ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি: পর্ব ৮


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (December 23, 2022)
     

    কাঠপুতুলের প্রাণ

    যখন কোনও বিখ্যাত বই অবলম্বনে কেউ সিনেমা বা অন্য কোনও শিল্প তৈরি করেন, সাধারণত একটা-আধটা অন্যরকম ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, যা মূল বইটায় ছিল না। তবেই ব্যাপারটা নতুন হয়ে ওঠে, পুনর্কথনের একটা সার্থকতা দেখা যায়। আর কখনও, নতুন স্রষ্টা বইটার আদত প্রতিপাদ্যটাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেন এবং গল্পটার কাঠামো মোটামুটি একই রেখে নীতিকথাটা পুরোপুরি উল্টে দেন। যেমন মাইকেল করেছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লেখার সময়। এই কাজই গিয়েরমো ডেল টোরো করলেন, তাঁর স্টপ-মোশন অ্যানিমেশন ছবি ‘পিনোকিও’তে (চিত্রনাট্য: গিয়েরমো ডেল টোরো এবং প্যাট্রিক ম্যাকহেল, পরিচালনা: গিয়েরমো ডেল টোরো এবং মার্ক গুস্তাফসন, ২০২২)। আসল গল্পে, পিনোকিও একটা জ্যান্ত পুতুল, যাকে সবাই মিলে শিক্ষা দেয়, কীভাবে ভাল ছেলে হয়ে উঠতে হবে। ভাল ছেলে মানে, বাধ্য ছেলে, যে গুরুজনের কথা শুনে চলে, সমাজের কথা শুনে চলে। পিনোকিও প্রথমে বাধ্য ছিল না, পরে সে বোঝে কোনটা উচিত আর কোনটা নয়। এই সিনেমায়, ব্যাপারটা অন্যদিকে যায়। পিনোকিও খুবই অবাধ্য, সব কিছুকেই সে প্রশ্ন করে। কাঠের পুতুল প্রাণ পেয়ে প্রথমে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এটা কী, ওটা কী, এটা দিয়ে কী করে, ওটা দিয়ে কী করে। বাবা তাকে আলমারিতে বন্ধ রেখে গির্জায় যায়, সে দরজা ভেঙে সোজা গির্জায় চলে যায়। গির্জায় খুব রেগে যখন পৌরপ্রধান তাকে বলে, ‘অ্যাই পুতুল, তোকে কে নিয়ন্ত্রণ করে?’, সে তার দিকে আঙুল তুলে চেঁচায়, ‘তোমায় কে নিয়ন্ত্রণ করে?’ অন্য এক দৃশ্যে, গির্জায় কাঠের যিশুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘এও কাঠের তৈরি কিন্তু একে সবাই ভালবাসে, আমিও কাঠের তৈরি কিন্তু আমাকে কেউ ভালবাসে না কেন?’ যখন তার যুদ্ধে যাওয়ার কথা, তখন সে পালিয়ে গান-বাজনার দলে যোগ দেয়, আর যখন মুসোলিনির সামনে চমৎকার একটা গান শোনানোর কথা, তখন সে দেশাত্মবোধক গানের অশ্লীল প্যারডি করে মুসোলিনিকে প্রাণপণ চটিয়ে দেয়। উপন্যাসটায়, একজন লোক টেবিলের পায়া তৈরি করতে গিয়ে চমকে ওঠে, কারণ কাঠটা কথা বলছে। তখন একজন খেলনা-তৈরির কারিগরকে কাঠটা দিতে, সে একটা ছেলে-পুতুল তৈরি করে, যার নাম পিনোকিও। এই সিনেমায়, এক খেলনা-কারিগরের ১০ বছরের ছেলে মারা যায়, কারণ যুদ্ধ চলছে এবং প্লেন থেকে বোম ফেলা হচ্ছে। বাবা এত বিষণ্ণ ও অবসন্ন হয়ে পড়ে যে তার সমাধির পাশে বসেই কাটিয়ে দেয় বহু