প্যান্ডেমিকের যুগে (এবং তার পরের) ভ্রমণ
কোভিড সম্ভবত সেই ম্যাজিক marker, যা এক অভূতপূর্ব চেঞ্জ-এজেন্ট রূপে আমাদের আগের জীবন এবং পরবর্তী জীবনের মধ্যে একটি অবিস্মরণীয় অথচ অদৃশ্য রেখা টেনে দেয়। কোভিডের পর থেকে মানুষের জীবন আর আগের মতো নেই; আমরা নতুন কয়েকটা ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছি। তাদের মধ্যে কিছু থাকবে, কিছু হয়তো কেটে যাবে। আমাদের এই অনেক ব্যবহারিক পরিবর্তনের মধ্যে একটি হল আমরা ভ্রমণকে যেভাবে দেখি।
ভার্চুয়ালই ভরসা
ভ্রমণ কথাটার মানে কী? সব অভিধানের মতেই, ভ্রমণ করা মানে শারীরিকভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা। লকডাউনে যখন তা অসম্ভব হয়ে উঠল, তখন ভ্রমণে প্রথম পরিবর্তন এল ওই পরিভাষায়— ভ্রমণের জন্য আর শারীরিক স্থানান্তরের প্রয়োজন নেই, এটি ভার্চুয়ালও হতে পারে। বিশ্বের নব্বই শতাংশ মানুষ যখন ঘরবন্দি হয়ে পড়ে, তখন VR— যা এতদিন নিছক কৌতুকে সীমাবদ্ধ ছিল— একটা নতুন রূপে নানান ছুটি নিয়ে আসে মানুষের হাতের মুঠোয়। কৌতুকের পরিবর্তে VR হয়ে ওঠে বিশ্বের নানা অজানা-অদেখা জায়গা ভ্রমণ করার একটি নিরাপদ, অপেক্ষাকৃতভাবে সস্তা, সহজ বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়। Aspace, World traveller VR এবং Google Earth VR এখন উপভোগ করা সহজ কারণ, আমাদের 4G বা 5G রূপান্তর আছে এবং headset-এর দামও কমেছে। তবে VR ভ্রমণ-গাইড হিসেবে সীমিত; তা শব্দ, গন্ধ এমনকী আশ্চর্য অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে না। বিভিন্ন কারণে যাঁরা একটি জায়গায় ভ্রমণ করতে পারেন না— যেমন অক্ষমতা, বার্ধক্য, বাজেট বা কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে দায়বদ্ধতা— VR তাঁদেরকে ভ্রমণ করতে সক্ষম করে তোলে।
তবে লকডাউন শেষ হওয়ার সাথে সাথে কি আমরা VR-কে একই চোখে দেখব? না কি, VR একটা প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হবে যে, দূর দেশে ভ্রমণ করতে যাওয়ার আগে বুঝে নাও জায়গাটি কীরকম, আদৌ ভাল লাগবে কি না।
Polaris Market Research-এর ২০২২ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী VR-এর বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তা, Real estate-এ আগে থেকেই প্রচলিত, যেখানে আমরা কী দেখব তার উপর নিয়ন্ত্রণটা একটি ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে, এবং ভবিষ্যৎমুখী ভার্চুয়াল workplace, যেখানে নানা স্থান ও পরিবেশ থেকে log in করা মানুষের জন্য একটি ইউনিফর্ম কর্মপরিবেশ তৈরি করা হয়— এই দুটির মাঝখানে। অর্থাৎ ভ্রমণে VR-এর প্রয়োজনীয়তা কোভিডের পরেও থাকবে। তবে ভ্রমণ স্বভাবতই স্বাধীন; VR-এর মতো authoritarian নয়— যা আপনাকে তাই দেখাবে, যা সে দেখাতে চায়। তাই ভ্রমণকে সরানো অসম্ভব।
এককই একশো
