ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যারা কোরিয়ান সিরিজ, এখনকার চলতি ভাষায় বললে— কে-পপ ড্রামা—দ্যাখে না, তাদের একটু হেয় করা হয়। প্যারাসাইট অস্কার পেয়ে গেল, স্কুইড-গেম দুনিয়া তোলপাড় করছে, আর ফ্যালফেলে-ভ্যালভেলেগুলোকে দেখো একবার, কোরিয়ার কিছু সম্পর্কেই কোনও জ্ঞান নেই। শুধু কি তাই? কোরিয়ান গ্লাস-স্কিন মেকআপ করার যা হিড়িক পড়েছে মেয়েদের মধ্যে, তা নিয়ে তো গিগা-টেরাবাইট খরচ হয়ে গেল। কোরিয়ান মেকআপ-সামগ্রী বাজারে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। তার ওপর গাড়ি, গ্যাজেট, আরও কত কী— সবকিছু মিলিয়ে কোরিয়া এখন রণে-বনে-ফোনে-মনে।
কিন্তু কোরিয়ায় একটা নারীবাদী আন্দোলন যে তোলপাড় করছে, সে বিষয়ে আমরা কি খবর রাখছি? না মনে হয়। এবং এমন আন্দোলন মেয়েরা শুরু করেছে, যা নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক তো চলছেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা পুরুষরা তেলে-বেগুনে জ্বলছেন, জ্বলবেনও। কারণ আন্দোলন বলছে— মেয়েদের জীবন থেকে পুরুষ বাদ। মানে একেবারে কেটে পুরোপুরি বাদ।
আন্দোলনটা কী, কেন, কোথা থেকে হঠাৎ টপকে পড়ল, সে সব বলার আগে একটা গল্প বলি। যার গল্প বলব, পশ্চিমি দুনিয়ায় তাকে নিয়ে কিন্তু ভালই লেখালিখি, আলোচনা হয়েছে। নারী আন্দোলনের কথা যখন বলতে শুরু করেছি, তখন একটা মেয়ের গল্পই তো হবে।
মেয়েটার নাম —ইয়ংমি। যার ছোটবেলাটা খুবই কঠিন ছিল, পিতৃতন্ত্রের মাপকাঠির কঠোর নিয়মে বাঁধা ছিল। এখন তার বয়স ২৫ বছর। সে একজন নার্স। দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগু শহরে থাকে। ইয়ংমির জন্ম একটি গরিব পরিবারে। দায়েগু হচ্ছে দেশের সবচেয়ে রক্ষণশীল শহরগুলোর মধ্যে একটা। ইয়ংমির মা, তার স্বামীর শারীরিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। তখন ইয়ংমি নিতান্তই ছোট। তাকে, তার দিদিকে আর ইয়ংমির ঠাকুমাকে সেই ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বাড়িতেই থেকে যেতে হয়েছিল। তার বয়স যখন পাঁচ, তার আট বছর বয়সি দিদি এমন মানসিক চাপের শিকার হয়েছিল যে, তার সব চুল পড়ে যেতে শুরু করে।
কোরিয়ার পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বড় হয়ে উঠতে থাকা ইয়ংমি অত ছোট্ট বয়স থেকেই একটা হতাশ জীবন কাটাতে শুরু করে। সে জানত না তার ভবিষ্যৎ কী। আর সবচেয়ে বড় কথা, তার কাছে তো কোনও টাকা-পয়সা নেই, থাকেও না। সে কী-ই বা করবে? ধরেই নিয়েছিল, অসহায় ভিকটিম হিসেবেই কেটে যাবে তার জীবন। তার বাবার অসম্ভব শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মধ্যে অসহ কাটছিল তার দিনগুলো। ছেলেরা যাতে ইয়ংমিকে দেখে খুশি হয়, সেজন্য বাবা ইংয়মিকে আরও আরও সুন্দর হয়ে ওঠার জন্য ক্রমাগত চাপ দিত: তার শরীরের গঠন যেন কাম্য হয়ে ওঠে, তার মুখ যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। টাকা-পয়সার ঘোর টানাটানি সত্ত্বেও, ইয়ংমি ‘এইচ অ্যন্ড এম’-এর মতো নামী সংস্থা থেকে জামাকাপড় কিনত। প্রায় দাঁত মাজা-চান করার অভ্যেসের মতো করে, মেকআপও করত। এত চেষ্টার পরেও, ইয়ংমির নিজেকে দেখে মনে হত, সে যথেষ্ট সুন্দর নয়। এবং সেজন্য তার লজ্জার অবধি ছিল না।
