নের দরকার পড়ে না। ক্যামেরার পেছনে, এমনকী সামনেও, সিনেমা যে আসলে যৌথ শিল্প, টালিগঞ্জ এক সময়ে সেটা জানত। তাই ১৯৭৩-এর জানুয়ারিতে জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া সাদা-কালো ‘বসন্তবিলাপ’ ২০২৩-এর জানুয়ারিতেও কোনওরকম ডিজিটাল কেরামতি ছাড়াই রং ছড়ায়। ছড়িয়ে যাবেও।