Airbnb-র একটি অভ্যন্তরীন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টার থেকে ২০২২ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টার অবধি যত বুকিং হয়েছে, তার প্রায় ত্রিশ শতাংশ ছিল একক ভারতীয় ভ্রমণকারীদের থেকে। আরও বলা হয়েছে যে, ২০১৯ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টার থেকে ২০২২ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের মধ্যে ভারতীয়দের একক ভ্রমণ সামগ্রিকভাবে ১২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (সূত্র : ‘সোলো ট্র্যাভেল অন দ্য রাইজ’, ‘আউটলুক ইন্ডিয়া’, ১৫ অক্টোবর ২০২২)। সারা পৃথিবীকে ধরলে গ্লোবাল ডেটাও একই কথা বলছে— ২০২২ সালে গুগল ট্রেন্ডে একক ভ্রমণের জন্য অনুসন্ধানের সংখ্যা ৭৬১.১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যুক্তরাজ্যে (UK) মহামারীর আগে এবং মাঝামাঝি সময়ে একক ভ্রমণ বুকিং ১৪% থেকে ২৩% হয়ে উঠেছে।
একক ভ্রমণ ট্রেন্ড হয়ে উঠল যখন প্যান্ডেমিকের দৌলতে আমরা অনেকেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন বুদবুদের মধ্যে বন্দি পেলাম। একক ভ্রমণ তখন গুটিকয়েক নিরাপদ আনন্দের মধ্যে একটি। সমান্তরাল ভাবে, লকডাউন আমাদের শেখাল ব্যক্তিগত সময়ের অপরিসীম মূল্য; স্বাধীনতা, নিজের জন্য একটু সময় এবং মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজনীয়তা। একক ভ্রমণ অদ্ভুতভাবে একা থাকা এবং একলা সময় বার করা— দুটোরই উত্তর হয়ে দাঁড়াল এবং প্যান্ডেমিকের বাজারে একটি বড় মাপের ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াল। মহামারীর পরেও, নানা থিমের একক ভ্রমণের ট্রেন্ড রমরম করে চলেছে— তার মধ্যে যোগ, মেডিটেশন, স্পা এবং তীর্থযাত্রার থিমগুলি উল্লেখযোগ্য।
ওয়ার্কেশন ওয়াকিবহাল
লকডাউনে যখন প্রথমবার ছাড় এল, তখন ভারতীয় কর্মীরা পালে-পালে পাহাড়ে পাড়ি দিলেন। তখনও অফিসে কর্মীদের ডাক পড়েনি, কারণ অফিস খোলেনি; সেই বাড়িতে বসে লগ ইন করার চেয়ে অনেকেই পাহাড় থেকে কাজ করতে চেয়েছিলেন। দিনের শেষে কাজের পরে যেখানে ছুটির আমেজ, বাড়ির একঘেয়েমি নয়। তাড়াহুড়োর উইকএন্ড বা সাতদিনের ছুটির থেকে লম্বা সময়ের জন্যে পাহাড়ে থাকা, সেখানকার আবহাওয়া-সংস্কৃতি ও মানুষজনের মধ্যে মিশে যাওয়াতে অনেকেই অভূতপূর্ব আনন্দ পেয়েছিলেন। এ এক সম্পূর্ণ অন্য ধরণের ভ্রমণ! এখন আমরা আবার অফিসগামী, ভারতের বেশির ভাগ কর্মস্থলই তলব করেছে, কিন্তু একবার এই স্বাদ পেয়ে কর্মীরা বাক্সবন্দী হয়ে যেতে নারাজ।
২০২১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Great Resignation-এ লোকে পালে পালে চাকরি ছেড়ে দিল এই flexibility এবং স্বাধীনতার খোঁজে। মানুষের মানসিকতার মধ্যে এখন দূরবর্তী কাজ বা remote work-এর বিকল্পটি দানা বেঁধেছে, এ সহজে যাওয়ার নয়। আরো অনেক ছুটি এখন ভ্রমণকর্তারা create করছেন যা অভিজ্ঞতামূলক, লম্বা এবং immersive। গুগলের সুন্দর পিছাই এখন কর্মীদের বছরে একটি মাসের দূরবর্তী কাজের নিয়ম চালু করেছেন, অন্যান্য মার্কিনি কোম্পানিও দূরবর্তী কাজের কথা ভাবছেন, ওয়ার্কেশন ক্রমশই কর্মজীবনের অংশ হয়ে উঠছে। মার্কিনি কোম্পানি Ladders.com-এর ডেটা বিজ্ঞানীদের ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সব কাজের ২৫% দূরবর্তী হয়ে যাবে। পরিবর্তনটি এত দ্রূত হবে কি না তা বিতর্কের বিষয়, তবে আমরা সকলেই ছোট শহর এবং শহরগুলির প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন দেখতে পাবো এবং এই ছুটির জায়গাগুলিতে দূরবর্তী কাজের অনুকূল ব্যব্স্থাপনা তৈরিও দেখবো— যেমন ভাল রাস্তা, হাসপাতাল, আরও ভাল ডিজিটাল সংযোগ, ইত্যাদি।