এমন দমচাপা একটা জীবন কাটাতে কাটাতেই, ২০১৮ সালে, একদিন টুইটারে স্ক্রোল করার সময়, ইয়ংমি সিওলের রাস্তায় একটা বিক্ষোভের ফুটেজ দেখতে পায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় সাধারণত নারীহত্যা, রিভেঞ্জ পর্ন এবং ডেটিং-সংক্রান্ত হিংসার ঘটনা ব্যাপক, স্পাই-ক্যামের মাধ্যমে নগ্ন ভিডিও বানিয়ে ছেলেরা বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারে। যদি কখনও ব্যাপারটা বিচারব্যবস্থা অবধি পৌঁছয়, তখন তাদের বেশিরভাগই জরিমানা দিয়ে ছাড় পেয়ে যায়। অথবা জেল-হাজতের নির্দেশ হলেও, তা কোনও কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে একটি ২৫ বছরের মেয়ে, আর্ট স্কুলে একটি নগ্ন পুরুষ মডেলের ছবি তোলে এবং মডেলের সম্মতি না নিয়েই সেটা অনলাইনে পোস্ট করে; তাকে ১০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং আদালতের নির্দেশে তাকে কাউন্সেলিং করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে এমন যৌন-অপরাধ সে না করে। যে ফুটেজটা ইয়ংমি দেখেছিল, সেই বিক্ষোভ ছিল কোরিয়ান বিচার-ব্যবস্থার নির্লজ্জ ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া।
ইয়ংমি প্রতিবাদের মধ্যে যে সংহতি দেখেছিল, তাতে সে ভারী অনুপ্রাণিত হয়েছিল। কিন্তু একটু অবাক হয়েছিল একটা ব্যাপার দেখে। বিক্ষোভে থাকা অনেক মহিলা ক্যামেরার সামনে তাদের মাথা ন্যাড়া করছিল। ইয়ংমি পরে বুঝতে পারে, এটি কোরিয়ান মহিলাদের উপর আরোপিত নান্দনিক প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করার একটা প্রক্রিয়া। ‘মেয়ে’ হয়ে উঠতে গেলে কী কী করতে হবে, সেই নির্দেশাবলির বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। আবার সমাজের প্রত্যাশ্যার চাপে মেকআপ আর প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে কোরিয়ান মেয়েরা দেশটিকে মেক-আপ প্রডাক্ট বিক্রি এবং প্লাস্টিক সার্জারিতে শীর্ষস্থানীয় করে তুলেছে, তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ।
ইয়ংমি ফুটেজ-টা দেখে ভেতরে ভেতরে বেপরোয়া হয়ে গেল। সে তার মাথা ন্যাড়া করল, মুখে মেকআপ করা বন্ধ করল। ‘এস্কেপ দ্য কর্সেট’ আন্দোলনে যোগ দিল, যা তখন দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণীদের মধ্যে প্রবল ভাবে চলছে। এই আন্দোলন ২০১৮ সালে প্রথম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, যখন কোরিয়ান মহিলারা প্রকাশ্যে তাদের চুল ছোট করে এবং মেকআপহীন মুখে চলতে-ফিরতে শুরু করে। ২০১৯ সালে, একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, ২০ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে ২৪ শতাংশ, গত বছরের তুলনায় এ-বছর সৌন্দর্য-পণ্য কিনেছে কম। অনেকে বলেছে, তারা আর চেষ্টাই করে না সামাজিক প্রথা মেনে মেকআপ করার।
শেষমেশ ইয়ংমি যোগ দেয় ‘4B’ নামক একটা আন্দোলনে। যে আন্দোলনটা এখনও ছোট, কিন্তু কোরিয়ান মহিলাদের মধ্যে বেড়ে চলেছে। 4B হল চারটে কোরিয়ান শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, প্রতিটি শব্দই ‘না’ দিয়ে শুরু হয়: প্রথম না, ‘বিহোন’— বিষমকামী বিবাহের প্রত্যাখ্যান৷ ‘বিকুলসান’— প্রসবে প্রত্যাখ্যান। ‘বিয়োনাই’— ডেটিংকে প্রত্যাখ্যান। এবং ‘বিসেকসু’— বিষমকামী যৌন সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান। মানে, বিয়ে করব না, বাচ্চার জন্ম দেব না, ছেলেদের সঙ্গে ডেটিং করব না, যৌনতা করব না। সোজা কথায়, ছেলেদের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্কই রাখব না। এটি একটি আদর্শগত অবস্থান এবং একটি জীবনধারাও বটে। এবং অনেক মহিলা রয়েছে, যারা তাদের গোটা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পুরুষকে, এমনকি আত্মীয়-পুরুষদেরও (মানে বাবা-কাকা-মামাদেরও) বয়কট করেছে।