বছর। সারাক্ষণ মদ খায় ও কাঁদে। তারপর এক রাতে, সে খুব রেগে একটা গাছ কেটে কাঠ এনে নিজের নতুন ছেলে গড়তে থাকে। সেই রাতে সে যখন নেশার ঘোরে ঘুমোচ্ছে, এক দেবী এসে পিনোকিওর দেহে প্রাণ দেয়, আর বলে, সে বাবার দুঃখ ঘোচাবে, বাবাকে আর একা থাকতে হবে না। বাবা অবশ্য পরেরদিন উঠে এই জ্যান্ত পুতুল দেখে মোটে খুশি হয় না, তার ওপর পুতুল যখন গোটা ঘরটাকে একেবারে তছনছ করে বেড়াতে থাকে, আর তাকে ‘বাবা’ ডাকে, সে চেঁচিয়ে বলে ‘তুই আমার ছেলে নয়’, এবং তাকে আলমারিতে বন্দি রেখে ‘কোত্থাও যাবি না, বেরোবি না’ বলে, গির্জায় চলে যায়। বাচ্চাটা যখন গির্জায় পৌঁছয়, জ্যান্ত পুতুল দেখে সবাই আঁতকে ওঠে। কেউ বলে এ তো একটা ভূত, কেউ বলে নির্ঘাত কোনও অপ-জাদু দিয়ে এ তৈরি। বাবা কোনওমতে হাবিজাবি বলে তাকে বাঁচায় ও বাড়িতে নিয়ে আসে। তারপর বাবার সঙ্গে কথা বলতে আসে পাদ্রি এবং পৌরপ্রধান (তাকে বলে ‘পোডেস্টা’)। তাদের হট চকলেট খেতে দেওয়া হলে, পিনোকিও বায়না ধরে, সেও খাবে। বাবা যত তাকে ঘরের কোনে গিয়ে বসতে বলে, সে রাজি হয় না। সে পুতুল, কিচ্ছু খাওয়ার দরকার নেই, তবু সে খাবেই। (আগে একবার তাকে এক ঝিঁঝিপোকা বলেছিল ‘বাবার কথার বাধ্য হতে হয়’, শুনে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাধ্য মানে কী’, ঝিঁঝিপোকার উত্তর শেষ হওয়ার আগেই সেখান থেকে চলে গেছিল)। পোডেস্টা ওই অঞ্চলের সবার নৈতিক চরিত্র ঠিক করে, সবই যাতে ফ্যাসিস্ট ইতালির নিখুঁত নাগরিক হয়ে উঠতে পারে তার তত্ত্বাবধান করে, সে বলে এই ছেলেটা কি সারাদিন ধরে শহরে অসভ্যতা করে বেড়াবে না কি, তখুনি বাবা বলে, না না, আমি ওকে তালাবন্ধ করে রাখব। পিনোকিও বলে, সে কিছুতেই বন্দি হবে না, জানলা ভেঙে বাইরে চলে যাবে। পোডেস্টা নিদান দেয়, একে শৃঙ্খলা শেখাতে হবে, ইস্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু ইস্কুল যাওয়ার পথেই পিনোকিও তামাশাওয়ালার পাল্লায় পড়ে ও আইসক্রিম পপকর্ন হট চকলেটের লোভে গান গাইতে চলে যায়। পোডেস্টা বাবাকে বলে, আপনার ছেলে ইস্কুলে যায়নি, এ তো দেখছি একটা বিদ্রোহী, একজন স্বাধীন চিন্তা-করা-লোক টাইপ। এই হল আসল কথা। ইতালিতে যখন মুসোলিনির রাজত্ব চলছে, আর সবাইকে বশ্যতার পাঠ দেওয়া হচ্ছে, তখন কোত্থেকে একটা কাঠের পুতুল এসে ফটাস ফটাস করে প্রশ্ন করে, সবার মতো নম্র-নত হয়ে কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে নেয় না। উপন্যাসের পিনোকিও অবাধ্য থেকে বাধ্য হয়, আর সিনেমার পিনোকিও অবাধ্যতাকেই তার মূলধন করে রাখে, এবং পরিচালক বলেন, অবাধ্যতার মূল্য অসীম, আর একটা ইন্টারভিউতে এও বলেন, তাঁর সিনেমায় ‘সকলেই পুতুল, একমাত্র পুতুলটা একেবারেই পুতুল নয়।’