আপাতত আঞ্চলিক
প্রথম লকডাউনের শিথিলতার সাথে সাথে যখন ভ্রমণ বাড়ল, তখন আশেপাশের জায়গাগুলিকে সবার আগে আকর্ষণীয় মনে হল। আঞ্চলিক ভ্রমণের খরচ কম, অনিশ্চয়তার যুগে তা জনপ্রিয়তা পেল; মানুষের পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে অনেকে আঞ্চলিক ভ্রমণকে প্রাধান্য দিলেন; ট্রেন এবং প্লেন না চলার দরুন বেশি দূর যাওয়ার সুযোগও ছিল না। অতএব স্থানীয় এবং কাছেপিঠের homestay জনপ্রিয় হল। আমরা এক অন্য ধরনের ছুটি উপভোগ করতে শিখলাম যা এখন trend-এ পরিণত হয়েছে— একটি স্থানীয় পর্যটন এলাকায় গিয়ে অতিরিক্ত খরচ না করে সেখানকার মানুষজন, তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের শৈলীকে জানা, তাতে নিমজ্জিত হওয়া— an immersive holiday. দেশের সীমানার মধ্যে বদ্ধ থাকায় স্থানীয় পর্যটন বৃদ্ধি পেল। তবে এই বৃদ্ধি সুখবর হলেও, Covid-এর হারে থাকবে না। আন্তর্জাতিক পর্যটন ফিরে আসছে; তবে এই দূরবর্তী কাজের যুগে তা হারে কমেছে কি না, আমরা এই আগামী বছর বুঝতে পারব— কাজ সংক্রান্ত ভ্রমণ কমলে কমতেও পারে।
বাকেট-তালিকা ভ্রমণ
তবে শেষ করার আগে একটি ট্রেন্ড নিয়ে লিখতে চাই; এই ভ্রমণটিকে বলে ‘বাকেট লিস্ট হলিডে’— মানে মৃত্যুর আগে তালিকাতে যে ভ্রমণ আছে, তাই।
এটি নিতান্তই ব্যক্তিগত, প্রায়শই দামি এবং অনেকেই বহু বছর প্ল্যান এবং অপেক্ষা করার পর এই ছুটিগুলি নিতেন। প্যান্ডেমিকের যুগে, মানুষ যখন ভবিষ্যতের কথা স্থায়ীভাবে কল্পনা করতে পারছে না, তখন এই ‘বাকেট লিস্ট হলিডে’ খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। যতই দামি হোক না কেন, যদি বর্তমান-ই সব হয়, তবে এই ছুটিটা করব না কেন? চুলোয় যাক দাম। আমরা একটি সুপার এক্সপেন্সিভ, লাক্সারি ভ্রমণ ক্যাটেগরি দেখতে পেলাম, যা প্যান্ডেমিকে বৃদ্ধি পেল, কমল না। Globaldata-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ত্রিশ শতাংশ মানুষ বলেন যে কোভিডের পর তাঁদের ভ্রমণের বাজেট বেড়েছে, কমা তো দূরের কথা, তা রিসেশন হোক বা না হোক। ষোল শতাংশ বলেন যে তাঁদের ভ্রমণের বাজেট অল্প নয়, অনেকটা বেড়েছে প্যান্ডেমিকের পরে। মানুষ তার আনন্দকে শিকেয় তুলে রাখতে আজ চায় না।
গরম পড়ছে; গরমের ছুটির একটা কোথায় যেন গন্ধ; আমার মন উড়ু-উড়ু— নানা ছুটির পরিকল্পনা চলছে মাথায়। জানি, পশ্চিমবঙ্গে একটা স্থানীয় ছুটি করবই, কাজের জন্য অন্তত একবার এই কোয়ার্টারে বেরবোই; উত্তর ভারতে একবার যাব, একটা সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক ছুটি করব— হয়তো এই কলকাতা শহরেই একটা স্টে-কেশন-ও করব। আর কীভাবে ভ্রমণ করা যায়? Machu Pichhu-র একটা VR ভ্রমণ করব ভাবছি। আর আপনি?