ইয়ংমি একটা চ্যাট-গোষ্ঠীর মাধ্যমে, দায়েগু-তে অন্যান্য নারীবাদীদের সাথে যোগাযোগ করে। খুব তাড়াতাড়ি তারা একে অপরের সঙ্গে অফলাইনে দেখা করে। ইয়ংমি বলেছিল, ’ছোট চুল দিয়ে একে অপরকে চেনা খুব সহজ।’ ইয়ংমির হাই স্কুল এবং মিডল স্কুলের যে সব বন্ধুরা মেকআপ, ছেলে-বন্ধু কিংবা ফ্যাশন নিয়ে কথাবার্তা বলত, তাদের সঙ্গেও সে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
ইয়ংমি এবং আরও অনেকের কাছে, 4B, বা ‘বিহোন অনুশীলন করা’ হল একমাত্র পথ যার মাধ্যমে একজন কোরিয়ান মহিলা আজ নিজের ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে। তাদের মতে, কোরিয়ান পুরুষরা সংশোধনের অতীত, এবং কোরিয়ান সমাজ ও সংস্কৃতি আগাপাশতলা পিতৃতান্ত্রিক— এবং ঘোরতর নারীবিদ্বেষী। কোরিয়ার ‘লিঙ্গ-সমতা ও পরিবার মন্ত্রক’-এর ২০১৬ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেয়েদের প্রতি হিংসার ক্ষেত্রে, তাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার ঘটনা ৪১.৫ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাপী গড় ৩০ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবু বিক্ষোভ এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে 4B-র অনুগামীরা সমাজ পরিবর্তনের আশা করছে, মহিলাদের একটি বিকল্প জীবনধারার পথ দেখাচ্ছে। এখানে সবচেয়ে লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল, মেয়েরা পুরুষদের মানসিকতাকে আর পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে না। পুরুষদের স্রেফ ছেঁটে ফেলছে, গোটাগুটি বর্জন করছে। বারবার ঘা খেয়ে তারা ঠিক করেছে, ওই দলটার কাছে আর যাবেই না। পচা আপেল ছুড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। এই আন্দোলন দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এবং বহু বাধা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই দেশে অনলাইন বক্তৃতার মাধ্যমে, বহু মহিলার জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
একজন ২৬ বছর বয়সি অফিসকর্মী ইয়েওন বলেছে, ’বিহোন অনুশীলন করার অর্থ হল, কোনও নারী বিষমকামী বিয়ের ঝুঁকিগুলোকে দূর করছে।’ কী ঝুঁকি? বোঝা সহজ। নারী ‘স্বাভাবিক সংসার-ধর্ম’ পালন না করে নিজের কেরিয়ারকে গুরুত্ব দিলে, পরিবারে যে অশান্তি হবে, তার ঝুঁকি। বউ হয়েও বাচ্চার জন্ম না দিতে চাইলে পরিবারে যে ঝঞ্ঝাট শুরু হবে, তার ঝুঁকি। এবং এসব অশান্তি শেষ পর্যন্ত যদি মেয়েটির প্রতি শারীরিক নিগ্রহে গড়িয়ে যায়, তার ঝুঁকি। ইয়েওন এ-ও বলেছে যে, কোরিয়ায় বিয়ে জিনিসটা হল মেয়েদের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় থ্রেট।