    পিনোকিওর মতো একটা গল্প, যা শেষ হয় পিনোকিওর কাঠপুতুল থেকে সত্যি-ছেলে হয়ে ওঠা এবং সুখে দিন কাটানো গিয়ে, যে কোনও রূপকথার মতোই— তাকে এমন বেদনাবিধুর একটা সমাপ্তি দেওয়া বেশ চমকপ্রদ

    বাবা যখন পিনোকিওকে গানের আসর থেকে ধরে নিয়ে আসে, আর তামাশাওয়ালা বলে ‘এ আমার’ (কারণ তার চুক্তিতে সই করেছে পিনোকিও), দুজনের টানাটানিতে পিনোকিও ছিটকে গাড়ির তলায় পড়ে এবং মরে যায়। কিন্তু দেখা যায় মৃত্যুদূতেরা  (কঙ্কালের গা-ওয়ালা চারটে খরগোশ) যখন তাস-টাস খেলছে, সে দিব্যি কফিন থেকে বেরিয়ে আসে এবং মৃত্যুর দেবীর সঙ্গে তাকে দেখা করতে হয়। দেবী তাকে বলেন, তোমার তো প্রাণ থাকার কথা নয়, তুমি টেবিল-চেয়ারের মতোই একটা কাঠের পুতুল। আমার বোন, একটা সেন্টিমেন্টাল বুদ্ধু, তোমায় প্রাণ দিয়েছে। তাই তুমি সত্যি মরতে পারবে না কখনও। যতবার মরবে, ততবার এখানে কিছুদিন করে থাকবে, আবার আমি তোমায় ফেরত পাঠিয়ে দেব। পিনোকিও যখন বেঁচে ওঠে, তখন পোডেস্টা বলে, আরে, এ তো অমর। তাহলে সৈন্যদলে ভর্তি করে নেওয়া যাক, কারণ একজন অমর সৈন্যই তো আদর্শ সৈন্য। একে যুদ্ধ শেখার মিলিটারি ক্যাম্পে পাঠানো হবে। বাড়ি ফেরার পথে পিনোকিওর বাবা যখন বলে যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস, পিনোকিও বলে তাহলে সে যুদ্ধে যাবে না, মিটে গেল। বাবা বলে, কিন্তু এটা তো আইন, তাকে যেতেই হবে। পিনোকিও বলে, আইন মানতে হবে কেন, যদি তা একটা খারাপ জিনিসের পক্ষে কথা বলে? বাবা বিরক্ত ও হতাশ হয়ে চেঁচায়, আমি তোকে গড়েছিলাম কার্লোর মতো একটা ছেলে চাই বলে। তুই কেন কার্লোর মতো হতে পারলি না? এর আগে, যখন পিনোকিওকে নাচগানের আসর থেকে নিয়ে এসেছিল, বাবা বলেছিল, তুই কার্লোর বই ছিঁড়ে দিয়েছিস, আমি তোকে বলেছিলাম তুই স্কুলে যাবি, কার্লোর মতো হবি। মৃত্যুর দেবী যখন পিনোকিওকে বলেন, তুমি মরবে না, পিনোকিও জিজ্ঞেস করে, ‘সে তো একটা ভাল ব্যাপার, তাই না?’ দেবী বলেন, তার মানে হল, তুমি কার্লোর মতো একটা সত্যিকারের ছেলে কখনও হতে পারবে না। সবাই সারাক্ষণ তাকে কার্লোর সঙ্গে তুলনা করে। পিনোকিও যুদ্ধ নিয়ে তক্কাতক্কির সময় বাবাকে বলে, আমি কার্লোর মতো নই, কারণ আমি কার্লো নই। আমি কার্লোর মতো হতে চাই না। বাবা তখন বলে, উফ, তুই যে আমার কত বড় একটা বোঝা! পিনোকিও তখন ফের তামাশাওয়ালার দলে গিয়ে যোগ দেয়, যাতে সে নাচ-গান করে প্রচুর পয়সা কামাতে পারে আর সেইসব পয়সা বাবাকে পাঠাতে পারে, যাতে সে ‘বোঝা’ না হয়। অনেক পরে, যখন পিনোকিও সমুদ্রে একটা বোমা ফাটিয়ে নিজের জীবন দিয়ে বাবাকে (এবং বন্ধু ঝিঁঝিপোকা ও বাঁদরকে) দানবিক মাছের গ্রাস থেকে বাঁচায়, এবং মৃত্যুর দেবীকে বলে, সে তখনই ফিরে যেতে চায়, অপেক্ষা করতে পারবে না, কারণ বাবাকে ফের বাঁচাতে হবে, সে অচৈতন্য হয়ে ডুবে