আজকাল এমনটাও দেখা যাচ্ছে, কমবয়সি মেয়েরা, যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারাও প্রায়ই কোরিয়ান পুরুষের সঙ্গে ডেটিং বা বিয়ে করতে চাইছে না।একটি ম্যাচমেকিং কোম্পানির সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক মেয়ে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক, কারণ বিয়ে করলে বাড়ির প্রায় সব কাজই তাদের করতে হবে। পুরুষরা মোটে সাহায্য করবে না। আবার অনেক পুরুষ বিয়ে করতে অনিচ্ছুক, কারণ মেয়েরা আজকাল ‘নারীবাদী’ হয়ে বড্ড তর্কাতর্কি করছে এবং সবসময় ঝামেলা বাধাচ্ছে।
২০১৪ এবং ২০১৫ সালে কোরিয়ায় একটি ভয়ানকভাবে নারীবিদ্বেষী এবং নারীবাদ বিরোধী সম্প্রদায়ের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তার নাম ‘ইলবে’। এই সম্প্রদায়ের যুক্তি হল, মেয়েরা অতিরিক্ত অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা দাবি করছে। কেন তাদের এমনটা মনে হয়েছে? কারণ, মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিতে হয় না। কোরিয়ান মেয়েরাও তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, ইন্টারনেট ট্রোলিং, গালিগালাজ চলছে— তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ ‘মেগালিয়া’ নামের একটি নারীবাদী সাইট তো ‘হ্যানামচুং’ বলে একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছে, যার ইংরেজি তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘কোরিয়ান মেল-বাগ’। তারা শব্দটির মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, একজন গড় কোরিয়ান পুরুষ ‘নারীবিদ্বেষী এবং যৌনতা কেনার জন্য উদগ্রীব ও মত্ত’।
২০১৬ ডিসেম্বরে একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, কোরিয়ার জন্মহার কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১.২ শতাংশে। সম্প্রতি অবশ্য তা আরও কমে গিয়ে ০.৭৮ শতাংশ হয়েছে, যা পৃথিবীতে সর্বনিম্ন জন্মহার। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক-ইওল ২০২২ সালের মার্চ মাসে কোরিয়ার নিম্ন জন্মহারের জন্য নারীবাদকে দায়ী করেন এবং (অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে) ‘লিঙ্গ সমতা ও পরিবার মন্ত্রণালয়’কে বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। দেখেশুনে মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবেই ভয়ঙ্কর রেগে যায়। নারীবাদীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তখন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যাশিত প্রজনন-শ্রমকে বয়কটের ডাক দেয়। মানে, মেয়েদের কাছে প্রধান প্রত্যাশা তো এ-ই, তারা বাচ্চা উৎপাদন করবে। এই নারীবাদীরা বলে, এই প্রত্যাশা পূরণের বাধ্যতামূলক দায় তারা বহন করবে না। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, গর্ভাবস্থা এড়ানোর সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হল পুরুষদের সম্পূর্ণভাবে এড়ানো। এরা মূলত ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, এই অনলাইন সম্প্রদায়গুলির মাধ্যমেই 4B একটি স্লোগান হিসেবে উঠে আসে, এবং শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের আকার নেয়।