মরছে, দেবী বলেন, নিয়ম ভাঙলে ভয়াবহ পরিণামের জন্য তৈরি থাকতে হয়। এখনই ফিরে গেলে সে নশ্বর হয়ে যাবে। এবং বাবাকে বাঁচাতে পারলেও, নিজে মরে যাবে। পিনোকিও তাতে রাজি হয়। দেবী তাকে বলেন, তাহলে নিজের হাতে নিয়ম ভাঙতে হবে, বলে কাচের বালিঘড়ি এগিয়ে দেন। এক মুহূর্ত থমকে, পিনোকিও তা ভাঙে। তারপর সে যখন বাবাকে জল থেকে টেনে তুলে মরে যায়, বাবা তার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের ছেলে বলে ডাকে, বলে, তুই কী স্বাধীন, তোকে আমার দরকার। আবার আগের দেবী উপস্থিত হন, ঝিঁঝিপোকার অনুরোধে পিনোকিওকে ফের জীবন দেন। তখন পিনোকিওর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি চেষ্টা করছিলাম তোকে অন্য একজনের মতো গড়ে তুলতে। কিন্তু তুই তো সে নয়, তুই তো তুই। তাই কার্লোর মতো হোস না, অন্য কারও মতোই হোস না। হুবহু তোর মতোই হ। আমি তোকে ভালবাসি, তুই তোর মতো বলেই। তার মানে, পিনোকিও উপন্যাসটা বলে, কেমন করে পিনোকিও হাজার স্বভাবদোষ কাটিয়ে তার বাবার মনের মতো ছেলে হয়ে উঠল। আর এই সিনেমাটা বলে, কীভাবে পিনোকিওর বাবা তার সীমাবদ্ধতাগুলো পেরিয়ে একজন ঠিকঠাক বাবা হয়ে উঠল। পিনোকিওর মনের মতো বাবা হয়ে উঠতে, তাকে নিজের স্বভাবদোষ কাটাতে হল, বুঝতে হল, কোনও মানুষকে অন্য কোনও মানুষের মতো গড়েপিটে নেওয়ার চেষ্টা করতে নেই। তাকে তার স্বকীয়তা নিয়ে গ্রহণ করতে শিখতে হয়। ফ্যাসিবাদ চায়, সবাইকে এক ছাঁচে গড়তে। মা-বাবাও চায়, শিশুকে তাদের ফ্যান্টাসির সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে, তার কোনও দোষ থাকবে না, শুধু গুণ থাকবে, আর সে সর্বক্ষণ বাধ্য হয়ে গুরজনদের কথা তামিল করবে, নিজের মতামত নিজের ইচ্ছে চেঁচিয়ে জানাবে না। মানে, সে একটা নমনীয় পুতুল হবে। এই সিনেমাটা বলে, কেউ যদি কাউকে ছাঁচে ফেলতে চায়, দোষী সে-ই। এই সিনেমা তাই বাবা-ছেলের গল্প বলে, যাদের উভয়েরই হয়তো কিছু দোষ আছে, কিন্তু সমঝদারির দায়িত্বটা বাবার কাঁধেই অর্পণ করে, কারণ শিশুকে একটা আঁটো খোপে ঢুকিয়ে দেওয়ার বদলে, বাবাকেই হয়ে উঠতে হবে অনেকটা সহিষ্ণু মুক্তমনা, আর সন্তানের মধ্যে আবিষ্কার করতে হবে তার গুণগুলো ও মৌলিকতাগুলো, টেক্সটবই মার্কা জগদ্দল মনোভাব নিয়ে তাকে শুধুই শাসন করলে চলবে না। পোডেস্টা-র ছেলে রোগা আর দুর্বল, তার নাম ‘মোমবাতির সলতে’। পোডেস্টা চায়, ছেলে হয়ে উঠবে শক্তিশালী আর সাহসী, ইতালির হয়ে যুদ্ধে যেতে এবং প্রাণ দিতে এতটুকু ভয় পাবে না। সে সারাক্ষণ ছেলেকে শাসনে রাখে, আর ছেলে ভাবে, ইশ, আমি কেন আমার বাবার মনের মতো হতে পারছি না। অন্যদিকে তামাশাওয়ালা যে বাঁদরকে বড় করে তুলেছে (তাকে বৃষ্টির মধ্যে খাঁচার ভেতর মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিল) তাকে