এই ধরনের উগ্র নারীবাদী হলে সমাজের যে চোখ-রাঙানি ও টিটকিরি সহ্য করতে হয়, তার সঙ্গে আরও কিছু বিপদ এসে এই মেয়েদের সামনে দাঁড়ায়। কোরিয়ায় নারী-পুরুষের বেতনের ব্যবধান অনেকটা। নারীরা পুরুষদের তুলনায় ৩১ শতাংশ কম উপার্জন করে। যে মেয়েরা 4B-জীবনধারায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতে হয়, কারণ তারা জানে যে তাদের জন্য উপার্জন করে আনবে এমন কোনও পুরুষ তাদের সঙ্গে নেই। অনেকে দু-তিনটে চাকরি করে নিজের খরচ চালানোর জন্য। শহরের বাইরে থাকে, যেখানে বাড়িভাড়া কম। এটাও বলা থাক, এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য হল, এই বেতন-বৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
ইয়ংমি এবং তার বন্ধুরা দায়েগু-তে মহিলাদের মালিকানাধীন ব্যবসার একটি ম্যাপ তৈরি করেছে, যাতে তাদের অর্জিত টাকা অন্য মহিলাদের সাহায্য করতে পারে। অন্যান্য 4B গ্রুপগুলি ফিনান্স-বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়, কীভাবে সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ করতে হবে। অনেকেই বিশ্বাস করে, নারীদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি বেড়ে উঠলে, তাদের রাজনৈতিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে।
4B দীর্ঘমেয়াদি হবে কি? এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচুর রাজনৈতিক হুমকি। সংগঠনগুলোর আর্থিক পরিস্থিতিও খুব সুবিধের নয়। তাছাড়া আন্দোলনের নিজস্ব প্রচুর দলাদলি, মতপার্থক্য তো আছেই। এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যেমন 4B-মহিলারা কি পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে? লেসবিয়ানিজম কি নারীবাদী সংহতি নষ্ট করে দেয়, কারণ তখন দুজন নারী শুধু নিজেদের কথা ভাবছে, সমগ্র নারীসমাজের কথা না ভেবে? কিছু 4B-অনুশীলনকারী ট্রান্স-নারীদের আন্দোলন থেকে বাদ দিয়েছে। তা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে।
পৃথিবীর কোনও আন্দোলনই ত্রুটিমুক্ত নয়, আর এই সব বাইরের ও ভেতরের বিরোধিতার মোকাবিলা করতে করতে ও মীমাংসা খুঁজতে খুঁজতেই এগিয়ে যেতে হয়। যদি আন্দোলনটা একটু চেনা ঠেকত, অনেক লোক এর প্রতি সহানুভূতিশীল হত। কিন্তু পুরুষদের একেবারে বাদ দিয়ে নারীরা জীবন যাপন করবে, এটা অনেকের চোখেই মনে হতে পারে একটু বাড়াবাড়ি রকমের কর্কশ। বা প্রকৃতিবিরোধী। কিংবা প্রেমবিরোধী। এই ধরনের নারীদের গায়ে অবশ্যই সমাজ একরকমের তকমা লাগিয়ে দেবে, আন্দোলন জোরদার হলে গণমাধ্যমের মূলস্রোতেও এদের নিয়ে অত্যন্ত উগ্র ঠাট্টা আরম্ভ হবে। এরা যে সমাজটা এবং দেশটাকে লাটে তুলে দেবে, তা নিয়ে খুব ক্ষমতাবান লোকেরাও বক্তৃতা দিয়ে সহজে আসর গরম করবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাচ্চা না হলে কোরিয়া অবলুপ্ত হয়ে যাবে তো— এই যুক্তিটা অনেকেই ফেলে দিতে পারবে না। হয়তো শেষ অবধি আন্দোলনটা ব্যর্থ হবে। দেখা যাবে, পুরুষ ও নারী দুই বর্গকে নিয়ে চলতে না পেরে, বেশি একবগ্গা হতে গিয়ে, স্রোতটা শুকিয়ে গেল। কিন্তু তাহলেও, প্রবল পিতৃতান্ত্রিক একটা সমাজের বিরুদ্ধে যে একেবারে বেপরোয়া ভাবে গর্জে ওঠা গিয়েছিল, তুইয়ে-বুইয়ে মানসিকতা বদলানো ও সচেতনতা আনার চলতি কর্মসূচি বাতিল করে যে একটা বিশাল কুঠার নিয়ে একদম শেকড়েই সটান ঘা মারা হয়েছিল, কোনও রাখঢাক না করে বলা হয়েছিল এই পুরুষগুলো কিছুতে শোধরাবে না, তবে যা ভাই বাড়ি যা আর আমাদের নিজেদের মতো বাঁচতে দে, এর মূল্য কোনওদিন চলে যাবে না। পরবর্তী যত আন্দোলন কোরিয়ায়, বা পৃথিবীর অন্য দেশেও হবে, এই আন্দোলনের স্পর্ধা আর জেদ তাকে আগুন জোগাবে।