যখন-তখন প্রকাণ্ড পেটায় ও শাসন করে, হতচ্ছেদ্দা করে। আর মুসোলিনি তো গোটা ইতালিকেই লোহামুঠোর মধ্যে টিপে রাখেন, যাতে সবাই ঠিক তাঁর মনোমতো ঘাড়-নলনলে প্রজা হয়ে উঠতে পারে। এক সময় পোডেস্টা যখন মোমবাতির সলতেকে বলে, গুলি করে তোর বন্ধু পিনোশিওকে মার, সে অস্বীকার করে এবং বলে, সারাজীবন শুধু তোমাকে খুশি করতে চেয়েছি, তুমি ঠিকই বলেছ আমি ভিতু, কিন্তু সব ভয় সত্ত্বেও আমি তোমাকে ‘না’ বলছি, তোমাকে অমান্য করতে আমার ভয় করছে না। কিন্তু তোমার কি সাহস আছে ‘না’ বলার? উত্তরে পোডেস্টা ছেলেকে ছুড়ে ফেলে ( ‘তুই আমার ছেলে নয়!’ ) পিনোশিওকে গুলি করতে যায়, ছেলে একটা রং-বন্দুক দিয়ে বাবার চোখে রং ছুড়ে মারে, বাবা গিয়ে একটা জালের ওপর পড়ে, এবং তা ছাড়িয়ে বেরোতে পারে না, তার ওপর বোম এসে পড়ে। আবার তামাশাওয়ালা যখন পিনোশিওকে একটা ক্রসে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে (কারণ মুসোলিনির আদেশে তার সবকিছুই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে), তখন বাঁদর ক্রসের দড়িদড়া খুলে পিনোশিওকে বাঁচাতে চায়, তামাশাওয়ালা তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে মেরে ফেলতে উদ্যত হলে, বাঁদর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারতে থাকে এবং তামাশাওয়ালা পাহাড় থেকে সমুদ্রে পড়ে মরে যায়। আর মুসোলিনির সামনে তো পিনোকিও পায়খানা আর বাতকম্ম নিয়ে গান গেয়ে যুদ্ধকে (এবং তার যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে) বিদ্রূপ করেইছে। তাই এই সিনেমাটা বাবাদের স্বৈরাচারের বিকুদ্ধে সন্তানের তীব্র বিদ্রোহ-চিৎকারও বটে।

    এবং সিনেমাটা মৃত্যু নিয়ে। পিনোকিও মৃত্যুর দেবীর সঙ্গে কথাটথা বলে, দেবী তাকে বলেন, অনন্ত জীবন এক অভিশাপও বটে, কারণ জীবন মানে দুঃখকষ্ট, আর অনন্ত জীবন মানে অনন্ত দুঃখকষ্ট। তুমি অমর, তোমার প্রিয়জনেরা তো নয়। তারা একে একে মরে যাবে, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। সে কি সুখকর? সিনেমা যখন শেষ হয়, তখন ঝিঁঝিপোকার নেপথ্যকণ্ঠে আমরা শুনতে পাই (এবং দৃশ্যে দেখতে পাই), পিনোকিওর বাবার বয়স হল, কিন্তু পিনোকিওর হল না। তারপর একদিন বাবা চলে গেল। এক শীতের সকালে, পিনোকিও দেখল তার পরম বন্ধু ও বিবেক হিসেবে কাজ করা ঝিঁঝিপোকা জানলার ধরে পড়ে আছে, আর নড়ছে না। তাকে পিনোকিও একটা দেশলাইবাক্সে ভরে রেখে দিল নিজের বুকের কোটরে। এক সময় বন্ধু বাঁদরও মারা গেল, আরও একটি সমাধিফলক গজিয়ে উঠল। এরপর ঝিঁঝিপোকা বলে, পিনোকিও পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ল, আর সম্ভত পৃথিবীও তাকে আলিঙ্গন করেছিল। শেষ অবধি সে কি মারা যাবে? মনে হয়। আর তা-ই তাকে করে তুলবে একজন সত্যিকারের ছেলে। যা ঘটার, তা ঘটে। তারপর, আমরা চলে যাই। এই কথা দিয়ে সিনেমা শেষ হতে পারে, তা ভাবা যায়নি। পিনোকিওর মতো একটা গল্প, যা শেষ হয় পিনোকিওর কাঠপুতুল থেকে সত্যি-ছেলে হয়ে ওঠা এবং সুখে দিন কাটানো গিয়ে, যে কোনও রূপকথার মতোই— তাকে এমন বেদনাবিধুর একটা সমাপ্তি দেওয়া বেশ চমকপ্রদ। আমরা জানি, ‘তারপর তারা সুখে থাকল চিরকাল’ দিয়ে কাহিনি শেষ হবে। কিন্তু everafter বলে তো কিছু হয় না, একদিন রাজপুত্রের দাঁত পড়ে যায় রাজকন্যার চামড়া ঝুলে যায়, তারপর একদিন মৃত্যু এসে তাদের একজনকে কেড়ে নিয়ে যায়, শেষে অন্যকেও। নিয়ম হচ্ছে সেগুলো না বলা, সেই অধ্যায়গুলো নািয়ে মাথা না-ঘামানো, তার আগেই, মধুর ঘোরের রেশ রেখে শেষ করে দেওয়া। এই ছবির পরিচালক বলেন, এই বেদনাগুলো বহন করার মধ্যে দিয়েই, প্রিয়জনকে ধরে রাখা যাবে না কিন্তু তাদের স্মৃতিকে মনে লেপে রেখে দিতে হবে তা জেনেই, আরও সত্যিকারের মানুষ হযে ওঠা যায়। নিজের মৃত্যু হবে, সে-কথা জেনেই জীবনে বেরিয়ে পড়তে হয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যুর দেবীর কাছে নিজের মৃত্যু কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত জেনে, পিনোকিও বাবার প্রতি ভালবাসাকে নিজের জীবনের উপরে স্থান দিতে একটা মুহূর্তমাত্র দেরি করেছিল, বালিঘড়ির কাচ চুরমার করে ভেঙেছিল (মহাকালের নিয়ম ভাঙতে অবধি ডরায়নি!)। বন্ধুকে একবার পিনোকিও মজা করে বলেছিল, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, বারদুয়েক তো মারা গিয়ে দেখলাম, ওখানে খরগোশ আছে, তাসখেলা আছে, আর অনেকটা নীল বালি আছে। ঠিক কথা, কিন্তু তা অবিনশ্বরদের ক্ষেত্রে সত্যি। এখন পিনোকিও দেখতে যদিও সেই অবিকল কাঠের পুতুলই, কিন্তু আদতে বোধহয় সত্যিকারের ছেলে। অর্থাৎ মৃত্যুর অধীন। এবং তা হওয়ার মধ্যে কোনও গ্লানি নেই। কারণ অবসান না থাকলে বোধহয় জীবনের বেদনা চিরকাল বহন করা আমাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ‘পিনোকি’ও তাই, পরিচালকেরই মতে, বাচ্চাদের ছবি নয়, তবে বাচ্চারাও দেখতে পারে। এবং সেটাও পরিচালকের আর এক অভিনব চাল। অমন একটা শিশুসাহিত্যকে যে আচমকা এমন দীর্ঘশ্বাসে মুড়ে পরিবেশন করা যায়, তা মাথায় আসা সহজ নয়। কাঠের পুতুল থেকে বাস্তবের ছেলে হওয়া মানে যে অ-বাস্তব থাকার সুবিধেগুলো ঝেড়ে ফেলে দেওয়া, পিনোকিওর চির-ফ্যান্টাসির মধ্যে যে নিজেকে রোগ-শোক-বিনাশের অধীন করার শর্ত নিহিত আছে, সে-কথা চট করে আমাদের মনে উদয় হয় না। কিন্তু পিনোকিও নশ্বর হয়ে আরও সত্যি হয়ে উঠল, এই উপসংহার আদত উপন্যাসকে অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করে দেয়। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook